www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

লোকটি

চার নম্বর চক্কর শেষে আমার প্রিয় বকুল তলার সিমেন্টে বাধানো বেঞ্চে বসতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে  এক  ভদ্রলোক শুয়ে আছেন, গত তিন মাস হোলো আমি রাতে পার্কে হাটতে আসি নিয়মিত, চারটা রাউন্ড দিয়ে এই বকুলতলার বেঞ্চটাতে বসে কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে আবার দুটো রাউন্ড দেই, তাতে কাটায় কাটায় ১২ মাইল হাটা হয়।  গত তিন মাসে এর ব্যাত্তয় হয়নি, এমন কি নির্দিষ্ট এই বেঞ্চে জিরিয়ে নেবার কাজটিরও অনিয়ম হয়নি কখোনো।  আজ হবে বলে মনে হচ্ছে।  ভাবছি লোকটাকে অনুরোধ করে একটু দূরে আরেকটি খালি বেঞ্চে গিয়ে শুতে বলবো নাকি, খানিকটা দ্বিধা কাজ করছে, প্রত্যুত্তরে কি বলে সেটা ভেবে, যদি যেতে অস্বীকার করে, কিংবা উলটো  আমি কেনো ওখানটায় বসছিনা জিজ্ঞেস করে, কিছুটা দিধাগ্রস্থ মন নিয়েই এগুলাম বেঞ্চটার দিকে, ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি বোঝা যাচ্ছেনা, আধশোয়া  ভঙ্গিতে একদমই নড়াচড়া নেই, কাছা কাছি যেতেই  বেঞ্চ লাগোয়া লাইট পোস্টটির আলো কেমন যেনো হঠাত উজ্জ্বল হয়ে উঠেই নিভে গেলো, আশে পাশের লাইটপোস্টগুলো সচল থাকলেও দূরত্ব বেশ খানিকটা  হওয়ায় যায়গাটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো, আমি চমকে উঠে থেমে গেলাম, লোকটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছেনা অথচ দূরত্ব দশ গজের বেশি হবে না,এই দূরত্বে সহজেই দেখা যাবার কথা, ভয় না পেলেও আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কেনো যেনো সাবধান করে দিলো আর এগূনো ঠিক হবে না, তা ছাড়া রাত প্রায় দশটা ,রাতে যারা হাটতে আসেন বেশিভাগই এর মধ্যে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন, ফাকা হয়ে আসছে পার্ক।  নানান ধরনের সুযোগসন্ধানী লোকজনের আনাগোনা বাড়বে এর পর । আশে পাশে তাকালাম দেখলাম  একটু দুরেই দুজন পুলিশের সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে আলাপে মগ্ন।  কিছুটা ভরসা পেয়ে এগিয়ে গেলাম ,আমার জন্য যে বিস্ময় টা অপেক্ষা করছিলো তা হোলো লোকটা সেখানে নেই,অথচ আমি কিন্তু পুলিশ দুটিকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরানো ছাড়া একবারের জন্যও লোকটার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাইনি,ব্যাপারটা কয়েক সেকেন্ডও না ,এর ভেতোরে একটা জলজ্যান্ত মানুষ  সরে হাওয়া হয়ে যাবে? এটা কিভাবে হয় ,উঠে চলে গেলেও আমার নজর এড়ানোর  কোনো সুযোগই নেই, মাত্র দশ গজ দুর থেকে আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম না! যেখানে তার দিকে লক্ষ্য রেখেই আমি এগিয়ে যাচ্ছি। গাটা কেমন ছমছম করে উঠলো, আরো এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চটার একদম কাছে গিয়ে দাড়ালাম,কোনো চিহ্নই নেই,এরপর যে ব্যাপারটা আমাকে আরো সন্ত্রস্ত করে তুললও তা হোলো আশপাশের যা তাপমাত্রা এতোক্ষন আমি অনুভব করছিলাম, বেঞ্চটার কাছের তাপমাত্রা তার তুলনায় বেশ ঠান্ডা , একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম, ঘুরে চলে আসার আগেই যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই,  অন্ধকারেও স্পষ্ট পড়লাম, বেঞ্চের কাঠের ব্যাক রেস্টের তক্তায় জ্বলজ্বল করছে সুন্দর হাতের লেখা যেনো কেউ ফসফরাস বা গ্লোইং কালিতে লিখে রেখেছে " আজ নয় অন্য কোনো দিন " চোখের সামনেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো লেখাটা। আর সেখানে দাড়ানোর মত মানসিক অবস্থা ছিলোনা আমার, দ্রুত ঘুরে পার্কের বের হবার গেটের দিকে অনেকটা দৌড় দিলাম বলা চলে।

দৌড়াচ্ছি আর আমার মনে হচ্ছে কেউ যেনো আমার পেছোন পেছন দৌড়ে আসছে, গেটের কাছে ছোট্ট একটা জটলা দেখে সাহস পেয়ে থামলাম,পেছন তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই, দারোয়ানটা সালাম দিয়ে বললও স্যার গাড়ী গেটে আনতে আনাউন্স করমু, তাড়াতাড়ি জানগা স্যার একটা ঝামেলা হইয়া গ্যেসে , আমি বললাম কি ঝামেলা? পার্কের ভিত্রে  লাশ পাওয়া গেসে স্যার, পুলিশরে খবর দেয়া হইসে হেরা আইয়া আবার কি প্যাজগি করে, রাইতে যারা হাটতে আয়, তাগোরেই তো জিগাইবো, দুইটা পুলিশ আইয়া লাশ পাহারা দিতাসে আওনের সময় দেহেন নাই? হ্যা দুজন পুলিশ দেখেছি কিন্তু কোনো ডেডবডিতো দেখলাম না, অবশ্য ওরা একটু দূরে ছিলো, বললাম আমি। অইহানেইতো , যানগা স্যার,  মাইকে ডাকমু ডেরাইভাররে?  আমি হাতের ইশারায় মানা করে,নিজেই কিছুদুর হেটে গাড়ীর কাছে গিয়ে দাড়ালাম, কি হচ্ছে আজ এইসব ! উত্তেজনা বা ভয় যে কোনো কারনেই আমি তখনো ঠিক ধাতস্ত হইনি চাবী বের করে ঠিকমত তা দিয়ে গাড়ীর দরজা খুলতে পারছিলামনা, নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিলাম আমি একজন পরিনত মানুষ সামান্য কারনে এতটা রিএক্ট করা বোকামি হচ্ছে, কিন্তু আমিতো নিজেকে চিনি, যা দেখেছি তাতো উড়িয়ে দিতে পারছিনা, দৃষ্টিভ্রমও হয়নি, আর আমি মাতালও নই,একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। কয়েকবার চেষ্টার পর দরজা খুলে গাড়ীতে বসলাম, স্টার্ট না দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম, মনে মনে পুরো ব্যাপারটার একটা রিভিউ করা দরকার । কি দেখলাম কি ঘটলো কোথায় কোথায় অস্বাভাবিকতা ছিলো, লোকটির হঠাত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আর জ্বলজ্বল করা লেখাটা মিলিয়ে যাওয়া ছাড়াতো আর কোনো অস্বাভাবিকতা ছিলোনা, হতে পারে যখন লাইটপোস্টের বাতিটা নিভে গেলো বা আমি যখন ঘাড় ঘুরিয়ে পুলিশদের দেখছিলাম সেই সময়ের হিসেবে গড়মিল ছিলো,আমার কাছে কম মনে হোলেও তা হয়তো একজন মানুষের উঠে সরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো । আর লেখার বিষয়টা হয়তো আলো আধারের ইলিউশন । অনেক আগে থেকেই ওখানে লেখা ছিলো , এখোনো আছে , আমার নড়াচরার কারনে আলোর প্রতিবিম্ব একবার লেখটার উপর পরেছে আবার সরে গেছে, যার কারনে তা একবার আমার দৃষ্টি গোচর হয়েছে আবার মিলিয়ে গেছে। মাথা থেকে মনে হোলো একটা পাথর সরে গেলো, নিজের এনালিসিসে নিজেই মুগ্ধ হয়ে,কিছুক্ষন আগে ভয় পাবার জন্য নিজেকেই মৃদু ধমকে দিলাম। স্টার্ট দিয়ে নিশ্চিন্তে গাড়ী ঘুরিয়ে বাসায় যাবার রাস্তায় উঠলাম, একটা ইউ টার্ন নিতে হয় আমাকে ফেরার জন্য, সেই ইউ টার্ন নেবার সময় পার্কে আমার প্রতিদিনের বসার জায়গাটা দেখা যায় স্পষ্ট, স্বাভাবিকভাবেই আমি একবার তাকাই জায়গাটার দিকে। আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ,একটু আগের করা এনালিসিস কে   বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, লোকটা সেই বেঞ্চটার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে, আমি এই দূরত্ব থেকেও তার মুখের চাপা হাসি বুঝতে পারলাম, কারন তখন আমার প্রিয় বকুল তলার বেঞ্চের পাশে  লাইটপোস্টের বাতিটা জ্বলছিল আর নিভছিলো।

স্বত্বঃসংরক্ষিত
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৯০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৬/১২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মোঃ মুলুক আহমেদ ০৬/১২/২০১৫
    অসাধারণ|
  • যতি পড়ি ততই মুগ্ধ হই।
  • ভাই, আমার তো ভয় করছে।
    • হাসান কাবীর ০৬/১২/২০১৫
      তাহলেতো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
 
Quantcast