www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নোনা জলের গল্প ২

সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলল উৎসব। ছেড়া দ্বীপে যেতে হলে দ্রুত খেয়ে ট্রলারে উঠতে হবে। চোখ খুলে মোবাইলের ঘড়িতে দেখি সময় সাড়ে আটটা। সাথে সাথেই না উঠে কম্বল গায়ে শুয়ে রইলাম। খানিক পরে উঠে দেখি শুধু উৎসব আর আমিই উঠেছি। ওয়াশরুমে ঢুকে ভাবলাম আবার শুয়ে পড়বো। কিন্তু বেরিয়ে দেখি সব উঠে পরেছে। আমার নাক বন্ধ। গত কাল ঠান্ডা লেগেছে। অনবরত পানি পড়েছে। আজকে সেটা কমেছে। তবে নাক বন্ধ থাকাটা পীড়াদায়ক।

ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করতে সৈকতের দিকে ছুটলাম। খাবারের অর্ডার দেয়া ছিল আগের রাতে যে হোটেলে খেয়েছি সেখানে। পরোটা, ডিম, সবজি খেলাম। খিদে পেয়েছিল ভালোই। খাওয়াও হলো বেশ। খাওয়া শেষ করার আগেই ট্রলারওয়ালা মামা তাড়া দিচ্ছিলো দ্রুত খাওয়া শেষ করে ট্রলারে যাওয়ার জন্য। তাই খাওয়া শেষ করেই ট্রলারের দিকে ছুটলাম। ট্রলার সৈকত থেকে একটু দূরে নোঙর করা থাকে। সেখানে যেতে হয় ডিঙি নৌকা করে। নৌকায় চড়ে ট্রলারে গিয়ে উঠলাম। আমাদের আমির আর উৎসব এর ট্রলারে ওঠা হলো এক দর্শনীয় দৃশ্য।

ট্রলার ছেড়ে দিলো। নীল জল চিড়ে বিকট শব্দে এগিয়ে যেতে লাগলো ট্রলার। আমরা ট্রলারে ১৮ জন। মোট চারটা গ্রুপ। আমরা ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চালকের হেল্পার মামা দূরে একটা অংশ দেখিয়ে বলল ওটাই ছেড়া দ্বীপ। রওনা হওয়ার প্রায় আধঘন্টা পর আমরা ছেড়াদ্বীপে পৌছুলাম। ওঠার মত একই কায়দায় ট্রলার থেকে সমুদ্র সৈকতে যেয়ে হয়। ট্রলারওয়ালা মামা বলে দিলো এক ঘন্টা পর আমরা ফিরবো।

আমরা বন্ধুরা মিলে এগিয়ে গেলাম ছেড়া দ্বীপের ভিতরের দিকে। মূলত প্রবাল, পাথর, বালুময় সৈকত, ঝোপ, পানিতে কাকড়া, শামুক এই নিয়েই ছেড়া দ্বীপ। সবচে সুন্দর এর পানি। পানি প্রায় কাঁচের মত স্বচ্ছ। আমি উৎসব আর ইশতিয়াক দ্বীপের আরেকপ্রান্তে গিয়ে পানিতে নেমে পড়লাম। অনেকখানি এগিয়ে একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো এই পানিতে নেমে একটা ডুব না দিলে ১৬ কলা পূর্ণ হবে না। শুধু টিশার্ট খুলে নেমে পড়লাম। কিন্তু এমনিতে ঠান্ডা লেগে আছে। এখন যদি আবার ভেজা মাথায় থাকি তাহলে যে কি সর্বনাশ হবে তার কোন ধারণা নেই। তাই ডুব আর দিলাম না। সৈকতে উঠে গেলাম। একঘন্টা প্রায় হয়ে গেছে। তাই বাকিদের উঠতে বলে আমি আর দ্বীপ ঘাটের দিকে এগোলাম।
আমরা পৌছে দেখি আমরাই প্রথমে। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় রইলো না। আমি আবার পানিতে নামলাম। হেটে অনেকদূর গিয়ে নামলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম পাথরের উপরে। হঠাৎ শুনি কে যেন ডাকছে। সেদিকে তাঁকিয়ে দেখি আমির, উৎসব, ইশতিয়াক, উৎস, সন্তুরা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।
আরো কিছুক্ষণ পর ডাঙা থেকে দীপ বলল বাকিরা চলে এসেছে ট্রলারে উঠতে হবে। এগিয়ে গেলাম ডাঙার দিকে। তারপর ট্রলারে উঠতে ডিঙিতে চড়তে হবে। মাথায় হঠাৎ ভূত চাপলো, ডিঙিতে করে না। হাটু পর্যন্তই তো পানি, আমরা দু জন হেটে গিয়ে ট্রলারে উঠবো। খানিকটা বেশ ভালোই এগোলাম। তারপর পানি বেটে প্রায় কোমর ছুঁয়ে ফেলল। আরো খানিকটা যাওয়ার পর ডুবো পাথরে খেলাম হোচট। পেলাম ব্যাথা। হাটু গেল কেটে। আর হেটে ট্রলারে ওঠার শখও গেল মিটে। ডিঙিতে চড়ে বসলাম। তারপর সহিহ তরিকায় ট্রলারে উঠলাম।
আমাদের গন্তব্যে পৌছুলাম কোন ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু সৈকতে যাওয়ার জন্য ডিঙিতে চড়ার আগে মাথায় আবার ভূত চাপলো। ডিঙিতে যাবো না। চালক মামা বললেন, এখানে পানি অনেক। ঠাই পাবো না। ঠিক আছে, সাতরে যাবো। কোন চাপ নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। দীপের কাছে জ্যাকেট আর স্যান্ডেল বুঝিয়ে দিয়ে লাফ দিলাম পানিতে। সাতরে চলে গেলাম সৈকতে।

রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার ফিরে গেলাম সৈকতে। দুপুরের খাবার খেয়ে উৎসবরা আবার পানিতে নামার প্ল্যান করছে। আমরা দ্রুত খেয়ে নিলাম। আবার, সেই ব্যপক খাওয়া দাওয়া। খেয়ে আমি বাদে সবাই আবার পানিতে নামলো। আমার জ্বর জ্বর লাগছিলো, তাই আর নামলাম না। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা সন্তুকে বালু চাপা দিবো। আমি সবাইকে বুদ্ধি দিলাম প্ল্যানে একটু পরিবর্তন আনার। গর্ত সন্তুর জন্যই খোঁড়া হবে। কিন্তু চাপা দেবো নাইমকে। গর্ত খোঁড়া শুরু করলো সবাই। নাইমও হাত লাগালো। আমি আর সন্তু বাদে সবাই হাত লাগালো। আর অনেকটা খোঁড়া হয়ে যাওয়ার পর নাইমকে হাত পা ধরে গর্তে বালু চাপা দিয়ে দেয়া হলো। পুরো চাপা দেয়া হলে আবার তুলে সমুদ্রে বিসর্জন দেয়া হলো।
ওদের জলকেলি যেন কোন অনন্ত মুহূর্ত। শেষ হতে চায় না। সূর্যও ডুবতে শুরু করে দিলো। কিন্তু ওদের ওঠার নাম নেই। আমি সবার মানিব্যাগ, মোবাইল, সানগ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর উৎস উঠে রুমে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আবার চলেও এলো। আমি ওর হাতে সবার মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে গোড়ালি সমান পানিতে গিয়ে দাড়ালাম। চোখের সানগ্লাসটা খুলে পকেটে ঢোকালাম। হাত দুটো বুকের কাছে বেঁধে সূর্যাস্ত দেখতে দাঁড়িয়ে গেলাম। সমুদ্রের নোনা জল আমার পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। খানিক পর পর। সূর্য ডুবছে। আকাশটা অদ্ভুত একটা বর্ণ ধারণ করেছে। লাল আবার লাল নয়। কমলা, আবার তাও না। হলুদও বলা যাবে না। আবার বললেও ভুল বলা হবে না। এই সৌন্দর্য আমার চোখের সামনে এই প্রথম। এক সময় টুপ করে ডুবে গেল। আমি যেন কোন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। হুশঁ ফিরতে দেখি পা প্রায় ছ'ইঞ্চি বালুর নিচে। আর পানি প্রায় হাটু ছুয়ে ফেলেছে। জোয়ার আসছে। গর্জন বাড়ছে সমুদ্রের। বঙ্গোপসাগরের।

বালু থেকে পা বের করে সবাই মিলেই রুমে গেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোব। উদ্দেশ্য আগের দিনের মাছ ভাজা খাওয়া। ফানুস নিয়েই বেরোলাম। একটা ফানুস কটেজের পাশে ফাঁকা যায়গায় ওড়াতে চাইলাম। কিন্তু গাছে বেঁধে গেল। এরপর গেলাম সৈকতে। সেখানে তো ফানুস উড়লো ঠিকই। কিন্তু আগুন ধরে গেল। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে কপাল খারাপ আজকে। তাই মীন গ্রহণের নিমিত্তে অগ্রসর হইলাম। সমুদ্রের তীর ধরে। উৎসবের কাঁধে বুম বক্সটা। আকাশের দিকে তাঁকিয়ে দেখি আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর দৃশ্য। অমাবশ্যার আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলজল করছে। আমরা হাটছি তারাও আমাদের সাথে হাটছে। আর উৎসবের কাঁধের বুম বক্স থেকে ভেসে আসছে অর্ণবের কন্ঠে, "তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো..." তারার রঙ নীল ছিল কিনা জানিনা। কিন্তু ওই মুহূর্তে জীবন ছিল সুন্দরতম।

মাছের দোকানে পৌছে মাছের দরদাম করে ১৬ টা চিংড়ি আর একটা মাঝারি সাইজের স্যামন ভাজতে বলা হলো। স্যামন খাওয়ার পর মনে হলো, এই মাছ এইটুকু খেলে আঁশ মিটবে না। তাই একটা বড় সাইজের স্যামন কেটে ভাজতে বলা হল। ওইদিকে খাবার হোটেলের মামা বলেছেন নটায় যেতে। আর ঘড়িতে তখন আটটা চল্লিশ। মাছ কেটে ভেজে খেয়ে শেষ করে দেখি সাড়ে নটার কিছু বেশি বাজে। দ্রুত দাম মিটিয়ে রওনা দিতে গিয়ে দেখি জোয়ারের পানি বেড়ে অনেক উপরে চলে এসেছে। মোটামুটি যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আমাদের যাওয়ার পথ মনে হয় বন্ধ। মাছওয়ালা মামাকে জিজ্ঞেস করতে মামা বললেন যাওয়া যাবে এই পথেই।
মোবাইলের আলো জ্বেলে চলা শুরু করলাম। স্যান্ডেল হাতে। অনেকটা যাওয়ার পর দেখি পানি হাটু সমান। তখন পাশের পাথরের উপর দিয়ে হেটে এগিয়ে গেলাম। এমনি করে অনেকটা যাওয়ার পর আবার বালু পেলাম। কিন্তু সমুদ্রের গর্জন অনেক বেড়েছে। সগর্বে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব।
একটা ফাঁকা যায়গা পেয়ে আমরা আবার দুটো ফানুস উড়িয়ে দিলাম। এবার ঠিকঠাকই উড়লো। তারপর আবার এগোনো। হাটতে হাটতে পৌছে গেলাম আমাদের সমুদ্র সৈকতে। সরাসরি খাওয়ার হোটেলে ঢুকলাম। ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর ডিম খেয়ে রুমে ফিরে গেলাম আমি। খুব ঠান্ডা লাগছে। আর জ্বর জ্বরও লাগছে। রুমে এসে লেখা শুরু করলাম। লেখা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রায় রাত একটা বেজে গেল। শুধু সন্তু রুমে এসেছে। বাকিরা বাইরে। হটাৎ সন্তুকে ফোন দিয়ে বলল আমাদের বাইরে যেতে। জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই মিলে সভা বসিয়েছে। ট্যুর পর্যালোচনা। আমি আলোচনা শেষ না করেই চলে এলাম। কারণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রুমে ফিরে এসে লেখাটা শেষ করছি।
আমাদের রুম দুটো সমুদ্র সৈকত থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তবুও কানে আসছে সমুদ্রের গর্জন। কাল বিকেল তিনটার শিপে টেকনাফ ফিরবো। সেখান থেকে কক্সবাজার। জানিনা কবে আবার সেন্টমার্টিন'স আসবো। তবে আসবো সেটা নিশ্চিত। কিন্তু ততদিন সমুদ্রের গর্জন আর বালুতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গল্পের আবেগ ছড়িয়ে বেড়াবো এখানে সেখানে।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৯৫০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/০১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast