প্রেমান্ধ-কপাট
প্রেমান্ধ-কপাট
-
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে শুভ। খুব পড়ুয়া। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং নিষ্ঠাবান। তবে ইদানিং তার মাঝে অন্যরকম একটা পবিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কারো মাঝে হঠাৎ করে বিশেষ কোনো পবিবর্তনের পেছনে বিশেষ কিছু উপসর্গ থাকে। প্রেমের ক্ষেত্রেও এই ধরণের কিছু উপসর্গ আছে যা শুভ’র স্বভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে আজকাল। তার কাছের মানুষদের চোখে খুব সহজেই তা ধরা পড়ে।
এক বড় ভাই সরাসরি জিগ্যেস করে বসল,-‘ কী শুভ! তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। নতুন হাওয়ায় গা ভাসালে নাকি? আর যায় করো, পড়াশোনা যাতে ঠিক থাকে। পিছুটানকে উপেক্ষা করো না।’
শুভ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। তারপর স্মিত হেসে শোনায়,,-‘ না সুজিত দা। ওসব কিছু না।’
শুভর বাবা শাফায়েত হোসেন। সামান্য মদি দোকানি। বয়স হবে চল্লিশের মতো। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বয়স্ক মনে হয়। নড়োবড়ো শরীর। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন এখন শুভ। ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছে পড়াশোনার জন্য। প্রতিদিন সকাল-বিকাল ফোন তাগিদ দিতে থাকেন।‘ বাবা, ঠিকমতো পড়াশোনা করিস। আড্ডা-টাড্ডা দিস না। টাকা-পয়সা নিয়ে তুই একটুও ভাবিস না। আমরা তো আছি।’
অথচ প্রতিমাসে চলতে হিমসিম খেতে হয় শাফায়েত হোসেনকে। শুভর জন্য প্রতিমাসে আট হাজার যোগাড় না হলে রাতে ঘুমই হয়না মা-বাবার।
এদিকে ঈষিকার প্রেমের হাবুডুবু খাচ্ছে শুভ। মরি মরি ভাব। বোধের সমস্ত উৎস গ্রাস করা প্রেম তাদের। সমস্ত কিছু বিসর্জন দিতে এখন সংকোচবিহীন তারা। বাড়তি বয়স। বাস্তবতা এখন উপেক্ষিত পায়ে। ঈষিকা ধবধবে এক চঞ্চলা মেয়ে। বাবা নেই। মা একটি সরকারী ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। বলা চলে ধনী পরিবার। কারণ সরকারী চাকরিজীবিরা এখন প্রথম শ্রেণীর ধনী।
এই দুই কপোত-কপোতি এখন সংসারের স্বপ্ন দেখে। যত দিন মাস বছর গড়ায়, এদের প্রেমের ধরণও বদলাতে থাকে। গভীরতা পাই। একে অন্যের সাথে জড়াতে থাকে নিদ্বিধায়। শারীরিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে হারহামেশা। অথচ তারা ভুলে যায় তাদের দুজনের অবস্থান দুই মেরুতে।
সম্পর্কের প্রায় দুবছর হয়ে এল। শুভ সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। সাইকোলজিতে ফাইনাল দেবে। ইতোমধ্যে ঈষিকাকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। ব্যবসায়ী ছেলে। সে এই বিয়েতে নারাজ হলেও সরাসরি না করতে পারেনি। কিন্তু মায়ের চাপের মুখে সম্মতি জানাতে বাধ্য হয়েছে তাকে। মায়ের সোজাসাপ্টা কথা, ‘বিয়েতে অমত করলে আমার খারাপ চাওয়া ছাড়া তোর বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।’ ঈষিকা এক কথায় থমকে যায়।
মেয়েকে দেখে-শুনে আঙটি পড়িয়ে গেলে ছেলেপক্ষ। দিন-তারিখ ঠিক হল আগামী শুক্রবার।
একদিকে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত দুপক্ষ। অন্যদিকে ঈষিকা-শুভ তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিল, তারা পালিয়ে যাবে দূরে কোথাও। যেখানে তাদের কেউ কোনোভাবেই খুঁজে পাবেনা। অবশ্য ঈষিকা কিছুটা নিমরাজি। কারণ তার কানে মায়ের কথাটি বারবার বেজে উঠছে। শুভ জানে, ব্যাপারটি তার পরিবারে কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। উল্টা মা-বাবা দুজনেই কষ্ট পাবে। তাই সে পরিবারের কাউকে জানাতে সাহস পাইনি। ঈষিকাকেও সে উপেক্ষা করতে পারবে না। ঈষিকাও তার ব্যতিক্রম না।
ঠিক কী করা উঠিত? পার্কের বেঞ্চিতে বসে বসে দুজন ভেজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশে দিকে। ভাবে, এ তবে মিথ্যে প্রেম। ‘না না, তা কেনো হবে? কিছুক্ষণ পর ঈষিকার হাতের উপর হাত রেখে স্মিত হেসে শুভ বলে,-‘চলো! আমরা মরে যায়!’
ঈষিকা প্রথমে অবাক হলেও সেই বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নেয়নি। তারপর সৌল্লাসে সম্মতি জানায় সে। বলে,-‘হ্যাঁ , এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানবো না। চলো, মৃত্যুকে বুকে জড়ায়। পৃথিবীর বুকে লিখে দিই একটি নিটোল প্রেমের ইতিহাস। চলো, আমরা মৃত্যুতে এক হই। উল্কাফুল ফুল হয়ে ফুটি আকাশে।’
দুজনের এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হল। বিয়ের আগের রাতে তারা আত্মহত্যা করবে। দুজনই বাসায় ফিরে গেলো শেষবার। ঈষিকার বাড়ি ভর্তি লোকজন। ধুমধাম আয়োজন হচ্ছে বাসায়। শেষবারের মতো স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আত্মহননের পথে রওনা দিবে। সবার কাছে কাঙ্খিত অনাকাঙ্খিত কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।
ঈষিকা সর্বশেষ মায়ের কাছে গেল। মা বিয়ের জন্য কেনা গয়নাঘাটি সুকেজে রাখছিল। ঈষিকাকে দেখে মা সেসব দেখাতে চাইলে সে অন্যমনস্কভাবে মাকে বলল,-‘এসব রাখো তো মা।’ মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। মা বলে,-‘পাগল মেয়ে কোথাকার। বিয়ের দিনে কাঁদতে নেই।’ ঈষিকা বলে,-‘ নিজের প্রতি যত্ন নিও মা। অনেক সময় তোমার অবাধ্য হয়েছি। কথা শুনিনি। খারাপ আচরণ করেছি। আমাকে ক্ষমা করবে তো মা? মা তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। পুনর্বার ঐকথায় জবাব দিলেন,-‘ আমার পাগলি কোথাকার।’
শুভ মা-বাবা কাউকে জানায়নি।বাসায় বসে বসে কেঁদেছে। অনেক যত্নে চিঠি লিখেছে। মায়ের আড়ালে গিয়ে ঈষিকাও লিখেছে মায়ের কাছে। তাদের দুজনের চিঠিতে মূলকথা ছিল অনেকটা এই রকম,-‘ জানি, মাকে উপেক্ষা করলে হবো কুলাঙ্গার আর প্রেমকে উপেক্ষা করলে হবো প্রতারক। স্বার্থপর আর ছলনাময়ী। কোনোদিকে যাওয়া হল না আমাদের। আমরা দুজনেই মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেলাম। আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের ক্ষমা করো। ভালো থেকো।’
অন্যান্য দিনের মতোই কেটে গেল শেষ অপরাহ্ন। দুজনেই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। প্রিয় মানুষদের সাথে শেষবার কথা বলে কষ্ট হচ্ছিল ঈষিকার। তবুও প্রকাশ করল না। আর দেখা হবে না কোনোদিন। আর কথা হবে না কোনোদিন। এই শেষ কথা, এই শেষ দেখা।
কাউকে না বলে সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল ঈষিকা-শুভ। দুজনে এসে উপস্থিত হল ঝাউতলা রেলস্টেশনে। দুজনেই নির্বিকার। কারো মুখে কোনো কথা নেই অনেকক্ষণ। শেষবারের মতো এ পৃথিবীকে দেখে নিচ্ছে তারা। দূরে হালকা আঁধার নেমেছে। ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে দিগন্ত।
বড় নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর মানুষ। এখানে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই কারো। মানুষ নিয়মের দেয়াল তোলে স্বাধীন জীবনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে মৃত্যুকে স্বীকার করে নেয় অনেকে। আজ সে পথেই হাঁটতে যাচ্ছে এই যুগল কপোত-কপোতি।
রেল লাইনের দুধারে দুজন বসে আছে মুখোমুখি। কত মানুষ তাদের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। কেউ জিগ্যেস করছে না তাদের,-‘কেনো এই বিষাদ তোমাদের। এই পৃথিবী তোমাদের বাঁচার পথ দেখাবে। শেখাবে প্রেমানুরাগীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।’ বরং যে যার মতো করে গড়ে নিচ্ছে গতানুগতিক জীবন। এখানে যে কোনো আনন্দ নেই, আহ্লাদ নেই। আছে কেবল কয়েদী যাপিত জীবন।
সময় ঘনিয়ে এসেছে। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। হাত ধরে শুরু হল হাঁটা। যেখানে গিয়ে থামে তাদের এই পথচলা। এ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। কোনো ভয় নেই। কোনো কৈফিয়ত নেই। কোনো অনুশোচনা নেই। এই পথ উন্মুক্ত, এই পথ অনন্তের। যাত্রা শুরু হল। যেখানে গিয়ে মিশে একাকার হওয়া যায়। তারপর রচিত হবে নতুন প্রেমোপাখ্যান।
হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল। স্লিপার থেকে খসে পড়ে দুজনার পা। দেখা গেল রেল লাইনের পাশে এক মাঝবয়সী মহিলা রক্তাক্ত লাশকে বুকে ধরে আর্তনাদ করছে। নাড়ীছেঁড়া তীব্র আর্তনাদ। জানা গেল পাশের বস্তিতেই তার একমাত্র ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকত। ঐ রক্তাক্ত লাশটি তার সন্তানের। ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে। ঐ মহিলার পুত্রহারা শোকে ভারী হয়ে উঠেছে ঝাউতলার আকাশ-বাতাস। মুহূর্তেই এই ঘটনায় খুলে গেল ঈষিকা-শুভ’র প্রেমান্ধ কপাট। হিম হয়ে এল দুজনার গহীন।
কিছুক্ষণের জন্য দুজনই আত্মহত্যার কথা ভুলে গেল। যখন সম্বিত ফিরে পেল-বুঝতে পারল তাদের চোখজোড়া স্যাঁতস্যাঁতে, অশ্রুসজল। চোখের কোণে জমে উঠেছে বিষাদের পাহাড়। এই পৃথিবী যত সুন্দর, প্রেম যত সুন্দর, স্বপ্ন যত সুন্দর তারচে লক্ষাধিক সুন্দর মায়ের নিষ্কলুষ ভালোবাসা। তারা বুঝি আজ সেই মায়ের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে মর্মমূলে আঘাত করতে চলেছে!
এই ঘটনায় দুজনেরই আত্মপোলব্ধি ঘটল-এক ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য অন্য ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলা শুধু মূর্খতা নয়, একপ্রকার অবক্ষয়ও বটে। তাই তারা দুজনই নিঃশব্দে বাসায় ফিরে গেল। মায়ের আঁচল তলে মাথা রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে যেদুজন তরুণ-তরুণী এখন উদগ্রীব, সে দুজন কিছুক্ষণ আগেও ট্রেনের তলে থাকতে পারত। এই ভেবে দুজনই একটা বড় ধরণের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দুজন ব্যতীত কেউ তা জানে না।
-
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে শুভ। খুব পড়ুয়া। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং নিষ্ঠাবান। তবে ইদানিং তার মাঝে অন্যরকম একটা পবিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কারো মাঝে হঠাৎ করে বিশেষ কোনো পবিবর্তনের পেছনে বিশেষ কিছু উপসর্গ থাকে। প্রেমের ক্ষেত্রেও এই ধরণের কিছু উপসর্গ আছে যা শুভ’র স্বভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে আজকাল। তার কাছের মানুষদের চোখে খুব সহজেই তা ধরা পড়ে।
এক বড় ভাই সরাসরি জিগ্যেস করে বসল,-‘ কী শুভ! তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। নতুন হাওয়ায় গা ভাসালে নাকি? আর যায় করো, পড়াশোনা যাতে ঠিক থাকে। পিছুটানকে উপেক্ষা করো না।’
শুভ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। তারপর স্মিত হেসে শোনায়,,-‘ না সুজিত দা। ওসব কিছু না।’
শুভর বাবা শাফায়েত হোসেন। সামান্য মদি দোকানি। বয়স হবে চল্লিশের মতো। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বয়স্ক মনে হয়। নড়োবড়ো শরীর। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন এখন শুভ। ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছে পড়াশোনার জন্য। প্রতিদিন সকাল-বিকাল ফোন তাগিদ দিতে থাকেন।‘ বাবা, ঠিকমতো পড়াশোনা করিস। আড্ডা-টাড্ডা দিস না। টাকা-পয়সা নিয়ে তুই একটুও ভাবিস না। আমরা তো আছি।’
অথচ প্রতিমাসে চলতে হিমসিম খেতে হয় শাফায়েত হোসেনকে। শুভর জন্য প্রতিমাসে আট হাজার যোগাড় না হলে রাতে ঘুমই হয়না মা-বাবার।
এদিকে ঈষিকার প্রেমের হাবুডুবু খাচ্ছে শুভ। মরি মরি ভাব। বোধের সমস্ত উৎস গ্রাস করা প্রেম তাদের। সমস্ত কিছু বিসর্জন দিতে এখন সংকোচবিহীন তারা। বাড়তি বয়স। বাস্তবতা এখন উপেক্ষিত পায়ে। ঈষিকা ধবধবে এক চঞ্চলা মেয়ে। বাবা নেই। মা একটি সরকারী ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। বলা চলে ধনী পরিবার। কারণ সরকারী চাকরিজীবিরা এখন প্রথম শ্রেণীর ধনী।
এই দুই কপোত-কপোতি এখন সংসারের স্বপ্ন দেখে। যত দিন মাস বছর গড়ায়, এদের প্রেমের ধরণও বদলাতে থাকে। গভীরতা পাই। একে অন্যের সাথে জড়াতে থাকে নিদ্বিধায়। শারীরিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে হারহামেশা। অথচ তারা ভুলে যায় তাদের দুজনের অবস্থান দুই মেরুতে।
সম্পর্কের প্রায় দুবছর হয়ে এল। শুভ সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। সাইকোলজিতে ফাইনাল দেবে। ইতোমধ্যে ঈষিকাকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। ব্যবসায়ী ছেলে। সে এই বিয়েতে নারাজ হলেও সরাসরি না করতে পারেনি। কিন্তু মায়ের চাপের মুখে সম্মতি জানাতে বাধ্য হয়েছে তাকে। মায়ের সোজাসাপ্টা কথা, ‘বিয়েতে অমত করলে আমার খারাপ চাওয়া ছাড়া তোর বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।’ ঈষিকা এক কথায় থমকে যায়।
মেয়েকে দেখে-শুনে আঙটি পড়িয়ে গেলে ছেলেপক্ষ। দিন-তারিখ ঠিক হল আগামী শুক্রবার।
একদিকে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত দুপক্ষ। অন্যদিকে ঈষিকা-শুভ তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিল, তারা পালিয়ে যাবে দূরে কোথাও। যেখানে তাদের কেউ কোনোভাবেই খুঁজে পাবেনা। অবশ্য ঈষিকা কিছুটা নিমরাজি। কারণ তার কানে মায়ের কথাটি বারবার বেজে উঠছে। শুভ জানে, ব্যাপারটি তার পরিবারে কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। উল্টা মা-বাবা দুজনেই কষ্ট পাবে। তাই সে পরিবারের কাউকে জানাতে সাহস পাইনি। ঈষিকাকেও সে উপেক্ষা করতে পারবে না। ঈষিকাও তার ব্যতিক্রম না।
ঠিক কী করা উঠিত? পার্কের বেঞ্চিতে বসে বসে দুজন ভেজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশে দিকে। ভাবে, এ তবে মিথ্যে প্রেম। ‘না না, তা কেনো হবে? কিছুক্ষণ পর ঈষিকার হাতের উপর হাত রেখে স্মিত হেসে শুভ বলে,-‘চলো! আমরা মরে যায়!’
ঈষিকা প্রথমে অবাক হলেও সেই বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নেয়নি। তারপর সৌল্লাসে সম্মতি জানায় সে। বলে,-‘হ্যাঁ , এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানবো না। চলো, মৃত্যুকে বুকে জড়ায়। পৃথিবীর বুকে লিখে দিই একটি নিটোল প্রেমের ইতিহাস। চলো, আমরা মৃত্যুতে এক হই। উল্কাফুল ফুল হয়ে ফুটি আকাশে।’
দুজনের এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হল। বিয়ের আগের রাতে তারা আত্মহত্যা করবে। দুজনই বাসায় ফিরে গেলো শেষবার। ঈষিকার বাড়ি ভর্তি লোকজন। ধুমধাম আয়োজন হচ্ছে বাসায়। শেষবারের মতো স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আত্মহননের পথে রওনা দিবে। সবার কাছে কাঙ্খিত অনাকাঙ্খিত কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।
ঈষিকা সর্বশেষ মায়ের কাছে গেল। মা বিয়ের জন্য কেনা গয়নাঘাটি সুকেজে রাখছিল। ঈষিকাকে দেখে মা সেসব দেখাতে চাইলে সে অন্যমনস্কভাবে মাকে বলল,-‘এসব রাখো তো মা।’ মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। মা বলে,-‘পাগল মেয়ে কোথাকার। বিয়ের দিনে কাঁদতে নেই।’ ঈষিকা বলে,-‘ নিজের প্রতি যত্ন নিও মা। অনেক সময় তোমার অবাধ্য হয়েছি। কথা শুনিনি। খারাপ আচরণ করেছি। আমাকে ক্ষমা করবে তো মা? মা তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। পুনর্বার ঐকথায় জবাব দিলেন,-‘ আমার পাগলি কোথাকার।’
শুভ মা-বাবা কাউকে জানায়নি।বাসায় বসে বসে কেঁদেছে। অনেক যত্নে চিঠি লিখেছে। মায়ের আড়ালে গিয়ে ঈষিকাও লিখেছে মায়ের কাছে। তাদের দুজনের চিঠিতে মূলকথা ছিল অনেকটা এই রকম,-‘ জানি, মাকে উপেক্ষা করলে হবো কুলাঙ্গার আর প্রেমকে উপেক্ষা করলে হবো প্রতারক। স্বার্থপর আর ছলনাময়ী। কোনোদিকে যাওয়া হল না আমাদের। আমরা দুজনেই মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেলাম। আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের ক্ষমা করো। ভালো থেকো।’
অন্যান্য দিনের মতোই কেটে গেল শেষ অপরাহ্ন। দুজনেই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। প্রিয় মানুষদের সাথে শেষবার কথা বলে কষ্ট হচ্ছিল ঈষিকার। তবুও প্রকাশ করল না। আর দেখা হবে না কোনোদিন। আর কথা হবে না কোনোদিন। এই শেষ কথা, এই শেষ দেখা।
কাউকে না বলে সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল ঈষিকা-শুভ। দুজনে এসে উপস্থিত হল ঝাউতলা রেলস্টেশনে। দুজনেই নির্বিকার। কারো মুখে কোনো কথা নেই অনেকক্ষণ। শেষবারের মতো এ পৃথিবীকে দেখে নিচ্ছে তারা। দূরে হালকা আঁধার নেমেছে। ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে দিগন্ত।
বড় নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর মানুষ। এখানে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই কারো। মানুষ নিয়মের দেয়াল তোলে স্বাধীন জীবনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে মৃত্যুকে স্বীকার করে নেয় অনেকে। আজ সে পথেই হাঁটতে যাচ্ছে এই যুগল কপোত-কপোতি।
রেল লাইনের দুধারে দুজন বসে আছে মুখোমুখি। কত মানুষ তাদের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। কেউ জিগ্যেস করছে না তাদের,-‘কেনো এই বিষাদ তোমাদের। এই পৃথিবী তোমাদের বাঁচার পথ দেখাবে। শেখাবে প্রেমানুরাগীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।’ বরং যে যার মতো করে গড়ে নিচ্ছে গতানুগতিক জীবন। এখানে যে কোনো আনন্দ নেই, আহ্লাদ নেই। আছে কেবল কয়েদী যাপিত জীবন।
সময় ঘনিয়ে এসেছে। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। হাত ধরে শুরু হল হাঁটা। যেখানে গিয়ে থামে তাদের এই পথচলা। এ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। কোনো ভয় নেই। কোনো কৈফিয়ত নেই। কোনো অনুশোচনা নেই। এই পথ উন্মুক্ত, এই পথ অনন্তের। যাত্রা শুরু হল। যেখানে গিয়ে মিশে একাকার হওয়া যায়। তারপর রচিত হবে নতুন প্রেমোপাখ্যান।
হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল। স্লিপার থেকে খসে পড়ে দুজনার পা। দেখা গেল রেল লাইনের পাশে এক মাঝবয়সী মহিলা রক্তাক্ত লাশকে বুকে ধরে আর্তনাদ করছে। নাড়ীছেঁড়া তীব্র আর্তনাদ। জানা গেল পাশের বস্তিতেই তার একমাত্র ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকত। ঐ রক্তাক্ত লাশটি তার সন্তানের। ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে। ঐ মহিলার পুত্রহারা শোকে ভারী হয়ে উঠেছে ঝাউতলার আকাশ-বাতাস। মুহূর্তেই এই ঘটনায় খুলে গেল ঈষিকা-শুভ’র প্রেমান্ধ কপাট। হিম হয়ে এল দুজনার গহীন।
কিছুক্ষণের জন্য দুজনই আত্মহত্যার কথা ভুলে গেল। যখন সম্বিত ফিরে পেল-বুঝতে পারল তাদের চোখজোড়া স্যাঁতস্যাঁতে, অশ্রুসজল। চোখের কোণে জমে উঠেছে বিষাদের পাহাড়। এই পৃথিবী যত সুন্দর, প্রেম যত সুন্দর, স্বপ্ন যত সুন্দর তারচে লক্ষাধিক সুন্দর মায়ের নিষ্কলুষ ভালোবাসা। তারা বুঝি আজ সেই মায়ের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে মর্মমূলে আঘাত করতে চলেছে!
এই ঘটনায় দুজনেরই আত্মপোলব্ধি ঘটল-এক ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য অন্য ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলা শুধু মূর্খতা নয়, একপ্রকার অবক্ষয়ও বটে। তাই তারা দুজনই নিঃশব্দে বাসায় ফিরে গেল। মায়ের আঁচল তলে মাথা রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে যেদুজন তরুণ-তরুণী এখন উদগ্রীব, সে দুজন কিছুক্ষণ আগেও ট্রেনের তলে থাকতে পারত। এই ভেবে দুজনই একটা বড় ধরণের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দুজন ব্যতীত কেউ তা জানে না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জয়শ্রী রায় মৈত্র ২৩/০৪/২০১৭অসাধারণ থিম । গল্পের শেষ দিকের শব্দ চয়ন এবং পরিবেশন সত্যিই অপূর্ব । আরও ভালো থিমের গল্প এবং সম্পাদিত পরিবেশন আশা করছি । শুভ কামনা রইল ।
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ২২/০৪/২০১৭স্বার্থক এক ছোট গল্প!!!
-
সাঁঝের তারা ২১/০৪/২০১৭খুব ভাল।