www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্বপ্নময়ী কন্যা জয়িতা

ছোট্ট মেয়ে, নাম তার জয়িতা। ছোট্ট জয়িতা ছিল খুবই হাসিখুশি ও চঞ্চল। তার চুল ছিল কালো ও কোকড়ানো, আর তার চোখ দুটি ছিল মায়াবী এবং উজ্জ্বল, যেন সেখান থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। প্রতিদিন সে নানান প্রশ্ন করে, কৌতূহলী মন নিয়ে পৃথিবীকে আবিষ্কার করত। তার আবিষ্কারের ভুবনে ছিল রঙিন পেন্সিল, ছোট ছোট পাখির গান, আর বাগানের নানা ধরনের ফুল। তার মা ছিল তার সবচেয়ে বড় বন্ধুর মতো। মায়ের হাত ধরে সে প্রথম বারের মতো স্কুলে পা রাখল, নীল আর সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে, পিঠে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে। স্কুলের প্রথম দিন থেকেই শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রিয় হয়ে উঠল জয়িতা তার নিষ্পাপ হাসি আর বুদ্ধিমত্তার জন্য। সে যখন প্রশ্ন করত, তার চোখের মধ্যে থাকত কৌতূহল ও আগ্রহের ঝিলিক, যা শিক্ষকদের মুগ্ধ করত। জয়িতা ক্লাসের প্রথম সারিতে বসে মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শিখত, আর তার ছোট্ট হাত দিয়ে সুন্দর সুন্দর অক্ষরে খাতায় লেখার চেষ্টা করত। শিক্ষকরা তার ভবিষ্যত নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন, কারণ তারা জানতেন, এই ছোট্ট মেয়েটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিশাল সম্ভাবনা।

জয়িতার শৈশব কাটত খেলার মাঠে, যেখানে সে বন্ধুদের সাথে দৌড়ঝাঁপ করে আনন্দে মেতে থাকত। খেলার মাঠ ছিল তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানে ছিল রং-বেরঙের দোলনা, স্লাইড, আর দোলনাচাঁপা গাছের ছায়া। তার বন্ধুরা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় সাথী, আর তাদের সাথে প্রতিদিন নতুন নতুন খেলা আবিষ্কার করত সে। পিটুলি ফুল আর কাঁঠালচাঁপার গন্ধ মাখা সেই মাঠে হাসি-ঠাট্টা, দৌড়ঝাঁপ, আর ছোট ছোট টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়ার মুহূর্তগুলো ছিল জয়িতার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়।



জয়িতার ছিল বই পড়ার প্রবল নেশা। সে বইয়ের পাতায় ডুবে গিয়ে নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কার করত। গল্পের বই, রূপকথা, আর কল্পকাহিনীর বই ছিল তার প্রিয়। বাবার সাথে বসে রূপকথার গল্প শোনার সময় তার চোখে-মুখে ভেসে উঠত সাহসী নায়িকাদের চেহারা, আর সে স্বপ্ন দেখত একদিন সেও হবে এক সাহসী নায়িকা। তার বাবা তাকে গল্প বলার সময় নানা রকমের চরিত্রে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে গল্পগুলো জীবন্ত করে তুলতেন। সেই সময়গুলো ছিল জয়িতার কাছে অমূল্য।



মা-বাবার ভালবাসা আর দারুণ পরিচর্যায় জয়িতা বেড়ে উঠতে লাগল। তার মা তাকে সবসময় শেখাতেন, “মন দিয়ে পড়াশোনা কর, মানুষের সেবা কর, জীবন হবে সুন্দর।” মায়ের কথা শুনে সে সবসময় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করত, আর বন্ধুদের সাহায্য করতে ভালোবাসত। মা তাকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে বড় করতেন, যাতে সে একদিন একজন সৎ, দয়ালু, এবং মানবিক মানুষ হয়ে ওঠে। মা-বাবার সেই অনুপ্রেরণা ও ভালবাসার মধ্যে দিয়ে জয়িতা ধীরে ধীরে এক মেধাবী ও সংবেদনশীল মেয়েতে পরিণত হচ্ছিল।

কৈশোরে পা রেখে জয়িতা আরও পরিপক্ক হয়ে উঠল। তার শরীরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনও পরিণত হতে লাগল। তার হাসিতে এল পরিণত স্বর, চোখে ঝিলিক দিল বিচক্ষণতা। স্কুলে সে ক্লাসের শীর্ষস্থান দখল করত, এবং তার নাম সবার মুখে মুখে ফিরত। জয়িতার ছিল অদম্য অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস, যা তাকে সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের পথে নিয়ে যেত।

তার শিক্ষকদের মতে, জয়িতার ছিল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতা। ক্লাসরুমে শিক্ষক যখন কোনো নতুন বিষয় বোঝাতেন, তখন জয়িতা মনোযোগ দিয়ে শুনত এবং দ্রুত তা আত্মস্থ করে নিত। সে সবসময়ই নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী ছিল, এবং তার কৌতূহল তাকে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন ধারণা এবং জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করত। তার মেধার প্রকাশ শুধু পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; জয়িতা শিল্প, সাহিত্য, এবং বিজ্ঞানেও সমানভাবে পারদর্শী ছিল।



স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় সে একটি প্রজেক্ট তৈরি করেছিল যা সকলের নজর কেড়েছিল। প্রজেক্টটির বিষয় ছিল পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি, এবং জয়িতা তার প্রকল্পে এমন কিছু উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করেছিল যা সবার কাছে অভিনব মনে হয়েছিল। তার প্রজেক্টটি ছিল একটি মডেল যেখানে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছিল। জয়িতা তার প্রজেক্টটি এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল যে শিক্ষকেরা, সহপাঠীরা, এমনকি মেলার বিচারকরাও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

তার এই উদ্ভাবনী মেধা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। বিজ্ঞান মেলায় সে প্রথম পুরস্কার জিতেছিল, এবং তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে স্থানীয় পত্রিকাতেও। জয়িতার এই সাফল্য শুধু তাকে নয়, তার পরিবারকেও গর্বিত করেছিল। তার মা-বাবা তাকে আরও উৎসাহিত করতে শুরু করলেন, যাতে সে ভবিষ্যতে আরও বড় বড় স্বপ্ন দেখতে পারে এবং সেগুলি পূরণ করতে পারে। এই সাফল্যের পর, জয়িতা বুঝতে পারল যে কঠোর পরিশ্রম এবং নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী থাকা তাকে জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে।

জয়িতা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। তার প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল ছিল অসাধারণ, যা দেখে শিক্ষক, সহপাঠী এবং পরিবারের সবাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। জয়িতার এই সাফল্যের পেছনে ছিল তার নিরলস পরিশ্রম, অধ্যবসায়, এবং শিক্ষার প্রতি তার গভীর আগ্রহ।

তার মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে একটি প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল দেশের অন্যতম সেরা, যেখানে শুধুমাত্র মেধাবী শিক্ষার্থীরাই প্রবেশের সুযোগ পায়। জয়িতার এই সুযোগ পাওয়া ছিল তার পরিবারের জন্য এক বিশাল গর্বের বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও তার প্রতিভা ফুটে ওঠে। সে ক্লাসে সবসময় প্রথম সারিতে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করত, আর প্রতিটি বিষয় গভীরভাবে আত্মস্থ করত। বিভিন্ন বিষয়ে সে এমন সব প্রশ্ন করত, যা শিক্ষকদেরও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করত। তার সহপাঠীরা প্রায়ই তার কাছ থেকে পড়াশোনার সাহায্য নিত, কারণ তারা জানত যে জয়িতা যেকোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত এবং পুরস্কার জিতত। বিজ্ঞান মেলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় সে তার মেধা এবং সৃজনশীলতার পরিচয় দিত। তার রচিত প্রবন্ধ এবং গবেষণা পত্রগুলি শুধু তার সহপাঠী এবং শিক্ষকদেরই নয়, বরং দেশের বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তিদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

তার সহপাঠী ও শিক্ষকরাও তার প্রশংসা করত। সহপাঠীরা তাকে তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখত, আর শিক্ষকেরা তাকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং মেধাবী ছাত্রছাত্রী হিসেবে গণ্য করত। তার অধ্যাপকরা প্রায়ই বলতেন, "জয়িতা শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব নয়, সে দেশের ভবিষ্যৎ।"

জয়িতার বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ সন্মানে গ্র্যাজুয়েট হল। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার নাম ঘোষণা করা হলে পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন তাকে মেডেল এবং সনদ প্রদান করেন, এবং তার ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ করেন। জয়িতার এই সাফল্য ছিল তার পরিবারের জন্য এক বিশাল গর্বের মুহূর্ত, আর তার জন্য ছিল একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।



জয়িতার জীবনে যেমন সুখের দিন এসেছে, তেমনি দুঃখের দিনও এসেছে। তার আনন্দময় দিনগুলো যেমন স্মৃতিতে গাঁথা রয়ে গেছে, তেমনি দুঃখের দিনগুলোও তাকে পরিণত করেছে, তাকে শিখিয়েছে কিভাবে জীবনের কঠিন সময়গুলোকে অতিক্রম করতে হয়।

একদিন তার প্রিয় দাদু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জয়িতার সাথে দাদুর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। দাদু ছিলেন তার প্রিয় সঙ্গী, যার সাথে সে অনেক সময় কাটাত, গল্প করত, আর নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। দাদুর অসুস্থতার খবরে জয়িতা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সে দাদুর পাশে থাকার জন্য তার সমস্ত সময় ব্যয় করতে লাগল।

জয়িতা তখন তার পড়াশোনার পাশাপাশি দাদুর যত্নও নিত। প্রতিদিন সকালে সে দাদুকে ওষুধ খাওয়াত, তাকে খাবার দিত, আর তাকে হাঁটতে সাহায্য করত। দাদুর সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত জয়িতার জন্য ছিল অমূল্য। দাদু তাকে বলতেন নানা রকম গল্প, শিখিয়েছিলেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো। জয়িতা দাদুর যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তার পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিল, যাতে দাদু তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন।

কিন্তু দাদুর শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। হাসপাতালে দিনগুলো ছিল জয়িতার জন্য অত্যন্ত কষ্টের। সে দাদুর পাশে বসে থাকত, তার হাত ধরে থাকত, আর প্রার্থনা করত যেন দাদু দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। দাদু তাকে বলেছিলেন, “তোমার ভালোবাসা আর যত্নে আমি সুস্থ হয়ে উঠব।” জয়িতার হৃদয় এই কথায় ভরে উঠত আশা ও ভালোবাসায়।

কিন্তু দাদু আর ফিরে এলেন না। দাদুর মৃত্যুতে জয়িতা ভেঙে পড়েছিল। তার পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। দাদুর না থাকাটা তাকে শূন্যতায় ভরিয়ে দিয়েছিল।

তবে দাদুর শেখানো শিক্ষাগুলো তাকে শক্তি যুগিয়েছে। দাদু সবসময় তাকে বলতেন, “জীবনে যতই কষ্ট আসুক, তুমি হাল ছেড়ো না। কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবল তোমাকে সবসময় সঠিক পথে রাখবে।” জয়িতা দাদুর সেই কথাগুলো মনে রেখেছিল। দাদুর মৃত্যু তাকে আরও শক্তিশালী ও ধৈর্যশীল করে তুলেছিল।

দাদুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে, জয়িতা তার পড়াশোনা আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে করতে শুরু করল। সে বুঝেছিল যে দাদু তার জীবনের এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, আর তার সাফল্যই হবে দাদুর প্রতি তার শ্রদ্ধাঞ্জলি। দাদুর শিখানো নৈতিক শিক্ষা, সৎ থাকার দীক্ষা, আর কঠোর পরিশ্রমের মন্ত্র তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল।

জয়িতা শিখেছিল, জীবনে দুঃখ থাকবেই, কিন্তু সেই দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করাই হলো জীবনের সার্থকতা।

অবশেষে জয়িতা তার স্বপ্নের চাকরিটি পেল। সে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করল যেখানে সে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে। তার কর্মজীবনে সে অনেক সফলতা অর্জন করল, কিন্তু সে সবসময় মনে রাখত তার মায়ের শেখানো সেই কথা, “মানুষের সেবা কর।” জয়িতা তার অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সমাজের অসহায় মানুষদের সাহায্য করত। তার এই মহান কাজের জন্য একদিন সে সম্মানিত হল।

জয়িতার জীবন যেন একটি শিক্ষনীয় গল্প হয়ে রইল। তার শৈশবের কৌতূহল, কৈশোরের পরিশ্রম, শিক্ষাজীবনের সাফল্য এবং মানবসেবার মাধ্যমে জীবন ধন্য করার এই গল্প আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। জয়িতা আমাদের শিখিয়ে গেল যে কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে সত্যিই সুন্দর করে তুলতে পারি।

তাং- ০৮/০৭/২০২৪ ইং (এম.এস./নৈ.গ.)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০৯/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • suman ১৬/০৯/২০২৪
    অসাধারণ গল্প, এই সময়ের উদাহরণ হয়ে থাকবে..
  • বিউটিফুল
  • ফয়জুল মহী ০৮/০৯/২০২৪
    অনিন্দ্য লেখন শিল্পে চমকপ্রদ প্রকাশ
 
Quantcast