www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অন্তর্দহন

‘আমার ঘরে এমন গর্দভ ছেলে জন্মাবে আমি ভাবতেও পারিনি কখনো’- কথাগুলো গভীর ক্ষোভে ক্ষুদ্ধস্বরে এক নিঃশ্বাসে বলেই উঠে দাঁড়ান ড. ফজলুল করিম। আসাদ চুপচাপ মৌনমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নত করে। অন্য পাশটায় নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে ভয়সন্ত্রস্থ চোখে তাকান মা সাফা বেগম। তিনি স্বামীকে প্রচন্ডরকম ভয় পান। তর্কে দুঃসাহস দেখান না। বাঙালি নারীদের এ এক বিশেষ গুণ। এই স্বামী ভক্তিও যেন আবহমান বাংলার এক চিরাচরিত রীতি।

       ড. ফললুল করিম সাফার প্রস্থিত মৌনতাকে লক্ষ করে বলল,-‘ছেলে তো একটা জন্ম দিয়েছ নিজের মতো আস্ত গাদা। মানুষ হবে না কোনোদিন।’ এ-বলেই ধপাস ধপাস পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। আসাদের চোখ-জোড়া জলে স্যাঁতস্যাতে। মা সাফা বেগম আসাদের মনঃকষ্টে কাতর। কিন্তু প্রকাশ করল না। মাঝে মাঝে সন্তানদের শাসনও প্রয়োজন। তাই রাগান্বিত হয়ে বললেন,-‘ তুই কেমন ছেলে রে বাবা! বোধশক্তি নেই ? অপমানবোধ নেই ? মায়ের প্রতি সামান্যটুকু দরদও নেই? যে সন্তানের জন্য মাকে কথা শুনতে হয়......সে সন্তানের কাছ থেকে ভবিষ্যপ্রাপ্তির চেয়ে অপপ্রাপ্তির আশঙ্কায় যে বেশি থাকে।’

     আসাদ মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়। সে মায়ের চোখে স্পষ্ট দেখতে পায় বিষাদের পাহাড়। যেন অসহায় মাতৃত্ববোধ প্রকাশ করে দিচ্ছে তাঁর নিষ্কলুষ চাহনী। আসাদ ঠিক বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত! একমাত্র তার  জন্যই মায়ের  এই করুণদৃশ্য পুনর্বার দেখতে হয়েছে।

       আসাদ ভেবে দেখে তার দোষ বা অপরাধ সে একটু-আধটু লেখালেখি করে। শুধুমাত্র এটার কারণেই বাবা মাকে বেশ কয়েকবার ধমক দিয়েছেন। এ লেখালেখি ছেড়ে দিতে হবে তাকে। ছেড়ে দিলেই সব চুকে যাবে। যদিও এক সময় ড. ফজলুল করিম বিশ্বাস করতেন ছাত্র বয়স থেকেই টুকিটাকি লেখালেখির অভ্যাস থাকাটা ভালো। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষায় খারাপ করার নেপথ্যে যে এ অতি আসক্তবোধটাই দায়ী বলে তিনি মনে করেন। আরো কিছু লক্ষণও বিবৃত করেছেন। যেমন পড়াশোনা, কাজ, সংসার, বাস্তবতা সবকিছুতেই একটা উদাসীনতা ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠা।

        ইতোপূর্বে ড. ফজলুল করিম আসাদকে বেশ ক’বার সতর্ক করেছেন-বুঝিয়েছেন-তাগিদ দিয়েছেন। পড়াশোনা ব্যতিরেকে অন্য সব কিছু তোমার কাছে প্রশ্রয় অপ্রত্যাশিত আর বুঝই তো, অপ্রত্যাশিত কোন কিছুই আমার কাম্য নয়।

       সাফা বেগম আসাদের কোনো ্উত্তরের অপেক্ষা না করে কথায় চপোটাঘাত করে বলল,-‘ তুই আমার সন্তান অথচ তোর শরীরে আমার রক্ত নেই। থাকলে তুই কেনো আমাকে কথা শূনাবি?’

        সাফা বেগম কথা শেষ করার সময় পেল না। তৎক্ষণাৎ আসাদ মাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। নাড়িতে টান লাগে মা’র। হু হু করে কেঁদে উঠে তাঁর ভিতর। প্রকাশ করল না। দু’এক ফোঁটা জল যেটুক জমেছিল চোখের কোণে, ডানহাতের আগুলে নিঁপুণভাবে মুছে দিল তার দাগ।

       রাতে খাবার খেতে বসেছেন ড. ফজলুল করিম। পাশের রুমে লাইট অফ করে জানালার ধারে বসে আছে আসাদ। প্রতিবেশির লাইটের মৃদু আলো অন্ধকারকে হালকা করে তোলেছে। সে মৃদু আলো মৃদু অন্ধকারের মাঝে আংশিক বোঝা যাচ্ছিল আসাদের মৌনমূর্তি। সাফা বেগম খেতে ডাকলেন। এ ডাকে কোনো সাড়া দিল না সে। আবার ডাকলেন,-‘ আসাদ খেয়ে যা।’ কিন্তু দ্বিতীয় ডাকেও কোনো সাড়া না পেয়ে ড. ফজলুল করিম গাম্ভীর্যস্বরে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন,-‘ অতো ডাকাডাকির কিসের? কেউ খেতে না চাইলে তাকে জোর করে খাওয়াতে পারবে? যত্তসব উজবুকের দল।’
- খেতে বসেছেন খান। খেয়ে বিদেয় হোন। ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও শিখেননি। নাকি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন?
ড. ফজলুল করিম অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন স্ত্রী সাফা বেগমের দিকে। এই প্রথম তিনি তাঁর মুখের উপর কাউকে কথা বলতে দেখছেন।

      তিনি খুব রগচটা ধরণের মানুষ। তার মুখের উপর কথা মোটেও বরদাস্ত করতে পারেন না। এ ধরণের বদমেজাজি মানুষগুলো ভেতরে ভেতরে অসম্ভবরকমের উদার হয়। অনেকটা আকাশের মতো এবং বিচিত্র। কেননা একেক সময় আকাশকে একেক রূপে দেখা যায়। যেমন গ্রীষ্মের আকাশ দাবদাহ প্রখর, বর্ষার আকাশ কখনো নিষ্কলুষ কিংবা বজ্রনিনাদের মতো ভয়ংকর, হেমন্তের আকাশ নির্মল আর শীতের আকাশ হিমশীতল ।

       কিন্তু তাঁর ভেতরকার রূপ আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেনি স্ত্রী সাফা বেগম।  এই অনভিজ্ঞতার কারণে প্রায়শই চুপচাপ থাকে হয়তো।  কিন্তু আজকের এ হঠাৎ পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবেই মনে নিতে পারেনি ড. ফজলুল করিম। বর্ষার বজ্রের মতো গর্জন করে বলল,-‘ কার সাথে কী ব্যবহার করতে হয় তোমার কাছে শিখতে হবে আমাকে? খুব উদ্ধত সীমা ছাড়িয়ে গেছ দেখছি।’

       সাফা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। ছেলেমেয়ে কোনো অপরাধ করে থাকলে পিতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সকল দায় মায়েদের কাধে এসে পড়ে। এ রীতি জগতের প্রতিষ্ঠিত সত্য। মা’রা নাড়ির টান উপেক্ষা করতে পারেনা। তাই মেনে নেয় বৈকি।

      আসাদ পাশের রুম থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে তার বাবার অকথ্য ভাষার কটুক্তি আর রূঢ় আচরণ লক্ষ করল। সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর পড়ার টেবিলে এসে বসল। ড্রয়ার খুলে তার অপ্রকাশিত কবিতা-গল্পের পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল। কত প্রয়োজনীয় মুহূর্ত নষ্ট করেছে, কত রাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে, কত চিন্তা-চেতনার ফসল এই এক একটি কবিতা-গল্প। প্রতিটি লেখা প্রসব করেছে অনেক সাধনার আদলে। প্রতিটি রচনা লেখকের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।  আপন সন্তানতূল্য। এ-কথা কেবলমাত্র সেই মানে যার রক্তে-ঘামে-চিন্তনে জন্ম হয় একটি কবিতা-গল্পের।

      রাত গভীর হল। চতুর্দিকে সুনসান নিরবতা। সে জেগে আছে যেমন জেগে আছে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক দুঃখরা। পৃথিবীর কোনো মানুষ নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে পারে না কেনো? প্রতিটি মানূষ এক একটা শৃঙ্খলে বাঁধা। প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা থাকে ব্যক্তিত্ব। কেউ অভাব-ঘোর শৃঙ্খল, কেউ চলায় শৃঙ্খল, কেউ মতামত প্রকাশের শৃঙ্খল, কেউ দায়-দায়িত্বের শৃঙ্খল কিংবা কেউ নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা। স্বাধীন জীবন যারা কামনা করে সংসার তাদের স্বীকৃতি দেয় না।  আজ যেমন অস্বাীকৃতি পেল আসাদ।

      সমস্ত পান্ডলিপি মেঝেতে রেখে আগুন ধরিয়ে দিল সে। ধবধব করে জ্বলতে থাকে তার কবিতার শরীর। দহনে তীব্রতা টের পাচ্ছে আসাদ। যেন কবিতা পুড়ছে না। পুড়ছে তার গহীন। সাধনার আত্মা। কবিতার শরীরে আগুন দিয়ে হয়তো সংসারের কলহ খানিকটা দূরীভূত হবে ঠিক কিন্তু আসাদের গহীনের যে নিষুপ্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলতে শুরু করেছে তা আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে নিভৃতে।

      ভোরবেলা আসাদের দরজার সামনে ছাই দেখে ড. ফজলুল করিম চেঁচিয়ে উঠেন। সাফা বেগম জায়নামাজ থেকে দৌড়ে এসে হতভম্ব হলেন ছাইয়ের স্তূপটা দেখে। মনে খটকা লাগল। তাই চুপ হয়ে গেলেন। তিনি স্ত্রীর কাছে এটার কারণ জানতে চান। সাফা বেগম বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে না পেরে রুমে মাথা উঁকি দিয়ে দেখেন। কিন্তু আসাদ ঘরে নেই। তাই কাচুমাচু করতেই ফজলুল করিম রাগতস্বরে বললেন,-‘পুরো বাড়িটাকেই জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়লে তোমরা।’

       সেদিন ভোর রাতে আসাদ বাড়ি ছেড়েছিল। আর ফিরে আসেনি। তারপর থেকে বাড়িটা শব্দহীন সুনসান। সময়-অসময় চেঁচামেচি নেই। ঝগড়া-বিবাদের কোলাহল নেই। মা-বাবার অভিমানি চোখে প্রতিদিন যে কাব্য রচিত হয় বিষাদের, আসাদ হয়তো সে কথা জানে না। হয়তো ফিরে আসবে একদিন, হয়তো না। তবুও সামান্য প্রত্যাশা রাখা দোষ কিসের?
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৫৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০৩/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast