www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমি কিছুই ইরেজ করবো না

দেখতে দেখতে দু’বছর পার করে দিলাম।আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে জন্মালে যা হয়, কোন স্বপ্ন সূর্যের মত সত্য হয়ে উঠলেও নদীর ওপারে বাস্তবে অবদমনের এক অপরিহার্য মেঘে লুকিয়ে রাখা বা তাকে রংধনু বানিয়ে মনের আকাশে খেলা করা এ সবই যেন অভ্যাসে পরিনত হয়। এপারে বাস্তবতার সাথে সংযোগের সাঁকোটা পেরিয়ে স্বপ্ন-বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটানোর মত সাহস বা পরিণতবোধ ঠিক ঐ বয়সে থাকে না, আমারো ছিল না।সেই তারুণ্যভরা বয়সে মাঝে মাঝেই প্রখর আবেগ দমকা বাতাসের মত চাংগা হয়ে উঠত। তারপরো দুটো শীত আর বর্ষাও পার করে দিলাম কোন অঘটন না ঘটিয়েই।

আচ্ছা আমি একে অঘটন বলছি কেন?মিথিলার প্রতি আমার আকর্ষন, ভালোলাগা প্রকৃতির হেঁয়ালী হলেও এর পরিণতির চিন্তা কি শুধু একটা অঘটন জন্ম দিত? বুঝতাম না বা হিসাব মেলাতে পারতাম না।এই দ্বিধার আদৌ কোন ভিত্তি আছে কি না আমি জানতাম না। মিথিলাদের ফ্যামিলিও মধ্যবিত্ত গন্ডীর বাইরে ছিল না। তার বাবা একজন বড় সরকারী চাকুরে আর আমার বাবা ব্যাবসায়ী। এই যা পার্থক্য। তাহলে বেহিসাবের জায়গাটা কি ছিলো মিথিলা বা আমি স্বয়ং?এই প্রশ্নের উত্তর তখন মহাকাশের সপ্তর্ষীমন্ডল থেকেও ব্যাপক আর ধাঁধাঁময় ছিলো অন্তত আমার কাছে।

অবসর পেলেই আমি আমার মনের মধ্যকার এই একমাত্র ধাঁধাঁর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতাম। চিন্তার রিপ্লেটা প্রথম থেকে শুরু করতাম -মিথিলা, যে কি না আমার একজন প্রাক্তন ছাত্রী,এখন একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে সেকেন্ড ইয়ারে।সেই প্রথম দেখা ওদের বাসায় টিচার হিসাবে, তারপর পড়া-শোনা, অংক-বিজ্ঞান,গল্প-কথা, গান ক্যাসেট অনেক কিছু।তারপর আমার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে একই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া। এই পর্যন্ত ছন্দ বেশ ভালো। তারপর একটু সরে যাওয়া, সিনিয়র ভাই হিসাবে আমার দায়িত্বশীল আচরন, সু্যোগ থাকা সত্বেও আট-দশটা ছেলে-মেয়ের মত রিক্সায় না ঘুরে বেড়ানো, অযথা ইমপ্রেস করার জন্য অভিনব কিছু করতে গিয়ে হাস্যকর না হয়ে ওঠা, শুধু তাই না ভিতরে ভিতরে এসিডে-দগ্ধ হলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার লিটমাস পেপার প্রয়োগের ঝুঁকি না নেয়া…..

আর মিথিলা- সে ছিলো আমার প্রতি সিরিয়াস, শ্রদ্ধাশীল সদা হাস্যজ্জল প্রাণবন্ত এক মেয়ে। সে তার সেই হাসি আর চোখে ধারন করতে পারতো একই সঙ্গে নীরবতা ও আহবানের দ্ব্যার্থবোধক এক শিল্প। যে শিল্প হ্যামিলনের বাঁশির মত আমাকে সম্মোহিত করতে পারতো। হয়তো তা সে জানতো না, অথবা জানতো।একজন সিনিয়র হিসাবে যতখানি একাডেমিক সাহায্য করার আমি তাকে করতাম, আর সেও জুনিয়ার হিসাবে নোট-এসাইনমেন্ট ইত্যাদি তৈরিতে আমার অনেক উপকার করতো।ইনভল্ভমেন্ট যতটুকুই ছিলো একটা পরিমিত দূরত্বের মধ্যে এবং সম্ভবত তা ছিলো আমার দিক থেকেই। সেই হাজার বছরের মধ্যবিত্ত মনের ভয়। সেই ভয় আমাকে আড়ষ্ট করে রাখতো। অথচ মিথিলা দু’একটা আভাস যে দেয় নি তা নয়।যেমন একদিন একটা গানের মিক্সড এলবাম উপহার দিয়েছিলো “ছেঁড়া-স্বপ্প” নামে।কভার পেজে ছিলো এক আধখোলা দরজার ওপাশে আবছা কোন নারীর ছবি।প্রায় বিমূর্ত সেই নারীর অবয়ব থেকে অনেক কিছুই ভেবে নেয়া যায়, আবার কিছুই নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। যাইহোক বলবো কি বলবো না এই ভেবে ভেবে দুটা বছর পার করেই দিয়েছিলাম –ডায়রীর পাতায় কবিতার শব্দে ,আর শ্রীকান্তের স্নিগ্ধ গানের সুরেই থেকে যেতে পারতো সব। কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনায় ছিল অন্য কিছু।

তখন ফাইনাল থিসিস জমা দেয়ার আর বেশী বাকি নেই। ক্লাসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলাম।হঠাৎ ডেস্কের কাছে চুড়ির আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি-মিথিলা দাঁড়িয়ে। নীল রঙের সেলোয়ার কামিজে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছিলো। আমি অপ্রস্তুত হয়ে -বললাম তুমি হঠাৎ কি মনে করে?
সেই হাসি দিয়ে মিথিলার জবাব
-কেন আসতে নেই না কি?
-না না ঠিক তা না, সচরাচর তুমি ক্লাসে আসো না তো। তা কি ব্যাপার বলো।
এবার মিথিলার হাসির রঙ পরিবর্তন হলো যার অর্থ বুঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছিলো
-কোন নিগুঢ় অর্থ নিশ্চয় আছে।
না মানে তেমন কিছু না, আপনার কাছে কি কোন ইরেজার আছে?
মনে মনে অবাক না হয়ে উপায় নেই। সা্মান্য একটা ইরেজারের জন্য সে এখানে এসেছে। বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আমার অবচেতন মনের দুর্বলাতার কারনে কি না জানি না। চুপ থাকতে পারলাম না,রসিকতার সুরে বললাম –
-তা,কি ইরেজ করবে?
সেও সমঝদার কম না। প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে বলল
- থাকলে বলেন আমার সময় নেই, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
আমি আমার ব্যাগ থেকে ইরেজার বের করতে করতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে এবারো মজা করে বললাম-
-জানোইতো সব দাগ ইরেজ করা যায় না।
বলার পরমূহুর্তেই আমার মনে হল কেন এসব বলতে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে কথা ডেলিভারী হয়ে গেছে। কি জানি কেন আমি ওর চোখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম।
-আমি কিছুই ইরেজ করবো না। এটা অন্য কাজে নিচ্ছি।
একটা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে মিথিলা ইরেজারটা নিয়ে হেলতে দুলতে চলে গেল।

মনে হলো ব্রেইনের নিউরন সংখ্যা হঠাৎ করেই অনেক কমে গেছে। স্তব্ধ হয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম সে কি বলতে চাইলো।ইরেজ করা ছাড়া ইরেজার দিয়ে আর কি করা যায় তা আমার মাথায় ঢুকলো না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৪৩৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/১১/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast