www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তুমি নরসুন্দর আমি হলাম দাসী

গ্রামটা খুব বেশি চাকচিক্যময় না হলেও মনে ধরার মতো একটি গ্রামীণ গন্ধ এই গ্রামে লুকিয়ে আছে। গ্রামের পেছনে উত্তর-পুবের সীমানা ঘেঁষে কয়েক যুগ আগে যে নদীটা ছিল সেটার কথা কেউ কেউ জানলেও চরণ কখনও বলতে বা দেখাতে পারেনি। চরণের দক্ষিণমুখী বাড়িটির পেছনে আরেকটি বাড়ি, বেশিদিন হয়নি, ছেলে বিদেশে গিয়ে যা কামাচ্ছে তা দিয়েই ইট-সুড়কিতে নতুন উঠা পোক্ত বাড়িটি চরণদের বাড়িটিকে সাদামাটা করে দিয়েছে। চরণ এই গ্রামের ইতিহাস জানে না, সে শুধু জানে প্রতিদিন ভোরবেলা পায়ে হাঁটা কয়েক ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে বাজারে যেতে হবে। বাজারের পশ্চিম প্রান্তে ‘জগদীশ নরসুন্দর’ সাইনবোর্ড লাগানো দোকানটি হচ্ছে তার, তার বাবার হাতে গড়া এই বাজারের সুপ্রতিষ্ঠিত চুল কাটানোর দোকান এটি। কয়েকটি গ্রামের মানুষ এই বাজারের উপর নির্ভর করে চলে, পুরো বাজারে কয়েক বছর আগে একটিমাত্র সেলুন ছিল, এখন সেই সংখ্যাটি আট-এ দাঁড়িয়েছে।

যে কেউ চরণদের গ্রামে এলে প্রথমেই চোখ পড়বে ভাঙাচুরা একটি টিনশেড কালী মন্দিরের দিকে, প্রতি বছর এর পাশেই দূর্গা পূজার আয়োজন করে শীলবাড়ির মানুষজন, মাত্র কয়েক বছর হলো দাসবাড়ির লোকেরা তাদের সঙ্গেই পুজো দিচ্ছে। বাজারফেরত গ্রামের রাস্তাটা বিশাল এক রেইনট্রি গাছের কাছে এসে পৃথক হয়ে গেছে; সোজা উত্তর দিকে দাস বাড়ি, অন্যদিকে পুবে গিয়ে উত্তর দিকে গেলেই শীলবাড়ি। শীলবাড়ির প্রথম বাড়িটিই চরণদের। দক্ষিণমুখী বাড়িটির সামনে মাঝারি আকারের সাদা উঠোন; কাদা আর জলের দিন এলে আগের মতো অপ্রসন্নতা পোহাতে হয় না এখন। উঠোন পেরিয়ে আরও দক্ষিণে গেলে বিভিন্ন গাছের দেখা মেলে, বিশেষ করে মেলালুকা গাছটির কারণে তাদের এই জলাবদ্ধতা ধীরে ধীরে কমে এসেছে, এখন দিব্যি শুকনো ভূমি। এই গাছ ছাড়াও আম, কাঁঠাল আর সুপারি গাছের ছোট্ট একটা বাগান, তারও সামনে একটি পুকুর। পুকুরের অংশীদার শীলবাড়ির সকলেই। বর্ষার বৃষ্টিতে নতুন নতুন মাছ এই পুকুরে ভীড় জমায়। চরণ গভীর রাতে মাছ ধরে যখন ফিরে আসে তখন গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে থাকে। কেউ টের পায় না, চরণ নরসুন্দর যে এত ভালো  মৎসশিকারী।

এবার আষাঢ়ের ঊনো বৃষ্টি বাতাসে দাবদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে তরতর করে। রাতের বেলা চাঁদের আলোয় চরণদের উঠোন সাদা রঙের দ্যুতি ছড়ায়। খালি গায়ে অনেক পুরুষ এই উঠোনে বসে থাকে। বাজার থেকে এসে ঘরের আঁচে ফেরার আগে দেহটাকে শান্ত করে যায় তারা। অনেকে আছে কয়েক ডুব দিয়ে দৌড় দেয় বউয়ের আঁচলে। চরণদের ঘরে তেমন কেউ থাকে না, একটা মাত্র বোন ছিল, বিয়ে হয়েছে গত বছর। চরণ একা একা এই গরমে সাদা উঠোনে শুয়ে থাকে, চাঁদ দেখে, চাঁদ না থাকলে তারার দিকে চোখ মেলে মা-বাবাকে খুঁজতে থাকে। চরণের বিয়ে নিয়ে তেমন কেউ ভাবার নেই। বোনটাও বিয়ের পর আর আসতে পারিনি স্বামীর ঘর ছেড়ে। চরণের বয়স থেমে নেই, থেমে থাকে না চরণের বাজারে যাওয়া, ক্ষুর আর কাচির শিল্পে ফুটিয়ে তুলে হাতের কারুকার্য।

আষাঢ় মাসের কথা ভেসে বেড়ায় সবার মুখে মুখে, এবার বুঝি বৃষ্টি হবে না, বৃষ্টির নামে যে ঝড় আসে তা ঐটুক পর্যন্তই। ক্ষেত-খামার নিয়ে যারা আছে সবাই সারা রাত জেগে থাকে। সেচের জল কে আগে দিবে, এ নিয়ে বেশ কাড়াকাড়ি চলে। জেনারেটরের ভকভক শব্দে রাতের এক ঝাঁক নতুন জোনাকি পোকার টিমটিম আলোতে কোনো একজন পথিক এসে চরণকে খোঁজে।
-চরণ আছে, চরণ। জোরে জোরে হাঁক দিয়ে যায় সে।
সেই পথিকের সঙ্গে চরণ চলে যায়, এই খবরটা কারও চোখে পড়ে না। সবাই দিব্যি যার যার নিজের মতো করে চরণকে আরও একা করে দেয়। সে এই একাকীত্ব মেনে নিতে পারেনি, সে কাউকে খুঁজে বেড়ায় যার কাছে সে তার শৈশব মেলে ধরবে, কৈশোরের উচ্ছলতা দেখাবে, নতুন যৌবনের কাব্য শোনাবে।



 সেদিনের পরদিন, সূর্য দেখা যায় নি, পাখিরা কেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে। দাস বাড়ির টুম্পা ঘর থেকে বেরিয়ে সূর্যপ্রণাম করছে নিত্যদিনের মতো, চোখ ধোয় নি, কোনো মতে চোখ কচলে আকাশের দিকে মুখ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের গুরুম গুরুম আওয়াজে সে চোখ খুলে ভয় পেয়ে যায়! সূর্যের চিহ্নমাত্র নেই, হাজারো মেঘ জলভারে নেমে এসে টুম্পাকেই প্রণাম করতে চাইছে, বৃষ্টির শুরু; শ্রাবণের বৃষ্টি। গাছের পাতা ভিজিয়ে নিচ্ছে আর কতদিনের ধুলোদের ঝেড়ে ফেলছে, সবুজ যেন আরও সবুজ করে নিচ্ছে নিজেদের।
ভেতর থেকে ডাক আসে, টুম্পা, তুই কি এভাবেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি? রুটিগুলো কে বানাবে শুনি! ঘরে এসে তোর ভাইটির জন্য এখনই রুটি বানা, কিছুক্ষণ পরেই তো স্কুল। না খাইয়ে মারবি নাকি ভাইটিকে।
এই শুনতে শুনতে টুম্পার দিনাতিপাত, হাতে শখ করে পরা চুড়িগুলো খুলে হেঁশেলে চলে যায় সে। অভাবের সংসারে টুম্পার কাজ বেড়ে গেছে অনেক, বৃষ্টি দেখার বিলাসিতা তার জন্য হয় না। সকাল সকাল সংসারের কাজে ঘাম ঝরাতে হয়।

হোমিওপ্যাথির ব্যবসাটা শিকেয় উঠেছে অনেক আগে। প্যারালাইজড হয়ে বিছানার একপ্রান্ত নির্মল দাসের নামে লেখা হয়েছে বহুদিন। সংসারের চাল-ডাল কীভাবে আসছে বা কীভাবে আসবে, সেই খবর টুম্পা আর টুম্পার মা-ই জানে। ঘরের পেছনে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে ফলের বাগান, চৌর্যবৃত্তির পর যা থাকে সেগুলো হাটে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে সাংসারিক নাগপাশ এগিয়ে চলে। উঠোনের এক কোণায় বর্ধিষ্ণু কুল গাছে টুম্পার ছোট ভাইকে প্রায়শই পাওয়া যায়, এই গাছটি টুম্পার হাতে কোনো এক বর্ষায় লাগানো। বড়ই গাছ ঘেঁষে পুরোনো ঘাসের উপর নতুন একটি হাঁটার রাস্তা তৈরি হয়েছে, এই পথ ধরেই পূর্বানন্দ আসে। পূর্বানন্দরা এই গ্রামে অর্বাচীন আগন্তুক, জমি কিনে বাড়ি করেছে। সারা গাঁ হেটে বেড়ানোই তার কাজ; টুম্পাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসত, এখন নিয়মিত। নির্মলের খোঁজ-খবর থেকে শুরু করে টুম্পার হাঁড়ির সব খবর আহরণ করাটা মধ্যবয়স্ক পূর্বানন্দের নেশা হয়ে উঠেছে। এক দ্বিপ্রহরে টুম্পা তার বাগান থেকে জামরুল পাড়ছিল, পূর্বানন্দ নিচে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, তুমি এভাবে গাছে উঠলে লোকে কী বলবে, নিচে নেমে আস, আমি পেড়ে দিচ্ছি। এই বলে সে উপরে উঠে অদ্ভুত কায়দায় এক বাহুতে জড়িয়ে ধরে টুম্পাকে নিচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি এত কষ্ট করছ কেন? এত কোমল আর স্নিগ্ধ ত্বককে কেন নষ্ট করছ? টুম্পার হাতে গলায় হাত বুলিয়ে বলে গেল পূর্বানন্দ।

কয়েকদিন বাদে মা’র কাছে বাগানের দাদন নেওয়ার সংবাদ শুনে টুম্পা বেশ খানিকটা চুপসে যায়। বাড়ির সামনে ‘টুম্পার মা’ আছ নাকি বলে পূর্বানন্দ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে, এই সময়ে সবাই ঘুমিয়ে থাকে, এমনকি টুম্পার ভাইটিও। একটা লুডুর ঘর এনে টুম্পার হাতে দিয়ে বলে, চলো সাপ-লুডু খেলি। টুম্পা খেলতে থাকে। সাপের কামড় খেয়ে টুম্পা নেমে আসে বারবার, নিচে পড়ে থাকে অবিরত।
এই বছরের সব জল শ্রাবণ মাসে খসে পড়ছে প্রবল ধারায়। টুম্পা জানালার শিক ধরে বাগানটির দিকে তাকিয়ে থাকে, গাছগুলো কেমন নিশ্চুপ হয়ে ভিজে যাচ্ছে, স্যাঁতসেঁতে মাটির ভেজা গন্ধে সে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’র দূর্গাকে মনে পড়ে তার, কী উচ্ছল মেয়েটি শেষে কিনা মরে গেল। কোনো এক দূর গ্রাম থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, বৃষ্টির জল সেই ধোঁয়াকে মিশিয়ে নিচ্ছে তার সঙ্গে। গাছ-পালার আড়ালে কারও আগমনের ঝপাৎ ঝপাৎ পায়ের শব্দ শোনা যায়, টুম্পা কান খাড়া করে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি রাখে। ভেজা প্যান্ট-শার্ট আর জল ঢুকে পড়া জুতো নিয়ে সিক্ত কেঁপে উঠা ঠোঁটে ‘টুম্পা টুম্পা’ বলে ডাক দেয় অজানা পথিক। টুম্পা খুব একটা দেরি করে না। আদুল চরণে টুম্পা পথিকের পাশে এসে যখন দাঁড়ায় বৃষ্টি আরও বাড়তে থাকে, ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে এগিয়ে যায় তারা। পেছনে পড়ে থাকে কতদিনের মায়াজড়ানো বাপ-মার ভিটে মাটি, যে মাটির গন্ধ বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৪১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০৪/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আহমাদ মাগফুর ১৯/০৪/২০১৫
    ভাল লিখেছেন . শুভ কামনা.
  • ইকবাল হাসান ১৮/০৪/২০১৫
    সুন্দর লেখা...
  • ফারুক নুর ১১/০৪/২০১৫
    অনেক সুন্দর লেখা ।
  • ঐশিকা বসু ০৬/০৪/২০১৫
    লেখার মধ্যে সুন্দর মাটির ছোঁয়া পেলাম। খুব ভাল লাগল। লেখককে শুভকামনা।
 
Quantcast