www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নাফাকুম কই ১

চারুকলায় যখন পৌছুলাম তখন সম্ভবত নয়টা বাজে। আমি আর উৎসব। গিয়ে দেখি জিনি, সজিব, মিম, শারমিন সহ বেশ কয়েকজন আগেই এসে বসে আছে। আমাদের দেখার সাথে সাথেই সবার একটা চাওয়া, টি-শার্ট!' অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে আরো কয়েকজন চলে এলো। আইরিন এলো ওর বাবার সাথে। আমি আর উৎসব আঙ্কেলকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে রাতের খাবার খেতে চানখাঁর পুল গেলাম। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখি প্রায় সবই চলে এসেছে।

টিশার্ট দিয়ে দিলাম যারা চলে এসেছে সবাইকে। সবাই টিশার্ট পরে ছবি তোলা শুরু করলো। আমিও যোগ দিলাম। গ্রুপ সেলফি তোলাটা বেশ আবেগ দিলো। টিশার্টের ডিজাইন করেছিল বন্ধু জাহিদ জামিল। এরপর বেশ আড্ডা হলো। কিন্তু বাস আসছে না। বাসের কোন খবরই নাই। সবাই চলে এসেছে। যে যার মত আড্ডা দিচ্ছে। তারমাঝেই আমি একটা 'একক সঙ্গীত সন্ধ্যা' করে ফেললাম গিটার হাতে। তারস্বরে ইচ্ছে মত চেচিয়ে উলটা পালটা গিটার বাজানো যাকেকে বলে আর কি! মাথায় ছিল একটা কাউবয় হ্যাট।

হঠাৎ দেখি চারুকলার দুই নাম্বার গেটে শ্যামলী পরিবহনের লাল বাস দেখা যায়। তখন রাত এগারোটার বেশি। আমরা মানুষ ২৯ জন। হঠাৎ কই থেকে রবিন আর সোহান এসে হাজির। তারাও যাবে। বাস ৩৬ সিটের। আমরা ২৯ জন। তো নেয়াই যায় ওদের। ওদেরও টিশার্ট দেয়া হল। মোট টিশার্ট ছিল ৩৫ টা। বাকি গুলো রেখে দেয়া হল গাইডদের দেয়ার জন্য।

এবার হেড কাউন্টের পালা। দেখা গেল যারা নাস্তা আনতে গিয়েছিল তারা ছাড়া সবাই আছে। বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম সবাই। পুলক আর জামিল গেল ব্যানার লাগিয়ে দিতে। বাসে গিয়ে বসতেই দেখি সবাই উঠে গেছে। বাস ছাড়লো ১২ টা ৩৬ মিনিটে। সায়েদাবাদ দিয়ে বের হতেই জ্যামে পড়ে গেলাম। আর তখন সবাই কে নাস্তা দিয়ে দিল হেলাল।

এদিকে বাসের ভেতর ব্যাপক ধূমপান ও গান বাজনা চলছে। গানের যেন কোন শেষ নাই। নাচানাচিও চলছে। আমিও যোগ দিলাম। বেশ অনেকক্ষন নাচানাচির পর দেখি আর এনার্জি পাচ্ছি না। বুঝলাম বাসে ওঠার আগে 'একক সঙ্গীত সন্ধ্যা' আর তার আগে সারাদিন দৌড় ঝাপের ফল। অগত্যা বাসের সিটটা নামিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। পাশেই চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর মাথার উপর আলোয় কি ঘুম আসে সহজে? তার উপর আবার বাস আছে জ্যামে আটকে। বাসের সব জানালা লাগানো। লাগছে গরম। জানালা খুলে দিতেই দেখি বাহিরে কার যেন বংশ উদ্ধার হচ্ছে। এমকি শ্বশুর বাড়িকেও বাদ দিচ্ছে না। মনযোগ দিতেই বুঝলাম একটা মালবাহি গাড়ি আরেকটা এসি বাসের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। তাই নিয়েই এতো কান্ড। পুরো রাস্তা ব্লক করে এরা একে অন্যের বংশ উদ্ধার করছে। আর জ্যাম লেগে আছে। আমাদের ড্রাইভার মামা চৌকশ ড্রাইভার। কিভাবে যেন পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে গেল। আমি জানালা লাগিয়ে দিয়ে চোখে স্লিপিং মাস্ক লাগিয়ে দিলাম ঘুম। খুব ক্লান্ত লাগছে কিন্তু ঘুম আসছে না। উত্তেজনায় সম্ভবত।

এরপর যখন ঘুম ভাঙলো তখন গাড়ি একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি সিট ছেড়ে বাস থেকে নামতে গিয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। নামবো কিনা ভাবতে গিয়ে দেখি প্রকৃতি করুন সুরে ডাকছে। সারা না দিয়ে উপায় নাই। বাধ্য হয়ে নামলাম বাস থেকে। ডাকে সারা দিয়ে কফি খাবো ভাবছি তখন মনে হল এখন কফি খেলে ঘুমের বারোটা বেজে যাবে। মাত্র বাজে সাড়ে চারটা। কফি খেলে ঘুম পালাবে। আর কাল সারা দিন বিশাল পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই আবার সিটে গিয়ে বসলাম। বন্ধু শান্ত চিপস নিয়ে এলো এক প্যাকেট। বেশ কয়েকজন মিলে খেয়ে ফেললাম সেটা। আইরিন তখন আরো দুই প্যাকেটের জন্য টাকা দিলো। শান্ত আবার নিয়ে এলো চিপস। আবার খেলাম। এই চিপসের নাম দেয়া হল 'হরিলুটের চিপস!' বন্ধু উৎসব তখন বেশ ঘুম। আমিও ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লাম। বাস ছেড়ে দিয়েছে।

পরের বার ঘুম ভাঙলো বলাটা ঠিক হবে না, হেলালের চিৎকারে কিছুটা ঘুম ছুটে গিয়েছিল। ওর চিৎকারটা ইগনোর করতেই ঘুম চলে এলো আবার। এরপর চুড়ান্ত ঘুম ভাঙলো বান্দরবান শহরে ঢোকার একটু আগে। বাসের ঘুম সব সময়ই বেশ ঝরঝরে ঘুম হয়। এই প্রথম আমার বিরক্ত লাগলো ঘুম ভাঙার পর। যাই হোক বাইরে তাঁকিয়ে দেখি পাহাড় কেটে বা পাহাড়ের গায়ে রিসোর্ট, বাজার, বাড়িঘর। দেখতে দেখতে চলে এলো 'রেইচা ক্যাম্প।' অতি পরিচিত রেইচা ক্যাম্প। গত বার বিশাল ঝামেলারর সূত্রপাত হয়েছিল এখান থেকেই। সেই গল্প আরেকদিন। এবার আর এখানে কোন ঝামেলা হল না। এগিয়ে গেলাম। একবারে বান্দরবান বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে নামলাম। সকাল ১০ টা। সেখানে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে 'আজমেরী হোটেল এন্ড রেস্তোরাঁ'য় সকালের নাস্তা সারলাম। ভাত, আলুভর্তা ডাল। আগেই আমাদের চান্দের গাড়ি চলে এসেছিল। গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছাড়লো তখন সাড়ে এগারো টা।

আমি বসেছিলাম ড্রাইভার মামার পাশে। মামার সাথে বেশ আড্ডা হলো পুরো পথ জুড়েই। আর এর মাঝেই চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছিলো বান্দরবানের সৌন্দর্যময় প্রকৃতি। এই রূপ যে নিজের চোখে না দেখেছে তাকে কি বোঝানো সম্ভব? আর যে দেখেছে তার কাছে কি কোন বর্ণনাই এই রূপের সমার্থক মনে হবে?

১২ মাইল নামক এক যায়গায় রাস্তা দুভাগ হয়ে দুই দিকে চলে গেছে। একটা রুমা বাজার-বগালেকের দিকে। আরেকটা চলে গেছে থানচি রেমাক্রির দিকে। চান্দের গাড়ির গন্তব্য থানচি। সেই পথেই আর্মি ক্যাম্পে গাইডের নাম, আমাদের ঠিকানা, আমরা কত জন কই যাচ্ছি এই সব লিখে আবার যাত্রা শুরু। এবারের পথ সম্পূর্ণ নতুন। এর আগের পথ টুকু গত বছরের চেনা।

আমরা যখন থানচি পৌছুলাম তখন ঘড়ির কাটা আড়াইটা ছুঁই ছুঁই। সেখানে পর্যটন অফিসে নাম ধাম জমা দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে ট্রলারে উঠলাম। গন্তব্য রেমাক্রি। সেখান থেকেই নাফাকুম। থানচি থেকেই আমাদের সাথে মিলিত হয়েছে আমাদের গাইড জওয়াই ফ্রো মারমা আর উত্তম কান্তি দে।

ট্রলার এক আজিব জিনিস। চালক আর হেল্পার সহ টোটাল সাতজন বসতে পারে। সরু এক নৌকার মত। যাদের আফ্রিকান 'ক্যানু' সম্পর্কে ধারণা আছে তারা এই জিনিসের ভালো চিত্র পাবেন মনে মনে। তো এখন সেই জিনিসে করে যাওয়া লাগবে ডুবে পাথরে ভরা সাঙ্গু নদীর বুক চিরে রেমাক্রির দিকে। থানচি ঘাট ছাড়ার আধ ঘন্টা পরেই আর কোন টেলিকম কোম্পানীর নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল না। অল্প কয়জন পাহাড়ির জন্য তাদের এতো টাকা খরচ করার মানে হয় না। যদিও সব দোষ তাদের না। যাতায়াতের অবস্থা প্রতিকূল।

রেমাক্রি যাওয়ার পথে যে দৃশ্য আমি দেখেছি আর এতে আমার যে আফসোস তৈরী হয়েছে তা নিয়ে আমি মোটামুটি 'ডিপ্রেসড!' এই দৃশ্য আমি কেন বিশ বাইশ বছর বয়সে দেখছি আরো আগে কেন দেখিনি! জীবন যেখানে পূর্ণতা খুঁজে পায়। আর জীবনকে ভালোবাসায়। এই দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার সাহস আমার নেই।

রেমাক্রি পৌছুলাম প্রায় সন্ধ্যার দিকে। সঠিক সময় মনে নেই। ঘড়ি দেখিনি। এখানে এসে তো আমি অবাক। শুনে এসেছি স্থানীয় পরিবারের সাথে থাকতে হবে, নেটওয়ার্ক তো থাকবেই না বিদ্যুৎও থাকবে না, মোবাইল চার্জ দেয়ার কোন ব্যবস্থা নাই। কিন্তু এখানে কটেজ আছে, জেনারেটর আছে; মোবাইল চার্জ দেয়া যায়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা অসাধারণ। এখানে স্যাটেলাইট চ্যানেল নেটওয়ার্কও আছে। এটা বগা লেকের চাইতেও রেমাক্রি অনেক বেশি ভিতরের দিকে। কিন্তু বগা লেকের চাইতে এখানের সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।

এই লেখা যখন লিখছি তখন রাত বারোটা বেজে তিন মিনিট। কটেজের বিছানায় শুয়ে শুনতে পাচ্ছি স্রোতস্বিনী সাঙ্গু'র স্রোতের শব্দ। কাল সকালে রওনা দেবো নাফাকুমের দিকে। তো, নাফাকুম কই?

তরীকুল ইসলাম সৈকত।
৯/১২/২০১৭

(চলবে)
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৮৪১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/১২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আলম সারওয়ার ১২/১২/২০১৭
    অসাধারণ একটি উপহার
    শুভেচ্ছা থাকল আমার
 
Quantcast