www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মাকড়সার জাল

অর্পিতার রুমে মাকড়সার জাল। অর্পিতার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতদিন কেন চোখে পড়ল না, তবে কী আজই জাল পেতেছে; এতদিন কোথায় ছিল এই অষ্টপদী কীট, বিছানার তলায় নাকি সুমনের অ্যাকুয়াস্টিক গীটারের ভেতর। গীটারটি বাজানো হয় না ছয় মাস হলো। সুমন এখন বাজানোর জন্য সময় পায় না আগের মতো। অফিস, মিটিং, আরও কত হাবিজাবি কাজ নিয়ে সে সারাদিন ব্যস্ত। গীটার ধরার সময় কোথায়। অর্পিতা আগে গীটারটিকে সময় পেলেই পরিষ্কার করে রাখত, এখন সেই আগ্রহও চলে গেছে। যে গীটারের টুং টাং শোনার জন্য অর্পিতা একসময় পাগল ছিল, তার সেই দম যেন ফুরিয়ে গেছে।


বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই মাকড়সার জালের দিকে তাকিয়ে পা জোড়া নেড়ে যাচ্ছে অর্পিতা। স্কুল থেকে এসেই শুয়ে পড়েছে আজ। খুব ক্লান্ত লাগছিল সকাল থেকে। রাতের ধকল সামলে না উঠতেই সকালবেলা ক্লাসের শিডিউল। ক্লাস ফোরের ইংরেজি নিতে হয়েছে। তারপর আরও তিনটি ক্লাস নিয়ে তবেই ছুটি। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা। ধপাস করে বিছানায় শোয়ার পর আর খবর নেই। চোখ মেলে দেখে রাত আটটা। পেটে কোনো দানাপানি নেই। তবু বিছানা ছেড়ে  উঠতেই ইচ্ছে করে না। ভাত-তরকারি না রাঁধলে সুমনই বা খাবেটা কী।


সুমন আর আগের মতো কথা বলে না। যখন খেতে থাকে, খাওয়ার গপগপ আওয়াজ ছাড়া অন্য সব নিস্তব্ধ। আজও একই অবস্থা। গতকাল যে কী হয়েছিল! অফিস থেকে ফিরেই অর্পিতাকে জড়িয়ে ধরল। অর্পিতার সারা শরীরে চুমো খেতে লাগল। সেই যে শুরু হলো, থামল ভোর রাতে গিয়ে। আদরের আতিশয্যে অর্পিতাকে নাজেহাল করে ছাড়ল। আজ যথারীতি আগের মতো। আগের পরিবেশ। টিকটিক শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। যে যার মতো করে শুয়ে পড়েছে বিছানায়। অর্পিতা তাকিয়ে আছে মাকড়সার জালের দিকে। জীবনটা কী মাকড়সার জালের মতো? যত দিন যায় ততোই ছড়াতে থাকে এর বিস্তার। আবার হারিয়ে যায় যেমনভাবে মাকড়সার জালকে ফুলঝাড়ু দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়। অর্পিতা ঠিক করল, মাকড়সার নতুন জালটি রেখে দেবে, পরিষ্কার করবে না কখনো, এটি ছড়াতে থাকবে মনের মতো। সে কখনো বাঁধা দিবে না তাতে।


ঘুম আসছে না অর্পিতার চোখে। সুমন একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। অথচ কী যে করল গতরাতে, বিছানা ভেঙে ফেলার উপক্রম। কালকের রাতটি সত্যিই ঘূর্ণিঝড়ের মতো, ঠিক যেন কালবৈশাখী ঝড়। কারও বাঁধা মানবে না, বৃষ্টির পতনকে যেমন থামানো যায় না সেরকম। আজ একেবারেই নীরব। লাইট নেভানোর কথাও বলছে না! না, এভাবে লাইট জ্বালিয়ে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। অর্পিতা লাইট নিভিয়ে টিভি রুমে চলে গেল।



২.


সুমন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার চোখেও ঘুম নেই। শরীর যেন স্পন্দনহীন, শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে বুঝাই যাচ্ছে না। অর্পিতার উপস্থিতি আর চলে যাওয়া সবকিছুই সে টের পাচ্ছে। তবু তার নীরবতা ভাঙে না। গীটারটির কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। গীটার শিখেছিল কলেজে থাকতে। ভালোই বাজাতে পারে, সাথে গানও জমায় বেশ। কিন্তু শামুকের মতো মাথা লুকিয়ে রাখতেই যার অভ্যেস, সে তো আর সহজে বাইরের কাউকে জানাবে না তার একটি মাথা আছে। পরিবার আর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনির্বাণ  ছাড়া কেউই জানত না তার গীটারে পারদর্শিতার কথা। অনির্বাণ অনেকটা বনমোরগের মতো। যেখানেই যাবে আওয়াজ দিবেই। বন্ধু গীটার বাজাতে পারে সেটা পেটে চেপে রাখবে এমন মানুষ অনির্বাণ নয়। এই দুই বন্ধুর মিতালি ছোটবেলা থেকেই। একই স্কুল, একই কলেজ, ভার্সিটিও এক। ভার্সিটিতে উঠে ভিন্ন সাবজেক্ট, আলাদা ডিপার্টমেন্ট, এই-ই পার্থক্য।


নদীর স্রোতকেও আটকে ফেলছে মানুষ, শুধু সময়কে আটকাতে পারল না। সময় চলে গেছে সময়ের মতোই, কারও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। দেখতে দেখতে ভার্সিটিতেও এক বছর শেষ। এই এক বছরেও অনির্বানের প্রেম হয়নি, এ কথা শুনে হাসির ফোঁয়ারা বয়ে যায় সুমনের মুখে। সুমন প্রেম করবে না, এটা সে আগেই বলে রেখেছে। কিন্তু অনির্বাণ! একটা মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে, অথচ মেয়ের সামনে গেলেই জবুথবু হয়ে যায়। সে যাই হোক, তাদের অনির্বচনীয় বন্ধুত্ব টিকে আছে অনির্বাণ দীপালোকের মতো।


অনির্বাণের ডিপার্টমেণ্টে বর্ষপূর্তির আয়োজন। সে সুমনকে ধরে নিয়ে গেছে গীটার বাজিয়ে গান গাওয়ার জন্য। সুমনের অবস্থা লজ্জাবতীর মতো; সবার সামনে গান গাইবে এ যেন তাকে দিয়ে হবে না। স্টেজে উঠে যেই গীটার ধরে গান শুরু করল, লজ্জাবতীর চুপসানো পাতা ছড়াতে আরম্ভ হলো। গান গেয়ে মঞ্চ মাতালো, সবার মুহুর্মুহু হাততালিতে মনটা ভরে গেল। অনুষ্ঠান শেষে এক মেয়ে খুব সুন্দর রিকমেনডেশনও দিয়ে দিল। টকটকে লাল জামা পরা মেয়েটি সুমনের মনটাকেও চুরি করে নিয়ে গেল। টানা টানা চোখ আর আকর্ষণীয় রূপের সেই মেয়েটিই অর্পিতা। সুমন পাগলের মতো খুঁজতে লাগল মেয়েটিকে। কিন্তু কোথায় যে হারালো, আর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত অনির্বানই ভরসা। সুমন যেভাবে মেয়েটির রূপের বর্ণনা দিয়েছে, অনির্বাণের বেগ পেতে হলো না মেয়েটিকে চিনতে। অর্পিতা যে অনির্বাণেরই ব্যাচমেট, সে তো চিনবেই। পরের দিন সুমনকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া দিল দুজনই। প্রতিদিনই দেখা হয় তবু ভালোবাসার কথা কেউই বলতে পারে না। এবারও ভরসা অনির্বাণ।



৩.


মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে অন্ধ হয়ে যায়; বাইরের জগত থেকে সে দূরে চলে যেতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের কথা তেমন খেয়াল থাকে না। না, সুমনের এমন কিছু হয়নি। তার জীবনে অর্পিতা এসেছে, অনির্বাণকেও রেখেছে যথাযোগ্য স্থানে। এই না হলো বন্ধুত্ব। সবকিছুই ঠিক থাকে, চলে যেতে থাকে সময়। সময়ের স্রোতে পাল্টে যেতে থাকে অনেক কিছু। সুমনের জীবনটা এখন প্রজাপতির মতো, খুব সুন্দর করে ঘুরে বেড়ায় অর্পিতার হাত ধরে। খুব সুন্দরও লাগে এই জুটিকে দেখলে। সবার কাছেই তারা একজোড়া প্রজাপতির মতো। দুজনার পরিবারই অখুশি হয়নি এই সম্পর্কের কথা জেনে। যথাসময়ে বিয়ে হলো। সে এক বিরাট অনুষ্ঠান, আয়োজনের নেতৃত্বে অনির্বাণ। বন্ধুর বিয়েতে রাতদিন খাটুনি খেটে একেবারে শয্যাশায়ী। তবু শুয়ে থাকার পাত্র সে নয়, বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমা না হলে বিয়ের মানে কী। সেটার ব্যবস্থা অনির্বাণই করে দিল। ভেতরে ভেতরে সে অনেকটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দিত না। মুখে হাসি লাগিয়ে বন্ধুর সামনে সবসময়ই হাজির। নানারকম খুনসুটিতে মেতে উঠত তিনজন মিলে। সুমন, অর্পিতা দুজনই তাকে খেপাতো জীবনে তার প্রেম হয়নি বলে। ছ্যাকা খাওয়া দূরে থাক, প্রেম নিবেদনই করতে পারল না।  কী সে পালোয়ান! হেসে কুটি কুটি হতো সবাই। অনির্বাণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকত তাদের কাছে। তারাও ছাড়ত না তাকে। মজার মজার আলাপ-আলোচনায় কেটে যেত সময়। তারা জোরাজুরি করত তার পছন্দের মেয়েটির পরিচয় জানতে। সুমন সবসময় এড়িয়ে যেত। অবশেষে একদিন ঠিক হলো, সে মেয়েটির কথা বলবে। বলতে যাবে, এমন সময় তার পেটের ব্যথা শুরু হলো। পেট ধরে গোঙাতে লাগল অনির্বাণ। সুমন বলল, অভিনয় করিস না। মেয়ের নাম বল। অনির্বাণ নিশ্চুপ, কোন সাড়াশব্দ নেই। সুমন তাড়াতাড়ি পানি এনে মাথায় ঢালল। তবু সে সংজ্ঞাহীন। না, এ কোনো অভিনয় না।  দিনের পর দিন অনির্বানের আন্ত্রিক-ক্ষত এতটাই তীব্র হয়েছে, কেউ বুঝতে পারেনি। সে নিজেও কোনো চিকিৎসা করায়নি। সুমন পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগল। অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতাল, সেখানে যখন উন্নতি হলো না, আরও বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। অনির্বাণ একটিবারের জন্য চোখ খুলে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল। সেই চোখে বাঁচার কোনো আগ্রহ ছিল না। কৃত্রিমভাবে দুইদিন মাত্র বেঁচে ছিল। আলসার এতটাই ভয়ংকর রূপ নিল ডাক্তারের সাধ্যি হলো না তাকে সুস্থ করার।


সুমনের বিশ্বাস হচ্ছে না অনির্বাণ নেই। হঠাৎ কী হয়ে গেল! পৃথিবীটা এত তাড়াতাড়ি বদলে গেল। অনির্বাণ কোথায় গেল তাকে ছেড়ে। সে খুঁজে বেড়াতে থাকে তার বন্ধুকে। অনির্বাণের বাসায় যায়। তার রুমে ঢুকে। তার বসার টেবিল, বিছানা আর জামাকাপড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। এতগুলো দিন একসাথে থেকে, আজ সে বড্ড একা। অনির্বাণের কোনো ডায়েরি নেই। টেবিলের ড্রয়ারে কী রেখে গেছে কে জানে। ড্রয়ার খুলে প্রথমেই চোখে পড়ে একটি নুপূর আর একটি কানের দুল।



৪.


সুমন, অর্পিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। আজ কেউ কারও কাজে যায়নি। বৃষ্টি দেখার মাঝে একধরনের গবেষণা আছে। কেউ বৃষ্টির শব্দে আনন্দ খুঁজে পায়, কেউ আবার নিজেদের দুঃখ মেলাতে চায়। তারা দুজন অনির্বাণকে খুঁজছে। অনির্বাণ হয়তো এই বৃষ্টিকেও মানবে না, তাদের কাছে ছুটে চলে আসবে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। অনির্বাণ এত ভালোবাসে তাদেরকে, ছুটে চলে আসতেই পারে। হ্যা, দুজনকেই ভালোবাসেই সে।


অনির্বাণ ভার্সিটিতে একটি মেয়েকে পছন্দ করত। পছন্দের কথা মেয়েটিকে কখনোই বলতে পারেনি। পরে হয়তো কখনো বলতে চায়নি। মেয়েটি সুখে আছে তা দেখেই তার আনন্দ। বন্ধুর সাথে মেয়েটিকে মানাতও বেশ। মেয়েটি অর্পিতা। অর্পিতা কখনো বুঝতেই  পারল না। সুমনও পারল না। মাকড়সার জাল শুধু ঘরেই থাকে না। ঘরের বাইরেও থাকে। এমনভাবে থাকে বৃষ্টিও তাকে ভাঙতে পারে না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১৫১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast