এই জীবন মানুষের জন্য মানবতার জন্য
সন্ধ্যার রেশ মিলিয়ে আঁধারে ঢেকেছে প্রকৃতি। তরগাঁও খেয়াঘাটের পাড়ে কিছু দোকানপাট এখনো খোলা। বেশিরভাগই চা আর ভাতের স্টল। এরা গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখে। টিভিতে চলে আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ত চ্যানেল। ব্যাপারটা ইদানিং খুব চালু হয়েছে মফস্বল শহরে। আব্দুর রহীম রিক্সার সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে, সাথে আরো দুজন রিক্সাচালক।
বয়সের ভারে জরাক্রান্ত একজন শ্মশ্রুমন্ডিত পাঞ্জাবী পরিহিত বৃদ্ধ ছায়ার আড়াল থেকে বলে উঠে- রহি আছসনিরে?
লোকটি এইমাত্র নদী পার হয়ে এসেছেন বলে বুঝা যাচ্ছে।রিক্সাচালক আব্দুর রহীম রিক্সা থেকে নেমে বলে, হ চাচা! বাড়ি যাইবেন নি?
( লোকটিকে চেনে রহীম, ওদের বাড়ির কাছের, এখন মির্জা চেয়ারম্যান বলে পরিচিত; যদিও কখনো পাস করে নি, দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন আশির দশকে।)
: হ, বাড়ি ছাড়া এতোরাতে আর কই যামু। আইজ এশার নামাজ বাড়ির মসজিদেই পড়ত অইব।
: দোকান কি বন্ধ করে আইছেননি।
: না, বকুইল্যা বন্ধ কইরা পরে আইব। চাচার চালের আড়ত। বকুল দোকানের চাকর।
রিক্সা চলার পর বৃদ্ধ চাচা চেঁচিয়ে বলল: দেইখ্যা চালাইতে পারস না, চহের মাতা খাইয়া বইয়া রইছস নি।
: আন্ধারে ঠাহর করা যায় না (হ্যারিকেনের টিপটিপ আলো খুব উজ্জ্বলতা ছড়ায় না।)
: কতার পিডে কতা কস, আস্তে চালা
: আস্তে অইতো চালাই, শইল্যে আর শক্তি কই। অহন আর জোরে চালাইতে পারি না। চল্লিশ পেরুনো আব্দুর রহীম থেমে থেমে শ্বাসের সাথে বলে।
: শইল্যের তাকত বেশি দিন থাহে নারে বাইছতা ( শরীরের শক্তি বেশিদিন থাকেনা, ভাতিজা)
আব্দুর রহীম বুঝতে পারে কথার প্রসঙ্গ বুড়ো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন রহীমের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। মনে চাড়া দিয়ে উঠে ক্ষোভের আগুন। ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে এই বুড়োকে নিচে ফেলে পিষে মারে। বাস্তবতার নির্মম প্রহসনে আর ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারে না।
আব্দুর রহীম যখন বুড়োর সাথে কথা বলে বেশিরভাগ সময় সে চুঁপ থেকে মনে মনে কথা চালাচালি করে মনের খায়েস মিটায়। এখন থেকে ওকে এইভাবেই চালাতে হবে যা বুঝা যাচ্ছে।
বৃদ্ধ এবার কথা পাল্টে বলে: মগরিবের নামাজ পরছসনি
: পড়ছি চাচা (জোরে)
: এশার নামাজে তো তরে জামাতে দেহি না, ফযরেও না।
: বেশির সময়ই রিক্সা থাহি এশার সময়, বাইত একলা পড়ি, আর ফযরের নামায ঘাটমসজিদে পড়ি।
: বাড়ির মসজিদ রেখে ঘাটে?
: কী করমু, ভোরে রিক্সা নিয়ে নেমে পড়ি।
: খালি দুনিয়া দুনিয়া করলে অইব? আখিরাতের কাম করতে অইব না? কতদিন কইলাম দিনের পথে সময় দে....
এ সময় আব্দুর রহীম মনে মনে জবাব চালাচালি করে।
" আমি আর কই দুনিয়া করলাম, সারাদিন রিক্সার পেডেলে শরীরের শক্তি ব্যয় করি দুমুঠো খাবারের জন্য। আপনি তো সারা দুনিয়া নিয়েই বসে আছেন। নিজে চালান চালের আড়ত, মুদির দোকান। পোলারা আছে স্টুডিও আর ভিডিওর দোকান দিয়ে।
: এই দুনিয়া কতদিন? শরীয়ত মত চলতে অইব না?
" শরীয়তের আপনে কী মানেন? এইসব দোকানের মালিক কীভাবে হয়েছেন সবাই তো জানে। স্টুডিও আর ভিডিওর দোকান চালানোতো আর জায়েজ নেই, নাকি আপনারা তাও জায়েজ করে নিয়েছেন?
: তর বউরে দেকলাম হেইদিন বাইরের থ্যে গরু আনে, ছি ছি এইসব কী বেআল্লাপনা।
" আপনাদের বাড়ির মেয়েলোকেরা তো বাজারে যায়। আমার পরিবার তো প্রয়োজনের জন্য বাইরে যায়।"
: কীরে কতা কস না ক্যান? ভালা কতা চিরতা রসের মত তিতা। আইচ্ছা তরে না কয়দিন কইছি আমার অফিসে আয়িছ মুক্তিযোদ্ধার সার্টফিকেট লয়ে দিমুনে।
" মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়া কী করমু, যুদ্ধতো আপনারা করেছেন, অহন ক্ষমতার স্বাদ লইবেন।
:রহীরে! কীরে কতা ক, নাম লেহাইলেতো কিছু পাইতি সরহারের কাছতে।
" আজ আমি রহি, আপনি আবুল হোসেন মির্জা, এক সময়ের "আবুল রাজাকার"। শান্তিকমিটির সভাপতি!
আব্দুর রহীমের সব মনে পড়ে। এই বৃদ্ধ একাত্তরের কুখ্যাত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। রহীমের তখন ষোল সতের বয়স। স্বাধীনতার উত্তাল ডাকে সেও যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সহকারী হিসেবে। বয়সের কারণে সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিতে পারে নি। তার দুই চাচার সাথে বাপও যুদ্ধে গিয়েছিল, এক চাচা হারিয়ে যায়, বাকি দুই ভাই যুদ্ধ শেষে বাড়ি আসে পঙ্গু হয়ে। চাচা এখনো বেঁচে আছে, রহীমের বাপ মারা গেছে দেশের উল্টো আচরণের আক্রমণ দেখার আগেই। লেখাপড়া করতে পারে নি শেষ। মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল সংগ্রামের সনে। স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অন্য সবার সাথে সেও তখন পরীক্ষা দেয় নি। স্বাধীনতার পরে বাপের পঙ্গুত্বের কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরী নিতে হয়। সেই চাকুরী গিয়েছে, অনেক ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধার একটা সার্টিফিকেটও দিয়েছিল তাকে সরকার। ক্ষমতার পট বদলে তাও কেড়ে নিল। আর সার্টিফিকেট তুলতে রুচি হয় নি। যখন দেখল এই আবুলের মত মুক্তি বিরোধীরা স্বাধীনতার স্বপক্ষ বলে পরিচিত দলের তত্বাবধানে মাথা চাড়া উঠল। এক সময় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে এই মির্জা সাহেব মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অনেক রাজাকারের সাথে। তার মৃত্যু ছিল নির্ঘাত। তবুও আজ সে জীবিত, কারণ এই আব্দুর রহীম। তার দায়িত্বে ছিল মির্জার পাহাড়া। মির্জা তার পায়ে পড়ে বাঁচার আকুতি জানায়, ক্ষমা চায় তার কর্মের জন্য, সে জানায় এখন থেকে মুক্তির সাথে থাকবে। আব্দুর রহীমের মন গলে যায়। বেওয়া বিলের পাড় দিয়ে ইস্কুলের ক্যম্পে আসার পথে তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পায়ে গুলি করে পরিস্থিতি সামলায়।
আবুল রাজাকার তার এই কর্মের প্রতিদান পুরোপুরি দিয়েছিল একমাস পরে। একদিন অনেক মুক্তির সাথে রহীমও ধরা পড়ে পাক বাহিনির হাতে। আবুলের সহায়তায়। এক কাতারে দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করলে সে একপাশে পড়ে যায় পায়ে গুলি খেয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
একে মৃত ভেবে ওরা চলে যায়। আবুল রাজাকার ওদের বাড়িঘর লুটেপুটে আগুন ধরিয়ে দেয়। এইভাবে সে অনেক পয়সার মালিক হয়ে দেশ স্বাধীনের পূর্বক্ষণে কোথায় যেন চলে যায়। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার এলাকায় আসে স্বপরিবারে, এসে মেম্বার পদে নির্বাচনে টাকা বিলিয়ে পদ দখল করে। তারপর তার উত্থানতো ফিল্মী কায়দায়।
তার আলিশান বাড়ির সামনে দিয়ে যখন আব্দুর রহীম আসা যাওয়া করে তখন আগুন ধরিয়ে পোড়াতে ইচ্ছে করে। কখনো অপারগের আবেগে নিজের গায়ে.........-.
এখন আবুল রাজাকার মির্জা চেয়ারম্যান নামে ধর্মের কাজ করে বেড়ায়। গ্রামের সালিশে প্রধান বনে যায়। রহীমের দুঃখ হয় খুব ,যখন তাদের কমান্ডারও এই লোকের বিরোধীতা করতে পারে না। এখন সে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সে সর্বজন(?) শ্রদ্ধেয় মেম্বার।
আব্দুর রহীম রিক্সার পেডেলে পা টিপে এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায় বাড়ির কাছে এসে পড়ে। সরকার তাদের জন্য কী করল?
হঠাৎ বৃদ্ধ চিৎকার দিয়ে উঠে। মরে গেলাম রে রহী"
: কী অইচে চাচা?
: প্র্রেসার মনে হয় বেড়ে গেছেরে। শ্বাস টেনে টেনে বলে বৃদ্ধ। হঠাৎ বৃদ্ধ চুঁপ হয়ে যায়, রহীম মিয়া ভয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। তার পরিবারের লোক বাড়ি ছেড়ে নিচে নেমে আসে। বলাবলি হতে থাকে চাচা স্ট্রোক করেছেন। আব্দুর রহীম রিক্সা ঘুরিয়ে গিলাপুরের ( থানা স্বাস্থ্য কমপ্ল্যাক্স) পথে পেডেল মারতে থাকে।
চাচার শরীর জড়িয়ে থাকা জন বলে, আরো জোরে আরো জোরে..
আব্দুর রহীম শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে পেডেল মারতে থাকে, একজন কুখ্যাত(!) মানুষের জীবনের জন্য। একজন মানবতার বাচানোর তাগিদে... যে মানবতার ধ্বংসের তুলা উড়িয়েছিল এই জঘন্য মানুষ!!!!!!!!
উৎসর্গ: আমার বড় মামা প্রচ্ছদশিল্পী এইচ হাসেম! ওনার মত সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা শুধু দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। পদক, সম্মান, পদবী আর সম্মানীর জন্য যুদ্ধ করেন নি। উনি মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেন নি। সেইসব সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধার তরে লাল সেলাম।
পুনশ্চ: আমার এই লেখা পড়ে কেউ যদি মনোকষ্ট পান তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ঘটনাটি বাস্তবতা থেকে নেয়া।
" হৃদয়ে একাত্তর"
বয়সের ভারে জরাক্রান্ত একজন শ্মশ্রুমন্ডিত পাঞ্জাবী পরিহিত বৃদ্ধ ছায়ার আড়াল থেকে বলে উঠে- রহি আছসনিরে?
লোকটি এইমাত্র নদী পার হয়ে এসেছেন বলে বুঝা যাচ্ছে।রিক্সাচালক আব্দুর রহীম রিক্সা থেকে নেমে বলে, হ চাচা! বাড়ি যাইবেন নি?
( লোকটিকে চেনে রহীম, ওদের বাড়ির কাছের, এখন মির্জা চেয়ারম্যান বলে পরিচিত; যদিও কখনো পাস করে নি, দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন আশির দশকে।)
: হ, বাড়ি ছাড়া এতোরাতে আর কই যামু। আইজ এশার নামাজ বাড়ির মসজিদেই পড়ত অইব।
: দোকান কি বন্ধ করে আইছেননি।
: না, বকুইল্যা বন্ধ কইরা পরে আইব। চাচার চালের আড়ত। বকুল দোকানের চাকর।
রিক্সা চলার পর বৃদ্ধ চাচা চেঁচিয়ে বলল: দেইখ্যা চালাইতে পারস না, চহের মাতা খাইয়া বইয়া রইছস নি।
: আন্ধারে ঠাহর করা যায় না (হ্যারিকেনের টিপটিপ আলো খুব উজ্জ্বলতা ছড়ায় না।)
: কতার পিডে কতা কস, আস্তে চালা
: আস্তে অইতো চালাই, শইল্যে আর শক্তি কই। অহন আর জোরে চালাইতে পারি না। চল্লিশ পেরুনো আব্দুর রহীম থেমে থেমে শ্বাসের সাথে বলে।
: শইল্যের তাকত বেশি দিন থাহে নারে বাইছতা ( শরীরের শক্তি বেশিদিন থাকেনা, ভাতিজা)
আব্দুর রহীম বুঝতে পারে কথার প্রসঙ্গ বুড়ো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন রহীমের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। মনে চাড়া দিয়ে উঠে ক্ষোভের আগুন। ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে এই বুড়োকে নিচে ফেলে পিষে মারে। বাস্তবতার নির্মম প্রহসনে আর ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারে না।
আব্দুর রহীম যখন বুড়োর সাথে কথা বলে বেশিরভাগ সময় সে চুঁপ থেকে মনে মনে কথা চালাচালি করে মনের খায়েস মিটায়। এখন থেকে ওকে এইভাবেই চালাতে হবে যা বুঝা যাচ্ছে।
বৃদ্ধ এবার কথা পাল্টে বলে: মগরিবের নামাজ পরছসনি
: পড়ছি চাচা (জোরে)
: এশার নামাজে তো তরে জামাতে দেহি না, ফযরেও না।
: বেশির সময়ই রিক্সা থাহি এশার সময়, বাইত একলা পড়ি, আর ফযরের নামায ঘাটমসজিদে পড়ি।
: বাড়ির মসজিদ রেখে ঘাটে?
: কী করমু, ভোরে রিক্সা নিয়ে নেমে পড়ি।
: খালি দুনিয়া দুনিয়া করলে অইব? আখিরাতের কাম করতে অইব না? কতদিন কইলাম দিনের পথে সময় দে....
এ সময় আব্দুর রহীম মনে মনে জবাব চালাচালি করে।
" আমি আর কই দুনিয়া করলাম, সারাদিন রিক্সার পেডেলে শরীরের শক্তি ব্যয় করি দুমুঠো খাবারের জন্য। আপনি তো সারা দুনিয়া নিয়েই বসে আছেন। নিজে চালান চালের আড়ত, মুদির দোকান। পোলারা আছে স্টুডিও আর ভিডিওর দোকান দিয়ে।
: এই দুনিয়া কতদিন? শরীয়ত মত চলতে অইব না?
" শরীয়তের আপনে কী মানেন? এইসব দোকানের মালিক কীভাবে হয়েছেন সবাই তো জানে। স্টুডিও আর ভিডিওর দোকান চালানোতো আর জায়েজ নেই, নাকি আপনারা তাও জায়েজ করে নিয়েছেন?
: তর বউরে দেকলাম হেইদিন বাইরের থ্যে গরু আনে, ছি ছি এইসব কী বেআল্লাপনা।
" আপনাদের বাড়ির মেয়েলোকেরা তো বাজারে যায়। আমার পরিবার তো প্রয়োজনের জন্য বাইরে যায়।"
: কীরে কতা কস না ক্যান? ভালা কতা চিরতা রসের মত তিতা। আইচ্ছা তরে না কয়দিন কইছি আমার অফিসে আয়িছ মুক্তিযোদ্ধার সার্টফিকেট লয়ে দিমুনে।
" মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়া কী করমু, যুদ্ধতো আপনারা করেছেন, অহন ক্ষমতার স্বাদ লইবেন।
:রহীরে! কীরে কতা ক, নাম লেহাইলেতো কিছু পাইতি সরহারের কাছতে।
" আজ আমি রহি, আপনি আবুল হোসেন মির্জা, এক সময়ের "আবুল রাজাকার"। শান্তিকমিটির সভাপতি!
আব্দুর রহীমের সব মনে পড়ে। এই বৃদ্ধ একাত্তরের কুখ্যাত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। রহীমের তখন ষোল সতের বয়স। স্বাধীনতার উত্তাল ডাকে সেও যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সহকারী হিসেবে। বয়সের কারণে সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিতে পারে নি। তার দুই চাচার সাথে বাপও যুদ্ধে গিয়েছিল, এক চাচা হারিয়ে যায়, বাকি দুই ভাই যুদ্ধ শেষে বাড়ি আসে পঙ্গু হয়ে। চাচা এখনো বেঁচে আছে, রহীমের বাপ মারা গেছে দেশের উল্টো আচরণের আক্রমণ দেখার আগেই। লেখাপড়া করতে পারে নি শেষ। মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল সংগ্রামের সনে। স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অন্য সবার সাথে সেও তখন পরীক্ষা দেয় নি। স্বাধীনতার পরে বাপের পঙ্গুত্বের কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরী নিতে হয়। সেই চাকুরী গিয়েছে, অনেক ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধার একটা সার্টিফিকেটও দিয়েছিল তাকে সরকার। ক্ষমতার পট বদলে তাও কেড়ে নিল। আর সার্টিফিকেট তুলতে রুচি হয় নি। যখন দেখল এই আবুলের মত মুক্তি বিরোধীরা স্বাধীনতার স্বপক্ষ বলে পরিচিত দলের তত্বাবধানে মাথা চাড়া উঠল। এক সময় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে এই মির্জা সাহেব মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অনেক রাজাকারের সাথে। তার মৃত্যু ছিল নির্ঘাত। তবুও আজ সে জীবিত, কারণ এই আব্দুর রহীম। তার দায়িত্বে ছিল মির্জার পাহাড়া। মির্জা তার পায়ে পড়ে বাঁচার আকুতি জানায়, ক্ষমা চায় তার কর্মের জন্য, সে জানায় এখন থেকে মুক্তির সাথে থাকবে। আব্দুর রহীমের মন গলে যায়। বেওয়া বিলের পাড় দিয়ে ইস্কুলের ক্যম্পে আসার পথে তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পায়ে গুলি করে পরিস্থিতি সামলায়।
আবুল রাজাকার তার এই কর্মের প্রতিদান পুরোপুরি দিয়েছিল একমাস পরে। একদিন অনেক মুক্তির সাথে রহীমও ধরা পড়ে পাক বাহিনির হাতে। আবুলের সহায়তায়। এক কাতারে দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করলে সে একপাশে পড়ে যায় পায়ে গুলি খেয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
একে মৃত ভেবে ওরা চলে যায়। আবুল রাজাকার ওদের বাড়িঘর লুটেপুটে আগুন ধরিয়ে দেয়। এইভাবে সে অনেক পয়সার মালিক হয়ে দেশ স্বাধীনের পূর্বক্ষণে কোথায় যেন চলে যায়। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার এলাকায় আসে স্বপরিবারে, এসে মেম্বার পদে নির্বাচনে টাকা বিলিয়ে পদ দখল করে। তারপর তার উত্থানতো ফিল্মী কায়দায়।
তার আলিশান বাড়ির সামনে দিয়ে যখন আব্দুর রহীম আসা যাওয়া করে তখন আগুন ধরিয়ে পোড়াতে ইচ্ছে করে। কখনো অপারগের আবেগে নিজের গায়ে.........-.
এখন আবুল রাজাকার মির্জা চেয়ারম্যান নামে ধর্মের কাজ করে বেড়ায়। গ্রামের সালিশে প্রধান বনে যায়। রহীমের দুঃখ হয় খুব ,যখন তাদের কমান্ডারও এই লোকের বিরোধীতা করতে পারে না। এখন সে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সে সর্বজন(?) শ্রদ্ধেয় মেম্বার।
আব্দুর রহীম রিক্সার পেডেলে পা টিপে এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায় বাড়ির কাছে এসে পড়ে। সরকার তাদের জন্য কী করল?
হঠাৎ বৃদ্ধ চিৎকার দিয়ে উঠে। মরে গেলাম রে রহী"
: কী অইচে চাচা?
: প্র্রেসার মনে হয় বেড়ে গেছেরে। শ্বাস টেনে টেনে বলে বৃদ্ধ। হঠাৎ বৃদ্ধ চুঁপ হয়ে যায়, রহীম মিয়া ভয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। তার পরিবারের লোক বাড়ি ছেড়ে নিচে নেমে আসে। বলাবলি হতে থাকে চাচা স্ট্রোক করেছেন। আব্দুর রহীম রিক্সা ঘুরিয়ে গিলাপুরের ( থানা স্বাস্থ্য কমপ্ল্যাক্স) পথে পেডেল মারতে থাকে।
চাচার শরীর জড়িয়ে থাকা জন বলে, আরো জোরে আরো জোরে..
আব্দুর রহীম শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে পেডেল মারতে থাকে, একজন কুখ্যাত(!) মানুষের জীবনের জন্য। একজন মানবতার বাচানোর তাগিদে... যে মানবতার ধ্বংসের তুলা উড়িয়েছিল এই জঘন্য মানুষ!!!!!!!!
উৎসর্গ: আমার বড় মামা প্রচ্ছদশিল্পী এইচ হাসেম! ওনার মত সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা শুধু দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। পদক, সম্মান, পদবী আর সম্মানীর জন্য যুদ্ধ করেন নি। উনি মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেন নি। সেইসব সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধার তরে লাল সেলাম।
পুনশ্চ: আমার এই লেখা পড়ে কেউ যদি মনোকষ্ট পান তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ঘটনাটি বাস্তবতা থেকে নেয়া।
" হৃদয়ে একাত্তর"
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইসমাত ইয়াসমিন ১২/১২/২০১৩খুবই সুন্দর একটি লেখা, সবাই কি সুন্দর করে লেখে, সত্যি অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে। শুভকামনা রইল।
-
প্রবাসী পাঠক ০২/১২/২০১৩আমরাই এই কুখ্যাত রাজাকারগুলোকে পুনর্বাসিত করেছি। অনেক কষ্ট পাই যখন দেখি রাজাকারগুলো বীরদর্পে বাংলার মাটিতে ঘুরে বেরায়।
এম আর আখতার মুকুল এর লেখা , 'আমি বিজয় দেখেছি ' কিছু লাইন তুলে ধরছি-
এখানে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের আসল চেহারাটা অনুধাবন করা যাবে । বাহাত্তর সালের গোঁড়ার দিকে কুষ্টিয়ার কোর্টে জনৈক রাজাকারের বিরুদ্ধে একটা মামলার শুনানি হচ্ছিল। সাক্ষি - সাবুদ গ্রহন আর জেরা শেষ হলে মাননীয় বিচারক অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আইনমত জিজ্ঞেস করলেন, ' আপনি দোষী না নির্দোষী।' আসামি একদৃষ্টে মাননীয় হাকিমের দিকে নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে রয়েছে। মিনিত কয়েক পর আসামির মুখ থেকে জবাব এল, ' আমি ভাবতাছি।' জনৈক উকিল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন,' কী ভাবতাস?' এবার আসামি জবাব দিলো , ' আমি ভাবতাছি, আমারে যে সাবে এই রাস্তায় আনছিল, সেই সাবই তো হাকিমের চেয়ারে বইস্যা রইছে। তা হইলে এইটা কেমন বিচার যে, হেই সাবে আজ প্রমোশন পাইয়া হাকিম, আর আমি হইলাম আসামি ?'
ঠিকই - একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মাননীয় বিচারক মহদয় ছিলেন কুষ্টিয়ার এডিসি ( রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ), আর এরই প্রচেষ্টায় এই আসামি রাজাকার বাহিনিতে যোগ দিয়েছিল। নিয়তির পরিহাস। সেদিনের গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটা আখন আসামির কাঠগড়ায় আর এডিসি মহোদয় প্রমোশন পেয়ে বিচারকের আসনে রয়েছেন। -
ভোরের পাখি ০১/১২/২০১৩সুন্দর আর ভাল লাগার মত।