www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নাফাকুম কই ৩

সকালে ঘুম ভাঙলো জানালা দিয়ে ঢোকা আলোতে। বাইরে চোখ পড়তে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরি ঝিড়ি বৃষ্টি। মোবাইলে সময় দেখলাম সকাল সাতটা। রুমের অনেকেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি দলের অনেকেই আরো ঘন্টা দুই এর মধ্যে ঘুম থেকে উঠবে না। তাই কম্বল জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরেরবার ঘুম ভাঙলো নয়টার কিছু পরে। উঠে বসে দেখি আমার রুমে আমি একাই ঘুমাচ্ছি। আর সবাই উঠে গেছে। পাশে ঘুমিয়েছিল উৎসব, সে পাশে নাই। অর্থাৎ উঠে গেছে। আমি বিছানা ছেড়ে বাইরে গিয়ে দেখি উৎসব দাঁড়িয়ে বারান্দায়। ব্রাশ হাতে। আমিও ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বৃষ্টি এখনো কমেনি। পুলক আর সজিব জানালো, ১২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এর মধ্যে বৃষ্টি না কমলে বৃষ্টি মধ্যেই বেরিয়ে যাবো।

১১ টার দিকে গাইড জয়দা জানালেন মাঝিদের থানচি যেতে হবে। এখনই রওনা না দিলে তারা নতুন ট্রিপ পাবে না। বাধ্য সবাই তখনই রওনা দিলাম। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রলারে উঠবো। সজিব এসে জিজ্ঞেস করল সজারুর মাংস খাবো কি না? আমি না বলে দিলাম। এরপর ট্রলারে উঠলাম। আমার সাথে উৎসব, আইরিন, জুজু আর শান্ত।

কিছুদূর যেতেই বৃষ্টি শুরু। সেই আগের মত। ঝিরি ঝিরি। বৃষ্টির মধ্যেই এগোতে থাকলাম। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট পাড়ায় ট্রলার থামানো হলো। সজারুর মাংস খাওয়া হবে। সবাই অল্প বিস্তর খেলো। নদীর তীরেই দেখলাম মাছ পোড়ানো হচ্ছে। আমি সকালে কিছু খাইনি। তাই চানাচুর নিলাম এ প্যাকেট। সাথে চা। হঠাৎ বাইরে থেকে উৎসব ডাকলো। মাছ খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। লাফিয়ে উঠলাম। আমরা দুজনে দুটো মাছ খেলাম। একটার দাম রাখলো ৬০ টাকা, অন্যটা ৮০ টাকা। এই মাছের স্বাদ আমি কোন দিন ভুলব না।

এরপর আবার যাত্রা শুরু। পথে আরেকটা পাড়ায় থামা হলো। তারপর আবার চলা। এবার নামলো ঝুম বৃষ্টি। মোবাইল উৎসবের পলি ব্যাগে দিয়ে আমি মাথায় পলিথিন দিয়ে বসে রইলাম। একটু পর শুরু করলাম হেড়ে গলায় গান। মাঝি মামাও শুরু করলো। আকাশেতে লক্ষ তারা, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, মনের মানুষ, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া, ও আমার বন্ধু গো, হৃদয় একটা আয়না এই রকম অনেক গান। থানচি ঘাটে যখন পৌছাই তখন আমার প্যান্ট পুরোটা, টি শার্ট শুধু ঘাড় বাদে বাকিটা ভিজে গেছে।

থানচিতে আবার আমরা খেয়ে নিলাম। কয়েকজন খেলাম ভাত বাকিরা ‘মুন্ডি’ নামক নুডুলস সদৃশ স্থানীয় খাবার খেতে গেল। আমাদের ফেরত যাওয়ার চান্দের গাড়ি আগেই চলে এসেছে। সেই আগের গাড়ি দুটোই। এবার আমি পিছনে সবার সাথে বসলাম। উৎসব সামনে ড্রাইভার মামার পাশে।

পিছনে আমার এক পাশে পুলক অন্য পাশে জুজু। জুজু বেশ অসুস্থ বোঝা যাচ্ছে। দুপুরে মেয়েটা কিছু খায়নি, রাস্তায় বমি হবে এই ভয়ে। সজিব গাড়ির উপরে উঠে বসছে। জিনি তাকে পেছন থেকে ধরে রেখেছে। একটু পর দেখা গেল একটা গামছা দিয়ে সজিব কে গাড়ির সাথে বাঁধছে। জামিল আর ওম গাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে। গাড়ি চলছে। এর মধ্যে একটা বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। অদ্ভুত বিয়ে। আমাদের এক বন্ধুকে আরেক বান্ধবীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। এই মহান দায়িত্ব পালন করলেন জামিল সাহেব। গারীতে মেডিকেল কমিটির শান্তও ছিল। চোখে কম দেখা আইরিনও ছিল। দোলন ছিল, সোহানা ছিল আর ছিল পাহাড়ি মদ। খানিক পরেই শুরু হলো মদ খাওয়া। মদ খেয়ে ঝাকড়া চুলের এক বন্ধু রীতিমত কথক হয়ে গেল। দুনিয়ার এহেন কোন বিষয় নেই সে কথা বলেনি। আর আরেকজন পানি টানি না মিশিয়ে শুধু মদ খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেল। কিন্তু শুধু মদ তাকে দেয়া হবে না। এই জন্য রীতিমত মন মালিন্য হয়ে গেল।

পথে আমরা নীলগিরিতে, চিম্বুক পাহাড়ে থামবো কথা ছিল। কিন্তু এতো কুয়াশা ছিল যে প্রথম এক যায়গায় থেমে আর থামার কথা কেউ বলেনি। যত উপরে উঠতে লাগলাম ততই কুয়াশা বাড়তে লাগলো। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলোও কমে গেছে। সামনের রাস্তা কিছু দেখা যায় না। আমি মনে মনে ভাবছি ড্রাইভার মামা গাড়ি চালাচ্ছে কিভাবে? মনে মনে নিজেকে সাজেশন দিয়ে ফেললাম যেকোন মুহূর্তে আমি নিজেকে গাড়ি সহ শূন্যে আবিস্কার করবো। এদিকে কুয়াশার সাথে সাথে শীতও বেড়ে গেল। লাগলো ক্ষুধাও। আইরিন নুডুলস বের করে দিলো। তা ভেঙে গুড়ো করে তাতে বিস্কুট ভাঙা, মটর ভাজা, বাদাম, নুডুলস এর মশলা ইত্যাদি মিশিয়ে চানাচুরের মত কিছু একটা বানানো হল। রেসিপি দিলো শান্ত, বানালাম আমি। খেয়ে ফেললাম সবাই মিলে।

ওইদিকে কথক টাল বন্ধু পরের বছরের ট্যুরের প্ল্যান করে ফেলল। আর শুধু মদ খেতে চাওয়া বন্ধুটা প্রচন্ড শীতের মধ্যে গাড়ির পেছনে হেল্পারের সাথে ঝুলতে লাগলো। হাজার বার বলার পরেও সে গাড়িতে এসে বসলো না। অনেকক্ষণ পর সে গাড়িতে এসে আমাদের বকাবকি করতে লাগলো আমরা কেন তাকে ভেতরে বসতে দেই নি।

শীত বেড়ে যাওয়ার কারনে মদ খাওয়ার পরিমান বেড়ে গেল। প্রায় অন্ধ(চশমা পড়ে এবং চশমা না পড়ে) এক বন্ধু টাল হয়ে গেল। সে ইমোশনাল টাল। সে আবার নিয়মিত মদ্যপ না। টাল হয়ে গেলে সে বাচ্চাদের মত আচরণ করে। ৬ ধাপের সিড়ি বেয়ে উঠতে তার প্রায় পাঁচ মিনিট সময় লাগে। মজার ব্যাপার হল সে যে টাল হয়ে গেছে আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তাই একটু দুষ্টুমি করে ঝাড়ি দিতেই শান্তর কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলল।

শীতটা তখন বেশ জাকিয়ে বসেছে। আর গাড়ি চলার কারণে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। আমি আইরিনের একটা কম্বল পেঁচিয়ে বসলাম। যদিও আইরিন সেটাকে চাঁদর বলে দাবি করে। তবুও শীত কমে না। মাঝে একবনার যাত্রা বিরতি দেয়া হল। তখন উৎসব এসে জানালো ড্রাইভার মামাও পথের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সে নিজে স্বীকার করেছে সে আন্দাজে গাড়ি চালাচ্ছে। বলে রাখা উচিত, ড্রাইভার মামার বয়স খুবই কম, সে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে এখন উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে থাকতো। এর পরে মনে হয় আর বুঝিয়ে বলা লাগে না যে কি রকম মনের অবস্থা নিয়ে গাড়িতে বসে ছিলাম বাকি রাস্তা।

গাড়ি চলছে। আমি রাস্তার দিকে তাঁকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো আমরা কোন গোলক ধাঁধাঁয় ঘুরছি। একই রকম দেখতে ব্রিজ, রোড সাইন পার করলাম কয়েকবার। এই ধারনাটা অনেকক্ষণ থাকলো মনের মধ্যে। অনেকক্ষন পর যখন বান্দরবান শহরের আলো দেখতে পেলাম তখন ভুল ভাঙলো। প্রায় রাত আটটার দিকে আমরা বান্দরবান বাস স্ট্যান্ডে পৌছাই। পেছনে ফেলে এসেছি ৭৩ কিলোমিটার পথ। গুগল বলছে সময় লাগে ২ ঘন্টা ৪৯ মিনিট। আর আমাদের লেগেছে প্রায় চার ঘন্টা। ঘন কুয়াশার কারণে গাড়ি চলেছে চান্দের গাড়ির স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে।

বাস স্ট্যান্ডে পৌছে সবার আগে বাসায় ফোন দিলাম। তারপর এককাপ চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে আইরিন আর উৎসব কে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। চা খেয়ে বের হয়ে দেখি বাস চলে এসেছে। সাড়ে নটায় ছাড়বে। ব্যাগে বাসে রেখে পুলক কে বললাম রাতে খাওয়ার জন্য ডাকতে। তারপর সিটে বসে পড়লাম। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছিল। আমার পাশে বসেছিল সোহানা নামের শিশু টা। ওর সাথে টুকটাক কথা বলছিলাম। একটু পর পুলক এসে খেতে ডাকলো।

খাওয়া শেষ করে দই এর সন্ধানে গেলাম। কোন এলাকায় নতুন গেলে তাদের দই খাওয়া আমার অন্যতম শখ। আগেরবার বান্দরবান এসে সময় পাইনি। এবার দই পেলাম। কিন্তু সে দই বরফ হয়ে আছে। বলল পাঁচ মিনিট পর ঠিক হয়ে যাবে। দাম দিয়ে বাসে উঠলাম। মিনিট দশেক পর বাস ছেড়ে দিল। আমি জুতো মোজা খুলে স্যান্দেল পড়ে ফ্রি হয়ে বসলাম। কিন্তু দই বাবাজি বরফই রয়ে গেলেন। সোহানা বলল গুতো দিয়ে বরফ ভাঙতে। তাহলে নাকি গলে যাবে। তাই করলাম কিন্তু বরফ পুরোপুরি গলল না।

এক সময় চোখে ঘুমের মুখোশ পরে ঘুমিয়ে গেলাম। রাস্তায় দুই এক যায়গায় হয়তো বাস থেমেছে। কিন্তু আমার ঘুম একবারই ভেঙেছে বিরতির সময়। কানে ইয়ারফোন গুঁজে পড়ে ছিলাম। বের হইনি। পানি কম খেয়েছিলাম ইচ্ছা করেই। তাই প্রকৃতিও ডাকলো না এবার।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাস শিশু পার্কের পাশ দিয়ে চারুকলার দিকে যাচ্ছে। আমি গা থেকে কম্বল সদৃশ চাঁদরটা সরিয়ে আইরিন কে ফেরত দিলাম। সব গুছিয়ে নিতে নিতে বাস চারুকলার সামনে চলে এলো। বাস থেকে নামার জন্য এগিয়ে গেলাম। নামতে নামতে মনে শুধু একটাই কথা এলো, “ট্যুর শেষ হয়ে গেল। আবার ব্যাচ ট্যুরের জিন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হবে!”

বাস থেকে নেমে ছোট পণ্ডের(ত্রিভু) পাশে বসলাম। কিছুক্ষন কথা বার্তা বলে সবাই যার যার বাসা বা হলের দিকে এগোল। কেউ কেউ দেবালয়ের দিকে। আমি আর উৎসব এক সাথে বেরিইয়ে এলাম। আইরিন আগেই চলে গেছে। একটা রিকশা নিয়ে উৎসব চলে গেল। আমিও একটা রিকশা নিয়ে চলে এলাম হলে।

লিখছি ১৩ ডিসেম্বর রাত ৩টা ২৯ মিনিটে। কিন্তু এখনো সব ভাসছে চোখের সামনে।

২৪ ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের ট্যুর শেষ হলো। পিছনে রয়ে গেল তারিখ ঠিক করা নিয়ে শত সহস্র মিটিং, প্রায় ৪০ জন হিসেব করে ৩১ জন নিয়ে ট্যুরে যাওয়া, বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়ার পথে ড্রাইভার মামার সাথে গল্প, থানচি থেকে সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রি যাওয়ার পথের উত্তেজনা, রেমাক্রি থেকে নাফাকুম যাওয়ার পথের জোক আর বগা লেকের রূপকথা, নাফাকুম থেকে রেমাক্রি ফিরে বারবিকিউ করা, হাল্কা মাতাল হয়ে মরার মত ঘুমানো, কটেজের জানালা থেকে সাঙ্গু নদী আর পাহাড়, থানচি ফেরার পথে মাছের বারবিকিউ, হেড়ে গলায় গান গাওয়া, থানচি থেকে বান্দরবান বাস স্ট্যান্ডে ফেরার পথে উত্তেজনা আরো কত কিছু। এতো কিছু কি সহজে ভুলে যাবো। নাফাকুম হয়তো আর কোন দিন যাবো না। কিন্তু মন যে এখনো পড়ে আছে সাঙ্গু নদীর ডুবো পাথর ভরা বাঁকে, রেমাক্রি খালের না দেখতে পাওয়া ডুবো পথে আর নাফাকুমের জলকেলিতে...

তরীকুল ইসলাম সৈকত
১১-১২-১৭
(শেষ)
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৮৮৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৬/১২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast