সমুদ্রের সৈকত ও একটি পরীর বাচ্চা
পিচ গলা রোদ বলতে একটা কথা আছে। পায়ের চটি জোড়া ভারী ভারী লাগছে। মনে পিচ গলে চটির তলায় লেগে আছে। চটি জোড়া আমাকে মিথিলা দিয়েছে। তাই জোরে জোরে পা ফেলছি। যেহেতু মিথিলার দেয়া চটি। তাই চটি যদি কষ্ট পায় তাহলে মিথিলাও কষ্ট পেতে পারে। আর মিথিলার ধারনা ওকে কষ্ট দিয়ে আমি নাকি পৈচাশিক আনন্দ পাই। আসলেই পাই কিনা পরীক্ষা করে দেখছি। অবশ্য এই কড়া রৌদ্রের মধ্যে অকারনে হেটে নিজেকে কষ্ট দিয়ে এক ধরনের পৈচাশিক আনন্দ আমি আসলেই পাচ্ছি। এই আনন্দের তীব্রতা এতবেশি যে আমি মিথিলাকে কষ্ট দেয়ার মধ্যে আনন্দ পাই কিনা তা বুঝতে পারছি না। জ্ঞানের কথা বলি, মানুষ সবচে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। তাই যে মানুষটা নিজেকে কষ্ট দেয়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় তাকে বেশ সাহসী বলতে হবে।
তবে আমি বিরাট ভিতু মানুষ। বাস প্রচন্ড গরমের মধ্যে অকারণে দাড়িয়ে থাকলেও আমি ড্রাইভারকে কিছু বলি না। বরং পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের, গলার আর ঘাড়ের ঘাম মুছি। তারপর শার্টের একটা বোতাম খুলে ঠোট গোল করে বুকে ফু দিই। এই ফু এর বাতাস বিচিত্র। কখনো ঠান্ডা। আবারবার কখনো গরম।
নিজের অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করি। পরিস্থিতি কতটুকু বুঝিয়ে বলতে পারবো জানিনা। নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেই সন্দিহান। তবে এধরনের অবস্থায় আমি মাঝে মাঝেই পড়ি।
বেশ নরম একটা সোফায় বসে আছি। দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারনে তন্দ্রাভাব আসছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঘুমিয়ে যাই। যদিও এক কাপ চা আর একটু স্যুপ খেয়েছি। চা টা সর ভাসা ছিল। দোকানে গিয়ে "মামা মালাই মাইরা চা দিও তো!" বলার পর মামা যে চা দেয়া হয় সেই ধরনের চা। মামার দোকানে কোন দিন কোন ভদ্র। গোছের কাউকে এধরনের চা চাইতে দেখিনি। তাই ভেবেছিলাম আমার মত পাবলিকই শুধু এই চা খায়। মানে অভদ্রের চা। মিথিলাদের বাসায় এই চা আবিস্কার করবো সেটা ভাবতে পারিনি। ঘুম ঘুম লাগার আরেকটা কারন হলো এ বাড়ির এসি। আমি আজ পর্যন্ত খুব কম যায়গায়ই সঠিক পাওয়ারে দেয়া এসি পেয়েছি। আর এ বাড়িরটা সঠিকের চেয়ে বেশি সঠিক।
আমার বসে থাকার কারন হলো মিথিলার বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন বলতে, নিজে ফোন করেছেন। পিএস টাইপ কাউকে দিয়ে ফোন করান নি। আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন জানিনা। মিথিলা যে দেয়নি সেটা নিশ্চিত। কারন মিথিলা ওর বাবার সাথে শেষ কথা বলেছে প্রায় দুই বছর আগে।
মিথিলার বাবার নাম আমি জানিনা। তাই নাম উল্লেখ করতে পারছি না। তবে মানুষটা ব্যক্তিগত জীবনে সফল। দু হাতে টাকা কামিয়েছেন। হুলস্থুল বড়লোক বললেও কম হয়।
আর সেই মানুষটা যদি আমাকে এক দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখে তাতে অভিমান করার কিছু নাই। বরং হাসি মুখে বসে থাকা উচিত। আর আমি তাই করার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎই মনে হচ্ছে মিথিলা পাশে এসে বসেছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাই। বাচ্চা ছেলের মত। আমি অস্ফুটভাবে ভাবে মিথিলাকে ডাকলাম,
-"মিথিলা!"
মিথিলা সাড়া দিলো কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে মিথিলার গায়ের চিরচেনা সেই স্নীগ্ধ গন্ধে আমার চারপাশটা ভরে গেল। আমি আবার ডাকলাম,
-"মিথিলা!"
মিথিলা কি জবাব দেবে?
চোখ মেলেই মিস্টি একটা হাসি দিলাম। সামনে যে মানুষটা বসে আছে, প্রথম দেখায় মনে হবে পুলিশ কমিশনার বা আর্মির রাঘব বোয়াল কেউ। জাঁদরেলি গোঁফে বেশ সুন্দর মানিয়ে গেছে। গায়ে একটা হাওয়াই শার্ট। মনে হচ্ছে কোন রাঘব বোয়াল ছোট মাছ খেতে এসেছেন। অবধারিত ভাবে ছোট পুটি মাছটা আমি।
-"কেমন আছেন....."
বলেই আটকে গেলাম। কি বলে সম্বোধন করবো। চাচা নাকি আঙ্কেল। প্রেমিকার বাবাকে কেউ খালু বলে ডেকেছে শুনিনি। অগ্যতা 'জনাব' বেছে নিলাম।
-"কেমন আছেন জনাব?"
উনি অবাক হলেন বলে মনে হলো না। তবে আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
-"ঘুম কেমন হলো?"
-"জ্বী জনাব। উত্তম নিদ্রা!"
-"প্রায় এক ঘন্টা ঘুমিয়েছ তুমি।"
-"আমি দুঃখিত জনাব!"
-"তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছো?"
-"না জনাব। আসলে প্রথমে খুঁজে পাইনি কি সম্বোধন করবো। তাই সবচে ভদ্র সম্বোধনটাই বেছে নিলাম।"
উনি আমার দিকে সর্প দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলেন। আমি বললাম,
-"পানি খাবো!"
আমাকে পানি দেয়া হলো। আমি পানি খাওয়ার পর মিথিলার বাবার সাথে স্বল্প দৈর্ঘ্যের আলোচনা হলো। অর্থনৈতিক আলোচনা। কি পরিমান অর্থ পেলে মিথিলার চারপাশ থেকে আমি সরে যাবো। আমি অবশ্য বলেছিলাম,
-"জনাব আমি ওর চারপাশে থাকি না। রাস্তায় হাটার সময় ও আমার ডান পাশে আর আমি ওর বাম পাশে থাকি।"
এতে তিনি আমার দিকে যে দৃষ্টি দিয়েছেন তাতে আমার হিউম্যান ফ্রাই হয়ে যাওয়ার কথা। আমি অপ্রস্তুত ভাবে বললাম,
-"জনাব উল্লেখ করতে ভুলে গেছি রিকশায়ও একই নিয়মে বসি। এবং অবশ্যই হুড তোলা থাকে।"
শেষ পর্যন্ত আমরা একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে এসে পৌছেছি। এবং বলাই বাহুল্য ওই অর্থ আমি নিতে রাজী হয়েছি। এবং সানন্দে। এমনিতেও মিথিলার বাবা কেন পৃথিবীর কোন বাবাই আমার কাছে মেয়ে দিতে রাজী হবে না। তাই শুধু শুধু টাকা পায়ে ঠেলার মানে হয়না।
মিথিলাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পরই মনে হলো অর্থের সাথে একটা বাহন দাবি করলেও হতো। কষ্ট করে রোদে ঘুরাঘুরি করা লাগতো না। শীট ম্যান!!
বাহন নাই। পা আছে। আমার আঞ্চলিক ভাষায় 'পাও।' আমার বড় চাচাকে প্রায়ই চাচিকে বলতে শুনতাম,
-"ডাইন পাও দিয়া লাত্তি মাইরা মাজা ভাইঙ্গা দিমু!"
আমি আমার পাও ব্যবহার করে নিউ মার্কেটের দিকে হাটা দিলাম। বিশাল পথ হাটতে হবে। আমি "হেইয়ো জোয়ান! হেইয়ো!" বলে হাটা শুরু করলাম।
হেইয়ো জোয়ান বলার কারনেই হয়তো দেহের ভিতরে আসুরিক স্ট্যামিনা চলে এলো। দু'ঘন্টার কিছু কম সময়ে ঢাকা কলেজের সামনে চলে এলাম।
ঢাকা কলেজ থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত এলাকাটুকু আমার অদ্ভুত রকম ভালো লাগে। নানা ধরনের মানুষ। হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক ফুলিয়ে হাটা ছাত্র থেকে 'বাইচ্ছা লন ১০০!' বলে হাক দেয়া রোদে পোড়া অন্যরকম সৌন্দর্যের মামাও আছে। তাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন গুলো আলাদা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ স্বপ্ন দেখে।
যে মাঝি রোজ আপনাকে আমাকে ছোট্ট নদীটা পার করায় সেও। সে স্বপ্ন দেখে হয়তো, যে তার ছেলে জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে। রোজ কলেজ বা ভার্সিটি যাওয়ার পথে লোকাল বাসে যে মামা ভাড়া নেয় আমরা তাকে 'হেল্পার' বলি। শব্দটা ইংরেজীর হলেও সেটা এখন বাংলারই। এই মামাও স্বপ্ন দেখে। আজ সে যে বাসের ভাড়া কাটে ঠিক সেই রকম একটা বাসের মালিক হবার স্বপ্ন। জ্যামের ভেতর গাড়ি থামলে যে অন্ধ।ভিখারী দুটি টাকা চেয়ে থালা বাড়িয়ে দেয়; জানেন, স্বপ্ন সেও দেখে। কাল সকালে একটু ভাত মাংস খাওয়ার স্বপ্ন।
এরা সবাই স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখে বলেই এরা বেঁচে আছে। থাকে। থাকবে।
নিউমার্কেট এর ওভার ব্রীজের উপরে কতক্ষন বসে ছিলাম জানি না। অনেক্ষন হবে। পর পর দু'টো আওয়াজ শুনেছি। অনেক দিন পর এভাবে বসে আছি। ওভার ব্রীজের নিচ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। তবে ইদানিং খেয়াল করছি সব গুলো বাস নতুন নতুন লাগছে। ভালো করে খেয়াল করতেই টের পেলাম আসলে গাড়ি সব পুরানো। শুধু নতুন করে রঙ লাগানো হয়েছে। আফসোস লাগলো কিছুটা। রঙ উঠে গেছে। মরিচা দেখা যাচ্ছে। রঙ করে দাও সব নতুন।
হঠাৎ করেই মনে হল মানুষ না হয়ে গাড়ি হয়ে জন্মালে খুব একটা খারাপ হতো না।
খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কিছুই পেলাম না খুঁজে। আসলে আমি কি খুঁজছি? টাকা? কিন্তু আমিতো জানি আমার পকেটে টাকা নেই। তাহলে? সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ তো। বেঁচে থাকাটাই আমাদের অনেকের কাছে সহজাত প্রবৃত্তি। বেঁচে আছি বলেই বেঁচে আছি। কোন উদ্দেশ্য নেই। শুধুই বেঁচে থাকা। তানজিনা ঠিকই বলতো,
"তুমি মরে গেলেও তোমার কোন আফসোস হবে না। রিয়েলি ইউ আর গুড ফর নাথিং!"
আমি হাসতাম। কখনো কখনো অট্টহাসি। আজও হাসলাম। আধো আলো আধো আধারিতে অট্টহাসি।
নিউ মার্কেটে আমার যাতায়াত অনেক বেশি। সেটা মিথিলার জন্য হোক বা নীলক্ষেতে বই কিনতে যাওয়ার জন্যই হোক। আর এখনও আমি সেই নিউ মার্কেটেই দাড়িয়ে। ওভার ব্রীজটার ঠিক নিচে। রোড ডিভাইডার এর উপর দাড়িয়ে। রাস্তার ওপারে যাবো কিনা ভাবছি। ওপাশে একটা বাচ্চা কাঁদছে। সাদা ফ্রক পড়া। মাথায় একটা ঝুটি। পরীর বাচ্চার মত লাগছে। প্রথম দেখায় তাই ভেবেছিলাম। কোন পরীর বাচ্চা বোধ হয় ভুল করে নিউ মার্কেটে নেমে গেছে। আর তারপরই উড়তে ভুলে গ্যাছে। কিন্তু কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ভুল। মেয়েটার থুতনিতে একটা কাটা দাগ আছে। পরীর বাচ্চার নিশ্চই থুতনিতে কাটা দাগ থাকবে না। ইচ্ছে করলেই মেয়েটার কাছে যেতে পারি। কিন্তু কি হয় সেটা দেখার প্রতি আরো বেশি আগ্রহ বোধ করছি। হয়তো মেয়েটার বাবা চলে আসবে কিংবা মা। তারপর হাসি মুখে তারা বাসায় চলে যাবে। যাওয়ার সময় হয়তো একটা আইসক্রিমও খাবে। হঠাৎই আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হলো। কাপ আইসক্রিম।
ছোট বেলায় বাবার কাঁধে চড়ে আইসক্রিম খেতাম। একবার বাবা আর মা আমাকে রেখেই বই মেলায় চলে গিয়েছিল বলে অনেক গুলো বই ছাড়াও চারটা আইসক্রিম খাইয়ে কান্না থামিয়েছিল বাবা। কাপ আইসক্রিম।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও মেয়েটার বাবা-মা কেউই আসছেন না। আমি রাস্তা পাড় হয়ে এগিয়ে গেলাম। চুল গুলো একটু ঠিকঠাক করে নিলাম নিজের। মেয়েটার সামনে দাড়িয়ে বললাম,
-'তুমি কি পরীর বাচ্চা?'
মেয়েটা মাথা নাড়লো।
-'তুমি পরী চিনো?'
এবারও মাথা নাড়লো। তবে এই মাথা নাড়ানো হ্যা বোধক।
-'পরীর কি থাকে বলো?'
-'তুমি কে?'
-'আমি সৈকত। সাগর চিনো? সেই।সাগরের সৈকত। মানে সাগরের পাড়। যেখানে সবাই দাড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখে। আর তোমার সাইজের বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হিসু করে। অনেক সময় বড়রাও করে।'
-'সূর্য ডোবে কেন?'
-'সূর্যর গোসল করতে হবে না??? সারা দিন বাইরে থেকে গায়ে ধূলা লেগে যায় তো তাই গোসল করার জন্য ডুব দেয়।'
-'ওই পানিতে তো বাচ্চারা হিসু করে। সেখানে সূর্য গোসল করে?? ইয়াক!!!'
পরীর বাচ্চাটা নাক কুঁচকে ফেলল। অবশ্য আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখানে তীব্রব অ্যামোনিয়ার গন্ধ। পরীর বাচ্চার নাক কুঁচকে ফেলা স্বাভাবিক। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-'তোমার আম্মু কই? মার্কেটের ভেতরে? কেনাকাটা করছে?'
-'না। আম্মু তো শুয়ে আছে। আম্মুর হাতে অনেক গুলো পাইপ লাগানো। নাকেও আছে একটা।'
-'আর আব্বু?'
-'আব্বু আম্মুর পাশে বসে আছে।'
-'আম্মু শুয়ে আছে কেন?'
-'জানিনা। আম্মু জানো আমার সাথে কথা বলে না।'
-'কেন বলেনা?'
-'জানিনা।'
-'তুমি তো দেখি কিছুই জানো না।'
পরীর বাচ্চার কথা পরিস্কার না। তবে যেহেতু এটা নিউমার্কেট এলাকা সেহেতু পরীর মা-আর বাবা খুব সম্ভবত ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তারা তাদের মত থাকুক। আমার এখন আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। পরীর বাচ্চা কে জিজ্ঞেস করলাম,
-'আইসক্রিম খাবে?'
সে উজ্জ্বল সম্মতি জানালো। আর জানালো সে 'কুন' আইসক্রিম খাবে। লাঠি আইসক্রিম খাবে না। লাঠি আইসক্রিম ভালো না। গলে হাতে লেগে যায়। জামা ময়লা হয়।
পকেটে টাকা নাই। গড়ের মাঠ। আইসক্রিম কিভাবে খাবো জানি না। আমি পরীর বাচ্চা কে কাঁধে তুলে নিলাম। গন্তব্য আমার আবাস স্থল। 'আকবর আলীর 'মেচ।'
মেস ম্যানেজারের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো তা নয়। কিন্তু লোকটা আমাকে পছন্দ করে। সে বিপত্নিক মানুষ। একা থাকে। আমি পরীর বাচ্চাকে নিয়ে ম্যানেরজার সাহেবের ঘরে গেলাম। নক করতেই বিরক্তি মাখা কন্ঠে অতি মধুর ধ্বনি শোনা গেল,
-'ওই কোন **র *ত রে?'
-'ম্যানেজার সাহেব আমি সৈকত।'
দরজা খুলে গেল। মানুষটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া। গেঞ্জিতে লাল লিপস্টিকের দাগ।
-'আপনে? কুন সমস্যা?'
-'আমাকে দুটো আইসক্রিম খাওয়াইতে পারবেন? একটা 'কুন' আরেকটা কাপ?'
ম্যানেজার ভ্রু-কুঁচকে তাঁকিয়ে আছেন।
-'সত্যিই আপনে আইসক্রিম চাইতে আইসেন?'
-'হ্যা ভাই। চিরন্তন সত্য। প্রেজেন্ট ইন্ডিফিনিট টেন্স।'
-'আচ্ছা। আপনে ঘরে যান। দশ মিনিটের মইধ্যে আইসক্রিম হাজির হইবো!'
সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পর আমার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি মেসের সামনে একটা কাঠের বেঞ্চ আছে সেটায় একজন লোক বসে আছেন। শাদা শার্ট, কালো স্যুট, কালো টাই, কালো প্যান্ট পড়ে এক বসে আছে। আমি ডান হাতে লুঙ্গির এক কোনা তুলে হাম্মাম খানার দিকে রওনা দিলাম। এই সময় হাম্মাম খানা ফাঁকা পাওয়ার কথা। একই সাথে প্রাকৃতিক কর্ম আর গোসল দুটোই সেরে ফেলা যাবে। কাজ কর্ম শেষ করার পর ঘর থেকে গামছা আনতে ঢোকার সময় লোকটা বলল,
-"আপনি সৈকত সাহেব?"
আমি হেসে বললাম,
-"সাহেব নই। তবে আমার নাম সৈকত। বাকি কথা ঘর থেকে গামছা এনে তারপর বলি?"
উত্তরের অপেক্ষা করলাম। লোকটা বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। গামছা নিতে নিতে একবার ভাবলাম আর বের না হলে কেমন হয়। কিন্তু গামছা নিলাম। এবং বের হলাম।
-"বলুন।"
-"আপনার নামে একটা ইনভেলাপ আছে।"
-"ও। আপনি তাহলে পোস্ট ম্যান! বাংলাদেশে ডাক বিভাগ কি পোস্ট ম্যানদের পোশাক চেঞ্জ করেছে? স্যুট প্যান্ট পড়িয়ে দিয়েছে? অবশ্য বিচিত্র কিছু না। এরচেও বিচিত্র কাজ এদেশে হয়।"
-"স্যরি মিস্টার সৈকত। আপনি ভুল করছেন। আমি আবেদ আহমেদ স্যারের পিএ।"
-"আবেদ সাহেব লোকটা কে?"
-"আপনি কাল যার বাসায় গিয়েছিলেন। একটু স্যুপ আর মালাই দেয়া চা খেয়েছেন"
-"দিন খাম দিন। তারপর ফাঁকে যান!"
-"স্যরি... কোথায় যাবো?"
-" গাড়িতে করে এসেছেন না? খামটা আমাকে দিয়ে গাড়ির দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যান।"
লোকটা আমাকে খামটা দিয়ে মোবাইল বের করতে করতে চলে গেলেন।
আমি খামটা খুললাম না। রহস্য থাকুক। হুমায়ূন স্যার প্রায়ই বলতেন, "প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।"
[ঘরে পরীর বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। তাকে বাবা-মা'র কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। আমি ওর মাথায় হাত রাখতেই চোখ খুলে তাঁকালো। আমি বললাম,
-"মায়ের কাছে যাবে না?"
পরীর বাচ্চা মাথা নাড়লো। হ্যা সে যাবে।
পরীর বাচ্চার সাথে রিকশায় উঠলাম। ঢাকা মেডিকেল। ১২০ টাকা ভাড়া। পকেটে ১২ টাকাও নাই। রিকশা ভাড়া কেমনে দিবো জানিনা। পরীর বাচ্চা আমার পাশে বসে আছে। আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে আছে।
আচ্ছা সৃষ্টিকর্তা কি আমাকেও একটা এমন মেয়ের পিতা করবেন? যে মেয়েটা অবিকল পরীর বাচ্চার মত হবে? হিমুদের স্বপ্ন দেখার অনুমতি দেয়া হয়নি। আমি যেহেতু হিমু নই তাই এই নির্দোষ স্বপ্নটা আমি দেখতেই পাই। কাল রাতে পরীর বাচ্চাটা যখন আম্মার বুকের উপর ঘুমিয়ে ছিল তখন আমি জেগেই জেগেই এই স্বপ্নটা দেখছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেই স্বপ্নে পরীর বাচ্চার কোন মা ছিল না।
ঢাকা মেডিকেল এর সামনে নামার আগে পরীর বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-'তোমার আব্বু-আম্মু কি এখানেই আছে?'
পরীর বাচ্চা আবারো মাথা নাড়লো। এবারো উত্তর হ্যাবোধক। নামার পর পরীর বাচ্চাই আমাকে পথ দেখালো।
মহিলা ওয়ার্ডের বিছানায় শোয়া মহিলাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। অবিকল মেয়ের মত চেহারা। পরী-মা ঘুম। পরী বাবা আশেপাশে নাই। আমি চেয়ারে বসলাম। পরী-মা চোখ খুলে তাঁকালেন। প্রথমে আমাকে তারপর তার মেয়েকে দেখলেন। চোখে উজ্জ্বল আভা। কিন্তু কিছু বললেন না। আমিও চুপচাপ বসে রইলাম।
কিছুক্ষন পরেই জ্বীন সাহেব এলেন। মানে পরীর বাচ্চার বাবা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। চোখে জল। আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
-'আপনি ভাই মানুষ না। ফেরেশতা। আপনি আমার ধর্মের ভাই। আজকেই জিডি করতে যামু ভাবছিলাম।
ওর মা কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করেই। চিকিৎসার পিছনে সব টাকা শেষ। কিন্তু কোন ফল নাই। চিন্তায় চিন্তায় আমি শ্যাস। সারা দিন ওর মার পিছনে থাহি। সিঞ্জি চালাইতাম। বউ লাইগা হেইয়াও বাদ দিছি। ভালোবাইসা বিয়া করছিলাম। বড় ভালো পল্লী গীতি গাইতো। আর অহন তো কতাই কইবার পারে না।'
-'ভাই আমি মানুষ না সত্যি কথা। কিন্তু ফেরেশতা না। অমানুষ।'
মিথিলার বাবা আবেদ আহমেদ সাহেবের দেয়া খামটা আমি জ্বীন সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম।
-'ভাই এর ভিতরে একটা চেক আছে। বেশ কিছু টাকা আপনি পাবেন। সঠিক অঙ্কটা আমি জানি না।'
-'ভাই আমি লাগলে রক্ত বেইচা চিকিৎসা করামু। কিন্তু কারুর দান আমি নিমু না।'
-'রক্ত বেচে এই যুগে বেশি টাকা পাওয়া যায় না। আর আমাকে ধর্মের ভাই ডাকছেন না? আপনার বিয়েতে তো কিছু উপহার দিতে পারি নাই। এইটা বিয়ের গিফট।'
জ্বীন সাহেব খামটা নিলেন। আমি বললাল,
-'ভাই সাহেব কালকে আমি আপনার মেয়েকে ৫৫ টাকার একটা 'কুন' আইসক্রিম খাওয়াইছি। সেই টাকাটা কি পাবো?'
তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম,
-'ভাই দিবেন? না দিলে বলেন। আমি চলে যাই।'
তিনি পকেট থেকে আমাকে ৬০ টাকা দিলেন। আমি আমার পকেট থেকে দুই টাকার দুটো নোট বের করে দিলাম।
-'স্যরি ভাই আমার কাছে এক টাকা ভাংতি নাই।'
বলে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করলাম।
শহীদ মিনারের সামনে বসে আমার মোবাইল থেকে সীম দুটো খুলে ফেলে দিলাম। মিথিলার সাথে আর যোগাযোগ করা যাবে না। মেসও বদলে ফেলতে হবে। মিথিলার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। একদম নেটওয়ার্কের বাইরে।
★ফেসবুকে আপনার মন্তব্য জানান এখানে,
'সমুদ্রের সৈকত ও একটি পরীর বাচ্চা'
তবে আমি বিরাট ভিতু মানুষ। বাস প্রচন্ড গরমের মধ্যে অকারণে দাড়িয়ে থাকলেও আমি ড্রাইভারকে কিছু বলি না। বরং পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের, গলার আর ঘাড়ের ঘাম মুছি। তারপর শার্টের একটা বোতাম খুলে ঠোট গোল করে বুকে ফু দিই। এই ফু এর বাতাস বিচিত্র। কখনো ঠান্ডা। আবারবার কখনো গরম।
নিজের অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করি। পরিস্থিতি কতটুকু বুঝিয়ে বলতে পারবো জানিনা। নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেই সন্দিহান। তবে এধরনের অবস্থায় আমি মাঝে মাঝেই পড়ি।
বেশ নরম একটা সোফায় বসে আছি। দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারনে তন্দ্রাভাব আসছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঘুমিয়ে যাই। যদিও এক কাপ চা আর একটু স্যুপ খেয়েছি। চা টা সর ভাসা ছিল। দোকানে গিয়ে "মামা মালাই মাইরা চা দিও তো!" বলার পর মামা যে চা দেয়া হয় সেই ধরনের চা। মামার দোকানে কোন দিন কোন ভদ্র। গোছের কাউকে এধরনের চা চাইতে দেখিনি। তাই ভেবেছিলাম আমার মত পাবলিকই শুধু এই চা খায়। মানে অভদ্রের চা। মিথিলাদের বাসায় এই চা আবিস্কার করবো সেটা ভাবতে পারিনি। ঘুম ঘুম লাগার আরেকটা কারন হলো এ বাড়ির এসি। আমি আজ পর্যন্ত খুব কম যায়গায়ই সঠিক পাওয়ারে দেয়া এসি পেয়েছি। আর এ বাড়িরটা সঠিকের চেয়ে বেশি সঠিক।
আমার বসে থাকার কারন হলো মিথিলার বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন বলতে, নিজে ফোন করেছেন। পিএস টাইপ কাউকে দিয়ে ফোন করান নি। আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন জানিনা। মিথিলা যে দেয়নি সেটা নিশ্চিত। কারন মিথিলা ওর বাবার সাথে শেষ কথা বলেছে প্রায় দুই বছর আগে।
মিথিলার বাবার নাম আমি জানিনা। তাই নাম উল্লেখ করতে পারছি না। তবে মানুষটা ব্যক্তিগত জীবনে সফল। দু হাতে টাকা কামিয়েছেন। হুলস্থুল বড়লোক বললেও কম হয়।
আর সেই মানুষটা যদি আমাকে এক দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখে তাতে অভিমান করার কিছু নাই। বরং হাসি মুখে বসে থাকা উচিত। আর আমি তাই করার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎই মনে হচ্ছে মিথিলা পাশে এসে বসেছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাই। বাচ্চা ছেলের মত। আমি অস্ফুটভাবে ভাবে মিথিলাকে ডাকলাম,
-"মিথিলা!"
মিথিলা সাড়া দিলো কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে মিথিলার গায়ের চিরচেনা সেই স্নীগ্ধ গন্ধে আমার চারপাশটা ভরে গেল। আমি আবার ডাকলাম,
-"মিথিলা!"
মিথিলা কি জবাব দেবে?
চোখ মেলেই মিস্টি একটা হাসি দিলাম। সামনে যে মানুষটা বসে আছে, প্রথম দেখায় মনে হবে পুলিশ কমিশনার বা আর্মির রাঘব বোয়াল কেউ। জাঁদরেলি গোঁফে বেশ সুন্দর মানিয়ে গেছে। গায়ে একটা হাওয়াই শার্ট। মনে হচ্ছে কোন রাঘব বোয়াল ছোট মাছ খেতে এসেছেন। অবধারিত ভাবে ছোট পুটি মাছটা আমি।
-"কেমন আছেন....."
বলেই আটকে গেলাম। কি বলে সম্বোধন করবো। চাচা নাকি আঙ্কেল। প্রেমিকার বাবাকে কেউ খালু বলে ডেকেছে শুনিনি। অগ্যতা 'জনাব' বেছে নিলাম।
-"কেমন আছেন জনাব?"
উনি অবাক হলেন বলে মনে হলো না। তবে আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
-"ঘুম কেমন হলো?"
-"জ্বী জনাব। উত্তম নিদ্রা!"
-"প্রায় এক ঘন্টা ঘুমিয়েছ তুমি।"
-"আমি দুঃখিত জনাব!"
-"তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছো?"
-"না জনাব। আসলে প্রথমে খুঁজে পাইনি কি সম্বোধন করবো। তাই সবচে ভদ্র সম্বোধনটাই বেছে নিলাম।"
উনি আমার দিকে সর্প দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলেন। আমি বললাম,
-"পানি খাবো!"
আমাকে পানি দেয়া হলো। আমি পানি খাওয়ার পর মিথিলার বাবার সাথে স্বল্প দৈর্ঘ্যের আলোচনা হলো। অর্থনৈতিক আলোচনা। কি পরিমান অর্থ পেলে মিথিলার চারপাশ থেকে আমি সরে যাবো। আমি অবশ্য বলেছিলাম,
-"জনাব আমি ওর চারপাশে থাকি না। রাস্তায় হাটার সময় ও আমার ডান পাশে আর আমি ওর বাম পাশে থাকি।"
এতে তিনি আমার দিকে যে দৃষ্টি দিয়েছেন তাতে আমার হিউম্যান ফ্রাই হয়ে যাওয়ার কথা। আমি অপ্রস্তুত ভাবে বললাম,
-"জনাব উল্লেখ করতে ভুলে গেছি রিকশায়ও একই নিয়মে বসি। এবং অবশ্যই হুড তোলা থাকে।"
শেষ পর্যন্ত আমরা একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে এসে পৌছেছি। এবং বলাই বাহুল্য ওই অর্থ আমি নিতে রাজী হয়েছি। এবং সানন্দে। এমনিতেও মিথিলার বাবা কেন পৃথিবীর কোন বাবাই আমার কাছে মেয়ে দিতে রাজী হবে না। তাই শুধু শুধু টাকা পায়ে ঠেলার মানে হয়না।
মিথিলাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পরই মনে হলো অর্থের সাথে একটা বাহন দাবি করলেও হতো। কষ্ট করে রোদে ঘুরাঘুরি করা লাগতো না। শীট ম্যান!!
বাহন নাই। পা আছে। আমার আঞ্চলিক ভাষায় 'পাও।' আমার বড় চাচাকে প্রায়ই চাচিকে বলতে শুনতাম,
-"ডাইন পাও দিয়া লাত্তি মাইরা মাজা ভাইঙ্গা দিমু!"
আমি আমার পাও ব্যবহার করে নিউ মার্কেটের দিকে হাটা দিলাম। বিশাল পথ হাটতে হবে। আমি "হেইয়ো জোয়ান! হেইয়ো!" বলে হাটা শুরু করলাম।
হেইয়ো জোয়ান বলার কারনেই হয়তো দেহের ভিতরে আসুরিক স্ট্যামিনা চলে এলো। দু'ঘন্টার কিছু কম সময়ে ঢাকা কলেজের সামনে চলে এলাম।
ঢাকা কলেজ থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত এলাকাটুকু আমার অদ্ভুত রকম ভালো লাগে। নানা ধরনের মানুষ। হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক ফুলিয়ে হাটা ছাত্র থেকে 'বাইচ্ছা লন ১০০!' বলে হাক দেয়া রোদে পোড়া অন্যরকম সৌন্দর্যের মামাও আছে। তাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন গুলো আলাদা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ স্বপ্ন দেখে।
যে মাঝি রোজ আপনাকে আমাকে ছোট্ট নদীটা পার করায় সেও। সে স্বপ্ন দেখে হয়তো, যে তার ছেলে জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে। রোজ কলেজ বা ভার্সিটি যাওয়ার পথে লোকাল বাসে যে মামা ভাড়া নেয় আমরা তাকে 'হেল্পার' বলি। শব্দটা ইংরেজীর হলেও সেটা এখন বাংলারই। এই মামাও স্বপ্ন দেখে। আজ সে যে বাসের ভাড়া কাটে ঠিক সেই রকম একটা বাসের মালিক হবার স্বপ্ন। জ্যামের ভেতর গাড়ি থামলে যে অন্ধ।ভিখারী দুটি টাকা চেয়ে থালা বাড়িয়ে দেয়; জানেন, স্বপ্ন সেও দেখে। কাল সকালে একটু ভাত মাংস খাওয়ার স্বপ্ন।
এরা সবাই স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখে বলেই এরা বেঁচে আছে। থাকে। থাকবে।
নিউমার্কেট এর ওভার ব্রীজের উপরে কতক্ষন বসে ছিলাম জানি না। অনেক্ষন হবে। পর পর দু'টো আওয়াজ শুনেছি। অনেক দিন পর এভাবে বসে আছি। ওভার ব্রীজের নিচ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। তবে ইদানিং খেয়াল করছি সব গুলো বাস নতুন নতুন লাগছে। ভালো করে খেয়াল করতেই টের পেলাম আসলে গাড়ি সব পুরানো। শুধু নতুন করে রঙ লাগানো হয়েছে। আফসোস লাগলো কিছুটা। রঙ উঠে গেছে। মরিচা দেখা যাচ্ছে। রঙ করে দাও সব নতুন।
হঠাৎ করেই মনে হল মানুষ না হয়ে গাড়ি হয়ে জন্মালে খুব একটা খারাপ হতো না।
খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কিছুই পেলাম না খুঁজে। আসলে আমি কি খুঁজছি? টাকা? কিন্তু আমিতো জানি আমার পকেটে টাকা নেই। তাহলে? সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ তো। বেঁচে থাকাটাই আমাদের অনেকের কাছে সহজাত প্রবৃত্তি। বেঁচে আছি বলেই বেঁচে আছি। কোন উদ্দেশ্য নেই। শুধুই বেঁচে থাকা। তানজিনা ঠিকই বলতো,
"তুমি মরে গেলেও তোমার কোন আফসোস হবে না। রিয়েলি ইউ আর গুড ফর নাথিং!"
আমি হাসতাম। কখনো কখনো অট্টহাসি। আজও হাসলাম। আধো আলো আধো আধারিতে অট্টহাসি।
নিউ মার্কেটে আমার যাতায়াত অনেক বেশি। সেটা মিথিলার জন্য হোক বা নীলক্ষেতে বই কিনতে যাওয়ার জন্যই হোক। আর এখনও আমি সেই নিউ মার্কেটেই দাড়িয়ে। ওভার ব্রীজটার ঠিক নিচে। রোড ডিভাইডার এর উপর দাড়িয়ে। রাস্তার ওপারে যাবো কিনা ভাবছি। ওপাশে একটা বাচ্চা কাঁদছে। সাদা ফ্রক পড়া। মাথায় একটা ঝুটি। পরীর বাচ্চার মত লাগছে। প্রথম দেখায় তাই ভেবেছিলাম। কোন পরীর বাচ্চা বোধ হয় ভুল করে নিউ মার্কেটে নেমে গেছে। আর তারপরই উড়তে ভুলে গ্যাছে। কিন্তু কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ভুল। মেয়েটার থুতনিতে একটা কাটা দাগ আছে। পরীর বাচ্চার নিশ্চই থুতনিতে কাটা দাগ থাকবে না। ইচ্ছে করলেই মেয়েটার কাছে যেতে পারি। কিন্তু কি হয় সেটা দেখার প্রতি আরো বেশি আগ্রহ বোধ করছি। হয়তো মেয়েটার বাবা চলে আসবে কিংবা মা। তারপর হাসি মুখে তারা বাসায় চলে যাবে। যাওয়ার সময় হয়তো একটা আইসক্রিমও খাবে। হঠাৎই আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হলো। কাপ আইসক্রিম।
ছোট বেলায় বাবার কাঁধে চড়ে আইসক্রিম খেতাম। একবার বাবা আর মা আমাকে রেখেই বই মেলায় চলে গিয়েছিল বলে অনেক গুলো বই ছাড়াও চারটা আইসক্রিম খাইয়ে কান্না থামিয়েছিল বাবা। কাপ আইসক্রিম।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও মেয়েটার বাবা-মা কেউই আসছেন না। আমি রাস্তা পাড় হয়ে এগিয়ে গেলাম। চুল গুলো একটু ঠিকঠাক করে নিলাম নিজের। মেয়েটার সামনে দাড়িয়ে বললাম,
-'তুমি কি পরীর বাচ্চা?'
মেয়েটা মাথা নাড়লো।
-'তুমি পরী চিনো?'
এবারও মাথা নাড়লো। তবে এই মাথা নাড়ানো হ্যা বোধক।
-'পরীর কি থাকে বলো?'
-'তুমি কে?'
-'আমি সৈকত। সাগর চিনো? সেই।সাগরের সৈকত। মানে সাগরের পাড়। যেখানে সবাই দাড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখে। আর তোমার সাইজের বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হিসু করে। অনেক সময় বড়রাও করে।'
-'সূর্য ডোবে কেন?'
-'সূর্যর গোসল করতে হবে না??? সারা দিন বাইরে থেকে গায়ে ধূলা লেগে যায় তো তাই গোসল করার জন্য ডুব দেয়।'
-'ওই পানিতে তো বাচ্চারা হিসু করে। সেখানে সূর্য গোসল করে?? ইয়াক!!!'
পরীর বাচ্চাটা নাক কুঁচকে ফেলল। অবশ্য আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখানে তীব্রব অ্যামোনিয়ার গন্ধ। পরীর বাচ্চার নাক কুঁচকে ফেলা স্বাভাবিক। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-'তোমার আম্মু কই? মার্কেটের ভেতরে? কেনাকাটা করছে?'
-'না। আম্মু তো শুয়ে আছে। আম্মুর হাতে অনেক গুলো পাইপ লাগানো। নাকেও আছে একটা।'
-'আর আব্বু?'
-'আব্বু আম্মুর পাশে বসে আছে।'
-'আম্মু শুয়ে আছে কেন?'
-'জানিনা। আম্মু জানো আমার সাথে কথা বলে না।'
-'কেন বলেনা?'
-'জানিনা।'
-'তুমি তো দেখি কিছুই জানো না।'
পরীর বাচ্চার কথা পরিস্কার না। তবে যেহেতু এটা নিউমার্কেট এলাকা সেহেতু পরীর মা-আর বাবা খুব সম্ভবত ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তারা তাদের মত থাকুক। আমার এখন আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। পরীর বাচ্চা কে জিজ্ঞেস করলাম,
-'আইসক্রিম খাবে?'
সে উজ্জ্বল সম্মতি জানালো। আর জানালো সে 'কুন' আইসক্রিম খাবে। লাঠি আইসক্রিম খাবে না। লাঠি আইসক্রিম ভালো না। গলে হাতে লেগে যায়। জামা ময়লা হয়।
পকেটে টাকা নাই। গড়ের মাঠ। আইসক্রিম কিভাবে খাবো জানি না। আমি পরীর বাচ্চা কে কাঁধে তুলে নিলাম। গন্তব্য আমার আবাস স্থল। 'আকবর আলীর 'মেচ।'
মেস ম্যানেজারের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো তা নয়। কিন্তু লোকটা আমাকে পছন্দ করে। সে বিপত্নিক মানুষ। একা থাকে। আমি পরীর বাচ্চাকে নিয়ে ম্যানেরজার সাহেবের ঘরে গেলাম। নক করতেই বিরক্তি মাখা কন্ঠে অতি মধুর ধ্বনি শোনা গেল,
-'ওই কোন **র *ত রে?'
-'ম্যানেজার সাহেব আমি সৈকত।'
দরজা খুলে গেল। মানুষটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া। গেঞ্জিতে লাল লিপস্টিকের দাগ।
-'আপনে? কুন সমস্যা?'
-'আমাকে দুটো আইসক্রিম খাওয়াইতে পারবেন? একটা 'কুন' আরেকটা কাপ?'
ম্যানেজার ভ্রু-কুঁচকে তাঁকিয়ে আছেন।
-'সত্যিই আপনে আইসক্রিম চাইতে আইসেন?'
-'হ্যা ভাই। চিরন্তন সত্য। প্রেজেন্ট ইন্ডিফিনিট টেন্স।'
-'আচ্ছা। আপনে ঘরে যান। দশ মিনিটের মইধ্যে আইসক্রিম হাজির হইবো!'
সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পর আমার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি মেসের সামনে একটা কাঠের বেঞ্চ আছে সেটায় একজন লোক বসে আছেন। শাদা শার্ট, কালো স্যুট, কালো টাই, কালো প্যান্ট পড়ে এক বসে আছে। আমি ডান হাতে লুঙ্গির এক কোনা তুলে হাম্মাম খানার দিকে রওনা দিলাম। এই সময় হাম্মাম খানা ফাঁকা পাওয়ার কথা। একই সাথে প্রাকৃতিক কর্ম আর গোসল দুটোই সেরে ফেলা যাবে। কাজ কর্ম শেষ করার পর ঘর থেকে গামছা আনতে ঢোকার সময় লোকটা বলল,
-"আপনি সৈকত সাহেব?"
আমি হেসে বললাম,
-"সাহেব নই। তবে আমার নাম সৈকত। বাকি কথা ঘর থেকে গামছা এনে তারপর বলি?"
উত্তরের অপেক্ষা করলাম। লোকটা বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। গামছা নিতে নিতে একবার ভাবলাম আর বের না হলে কেমন হয়। কিন্তু গামছা নিলাম। এবং বের হলাম।
-"বলুন।"
-"আপনার নামে একটা ইনভেলাপ আছে।"
-"ও। আপনি তাহলে পোস্ট ম্যান! বাংলাদেশে ডাক বিভাগ কি পোস্ট ম্যানদের পোশাক চেঞ্জ করেছে? স্যুট প্যান্ট পড়িয়ে দিয়েছে? অবশ্য বিচিত্র কিছু না। এরচেও বিচিত্র কাজ এদেশে হয়।"
-"স্যরি মিস্টার সৈকত। আপনি ভুল করছেন। আমি আবেদ আহমেদ স্যারের পিএ।"
-"আবেদ সাহেব লোকটা কে?"
-"আপনি কাল যার বাসায় গিয়েছিলেন। একটু স্যুপ আর মালাই দেয়া চা খেয়েছেন"
-"দিন খাম দিন। তারপর ফাঁকে যান!"
-"স্যরি... কোথায় যাবো?"
-" গাড়িতে করে এসেছেন না? খামটা আমাকে দিয়ে গাড়ির দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যান।"
লোকটা আমাকে খামটা দিয়ে মোবাইল বের করতে করতে চলে গেলেন।
আমি খামটা খুললাম না। রহস্য থাকুক। হুমায়ূন স্যার প্রায়ই বলতেন, "প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।"
[ঘরে পরীর বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। তাকে বাবা-মা'র কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। আমি ওর মাথায় হাত রাখতেই চোখ খুলে তাঁকালো। আমি বললাম,
-"মায়ের কাছে যাবে না?"
পরীর বাচ্চা মাথা নাড়লো। হ্যা সে যাবে।
পরীর বাচ্চার সাথে রিকশায় উঠলাম। ঢাকা মেডিকেল। ১২০ টাকা ভাড়া। পকেটে ১২ টাকাও নাই। রিকশা ভাড়া কেমনে দিবো জানিনা। পরীর বাচ্চা আমার পাশে বসে আছে। আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে আছে।
আচ্ছা সৃষ্টিকর্তা কি আমাকেও একটা এমন মেয়ের পিতা করবেন? যে মেয়েটা অবিকল পরীর বাচ্চার মত হবে? হিমুদের স্বপ্ন দেখার অনুমতি দেয়া হয়নি। আমি যেহেতু হিমু নই তাই এই নির্দোষ স্বপ্নটা আমি দেখতেই পাই। কাল রাতে পরীর বাচ্চাটা যখন আম্মার বুকের উপর ঘুমিয়ে ছিল তখন আমি জেগেই জেগেই এই স্বপ্নটা দেখছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেই স্বপ্নে পরীর বাচ্চার কোন মা ছিল না।
ঢাকা মেডিকেল এর সামনে নামার আগে পরীর বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-'তোমার আব্বু-আম্মু কি এখানেই আছে?'
পরীর বাচ্চা আবারো মাথা নাড়লো। এবারো উত্তর হ্যাবোধক। নামার পর পরীর বাচ্চাই আমাকে পথ দেখালো।
মহিলা ওয়ার্ডের বিছানায় শোয়া মহিলাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। অবিকল মেয়ের মত চেহারা। পরী-মা ঘুম। পরী বাবা আশেপাশে নাই। আমি চেয়ারে বসলাম। পরী-মা চোখ খুলে তাঁকালেন। প্রথমে আমাকে তারপর তার মেয়েকে দেখলেন। চোখে উজ্জ্বল আভা। কিন্তু কিছু বললেন না। আমিও চুপচাপ বসে রইলাম।
কিছুক্ষন পরেই জ্বীন সাহেব এলেন। মানে পরীর বাচ্চার বাবা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। চোখে জল। আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
-'আপনি ভাই মানুষ না। ফেরেশতা। আপনি আমার ধর্মের ভাই। আজকেই জিডি করতে যামু ভাবছিলাম।
ওর মা কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করেই। চিকিৎসার পিছনে সব টাকা শেষ। কিন্তু কোন ফল নাই। চিন্তায় চিন্তায় আমি শ্যাস। সারা দিন ওর মার পিছনে থাহি। সিঞ্জি চালাইতাম। বউ লাইগা হেইয়াও বাদ দিছি। ভালোবাইসা বিয়া করছিলাম। বড় ভালো পল্লী গীতি গাইতো। আর অহন তো কতাই কইবার পারে না।'
-'ভাই আমি মানুষ না সত্যি কথা। কিন্তু ফেরেশতা না। অমানুষ।'
মিথিলার বাবা আবেদ আহমেদ সাহেবের দেয়া খামটা আমি জ্বীন সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম।
-'ভাই এর ভিতরে একটা চেক আছে। বেশ কিছু টাকা আপনি পাবেন। সঠিক অঙ্কটা আমি জানি না।'
-'ভাই আমি লাগলে রক্ত বেইচা চিকিৎসা করামু। কিন্তু কারুর দান আমি নিমু না।'
-'রক্ত বেচে এই যুগে বেশি টাকা পাওয়া যায় না। আর আমাকে ধর্মের ভাই ডাকছেন না? আপনার বিয়েতে তো কিছু উপহার দিতে পারি নাই। এইটা বিয়ের গিফট।'
জ্বীন সাহেব খামটা নিলেন। আমি বললাল,
-'ভাই সাহেব কালকে আমি আপনার মেয়েকে ৫৫ টাকার একটা 'কুন' আইসক্রিম খাওয়াইছি। সেই টাকাটা কি পাবো?'
তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম,
-'ভাই দিবেন? না দিলে বলেন। আমি চলে যাই।'
তিনি পকেট থেকে আমাকে ৬০ টাকা দিলেন। আমি আমার পকেট থেকে দুই টাকার দুটো নোট বের করে দিলাম।
-'স্যরি ভাই আমার কাছে এক টাকা ভাংতি নাই।'
বলে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করলাম।
শহীদ মিনারের সামনে বসে আমার মোবাইল থেকে সীম দুটো খুলে ফেলে দিলাম। মিথিলার সাথে আর যোগাযোগ করা যাবে না। মেসও বদলে ফেলতে হবে। মিথিলার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। একদম নেটওয়ার্কের বাইরে।
★ফেসবুকে আপনার মন্তব্য জানান এখানে,
'সমুদ্রের সৈকত ও একটি পরীর বাচ্চা'
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কল্লোল বেপারী ৩০/০৮/২০১৫ভালো লাগলো।