www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আড়ষ্ট

বেশ কিছুদিন হলো দীপন শহরে এসেছে। পুরো নাম আজিজুল হাকিম দীপন।  নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে এবার। নতুন স্কুল, নতুন মুখ। জন্মের দু’বছর পর বাবা মারা যায়। তারপর থেকে মা’ই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরিক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পূর্বেই মা’ও পাড়ি জমান অন্তহীন পথে। তাই মাধ্যমিকে পড়াশোনার জন্য শহরে খালার বাসায় উঠেছে নিরুপায় হয়ে। কিন্তু গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে উঠা এ কিশোর শহুরে পরিবেশে নিজেকে কোনোভাবেই মেলাতে পারছেনা। না চলাফেরা, না বেশভূষা-কথাবার্তা, কোনো কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। বিশেষ করে কমবয়সী সুন্দর তরণীদের দেখে হকচকিয়ে যায়। নিজেকে গোপন করতে চাই। কোথায় যেন ব্যাপক শূন্যতা। সে বুঝতে পারে কিন্তু জানে না তার কারণ কী। হয়তো বা সে নিজেকেই পুরোপুরি বুঝতে পারে না। ফ্যাকাশে মুখখানিই তার বহিঃপ্রকাশ।

বন্ধু মহলে দীপন খুবই নিরব ও নিরস প্রকৃতির। অমিশুক ও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। ভাবনাই যেন তার অন্তর্জগতের প্রতিপাদ্য বিষয়। তাকে দেখে খুব করে বুঝা যায় গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। মাথা থেকে তেল চিটচিটে গন্ধ, অপরিচ্ছন্ন মুখাবয়ব, রোজকার একটিমাত্র শাদা শার্ট। যার ফলে খুব সহজেই সবার চোখে পড়ে। কিন্তু পড়াশোনায় খুব একটা দুর্বল নয়। মূলত সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। তার চতুর্দিকে কিসের যেন পুরুদস্তর প্রাচীর যা তাকে এই রঙরঙা পরিবেশের সাথে মিশতে অনুমতি দেয় না।

ক্লাসের প্রথম দিনকার কথা। ফাস্ট পিরিয়ডে এসেছেন ভূ-পতি ভূষণ নন্দি। তিনি বাংলা পড়ান। প্রথমেই তিনি সবার সাথে পরিচিতি পর্বটা সেরে নিতে চান। এক নিমিষে পুরো ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিলেন। চশমার চোখ মুছতে মুছতে স্পষ্ট স্বরে বললেন-
তোমরা সকলে এক এক করে তোমাদের নামঠিকানা  বলে যাও।

কথামত প্রথম বেঞ্চ থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল। তারপরে অন্যজন। দীপন বসেছে দি¦তীয় বেঞ্চের শেষের দিকে। জানালার পাশে। আটজনের পরে তাকেও বলতে হবে। এটা ভেবে সে অস্বস্তিবোধ করে। রীতিমত ঘামতে শুরু করেছে। তার চোখে এক ধরণের শঙ্কা। খানিকটা ভয়। কিছু স্থির জড়তা। শহুরে ছেলেগুলো অনেক স্মার্ট। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। সে তাদের মত করে বলতে পারবে তো? নাকি..

একসময় সে ব্যাপক অস্থিরতা অনুভব করল। তার পালাও ঘনিয়ে আসছে। আর মাত্র দু’জন। তারপর সে। তার দৃষ্টি একবার যাচ্ছে বেঞ্চের পায়ার দিকে। আরেকবার যাচ্ছে স্যারের দিকে। পুরো শরীর ঘামে স্যাঁতস্যেঁতে। ঘর্মাক্ত সকরুণ চেহারা। অবশেষে নন্দিবাবু বলে উঠল-
এই ছেলে তুমি?
দীপন দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছে এমন সময় নন্দিবাবু আকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসল-জিগ্যেস করল
কি ব্যাপার! তোমার এ দশা কেনো?

দীপন হা করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন তাঁর কথা মোটেও বুঝতে পারছে না। নন্দিবাবু তার এ ইতস্তত বোধ দেখে একটু বিরক্ত হলেন বটে। তবুও স্বাভাবিক ভাবে বলেন-
তোমার নাম-দাম কিছু নেই নাকি?

দীপন কথা বলার আগেই চারিদিকে একবার দেখল। সে খেয়াল করল সকল ছেলেমেয়ে তার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।  সে আবার স্যারের দিকে নজর দিল। কিন্তু সে স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছে তার হাটু, বাহুযুগল এবং ঠোঁটের অগ্রাংশ কাঁপছে। কিন্তু কিছু করার নেই। তাই নিজেকে স্থির রেখে বলতে চেষ্টা করল-
আমি দীপন....
মুহুর্তেই বাকি ছাত্রছাত্রীরা হু হু করে হেসে ওঠল। নন্দিবাবু ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। বলেন
চুপ করো সবাই।
যদিও তিনি নিজেও হেসেছেন প্রথমে। দীপনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল তার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি। অস্থির সময়গুলোতে সাধারণত এমন হয়।

তার মূল কারণ জড়তা। দীপন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে পানি টলোমলো করছে। সে এক ধরণের অপমান বোধ করতে লাগল।

নন্দিবাবু খানিকটা বিস্মিত হলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন দীপন কাঁদছে। আজব ব্যাপার। এখানে কান্না করার মতো কিছুই হয়নি। তিনি অদ্ভুত রাগতস্বরে জিগ্যেস করলেন
এই ছেলে কাঁদছো কেনো?
দীপন এই কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। বরং চোখ টিপে টিপে অনর্গল কাঁদতে লাগল। অবশ্য নন্দিবাবুও তার উত্তরের আশা না করেই পরবর্তিজনের দিকে নজর দিলেন। সেদিন থেকে সবাই দীপনের প্রতি কেমন একটা মনোভাব পোষণ করতে থাকে।

পরেরদিন ক্লাসমিটদের আচরণ আরো ব্যথিত করে তাকে। সেই দিনও দীপন বসল জানালার পাশে। ক্লাস শুরুর পূর্বে দেখা গেল উপস্থিত ছাত্রদের চমশা পড়–য়া একজন ব্ল্যাকবোডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও তাকে ছাত্র বলে মনে নাও হতে পারে নতুন কারো কাছে। বেশ বড়সড় এবং দুষ্ট প্রকৃতির। সে অবিকল নন্দিবাবুর মতো কণ্ঠকে পরিপাটি করে  দীপনের পাশে বসা মিশু নামের একজনকে জিগ্যেস করল
এই ছেলে তোমার নাম কী যেন?
মিশু ছেলেটিও তার নিজস্ব অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন করে দীপনের মতো করে জবাব দিল
দীপন.. ..

পুরো ক্লাস হু হু শব্দে ধ্বনিত হল। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের এক ধরণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল তারা অন্যকে বোকা বানাতে পারলেই নিজেকে চালাক দাবী করে। আজও সে রকম কিছু এখানে প্রকাশ করছে ওরা। শুধুমাত্র তন্নি নামের একটি মেয়ের মুখ বন্ধ ছিল। সে খ্যাপাটে চেহারা নিয়ে মিশুকে দাঁত কাটতে কাটতে বলে
এ ম্যারা তোর নাম কি দীপন?
মিশু। আমার নাম আরাফাত সানি মিশু।
তাহলে দীপন বললি কেনো হ্যাঁ?

মিশু হকচকিয়ে যায়। অন্যরা তাকে অনুসরণ করল। দীপন তন্নির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটি খামাখা তার পক্ষ হয়ে একজনের সাথে তর্কে জড়াচ্ছে। এর কোনো মানে হয়না। এ সময় তন্নি একবার দীপনের দিকে তাকাল। হয়তো তার মানসিক অবস্থা বুঝতে চেয়েছিল সে।

এরকম প্রতিদিন দীপনকে নিয়ে কোনো না কোনো হাস্যকর ঘটনা তৈরি করছে তার সহপাঠিরা। তার দুর্বলতা নিয়ে অন্যেরা যেভাবে মজা নিচ্ছে, উপহাস করছে, তাতে করে দিন দিন নিজের কাছে নিজেই যেন তুচ্ছ হয়ে উঠছে। তবুও সে অতিমাত্রায় সরল হওয়ার কারণে কারোরই প্রতিবাদ করত না। বরং একটা সময় সে সাবলীল হতে থাকে এবং মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে।

তাছাড়া খালার পরিবারে খালাতো ভাই-বোনদের অযাচিত ব্যবহার তার মনকে আরো বিষাদগ্রস্থ ও ব্যাথাতুর করে তোলে। বাসায় অন্তর্পীড়ন এবং সহপাঠিদের রূঢ় আচরণে আরো অধিক উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে ওঠে। মা নেই, বাবা নেই। অনাথ অসহায় নিরাশ্রয়ী দীপন সবগুলো দুঃখকে জমাট করে চোখের জল অঝোরে বের করে দিতে চায় ল্যাক্রিমালগ্রন্থির সাহায্যে। আড়ালে অবচ্ছায় কাঁদতে থাকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। তার অতিমাত্রার সরল মনোভাব। কারো সাথে বিতর্কে যেতে নারাজ। তার কাছের মানুষগুলো যদি তাকে নিয়ে মজা করে কিছু পায়, তবে তারা করে যাক। বরং সে নিজেকে সাবলীল ও মানিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগল।

এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। হঠাৎ একদিন সবাই লক্ষ্য করল দীপন ক্লাসে আসেনি। কারণে-অকারণে কখনোই ক্লাস মিস করেনা সে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য দীপন আজ ক্লাসে উপস্থিত নেই। তাই কারোই পাঠে মন নেই কোনো এক অজানা কারণে। পুরো ক্লাসরুম জুড়েই সুনসান নিরবতা আর মৃদু শূন্যতা। নন্দিবাবু নিজেও যেন পড়িয়ে আরাম পাচ্ছেন না আজ। ছাত্রদের অহাস্যমুখ আর মৌনতা লক্ষ্য করে এবং রসহীন পাঠের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। কেবল একটি কারণ ছাড়া আর কোনো কারণ পেলেন না তিনি। আর সেটি হল ক্লাসে আজ দীপন উপস্থিত নেই। চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন
কি ব্যাপার ! আজ দীপন আসে নি?
একজন জবাব দিল, না স্যার।
আজ দেখছি তোমাদের সবার মুখ গোমরা হয়ে আছে। পড়িয়েও মজা পাচ্ছি না। আমার নিজেরই ইচ্ছে করছে না পড়াতে।

আসবো স্যার?, দরজায় দাঁড়িয়ে প্রচন্ড উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ঋজু। তার চোখেমুখে বিষাদমিছিল। সবাই কেমন থমকে গেল। নন্দিবাবুর মনে খটকা লাগল। তবুও তিনি স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইলেন
আসো। তোমাকে এতটা হতাশাগ্রস্থ আর বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেনো ঋজু ?

অস্থিরতা ঋজুর চোখে-মুখে রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই জবাবে বেশি কিছু বলতে পারছে না ঋজু। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়তে গিয়ে সে বলল
দীপন এক্সিডেন্ট করেছে স্যার। বাঁচবে না হয়তো।
কী !! কী বললে ?
মুহুর্তেই যেন ঝাপসা হয়ে উঠে নন্দিবাবুর দৃষ্টিসীমা। তিনি স্থির থাকতে পারেননি। চেয়ারে বসে পড়েন। উপস্থিত ছাত্রদের মাঝ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠল স্তদ্ধতার গুঞ্জন।              চশমার ফাঁকে চোখের কোণের জমে উঠা পানি মুছতে মুছতে নন্দিবাবু বলল
যে এতদিন আমাদের হাসির জোয়ারে ভাসিয়েছিল আজ কিনা সেই.. .. ..
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৯৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/১২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মোনালিসা ০৩/০১/২০১৭
    অসাধারন
  • সোলাইমান ০১/০১/২০১৭
    কষ্টের পর সুখ আসবেই।
  • রাবেয়া মৌসুমী ৩১/১২/২০১৬
    সুন্দর! কষ্ট পেয়েছি দীপনে...
  • আব্দুল হক ৩০/১২/২০১৬
    লম্বা লিখা, সুন্দর হয়েছে, ধন্যবাদ
 
Quantcast