www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

একজন গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়লের বক্তৃতা ২

২৯ আগস্ট ২০১৪
শুক্রবার
সিলেট সিটি কর্পোরেশন সম্মেলন কক্ষ
বিকাল ৪ টা

একদিন এক পরীক্ষার হলে ডিউটি দিচ্ছিলাম। এক গুণধর ছাত্র আমার গায়ে খোঁচা গিয়ে বলে ‘টাইম কত?’ আমি দাঁড়ালাম। ওর দিকে তাকালাম। পরীক্ষা দিচ্ছে তো তাই তেমন কিছু বলতেও দ্বিধা লাগছিলো। তবুও বললাম, ‘আমি তোমার শিক্ষক।’ সে আমার দিকে কটমট করে তাকায়। এরা একটা সার্টিফিকেটের জন্য পয়সা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এদের শিষ্টতা শেখার কোন তাড়া নেই, ইচ্ছেও নেই। শিষ্টতা কি তা-ই হয়ত জানে না।

মাননীয় সভাপতি, এবং আজকে যারা শুনছেন।

আমি প্রথাগত বক্তৃতা জানি না, দিতে পারিও না। ফলে আজকের কথামালায় ঘুরে ফিরে হয়ত আমার নিজের অভিজ্ঞতাগুলোকেই শুধু শেয়ার করা হবে। সেটা বক্তৃতা হয়ে উঠবে না হয়ত, কিন্তু হয়ত কিছু বলা হবে, এবং সেই হয়ত আমার আজকের মত দায় মেটানো। তাছাড়া আমার জানার পরিধি অত্যন্ত ক্ষুদ্র, তাই বলার পরিসরও সিমীত।

শিক্ষার বেসরকারিকরণ শিরোনামের আজকের এই প্রোগ্রামের নাম আমার মতে হওয়া উচিৎ ছিলো শিক্ষায় সাম্রাজ্যবাদ। বেসরকারিকরণের নামে আসলে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়ে গেছে। কতটুকু গেছে তা একটু ভাবলেই বোঝা যাবে। আলাপ আলোচনায়ও অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু শিক্ষা-এর মত পবিত্র নাম নিয়ে এর গর্তে লুকিয়ে থাকা কেঁচোটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে। সেটা আজ হয়ত সাপ হয়ে গেছে। এখন চেপে ধরবার পালা। হা হা হা, কিন্তু কে চেপে ধরবে? আমার খুবই ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার বাহুতে জোর অত্যন্ত কম। একেবারেই নেই বলতে পারেন।
একটা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে ডাক্তার হয়েছে কেবল। পাশে একজন বৃধের প্রেশার মাপার দরকার হলো। সদ্য পাশ করা প্রতিবেশি ডাক্তারের ডাক পড়লো। তিনি গেলেন, কি করলেন জানি না। কিছুক্ষণ পরে আমাকে ডাকতে এল কেউ একজন সে বাসা থেকে। আমি আমার যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলাম এবং প্রেশার মেপে দিয়ে এসেছিলাম।

রহস্য হলো, ডাক্তার সাহেবের বাসায় প্রেশার মাপার মেশিন নেই! আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার বাসায় স্ফিগমোম্যানোমিটার নেই! সে স্ফিগমোম্যানোমিটার চেনে না! হায় আল্লাহ বলে কি! এই ডাক্তাররাই পাশ করে সাইনবোর্ড টাঙাবে ডঃ অমুক, (ডিইউ, সিইউ ইত্যাদি)। আপনি এখন কার কাছে যাবেন, ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাশ করা ডঃ অমুক (ডিইউ) এর কাছে নাকি নামে মাত্র প্রাইভেট মেডিক্যাল থেকে পাশ করা ডঃ অমুক (ডিইউ) এর কাছে? ধন্ধ লেগে গেছে না? আমি আবারও সবার প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, মক্কায় গাধা ও মোহাম্মদ দুজনই থাকে। তবে এখনো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ বলতে হবে।
এভাবেই চলছে আমাদের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা। আগেও বলেছি সবাই ই যে একই রকম করছে তা কিন্তু নয়, কিন্তু বাস্তব চিত্র অত্যন্ত ভয়ংকর। প্রাইভেট বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাশ করে একজন ইঞ্জিনিয়ার যখন ‘বিএসসি’ লিখতে গিয়ে সবকটি লেটারকে ক্যাপিটালাইজ করে, তখন পরিস্কার হয়ে যায় কি শিখছে ওরা।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মধ্যে মানবিকতার স্থান অত্যন্ত ক্ষুদ্র হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিসর আবহে লেখাপড়ার মধ্যে যে বিশালতাকে আত্মীকৃত করার সুযোগ, এখানে তার ছিটেফোটাও মিলবে না। সুতরাং কূপমন্ডুকতার মধ্যে যেমন আছে আত্ম অহমিকার চিহ্ন, এখানেও তাই। কিন্তু অহমিকাটা আসলে ফাঁকা ও শূন্য। কিন্তু যদি তারা বুঝতে পারত! তারা বুঝতে পারছে না। আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটা-ই এখন এই শূন্যতার মধ্যে দুলছে।

এবার আসুন দেখি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক কারা? একটু চোখ মেলুন আর দেখুন, সিলেটের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মালিকানা কাদের হাতে। এরা সেই চিরপরিচিত মুখ, যারা পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রে তাদের সেবার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এরা সেই চিরচেনা ভূমিখেকো, বনখেকো, চা-বাগান খেকো অতি-মানুষদেরই কয়েকজন। বাংলাদেশে ১৯৫২ সালে ভূমিহীনদের পরিমান ছিলো মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ। ১৯৭২ সালে সেটা ৩২ শতাংশ হলো। ২০০৯ সালের একটি পরিসংখ্যন বলছে এই হিসেব বেড়ে গিয়ে এখন হয়েছে ৭০ শতাংশ। সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে ট্রেন্ডটা খেয়াল করুন। এই ভূমিখেকোরাই শিক্ষাকে বানিজ্যিক রূপ দিয়ে এখন জেঁকে ব্যবসা করছে।

তো এ রকম একজন ভূমিখেকো সে দিন আমার এক বন্ধুকে হুমকির সুরে বললেন, আমার ছেলেরা কেউ যেন ফেল না করে! বন্ধু বলল, স্যার সে তো কিছুই লেখেনি খাতায়, কেমন করে পাশ করাবো! তিনি বললেন, জানি না। আমরা যে খুব জুত করে টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি, কিন্তু রিসোর্সটাকে নষ্ট না করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে তারপর উন্নয়ন করবেন কাকে দিয়ে? রিসোর্স তো আগে থাকতেই পঁচে যাচ্ছে! এদের দিয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন করে চলবে সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের মতি কিন্তু খারাপ ছিলো না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার একটা আন্দোলন গড়ে তোলা যেত। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা সিমীত হবার কারণে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় যে সময়ের একটা দাবি সেটা বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু সরকারের সে নিয়তের দুধে বিষ পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিষ। এখান থেকে এখন আর বের হওয়া যাবে কি না সেটা জানার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশের পক্ষে এত এত বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে বারফট্টাই করার চাইতে ডিপ্লোমা ইন্সটিটিউটগুলোকে শক্তিশালি করে এবং আরো বেশি সংখ্যক ডিপ্লোমা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা উচিত ছিলো। ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বাড়ানো উচিৎ ছিলো। এখানকার কারিগরি বিদ্যাকে বিশ্বমানের করা সম্ভব। কিন্তু এদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বিশেষ করে ইংরেজিবিদ্যার কথা যদি বলি। কিন্তু সরকার সেদিকে মন দিলেন না। সরকার সব কিছুকে কুমারী দেখলেন। কিন্তু দেশ যে বেশ্যার বহুচর্চিত আলুথালু শরীরের মত, শীতের পাতা ঝরা বৃক্ষের মত হয়ে যাচ্ছে সে দিকে এঁর কোন খেয়াল নেই। এরা হেলিকপ্টারে বসে বন্যা দেখেন। আফসোস!

এতে করে শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট বিক্রয়ের ধুম পড়ে গেছে। পড়াশোনা করতে হলে কষ্ট করতে হয়। কষ্ট না করলে দেশের সেবা হবে কেমন করে? এই পয়সার সার্টিফিকেটে দেশের সেবার যে মূল্যবোধ, তা-ই ত তৈরি হবে না এদের। সরকার বলছেন, বেশ করেছি! এইত আমাদের উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। জাতীয় উন্নয়ন ও জাতির উন্নয়নের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা নিয়ে আমাদের শিক্ষাটা এগোচ্ছে না। নইলে গণজাগরণ মঞ্চ নামে একটা ফার্স হয়ে গেলো বাংলাদেশে, সেখানে দেখা গেলো জাতীয় পতাকাকে শাহবাগের রাস্তায় বিছিয়ে আসন গেড়েছে এ দেশের নতুন একাত্তরের সেনারা। নতুন নাকি এক একাত্তর এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মত আর একটা যুদ্ধ বাঁধলে এরা নেংটি খাড়া করে পালাবে। এখন যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে বলতে ফানা হয়ে যাওয়া প্রগতির ধ্বজাধারী অনেক বুদ্ধিজীবিরা একাত্তরে যদ্ধ না করে অন্য দেশে পালিয়েছিলো, অথবা দালাল সেজেচ নিজের জান ও মাল বাঁচিয়েছিলো। সে অন্য প্রসঙ্গ। যা হোক ওই ছেলেরা কতক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রগতিশীল যুবক।

আমার বক বক শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছেন বুঝতে পারছি। আমি আর যে কথাগুলো বলে শেষ করতে চাই, তা হলো আপনারা যেভাবে আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলছেন এতে পরিবর্তন অনিশ্চিত ও সুদূর প্রসারী। আমাদের মধ্যে বিভেদ এত বেশি, ভাবতে এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি ভাগ হতে হতে একদিন নিঃশ্বেষ না হয়ে যাই। এই সভার মাধ্যমে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হতে পারে। কিন্তু রিভোল্ট হলো রাস্তার সামগ্রী। এবং রিভোল্ট মানেই সেটা হবে দূর্বার। রাস্তায় নাবতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকবার আগেই। এবং এটা জেনে রাখুন শ্রেনিশত্রুরা এখন আগের থেকে বেশি শক্তিশালী। আসুন শিক্ষার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আখেরে সাম্রাজ্যবাদি অপশক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবের আগ্নিমন্ত্রে দিক্ষীত হই। আমি চাই নীটশের কথাটা সত্য হোক।
দ্যাট হুইচ ডাজেন্ট কিল আস মেকস আস স্ট্রঙ্গার।

এখনো বেঁচে আছি, এখনো সময় আছে।

সবাই ভালো থাকুন। ধন্যবাদ
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১৩৯৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অনেক ভালো লাগলো...........................। সুন্দর গল্প।
  • ইউরিদ ১৪/০২/২০১৫
    পরীক্ষার হলে একদিন এক ছাত্রকে নকল সহ ধরলেন পরীক্ষার ডিউটিরত শিক্ষক। স্যার তাকে তার খাতা জমা দেওয়ার জন্য বললে সে খাতা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। স্যার যখন টান দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সে নিজ জায়গায় বসে কারো সাথে ফোন ৩০ সেকেন্ড কথা বলল। তার কথা শেষ হওয়ার ৩ মিনিটের মাথায় একজন অফিসার লেভেল আর কর্মচারী পরীক্ষার হলে ঢুকলেন(যার আত্মীয় নেতা বলে পরিচিত), স্যার এর কাছ থেকে সব জানলেন এবং ছাত্রটিকে শুধু একটি কথাই বললেন,"ধুর, এই রকম করতে হয় না "। এই বলে টেবিল এর উপর রাখা খাতা(নকল সহ) ছাত্রের কাছে দিয়ে আসলেন। স্যার কে তখন কতটুকু অসহায় লাগছিল, তা তখন হলে উপস্থিত ছাত্ররাই অনুধাবন করতে পেরেছিল

    (ঘটনাটি সত্য না কাল্পনিক, তা আপনার উপরে ছেড়ে দিলাম)
    • ভানু ভাস্কর ১৮/০২/২০১৫
      অনেক হতভাগা শিক্ষক এ রকম ঘটনা সয়ে সয়ে বড় হয়েছেন, আর নিজের অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করেছেন।
      যার অস্তিত্ত্ব নেই তার থেকে ধারণার জন্ম হতে পারে না। ফলে এই ঘটনা একেবারে সত্যি।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ১৪/০২/২০১৫
    দারুন ভালো
  • জহির রহমান ১৪/০২/২০১৫
    ভূমিকাটা পড়লাম। আসলেই এমনই হচ্ছে আজকাল। টাকা নিয়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারছে না। সময় করে পুরোটা পড়বো। হয়তো আমার জন্যও কোন কিছু আছে, যা আমার কাজে আসবে। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
 
Quantcast