আমাদের হিমু(৩)
মাথার উপরের সূর্যটা আজকে যেন পন করেছে যে সবাইকে আজ সে সেধ্য করে ছাড়বে।
রাস্তার পিচ গলে জুতার নিচে লেগে জুতা ভারি হয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে নিজের উজন হটাত করে ৫ কেজি বেড়ে গেছে।
রাস্তার পাশে আখ এর রস বিক্রেতা আখ রস বিক্রি করছে ।
এরা কড়া রোদ উঠলে খুশি।
এতে তাদের বিক্রি বেড়ে যায়।
রাস্তার পাশে আখ এর রস বিক্রেতা আখ রস বের করার ফাঁকে ফাঁকে পথচারির মুখ দেখে নিচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রত্যেক শ্রেণীর পেশাজিবির চোখ তাদের পেশার সাথে সম্পৃক্ত জিনিসের দিকে প্রথমে খেয়াল করে।
একজন মুচি প্রথমে একজন মানুষের জুতার দিকে খেয়াল করে,
একজন কাপড় বিক্রেতা প্রথমে একজন মানুষের কাপড়ের দিকে খেয়াল করে।
তাই আখ এর রস বিক্রেতা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে বিচার করে নিচ্ছে যে এই লোককে ডাকলে সে কি তার রস খাবে কি না।
আমি আখ এর রস বিক্রেতাকে পাস কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
সামনে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সামনে কিছু মানুষ দাড়িয়ে আছে।
মাঝখানে একটা বেড, একজন মানুস শুয়ে আছে।
আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কুনো এক প্রয়াত কবির জন্মদিন উপলক্ষে রক্তদান কর্মসূচি হছে।
একটা মেয়েলি চেহারার ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
ভাই আপনি কি রক্ত দিতে আগ্রহী?
ছেলেটা এমন ভাবে বলল যেন তার অনেক আপন কারো জন্য রক্তের প্রয়োজন, আমি তার শেষ ভরসা।
আমাই বললাম কেন নয়।“ আমার গায়ে যত রক্ত হয়, নিয়ে নাও তুমার মনে যাহা লয়”
ছেলেটি যেন একটু ধাক্কা খেল, সে আমাকে নিয়ে বেড শুয়িয়ে দিল। আমার হাতের কুনুই এর উপর বেঁধে সুই ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
ভাই ভয় পাবেন না।
আমি কিছু বললাম না।
আমার হাতে সে একটা ছোট বল দিল।
ভাই এই বলটা পাঞ্চ করতে থাকুন।
আমি পাঞ্চ করতে থাকলাম, খারাপ লাগছে না।
রক্ত নেয়া শেস হলে সে আমার হাতে একটা আমের জুস ধরিয়ে দিল।
আমি বললাম ভাই, নিলা রক্ত, দিলা জুস।
সে আমার দিকে একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দিল।
ভাই, এই টাকাটা রাখেন। সরকার সকল রক্তদাতাকে এটা সম্মান সরূপ দিচ্ছে।
আমি টাকাটা হাতে নিয়ে চলে আসছি।
আমি ভাবছি এই টাকাটা দিয়ে আমি কি করব।
কারণ, এক অর্থে এটা আমার রক্ত বিক্রির টাকা।
এই টাকা আমাকে বুজে শুনে খরচ করতে হবে...............
আমি মেসে ফিরে দেখি আমার বিছানায় একটা খাম রাখা। আমার মন বলছে এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে প্রবল ভাবে টানছে। আমি খামটা না খুলে গোছল করতে গেলাম।
আমি মাথায় পানি ঢালছি আর চিন্তা করছি কি আছে এই খামে?
কিন্তু মহাপুরুষদের ত কুনো বিষয়ে এত আগ্রহ থাকতে নেই।
সব কুতূহল মহাপুরুষদের মিটাতে হয় না। আমি ঠিক করলাম খামটা আমি খুলব না।
এখন মাথায় পানি ঢালতে ভাল লাগছে, যেন মাথা থেকে পানির সাথে কুতূহল ঝরে পড়ছে।
রুমে ফিরে দেখি রুপা বসে আছে। আজ সে একটা হলুদ সাড়ী পড়েছে।
মেয়েদের সাড়ী পরলে কেন জানি আরও সুন্দর লাগে।
রুপাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। আজ গায়েহলুদ। তার চেহারায় কনের বান্ধবীর মত খুশির আভাশ।
আমি গুনগুন করে গাইতে লাগলাম,
“ আইজ কইনার গায়ে হলুদ,
কাইল কইনার বিয়া,
কাইলকু কইনা জাইতা গিয়া ঢাক ঢুল বাজাইয়া। “
রুপা জিজ্ঞাসা করল, এইটা কি গান?
এই গান আমি অপু শাহেবের মুখে শুনেছি। তিনি প্রায়ই এই গান গুনগুন করেন।
অপু সাহেবটা আবার কে?
যার বিয়ের বিয়ের চিঠি নিয়ে তুমি বসে আছো। ভিতরে একাটা ট্রেনের টিকেটও আছে।
রুপা চিঠিটা ভাল করে দেখল।
খামটা এখন খুলা হয়নি তাহলে কি করে বুজলে ভিতরে ট্রেনের টিকেট আছে?
আমার অনুমান শক্তি ভাল।
রুপা চিঠিটা খুলল।
রুপার হাতে একটা বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট দেখা যাছে।
রুপা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, বলত কুন জায়গায় যাওয়ার টিকেট?
আমি জানি না রুপা, আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে পারি, সবসময় না।
রুপা যেন একটু হতাশ হল। শেষে বলল, তৈরি হয়ে নাও। এক ঘণ্টা পরের ট্রেন। আমি তুমাকে ষ্টেশনে নামিয়ে দিয়ে বাসায় যাব।
আমি বাধ্যগত ছেলের মত তৈরি হতে লাগলাম।
রুপা আমার কাপড় পাল্টানো দেখছে।
আমি হলুদ রঙের শাড়ি পরেছি, তুমি কিছু বললে না।
আমি মাথা না ঘুরিয়ে বললাম, তুমাকে কদম ফুলের মত লাগছে।
রুপা কিছু বলল না।
আমি তৈরি হয়ে রুপার সাথে বের হলাম।
রুপা গাড়িতে একটি কথাও বলল না।
আমার সাথে ট্রেনে উঠল, আমাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল।
“ফেরার আগে আমাকে জানিও। আমি নিতে ষ্টেশনে আসব।”
রুপা যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
আমি মনে মনে বল্লাম,” তুমি জান না রুপা আমি তুমাকে কত ভালোবাসি।”
রুপা দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল, মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, যেন সে কি শুনে পিছনে ফিরেছে।
একটু সময় আমার মুখে সে কি খুজল। কুনো সারা না পেয়ে সে আবার চলে যাচ্ছে।
আমি জানি রুপা কাঁদছে।
ট্রেন ছুটে চলছে।
আমি টিকেটটা হাতে নিলাম।
গন্তব্য
সিলেট
চিন্তা করছি মানুষের হাতে কি সত্যিই তার ভাগ্য থাকে না আগেই তা লেখা থাকে।
আধ ঘণ্টা আগেও আমি জানতাম না আমি আজ কোথায় যাব। হয়ত ঢাকার কুনো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম।
সিলেটে এর আগে আমার যাওয়া হয় নি । সিলেটের রাস্তায় কি আমি মাঝ রাতে ঘুরে বেড়াতে পারব? ঢাকার রাস্তা আমাকে যে ভাবে আপন করে নেয়, সিলেটের রাস্তা কি সে ভাবে আপন করে নিতে পারবে?
ভাই কিতা সিলেট যারা নি?
মানুষটার কথায় আমার চিন্তায় বাঁধা পরল। আমার শাম্নের সিটে একটা ২৪-২৫ বছরের ছেলে বসে আছে। মাঝারি গড়ন, চেহারায় মেয়েলি ভাব। ছেলেটার দিকে তাকেয়ে মিষ্টি হেসে বললাম, অয় অয় ভাইসাব।
এই একটাই সিলেটি শব্দ আমার জানা ছিল।
ভাই সাব আপনে সিলেটি না কিতা? আপ্নারে পাইয়া আমার যে কিলা ভালা লাগের আপনারে কিলান বুজাইতাম। গত তিনদিন ঢাকাত আসলাম, বউত কষ্টে দিন গেসে। এগু সিলেটি মানুষ পাইসি না যে নন মাত তারে কইতাম। মন অইছিল যেন জেলখানাথ আসলাম। শুধ মাথ মাতি মাতি আমার মুখ বেদনা ঐ গেসে।
আপনারে পাইয়া যেন আমার জান পানি আইসে। গুষ্টি কিলাই ঢাকার, ঢাকা ত মানুষ যে কিলান থাকে, এক আল্লাহ মাবুদ এ জানে, অকান থাকি হকান জাইতে এক ঘণ্টা লাগে। আমারে যে কুন ভুতে ধরসিল যে অন আইসলাম।
এক নিঃশ্বাসে ছেলেটা এত গুলো কথা বলে গেল। তার মুখে বীরের হাসি।
আমি কিছু না বলে মুচকি হাসলাম।
সে আবার বলতে লাগল।
তার কথার সারমর্ম হচ্ছে তার ফেসবুক এ বৃষ্টি নামের একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। সে ঢাকায় এসে মেয়েটির সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখে কয়েকটা ছেলে রেস্টুরেন্ট এ বসে আছে। তারা তাকে নিয়ে মজা করে।
ছেলেটা সহজে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে তার গুপন কথা গুলো বলে ফেলল।
ভাই, ঔ কান ধরছি, আর জিবনেও প্রেমর নাম মুখ আনতাম নায়।
আমি কথা ঘুরানর জন্য বললাম, ভাই আমি ত সিলেটি না, এই প্রথম সিলেটে যাচ্ছি।
ছেলেটা হেসে উঠল। হাসতে হাসতে শুধ ভাষায় বলল, ভাই মাফ করে দিবেন, আপনি সিলেটি না ত কি হয়েছে, আপনি ত এই বাংলাদেশ এর ই সন্তান।
ভাই, আপনি কই যাবেন?
পল্লবি কমিউনিটি সেন্টার, সুবিদবাজার।
ছেলেটা হেসে বলল, ভাই আপনি কুনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
আমার বলতে ইচ্ছে করল, না ভাই আপনার কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু বললাম না। ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
সিলেট ষ্টেশনে নেমে ছেলেটা আমাকে নিয়ে একটা রিকশাতে উঠল। সে ভাড়া নিয়ে মুলমুলি করে বন্দর পর্যন্ত ঠিক করল।
ট্রেনে ছেলেটার নাম জানা হয়েছে।
সামির।
বন্দর এ এসে রিকশা থেকে নেমে সেই আমাদের ভাড়া দিল। একবারও তাকাল না আমি ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছি কি না ধেখার জন্য।
আমাকে নিয়ে সে অটোরিকশায় উঠল, এবং সারা রাস্তা সব জায়গার বর্ণনা দিল, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলাম।
অটোরিকশা থেকে নেমে সে একই কাজ করল। আমি তার ব্যাবহারে মুগ্ধ হলাম। এই মানুষ গুলো এখনও ভাল রয়েছে। ঢাকার মত এরা যান্ত্রিক হয়ে যায়নি।
আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, যান ভাই আমার কাজ শেষ। ভাল থাকবেন।
আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বিদায় নিল।
আমি সেন্টারের ভিতরে গিয়ে দেখি, সবাই এক জায়গায় জড় হয়ে আছে। মাজখানে অপু সাহেব একটা চেয়ারে বসে কাঁদছেন। আমিও ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে গেলাম।
এই অবস্থায় কিছু জানাও সহজ উপায় হল, পাসে দাঁড়ান লোকটাকে জিজ্ঞাসা করা, ভাই কি হয়েছে?
আমি সহজ পন্থাই অবলম্বন করলাম।
ভাই, আর কিতা কইতাম, কইন্নার আরেগু পুওার লগে সম্পর্ক আসিল, তাইরে আইজকু জকন পার্লারও হাজানির মাগি নেওয়া অইসিল, তাই হকান থাকি তাইর প্রেমিকঅর লগে ভাগসে। কইন্নার বারিএ মানুশে করা, তারা কিছু জানইন না। অতা কুনো মাত অইল নে ভাইসাব?
আমি লোকটার সব কথা বুজতে না পারলেও ধরতে পারলাম কি হয়েছে।
আমি অপু সাহেবের কাছে না গিয়ে দূরে দাড়িয়ে থাকলাম।
আমি জানি, যে করেই হউক আজ অপু সাহেবের বিয়ে হবে।
শুধু জানি না কিভাবে??????????????????
অপু সাহেব বসে আছেন। তার কাছে কেঊ দাড়িয়ে নেই। কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না।
আরেক দিকে একজন বয়স্ক লোকের চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে।
কাছে গিয়ে দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক আরেকজন বৃদ্ধ লোককে যা মোণে আসছে বলে যাচ্ছে।
একজন শুধু বলছে, আরেকজন শুধু শুনছে।
কাঊকে বলে দিতে হল না কে কনের বাবা, আর কে বরের পিতা।
কোনের বাবার চোখের পানি পড়ছে, কিন্তু বরের বাবার সে দিকে খেয়াল নেই।
ভিতর থেকে খবর আসলো কনের মা বেহুশ হয়েছেন, তার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। মহিলাদের কান্নার শব্দ আসছে।
কণের বাবা তার স্ত্রী কে সামলাতে গেলেন। বরের বাবা গেলেন তার ছেলের দিকে।
“ আমাদের কি পেয়েছে তারা ?
আমাদের কি কোন মান সম্মান নেই ?
এতজন মানুষের সামনে আমি মুখ দেখাব কি করে ?
তারা আমাকে চিনে নাই। আমার নাম তানভীর শেখ ।
আমার ছেলেকে রেখে অন্য ছেলের সাতে মেয়েকে পালাতে দেয়।
যদি আমি ওদের জেলের ভাত না খাইয়ে ছেড়েছি, তাহলে আমি আবদুল্লাহ শেখ এর পূলা না। “
অপু সাহেব ঊঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুছে বাবার হাত ধরে তাকেও দাড় করালেন।
“ বাবা তুমি এ সবের কিছুই করবে না।
সবাইকে বল যার যার টেবিলে বসে পড়তে।
খাবার দিতে বল। এতোগুলো মানুষ কত আশা নিয়ে বিয়ে খেতে এসেছে। আমরা চলে গেলে এদের আর খাওয়া হবে না।
শুধু একজন মানুষের ভুলের জন্য এতজন মানুষকে তুমি তাদের আহার থেকে বঞ্চিত কোড়ো না”
অপু সাহেবের বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মুখ যথেষ্ট পরিমাণ হা হল যাতে মাছি যাতায়াত করতে পারে।
বাবাকে সামলে উঠার সময় না দিয়ে অপু সাহেব বরের আসনে গিয়ে বসলেন।
তার মুখের হাসি যেন ফেটে পড়ছে। .........।
সবাই যার যার টেবিলে বসে পড়েছে, খাবার দেওয়া হয়েছে, সবাই খাচ্ছে, কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছেন বরের কি অবস্থা।
অপু সাহেবকে দেখা গেল এই টেবিল ঐ টেবিল ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কার কি লাগে তাও খেয়াল রাখছেন।
যেখানে প্রচলিত নিয়মে বর চুপচাপ বসে থাকে, সেখানে অপু সাহেব ছুটাছুটি করছেন, কে বলবে, ইনিই বর যার বউ, বউ হবার আগেই অন্নের বউ হয়ে গেছে।
অপু সাহেব ঘুরতে ঘুরতে আমার শাম্নে এসে থমকে দাঁড়ালেন,
দুঁহাতে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন,
হিমু ভাই, আপনি এসেছেন, আমি যে কি পরিমান খুশি হয়েছি তা বুজাতে পারব না।
তার কান্না যেন থামতে চায় না।
অনেকে হয়ত মনে করছে তিনি কষ্টে কাঁদছেন, কিন্তু যারা তাকে চিনেন, তারা জানেন, এই কান্না কত আনন্দের কান্না।
আমি কুন রকম নিজেকে ছারিয়ে, বললাম, অপু সাহেব, আপনাকে ত দারুন লাগছে ।
অপু সাহেব লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন।
আমায় নিয়ে বরের আসনের পাসে বসালেন,
গলা নিচে নামিয়ে বললেন, খবর শুনেছেন?
আমি কিছু বললাম না।
ভাই মনে হয় আমার কপালে বিয়ে লেখা নাই,
তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখের কনে পানির আভাশ পাওয়া যাচ্ছে।
অপু সাহেব, আমার দেখা ভাল মানুষের মধ্যে আপনি একজন, আর ভাল মানুশকে নিয়ে প্রকৃতি খেলা করতে পছন্দ করে, এই কারনে ভাল মানুষরা কষ্ট পায় বেশি।
অপু সাহেব আমার দিকে চেয়ে আছেন।
অপু সাহেব?
জি হিমু ভাই?
এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে শুরু করেন।
কুনু প্রশ্ন না করে অপু সাহেব মৃদু শব্দে গুনতে শুরু করলেন।
এক...
দুই...
তিন...
চার...
...
...
...
...
...
...
পঁয়তাল্লিশ।।
“এইযে, একটু শুনবেন”?
আমি আর অপু সাহেব পিছনে তাকালাম?
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। একটু এদিকে আসবেন”?
অপু সাহেব কি কবেন বুজতে পারলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে যেন যাবার অনুমতি চাইলেন।
আমি একটু ধাক্কা দিয়ে তাকে আগিয়ে দিলাম।
মেয়েটা অপু সাহেবের সাথে নিচু গলায় কথা বলছে, তবুও আমি এত কাছে ছিলাম যে তাদের কথা আমার শুনতে কুন অসুবিধা হছিল না।
“আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন” ।?
অপু সাহেব যেন আকাশ থেকে পরলেন?
“মেয়েটা বলে যাচ্ছে, আমি অধরা, বিবিএ পড়ছি, যে মেয়েটার সাথে আপনার বিয়ে হবার কথা ছিল, আমি তার বোন।
আমার বাবার সম্মান বাঁচাতে, বা আপনার উপর দয়া করে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি না, আমি আপনাকে আজ খুব ভাল করে লক্ষ্য করেছি, বিয়ে ভাঙার পর আমি আপনাকে হাসতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি, সবার খেয়াল রাখতে দেখেছি। আমার মনে হয় আপনি একজন ভাল মনের মানুষ যাকে বিয়ে করলে আমি অনেক সুখী হব। তাই আমি আপনাকে হারাতে চাই না, আর কে কি বলল তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
so, now the million dollar question is, will u marry me”?
অপু সাহেব যেন ঠাণ্ডায় কাঠ হয়ে গেছেন, অনেক কষ্টে শুদু দুটি শব্দ উচারন করতে পারলেন।
“আমি রাজি”।
মেয়েটা এত সুন্দর করে একটা হাসি দিল, যে পৃথিবীর কুনো ছেলে এই হাসি দেখে প্রেমে না পড়ে থাকতে পারবে না।
পরের ঘটনাগুল খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে লাগল। কিছুক্ষণ অপু সাহেবের সাথে তার বাবার কথা কাটাকাটি, মেয়ের অ একই অবস্থা।
কিন্তু একটু পর দেখা গেল দুই বেয়াই কুলাকুলি করছেন হেসেহেসে।
কাজি বেচারা মাত্র খেতে বসেছিল, তাকে এই অবস্থা থেকে তুলে আনা হল।
সে যে এই কারনে খুশি না, তা তার বিয়ে পড়ানর সময় তার কণ্ঠস্বর জানান দিল।
বিয়ে পড়ান শেষ।
বর কনে একে একে মুরব্বিদের সালাম করল।
অপু সাহেব সবাইকে ছেড়ে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন,
“এই হচ্ছেন হিমু ভাই, আমার নিজের ভাই এই চেয়েও বেশি। ”
অধরা আমাকে সালাম করল, আমি উঁচু সরে বললাম, বেঁচে থাক।
“হিমু ভাই”?
আমি অপু সাহেবের দিকে তাকালাম।
আপনি বিশ্বাস করবেন না, অধরার চেহারাটা না হুবুহু...............
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বল্লাম...... “আমি জানি”।
আমি পকেটে হাত দিয়ে ১০০ টাকার নোটটা বের করলাম যা আমি রক্ত বিক্রি করে পেয়েছিলাম।
অধরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই টাকাটা হাতে নিল।
।
।
।
আমি চলে আসছি।
পিছনে রেখে আসছি একজোড়া সুখী মানুষকে.....................।
আমি সেন্টার থেকে বের হয়ে দেখলাম সামির সামনের চায়ের দোকানে বসে আছে। তার এক হাতে চা, আরেক হাতে কলা। সে এক চুমুক চা খাচ্ছে আর এক কামড় কলা। সে যখন চা এ চুমুক দিচ্ছে থিকন কপাল এ ভাজ পড়ছে, কিন্তু যখন কলাতে কামড় দিচ্ছে তখন তার কপাল প্রসারিত হচ্ছে। সে কলাটা শেষ করে আরেকটা কলা নিল। আমি রাস্তা পার হয়ে তার পাসে গিয়ে বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে সে এমন ভাবে হাসল যা আমি খুব মানুষকে হাসতে দেখেছি। মানুষ নকল কান্না সহজে ধরতে পারে না। কিন্তু নকল হাসি সহজে ধরতে পারে। সকল মানুষকে কান্নার সময় ভাল লাগে না, বেশির ভাগ মানুষকে খারাপ দেখায়। কিন্তু মানুষ যখন হাসে তখন তার মুখ তার ভাল দিক টুকু ফুটিয়ে তুলে।
আমি সরাসরি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম।
ভাই।
আপনারে নামাই দিয়া একবার চিন্তা করলাম জাওাগির। পরে মন আইল আপনে সিলেটও নয়া। কুনবায় তাকি তুনবায় জাইবা আর কুন বেরাত পরবা, আল্লাহ মালুম। আপনারে একলা ছাড়তে কইলজায় দিল না। অতার লাগি রই গেলাম।
আবার সে তার সেই হাসি দিল।
পৃথিবীতে সকল মানুষ অন্য মানুষের উপকার করে মজা পায়। কেউ বেশি, কেউ কম। বেশিরভাগ মানুষই উপকারের প্রতিদানের আশা করে। এবং যে উপকারের কুনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না, এমন উপকার বেশির ভাগ মানুষ করতে চায়।
কিছু কিছু মানুষ আছে এর বেতিক্রম।
সামির তাদের ই একজন।
“অকন কই জাইতা ভাইচ্চাব”?
আমি কই যাব টা ঠিক করতে থাকলাম মনেমনে। চাইলে ঢাকায় ফিরত জেতে পারি। অথবা সিলেট শহরে কয়েকদিন থেকে যেতে পারি। সিলেট পর্যটন শহর। দেখার মত অনেক কিছু আছে। কিন্তু আমি পর্যটক নই। আমার সাধারন মানুষের মত ইচ্ছা পূষন করার অধিকার নাই। হটাত মনে পড়ল হ্যাপি খালার সেই উদলা বাবার কথা। তিনিও সিলেটে থাকেন।
প্রকিতি চায় আমার দেখা জেন হয় তার সাথে। শুদু অপু শাহেবের বিয়ের জন্য আমাকে প্রকিতি সিলেটে আনেনি।
সামির ভাই, আপনি উদলা বাবাকে চিনেন?
সামির সবজান্তার হাসি দিয়ে বলল, “আরে ভাইসাব আপ্নেও তার নাম হুঞ্ছইন নি? বউথ বর বাবা। ক্যান্সার তাকি মিরগি বেমার পর্যন্ত তাইন সারাইতা পারইন। মানশর মুক দেকিয়া বেমার কই লাইন। আপ্নে জাইতা নি তানর লগে দেখা করাত”?
আমি শম্মতি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম।
উদলা বাবাকে কখন পাওয়া যাবে?
তাইন শব সময় গাছর তলে বই থাকইন। যে সময় জাইবা, তান্রে পাইবা। জাইতা নি অকন?
আমি বললাম চলেন।
আমরা হাঁটছি ফুতপাত ধরে।
একটা জিনিশ সামির ভুলে গেছে যে আমি সিলেটি ভাষা ভাল বুজি না। যদিও সে ভাল শুধও ভাষা বলতে পারে, কিন্তু সে সিলেটি ভাষায় কথা বলছে।
আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম না।
সে বলুক তার নিজের ভাষায়। যা তার মনের ভাব শতভাগ প্রকাশ করে..................।
রাস্তার পিচ গলে জুতার নিচে লেগে জুতা ভারি হয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে নিজের উজন হটাত করে ৫ কেজি বেড়ে গেছে।
রাস্তার পাশে আখ এর রস বিক্রেতা আখ রস বিক্রি করছে ।
এরা কড়া রোদ উঠলে খুশি।
এতে তাদের বিক্রি বেড়ে যায়।
রাস্তার পাশে আখ এর রস বিক্রেতা আখ রস বের করার ফাঁকে ফাঁকে পথচারির মুখ দেখে নিচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রত্যেক শ্রেণীর পেশাজিবির চোখ তাদের পেশার সাথে সম্পৃক্ত জিনিসের দিকে প্রথমে খেয়াল করে।
একজন মুচি প্রথমে একজন মানুষের জুতার দিকে খেয়াল করে,
একজন কাপড় বিক্রেতা প্রথমে একজন মানুষের কাপড়ের দিকে খেয়াল করে।
তাই আখ এর রস বিক্রেতা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে বিচার করে নিচ্ছে যে এই লোককে ডাকলে সে কি তার রস খাবে কি না।
আমি আখ এর রস বিক্রেতাকে পাস কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
সামনে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সামনে কিছু মানুষ দাড়িয়ে আছে।
মাঝখানে একটা বেড, একজন মানুস শুয়ে আছে।
আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কুনো এক প্রয়াত কবির জন্মদিন উপলক্ষে রক্তদান কর্মসূচি হছে।
একটা মেয়েলি চেহারার ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
ভাই আপনি কি রক্ত দিতে আগ্রহী?
ছেলেটা এমন ভাবে বলল যেন তার অনেক আপন কারো জন্য রক্তের প্রয়োজন, আমি তার শেষ ভরসা।
আমাই বললাম কেন নয়।“ আমার গায়ে যত রক্ত হয়, নিয়ে নাও তুমার মনে যাহা লয়”
ছেলেটি যেন একটু ধাক্কা খেল, সে আমাকে নিয়ে বেড শুয়িয়ে দিল। আমার হাতের কুনুই এর উপর বেঁধে সুই ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
ভাই ভয় পাবেন না।
আমি কিছু বললাম না।
আমার হাতে সে একটা ছোট বল দিল।
ভাই এই বলটা পাঞ্চ করতে থাকুন।
আমি পাঞ্চ করতে থাকলাম, খারাপ লাগছে না।
রক্ত নেয়া শেস হলে সে আমার হাতে একটা আমের জুস ধরিয়ে দিল।
আমি বললাম ভাই, নিলা রক্ত, দিলা জুস।
সে আমার দিকে একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দিল।
ভাই, এই টাকাটা রাখেন। সরকার সকল রক্তদাতাকে এটা সম্মান সরূপ দিচ্ছে।
আমি টাকাটা হাতে নিয়ে চলে আসছি।
আমি ভাবছি এই টাকাটা দিয়ে আমি কি করব।
কারণ, এক অর্থে এটা আমার রক্ত বিক্রির টাকা।
এই টাকা আমাকে বুজে শুনে খরচ করতে হবে...............
আমি মেসে ফিরে দেখি আমার বিছানায় একটা খাম রাখা। আমার মন বলছে এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে প্রবল ভাবে টানছে। আমি খামটা না খুলে গোছল করতে গেলাম।
আমি মাথায় পানি ঢালছি আর চিন্তা করছি কি আছে এই খামে?
কিন্তু মহাপুরুষদের ত কুনো বিষয়ে এত আগ্রহ থাকতে নেই।
সব কুতূহল মহাপুরুষদের মিটাতে হয় না। আমি ঠিক করলাম খামটা আমি খুলব না।
এখন মাথায় পানি ঢালতে ভাল লাগছে, যেন মাথা থেকে পানির সাথে কুতূহল ঝরে পড়ছে।
রুমে ফিরে দেখি রুপা বসে আছে। আজ সে একটা হলুদ সাড়ী পড়েছে।
মেয়েদের সাড়ী পরলে কেন জানি আরও সুন্দর লাগে।
রুপাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। আজ গায়েহলুদ। তার চেহারায় কনের বান্ধবীর মত খুশির আভাশ।
আমি গুনগুন করে গাইতে লাগলাম,
“ আইজ কইনার গায়ে হলুদ,
কাইল কইনার বিয়া,
কাইলকু কইনা জাইতা গিয়া ঢাক ঢুল বাজাইয়া। “
রুপা জিজ্ঞাসা করল, এইটা কি গান?
এই গান আমি অপু শাহেবের মুখে শুনেছি। তিনি প্রায়ই এই গান গুনগুন করেন।
অপু সাহেবটা আবার কে?
যার বিয়ের বিয়ের চিঠি নিয়ে তুমি বসে আছো। ভিতরে একাটা ট্রেনের টিকেটও আছে।
রুপা চিঠিটা ভাল করে দেখল।
খামটা এখন খুলা হয়নি তাহলে কি করে বুজলে ভিতরে ট্রেনের টিকেট আছে?
আমার অনুমান শক্তি ভাল।
রুপা চিঠিটা খুলল।
রুপার হাতে একটা বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট দেখা যাছে।
রুপা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, বলত কুন জায়গায় যাওয়ার টিকেট?
আমি জানি না রুপা, আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে পারি, সবসময় না।
রুপা যেন একটু হতাশ হল। শেষে বলল, তৈরি হয়ে নাও। এক ঘণ্টা পরের ট্রেন। আমি তুমাকে ষ্টেশনে নামিয়ে দিয়ে বাসায় যাব।
আমি বাধ্যগত ছেলের মত তৈরি হতে লাগলাম।
রুপা আমার কাপড় পাল্টানো দেখছে।
আমি হলুদ রঙের শাড়ি পরেছি, তুমি কিছু বললে না।
আমি মাথা না ঘুরিয়ে বললাম, তুমাকে কদম ফুলের মত লাগছে।
রুপা কিছু বলল না।
আমি তৈরি হয়ে রুপার সাথে বের হলাম।
রুপা গাড়িতে একটি কথাও বলল না।
আমার সাথে ট্রেনে উঠল, আমাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল।
“ফেরার আগে আমাকে জানিও। আমি নিতে ষ্টেশনে আসব।”
রুপা যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
আমি মনে মনে বল্লাম,” তুমি জান না রুপা আমি তুমাকে কত ভালোবাসি।”
রুপা দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল, মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, যেন সে কি শুনে পিছনে ফিরেছে।
একটু সময় আমার মুখে সে কি খুজল। কুনো সারা না পেয়ে সে আবার চলে যাচ্ছে।
আমি জানি রুপা কাঁদছে।
ট্রেন ছুটে চলছে।
আমি টিকেটটা হাতে নিলাম।
গন্তব্য
সিলেট
চিন্তা করছি মানুষের হাতে কি সত্যিই তার ভাগ্য থাকে না আগেই তা লেখা থাকে।
আধ ঘণ্টা আগেও আমি জানতাম না আমি আজ কোথায় যাব। হয়ত ঢাকার কুনো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম।
সিলেটে এর আগে আমার যাওয়া হয় নি । সিলেটের রাস্তায় কি আমি মাঝ রাতে ঘুরে বেড়াতে পারব? ঢাকার রাস্তা আমাকে যে ভাবে আপন করে নেয়, সিলেটের রাস্তা কি সে ভাবে আপন করে নিতে পারবে?
ভাই কিতা সিলেট যারা নি?
মানুষটার কথায় আমার চিন্তায় বাঁধা পরল। আমার শাম্নের সিটে একটা ২৪-২৫ বছরের ছেলে বসে আছে। মাঝারি গড়ন, চেহারায় মেয়েলি ভাব। ছেলেটার দিকে তাকেয়ে মিষ্টি হেসে বললাম, অয় অয় ভাইসাব।
এই একটাই সিলেটি শব্দ আমার জানা ছিল।
ভাই সাব আপনে সিলেটি না কিতা? আপ্নারে পাইয়া আমার যে কিলা ভালা লাগের আপনারে কিলান বুজাইতাম। গত তিনদিন ঢাকাত আসলাম, বউত কষ্টে দিন গেসে। এগু সিলেটি মানুষ পাইসি না যে নন মাত তারে কইতাম। মন অইছিল যেন জেলখানাথ আসলাম। শুধ মাথ মাতি মাতি আমার মুখ বেদনা ঐ গেসে।
আপনারে পাইয়া যেন আমার জান পানি আইসে। গুষ্টি কিলাই ঢাকার, ঢাকা ত মানুষ যে কিলান থাকে, এক আল্লাহ মাবুদ এ জানে, অকান থাকি হকান জাইতে এক ঘণ্টা লাগে। আমারে যে কুন ভুতে ধরসিল যে অন আইসলাম।
এক নিঃশ্বাসে ছেলেটা এত গুলো কথা বলে গেল। তার মুখে বীরের হাসি।
আমি কিছু না বলে মুচকি হাসলাম।
সে আবার বলতে লাগল।
তার কথার সারমর্ম হচ্ছে তার ফেসবুক এ বৃষ্টি নামের একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। সে ঢাকায় এসে মেয়েটির সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখে কয়েকটা ছেলে রেস্টুরেন্ট এ বসে আছে। তারা তাকে নিয়ে মজা করে।
ছেলেটা সহজে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে তার গুপন কথা গুলো বলে ফেলল।
ভাই, ঔ কান ধরছি, আর জিবনেও প্রেমর নাম মুখ আনতাম নায়।
আমি কথা ঘুরানর জন্য বললাম, ভাই আমি ত সিলেটি না, এই প্রথম সিলেটে যাচ্ছি।
ছেলেটা হেসে উঠল। হাসতে হাসতে শুধ ভাষায় বলল, ভাই মাফ করে দিবেন, আপনি সিলেটি না ত কি হয়েছে, আপনি ত এই বাংলাদেশ এর ই সন্তান।
ভাই, আপনি কই যাবেন?
পল্লবি কমিউনিটি সেন্টার, সুবিদবাজার।
ছেলেটা হেসে বলল, ভাই আপনি কুনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
আমার বলতে ইচ্ছে করল, না ভাই আপনার কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু বললাম না। ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
সিলেট ষ্টেশনে নেমে ছেলেটা আমাকে নিয়ে একটা রিকশাতে উঠল। সে ভাড়া নিয়ে মুলমুলি করে বন্দর পর্যন্ত ঠিক করল।
ট্রেনে ছেলেটার নাম জানা হয়েছে।
সামির।
বন্দর এ এসে রিকশা থেকে নেমে সেই আমাদের ভাড়া দিল। একবারও তাকাল না আমি ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছি কি না ধেখার জন্য।
আমাকে নিয়ে সে অটোরিকশায় উঠল, এবং সারা রাস্তা সব জায়গার বর্ণনা দিল, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলাম।
অটোরিকশা থেকে নেমে সে একই কাজ করল। আমি তার ব্যাবহারে মুগ্ধ হলাম। এই মানুষ গুলো এখনও ভাল রয়েছে। ঢাকার মত এরা যান্ত্রিক হয়ে যায়নি।
আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, যান ভাই আমার কাজ শেষ। ভাল থাকবেন।
আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বিদায় নিল।
আমি সেন্টারের ভিতরে গিয়ে দেখি, সবাই এক জায়গায় জড় হয়ে আছে। মাজখানে অপু সাহেব একটা চেয়ারে বসে কাঁদছেন। আমিও ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে গেলাম।
এই অবস্থায় কিছু জানাও সহজ উপায় হল, পাসে দাঁড়ান লোকটাকে জিজ্ঞাসা করা, ভাই কি হয়েছে?
আমি সহজ পন্থাই অবলম্বন করলাম।
ভাই, আর কিতা কইতাম, কইন্নার আরেগু পুওার লগে সম্পর্ক আসিল, তাইরে আইজকু জকন পার্লারও হাজানির মাগি নেওয়া অইসিল, তাই হকান থাকি তাইর প্রেমিকঅর লগে ভাগসে। কইন্নার বারিএ মানুশে করা, তারা কিছু জানইন না। অতা কুনো মাত অইল নে ভাইসাব?
আমি লোকটার সব কথা বুজতে না পারলেও ধরতে পারলাম কি হয়েছে।
আমি অপু সাহেবের কাছে না গিয়ে দূরে দাড়িয়ে থাকলাম।
আমি জানি, যে করেই হউক আজ অপু সাহেবের বিয়ে হবে।
শুধু জানি না কিভাবে??????????????????
অপু সাহেব বসে আছেন। তার কাছে কেঊ দাড়িয়ে নেই। কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না।
আরেক দিকে একজন বয়স্ক লোকের চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে।
কাছে গিয়ে দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক আরেকজন বৃদ্ধ লোককে যা মোণে আসছে বলে যাচ্ছে।
একজন শুধু বলছে, আরেকজন শুধু শুনছে।
কাঊকে বলে দিতে হল না কে কনের বাবা, আর কে বরের পিতা।
কোনের বাবার চোখের পানি পড়ছে, কিন্তু বরের বাবার সে দিকে খেয়াল নেই।
ভিতর থেকে খবর আসলো কনের মা বেহুশ হয়েছেন, তার দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। মহিলাদের কান্নার শব্দ আসছে।
কণের বাবা তার স্ত্রী কে সামলাতে গেলেন। বরের বাবা গেলেন তার ছেলের দিকে।
“ আমাদের কি পেয়েছে তারা ?
আমাদের কি কোন মান সম্মান নেই ?
এতজন মানুষের সামনে আমি মুখ দেখাব কি করে ?
তারা আমাকে চিনে নাই। আমার নাম তানভীর শেখ ।
আমার ছেলেকে রেখে অন্য ছেলের সাতে মেয়েকে পালাতে দেয়।
যদি আমি ওদের জেলের ভাত না খাইয়ে ছেড়েছি, তাহলে আমি আবদুল্লাহ শেখ এর পূলা না। “
অপু সাহেব ঊঠে দাঁড়ালেন। চোখ মুছে বাবার হাত ধরে তাকেও দাড় করালেন।
“ বাবা তুমি এ সবের কিছুই করবে না।
সবাইকে বল যার যার টেবিলে বসে পড়তে।
খাবার দিতে বল। এতোগুলো মানুষ কত আশা নিয়ে বিয়ে খেতে এসেছে। আমরা চলে গেলে এদের আর খাওয়া হবে না।
শুধু একজন মানুষের ভুলের জন্য এতজন মানুষকে তুমি তাদের আহার থেকে বঞ্চিত কোড়ো না”
অপু সাহেবের বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মুখ যথেষ্ট পরিমাণ হা হল যাতে মাছি যাতায়াত করতে পারে।
বাবাকে সামলে উঠার সময় না দিয়ে অপু সাহেব বরের আসনে গিয়ে বসলেন।
তার মুখের হাসি যেন ফেটে পড়ছে। .........।
সবাই যার যার টেবিলে বসে পড়েছে, খাবার দেওয়া হয়েছে, সবাই খাচ্ছে, কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছেন বরের কি অবস্থা।
অপু সাহেবকে দেখা গেল এই টেবিল ঐ টেবিল ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কার কি লাগে তাও খেয়াল রাখছেন।
যেখানে প্রচলিত নিয়মে বর চুপচাপ বসে থাকে, সেখানে অপু সাহেব ছুটাছুটি করছেন, কে বলবে, ইনিই বর যার বউ, বউ হবার আগেই অন্নের বউ হয়ে গেছে।
অপু সাহেব ঘুরতে ঘুরতে আমার শাম্নে এসে থমকে দাঁড়ালেন,
দুঁহাতে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন,
হিমু ভাই, আপনি এসেছেন, আমি যে কি পরিমান খুশি হয়েছি তা বুজাতে পারব না।
তার কান্না যেন থামতে চায় না।
অনেকে হয়ত মনে করছে তিনি কষ্টে কাঁদছেন, কিন্তু যারা তাকে চিনেন, তারা জানেন, এই কান্না কত আনন্দের কান্না।
আমি কুন রকম নিজেকে ছারিয়ে, বললাম, অপু সাহেব, আপনাকে ত দারুন লাগছে ।
অপু সাহেব লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন।
আমায় নিয়ে বরের আসনের পাসে বসালেন,
গলা নিচে নামিয়ে বললেন, খবর শুনেছেন?
আমি কিছু বললাম না।
ভাই মনে হয় আমার কপালে বিয়ে লেখা নাই,
তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখের কনে পানির আভাশ পাওয়া যাচ্ছে।
অপু সাহেব, আমার দেখা ভাল মানুষের মধ্যে আপনি একজন, আর ভাল মানুশকে নিয়ে প্রকৃতি খেলা করতে পছন্দ করে, এই কারনে ভাল মানুষরা কষ্ট পায় বেশি।
অপু সাহেব আমার দিকে চেয়ে আছেন।
অপু সাহেব?
জি হিমু ভাই?
এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে শুরু করেন।
কুনু প্রশ্ন না করে অপু সাহেব মৃদু শব্দে গুনতে শুরু করলেন।
এক...
দুই...
তিন...
চার...
...
...
...
...
...
...
পঁয়তাল্লিশ।।
“এইযে, একটু শুনবেন”?
আমি আর অপু সাহেব পিছনে তাকালাম?
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। একটু এদিকে আসবেন”?
অপু সাহেব কি কবেন বুজতে পারলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে যেন যাবার অনুমতি চাইলেন।
আমি একটু ধাক্কা দিয়ে তাকে আগিয়ে দিলাম।
মেয়েটা অপু সাহেবের সাথে নিচু গলায় কথা বলছে, তবুও আমি এত কাছে ছিলাম যে তাদের কথা আমার শুনতে কুন অসুবিধা হছিল না।
“আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন” ।?
অপু সাহেব যেন আকাশ থেকে পরলেন?
“মেয়েটা বলে যাচ্ছে, আমি অধরা, বিবিএ পড়ছি, যে মেয়েটার সাথে আপনার বিয়ে হবার কথা ছিল, আমি তার বোন।
আমার বাবার সম্মান বাঁচাতে, বা আপনার উপর দয়া করে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি না, আমি আপনাকে আজ খুব ভাল করে লক্ষ্য করেছি, বিয়ে ভাঙার পর আমি আপনাকে হাসতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি, সবার খেয়াল রাখতে দেখেছি। আমার মনে হয় আপনি একজন ভাল মনের মানুষ যাকে বিয়ে করলে আমি অনেক সুখী হব। তাই আমি আপনাকে হারাতে চাই না, আর কে কি বলল তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
so, now the million dollar question is, will u marry me”?
অপু সাহেব যেন ঠাণ্ডায় কাঠ হয়ে গেছেন, অনেক কষ্টে শুদু দুটি শব্দ উচারন করতে পারলেন।
“আমি রাজি”।
মেয়েটা এত সুন্দর করে একটা হাসি দিল, যে পৃথিবীর কুনো ছেলে এই হাসি দেখে প্রেমে না পড়ে থাকতে পারবে না।
পরের ঘটনাগুল খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে লাগল। কিছুক্ষণ অপু সাহেবের সাথে তার বাবার কথা কাটাকাটি, মেয়ের অ একই অবস্থা।
কিন্তু একটু পর দেখা গেল দুই বেয়াই কুলাকুলি করছেন হেসেহেসে।
কাজি বেচারা মাত্র খেতে বসেছিল, তাকে এই অবস্থা থেকে তুলে আনা হল।
সে যে এই কারনে খুশি না, তা তার বিয়ে পড়ানর সময় তার কণ্ঠস্বর জানান দিল।
বিয়ে পড়ান শেষ।
বর কনে একে একে মুরব্বিদের সালাম করল।
অপু সাহেব সবাইকে ছেড়ে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন,
“এই হচ্ছেন হিমু ভাই, আমার নিজের ভাই এই চেয়েও বেশি। ”
অধরা আমাকে সালাম করল, আমি উঁচু সরে বললাম, বেঁচে থাক।
“হিমু ভাই”?
আমি অপু সাহেবের দিকে তাকালাম।
আপনি বিশ্বাস করবেন না, অধরার চেহারাটা না হুবুহু...............
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বল্লাম...... “আমি জানি”।
আমি পকেটে হাত দিয়ে ১০০ টাকার নোটটা বের করলাম যা আমি রক্ত বিক্রি করে পেয়েছিলাম।
অধরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই টাকাটা হাতে নিল।
।
।
।
আমি চলে আসছি।
পিছনে রেখে আসছি একজোড়া সুখী মানুষকে.....................।
আমি সেন্টার থেকে বের হয়ে দেখলাম সামির সামনের চায়ের দোকানে বসে আছে। তার এক হাতে চা, আরেক হাতে কলা। সে এক চুমুক চা খাচ্ছে আর এক কামড় কলা। সে যখন চা এ চুমুক দিচ্ছে থিকন কপাল এ ভাজ পড়ছে, কিন্তু যখন কলাতে কামড় দিচ্ছে তখন তার কপাল প্রসারিত হচ্ছে। সে কলাটা শেষ করে আরেকটা কলা নিল। আমি রাস্তা পার হয়ে তার পাসে গিয়ে বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে সে এমন ভাবে হাসল যা আমি খুব মানুষকে হাসতে দেখেছি। মানুষ নকল কান্না সহজে ধরতে পারে না। কিন্তু নকল হাসি সহজে ধরতে পারে। সকল মানুষকে কান্নার সময় ভাল লাগে না, বেশির ভাগ মানুষকে খারাপ দেখায়। কিন্তু মানুষ যখন হাসে তখন তার মুখ তার ভাল দিক টুকু ফুটিয়ে তুলে।
আমি সরাসরি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম।
ভাই।
আপনারে নামাই দিয়া একবার চিন্তা করলাম জাওাগির। পরে মন আইল আপনে সিলেটও নয়া। কুনবায় তাকি তুনবায় জাইবা আর কুন বেরাত পরবা, আল্লাহ মালুম। আপনারে একলা ছাড়তে কইলজায় দিল না। অতার লাগি রই গেলাম।
আবার সে তার সেই হাসি দিল।
পৃথিবীতে সকল মানুষ অন্য মানুষের উপকার করে মজা পায়। কেউ বেশি, কেউ কম। বেশিরভাগ মানুষই উপকারের প্রতিদানের আশা করে। এবং যে উপকারের কুনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না, এমন উপকার বেশির ভাগ মানুষ করতে চায়।
কিছু কিছু মানুষ আছে এর বেতিক্রম।
সামির তাদের ই একজন।
“অকন কই জাইতা ভাইচ্চাব”?
আমি কই যাব টা ঠিক করতে থাকলাম মনেমনে। চাইলে ঢাকায় ফিরত জেতে পারি। অথবা সিলেট শহরে কয়েকদিন থেকে যেতে পারি। সিলেট পর্যটন শহর। দেখার মত অনেক কিছু আছে। কিন্তু আমি পর্যটক নই। আমার সাধারন মানুষের মত ইচ্ছা পূষন করার অধিকার নাই। হটাত মনে পড়ল হ্যাপি খালার সেই উদলা বাবার কথা। তিনিও সিলেটে থাকেন।
প্রকিতি চায় আমার দেখা জেন হয় তার সাথে। শুদু অপু শাহেবের বিয়ের জন্য আমাকে প্রকিতি সিলেটে আনেনি।
সামির ভাই, আপনি উদলা বাবাকে চিনেন?
সামির সবজান্তার হাসি দিয়ে বলল, “আরে ভাইসাব আপ্নেও তার নাম হুঞ্ছইন নি? বউথ বর বাবা। ক্যান্সার তাকি মিরগি বেমার পর্যন্ত তাইন সারাইতা পারইন। মানশর মুক দেকিয়া বেমার কই লাইন। আপ্নে জাইতা নি তানর লগে দেখা করাত”?
আমি শম্মতি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম।
উদলা বাবাকে কখন পাওয়া যাবে?
তাইন শব সময় গাছর তলে বই থাকইন। যে সময় জাইবা, তান্রে পাইবা। জাইতা নি অকন?
আমি বললাম চলেন।
আমরা হাঁটছি ফুতপাত ধরে।
একটা জিনিশ সামির ভুলে গেছে যে আমি সিলেটি ভাষা ভাল বুজি না। যদিও সে ভাল শুধও ভাষা বলতে পারে, কিন্তু সে সিলেটি ভাষায় কথা বলছে।
আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম না।
সে বলুক তার নিজের ভাষায়। যা তার মনের ভাব শতভাগ প্রকাশ করে..................।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সবুজ আহমেদ কক্স ২৫/০২/২০১৫দারুন গল্প...।।
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ২৫/০২/২০১৫ধন্যবাদ। আপনাকে। আপনার জন্য প্রিয় হিমু কে বারবার খুজে পাই। ভালো লাগলো।