www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমাদের কালো যাদুকর





মিফরা বেশ ঝামেলায় পড়ে আমাকে ফোন দিল।ওর এবারের ঝামেলাটা নাকি খুবই জটিল। তিনজন ফেলুদা সাতজন শার্লক হোমস আর ডজন খানেক মিসির আলীও নাকি ওর এই ঝামেলা দূর করতে হিমশিম খাবে। মিফরা কোন সমস্যা হলেই আমাকে ফোন করে। আমি না মিসির আলী না ফেলুদা না হিমুর মত ভবঘুরে। সুতরাং আমার কাছে যে কোন কিছুরই সমাধান মিলবেনা তা জেনেও মিফরা আমাকেই ফোন করে। যদিও বলেছে সমস্যাটা ভীষণ গুরুতর কিন্তু আমি মনে মনে মোটেই পাত্তা দিইনি। আমার এই বোনটাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। গল্পের বই পড়ে পড়ে এমন ভাবে কথা বলে যে যে কারোরই অবিশ্বাস লাগবে।ও যদিও বলেছে সমস্যাটা জটিল কিন্তু আমি জানি সমস্যাটা একেবারেই তুচ্ছ।

কেননা প্রতিবারই সমস্যার কথা বলার আগে মিফরা আমাকে বলে ভাইয়া এবারের সমস্যাটা ভয়ানক। তবে হ্যা মিফরা যা বলে আমি তা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি। সেটা সত্যি হোক বা মিথ্যা হোক তা আমার দেখার বিষয়না। আমি আমার এই বোনটাকে খুব ভালবাসি। আমার আদর পেয়ে পেয়ে ও বাদর হয়নি ঠিকই তবে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।এবারের বিষয়টাও যে খুবই তুচ্ছ হবে সেটা জানতাম। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ওর কাছে জানতে চাইলাম কি ঘটেছে। ও বললো কানাডা থেকে তারেক ভাইয়া এসেছে। সাথে করে নিয়ে এসেছে ব্ল্যাক ম্যাজিক মানে কালো যাদুর বই। তারেক ভাইয়া বলেছে সে নাকি এমন সব যাদু জানে তা দেখলে যে কারো মাথা ঘুরে যাবে।

আমি খুব আদুরে গলায় বললাম মিফরা তুমিকি তারেকের কথা বিশ্বসি করেছ? আরে ধুর তুমি যে কী বলোনা ভাইয়া পৃথিবীতে যাদু বলে কিছু আছে নাকি। সব গাজাখুরি ব্যাপার। আমি তারেক ভাইয়াকে পাত্তাই দিইনি। মিফরার ঝামেলাটা কোথায় ঠিক বুঝলাম না। যেহেতু তারেকের গাল গল্পে ও বিশ্বাস করেনি সেহেতু কোন ঝামেলা হওয়ারতো কথা নয়। আমি বললাম তো সমস্যার কথাতো বলছোনা। মিফরা বললো সমস্যা ভীষণ ভাবে আষ্টে পিষ্ঠে ধরেছে। সন্ধ্যার পর তারেক ভাইয়া জামিল ফারিন মিতু ত্রয়ী সবাইকে এক রুমে নিয়ে গেল। ওরা সবাই কম বেশি তারেক ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করেছে।সবাই মিলে তারেক ভাইয়ার যাদু দেখতে বসেছে। আমি যেহেতু বিশ্বাস করিনা তাই আমি যাইনি আর রিফার পরের দিন পরীক্ষা ছিল বলে রিফাও যায়নি। তারেক ভাইয়া যাদু দেখানোর সময় ঘরের বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে দিল। তার সামনে একটা খালি গ্লাস।

সে বললো সে যাদু দিয়ে জামিলকে পানি বানিয়ে এই গ্লাসে রাখতে পারবে। সবার চোখ কপালে। তারেক ভাইয়া তার ব্ল্যাক ম্যাজিকের মোটা বইটা দেখিয়ে বললো এই বইয়ে সব লেখা আছে। যদি কেউ বিশ্বাস না কর তাহলে নির্ঘাত তার লটকইন্যা রোগ হবে। এই রোগটা কি ধরনের রোগ কিংবা আদতেই এ নামে কোন রোগ আছে কিনা তা কেউ জানেনা। তার পরও সবাই ভয়ে বিশ্বাস করে নিল। সবাই গ্লাসটা হাতে নিয়ে দেখলো সেটা খালি। আশে পাশে কোন পানির জগও নেই। লাইট বন্ধ করে শব্দ করে মন্ত্র পড়লো তারেক ভাইয়া। সেই অন্ধকারেই শোনা গেল পানি পড়ছে। তারেক ভাইয়া বললো জামিল আমার ব্লাক ম্যাজিকের কারণে আস্তে আস্তে পানি হয়ে গ্লাসে পড়ছে।এক সময় পানি পড়া থেমে গেল। তারেক ভাইয়া ফারিনকে বললো লাইট জ্বালাতে। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল সেই খালি গ্লাস ভর্তি পানি আর সবার মাঝখান থেকে জামিল উধাও হয়ে গেছে।

সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। এরপর আম্মু সবাইকে খেতে যেতে বললে সবাই খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।জামিলের কথা আর কারো মনে থাকলোনা। তারেক ভাইয়া পানি ভর্তি গ্লাসটা নিয়ে টি টেবিলে রেখে নিজেও খেতে গেল। পড়া শেষ করে রিফা খেতে আসলো। রিফার অভ্যাস খাবার আগে এক গ্লাস পানি খাওয়া। টি টেবিলে গ্লাস ভর্তি পানি দেখেই সে গপগপ করে পানিটুকু খেয়ে ফেললো। এর পর ডায়নিং টেবিলে একটা চেয়ার টেনে খেতে বসলো। একটা চেয়ার তখনও ফাকা। আম্মু সবার দিকে তাকিয়ে দেখলেন জামিল নেই। জানতে চাইলেন জামিল কোথায়। হঠাৎ সবার মনে হল তারেক ভাইয়ার ম্যাজিকের কথা। এক সাথে দুই তিনজন বলে উঠলো তারেক ভাইয়া ম্যাজিক দিয়ে জামিলকে পানি বানিয়ে গ্লাসে ভরে রেখেছে। আম্মু ফিক করে হেসে দিলেন। সব পাকামো করা শিখে গেছে। যাদু বলে কি পৃথিবীতে কিছু আছে? আর মানুষ কিভাবে পানি হবে? ঠিক করে বলো ও কোথায়। ফারিন বললো না খালামনি তারেক ভাইয়া সত্যিই যাদু করে জামিলকে পানি বানিয়ে গ্লাসে ভরে রেখেছে। কি জানি কি হল আম্মুও বিশ্বাস করলেন। জানতে চাইলেন জামিলকে যে যাদু দিয়ে পানি বানিয়ে গ্লাসে রাখা হয়েছে সেই গ্লাসটা কোথায়? তারেক ভাইয়া বললো টি টেবিলে রেখেছি। সবাই দেখলো টি টেবিলে খালি গ্লাস পড়ে আছে।

তাহলে জামিল গেল কোথায়। রিফা বেশ চুপচাপ ছিল সে বলে উঠলো সর্বনাশ হয়ে গেছে। টি টেবিলে গ্লাসে যে পানি ছিল তাতো আমি পুরোটাই খেয়ে ফেলেছি। সবাই আর্তনাদ করে উঠলো। তাহলে রিফা জামিলকে খেয়ে ফেলেছে। এখন জামিলকে ফেরত পাব কি করে? সবাই তারেককে চেপে ধরলো কিন্তু তারেক কোন কথা বললোনা। রাতে সবাই উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়লো। রিফার পেট ব্যাথা শুরু হয়েছে। মনে হয় জামিল ওর পেটের ভিতরে ঢুকে ফুটবল খেলছে কিল ঘুশি মারছে।পানি হয়ে যাওয়ার পরও জামিলে শক্তি কমেনি। রিফা পেট ধরে বসে আছে। শাকিল চাচ্চুকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। তার পরিবর্তে ফোন ধরেছে আইমান। রিফার অবস্থা শুনে আইমান বলেছে ওর যখন পেট ব্যাথা হত বাবা ওকে ডমপেরিডিন ২৫০ এমজি খেতে দিত। রিফাকেও যেন এটা দেয়া হয়। আইমান জানেনা যে রিফা জামিলকে খেয়ে ফেলেছে। আর রিফার পেটের ভিতর গিয়ে জামিল মনে হয় মনের আনন্দে ফুটবল খেলছে। সে জন্য রিফার পেট ব্যাথা করছে। সবাই জোরাজুরি করেও রিফাকে ট্যাবলেট খেতে রাজি করাতে পারেনি। ট্যাবলেট খেলে পেরে ভিতরে জামিলের যদি কোন ক্ষতি হয়। জামিল ওর আপন ছোট ভাই। জামিলকে ও খুব ভালবাসে আদর করে।

কোন ভাবেই সে জামিলকে কষ্ট দিতে পারবেনা। বাসার সবাই তটস্থ হয়ে আছে। এরকম ভয়ানক কান্ড ঘটতে পারে তা জানতাম না। ওদিকে তারেক ভাইয়ার ব্ল্যাক ম্যাজিকের বইটাও পাওয়া যাচ্ছেনা। মামা সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরই ঢাকা চলে গেছেন। তাকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছেনা এরকম একটা ঝামেলা হবে জানলে তারেক ভাইয়াকে যাদু দেখাতে বারণ করতাম। তুমি যেভাবেই পার চলে আসো। মিফরা এতো সব বলে ফোন রেখে দিল। আমি অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে অসীম আকাশের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এটা কি করে সম্ভব? পৃথিবীতেতো যাদু বলেই কিছু নেই। তাহলে তারেক কিভাবে জামিলকে পানি বানিয়ে গ্লাসে ভরে রাখলো। কিভাবেইবা সেই পানি রিফা খেয়ে ফেললো। নাহ সব গাল গল্প। মিফরা নিশ্চই আজও আমাকে বোকা বানানোর মতলব করেছে। আমি খালামনিকে ফোন করতেই খালামনির হাহাকার। রিফা জামিলকে খেয়ে ফেলেছে। কী উদ্ভট কথা! রিফা কি ভ্যাম্পায়ার নাকি যে জামিলকে খেয়ে ফেলবে। তাছাড়া ভ্যাম্পায়ার হলেও নিজের ভাইকে নিশ্চই খাবেনা। যেহেতু মিফরার সাথে কথা বলেই আগেই জেনেছি তাই বুঝলাম খালামনি আসলে কি বলছে। বুঝলাম অন্যবারের মত এবার মিফরার কথা হেলাফেলার নয়। ভার্সিটিতে হলে থাকি। ইচ্ছে হলেই ঘুরতে যেতে পারি।

দু চারদিন না ফিরলেও কেউ খোজ নেবেনা। সাথে সাথে ব্যাগ গুছিয়ে দিনাজপুরের দিকে রওনা হই। সময় যেন যেতেই চাচ্ছেনা। সকাল দশটা নাগাদ বসুনিয়া পট্টিতে পৌছালাম। রিফার পেট ব্যাথা কমেনি। জামিল বোধ হয় এখনো ওর পেটের ভিতর ফুটবল খেলছে। সবাই খুব চিন্তিত। রিফাকে কোন ভাবেই ব্যাথা কমানো ওষুধ খাওয়ানো যায়নি।আমি আসতেই মিফরা দৌড়ে আসলো। আমি ওকে আশ্বস্থ করে বললাম চিন্তা নেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মনে মনে বললাম কিভাবে ঠিক হবে এরতো কোন আগামাথাই নেই।উদ্বেগ উৎকন্ঠায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। রিফা পেট চেপে বসে আছে। সদর হাসপাতালের বড় ডাক্তার এসে রিফার পেট টিপে স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু রিফা বলছে তার পেট ব্যাথা হচ্ছেই। সে তার নিজের ভাইকে খেয়ে ফেলেছে। ডাক্তার এসব কথা শুনে বোকার মত তাকিয়ে আছেন। ক্লাস ফাইভে পগুয়া একটা মেয়ে তার ছয় বছর বয়সী ভাইকে কিভাবে খেয়ে ফেলতে পারে তা তার মাথায় আসছেনা। ডাক্তার ফিরে যাবার পর আমরা সবাই এক জায়গা বসলাম। রিফাও পেট চেপে ধরে পাশে বসলো।

আমি তারেককে বললাম তুমি যেহেতু যাদু দিয়ে জামিলকে পানি বানিয়েছ এখন যাদু দিয়ে রিফার পেট থেকে জামিলকে বের করে আন। তারেক বললো আমি পানি বানানো যাদুটা বই দেখে করেছিলাম এখন যেহেতু বই নেই তাই ওটা পারা কঠিন।তার পরও রাত দশটার দিকে চেষ্টা করা যাবে। রাত আটটা বাজে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম রাত দশটা বাজার। সবাই আগে ভাগেই রাতের খাবার খেয়েছি। ড্রয়িং রুমে সবাই চিন্তিত মূখে বসে আছি এমন সময় দেখি রিফা হাত নাড়িয়ে কাউকে চলে যেতে বলছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখি জামিল দাড়িয়ে আছে। রিফার কথা মত সে চলে না গিয়ে রিফার গা ঘেষে দাড়িয়ে বললো আপু মনি মশায় খুব কামড়াচ্ছিল আর চকলেটও শেষ তাই চলে আসলাম। আরও দশটা চকলেট দাও আমি গিয়ে লুকিয়ে থাকি। রিফার পেটে ব্যাথা সেরে গেছে। ও কোন কথা বলছেনা।কেউ কোন কথা বলছেনা। তারেকের মূখটা কালো হয়ে আছে। আমি আর মিফরা মূখোমুখি বসে আছি। হাতে তারেকের কালো যাদুর বই। সেখানে লেখা কিভাবে মানুষকে যাদু দিয়ে পানি বানিয়ে গ্লাসে রাখতে হয়। যদিও তারেক বলছিল তার যাদুর বই পাওয়া যাচ্ছেনা তারপরও সেটা পাওয়া গেল। জামিল ফিরে এসেছে এতেই আমরা খুশি।

তারেক মুখ গোমরা করে বসে আছে। রিফা তারেকের সামনে গিয়ে বললো তারেক ভাইয়া আরও দুইশো টাকা দাও। এতো কিছু করার পর একশো টাকায় পোষায়না। তারেক একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো একশো টাকা কাটা। জামিল সময় মত লুকিয়ে থাকতে পারেনি বলে পারিশ্রমিক কম দিলাম। আমি আর মিফরা তখন ব্ল্যাক ম্যাজিকের মধ্যে ডুবে আছি। সময় পেলেই মিফরা তারেককে ফোন করে বলে ভাইয়া নতুন নতুন ম্যাজিক দেখাতে চলে আসো কিন্তু তারেক আর ম্যাজিক দেখাতে আসেনা। ও এখন কানাডার টরেন্টোতে। কী জানি হয়তো সেখানেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের পানি বানিয়ে গ্লাসে রাখছে।

৩০/১১/২০১৩
রাত ২ টা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৪৩১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৬/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এস,বি, (পিটুল) ০৩/০৬/২০১৪
    খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম,, আমার পাতায় আসবেন।
  • অমর কাব্য ০১/০৬/২০১৪
    সবটা পড়তে পারিনি।শুভেচ্ছা জানবেন
  • কবি মোঃ ইকবাল ০১/০৬/২০১৪
    এত বড় গল্প!!! বাবা!!! অনেক সময় লাগলো পড়তে। ভালো লেগেছে।
    • জাজাফী ০৩/০৬/২০১৪
      ভাই এতোটুকু গল্প যদি বলেন অনেক বড় তাহলে ড্যান ব্রাউন পড়তে গেলে না জানি কি বলবেন। ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।
  • দারুণ লিখেছেন ।
 
Quantcast