উপেক্ষা
আমার বেশির ভাগ গল্পের শুরুর মত এই গল্পটাও বৃষ্টি দিয়ে শুরু করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু বৃষ্টি যে আমাকে মায়ায় ফেলে দিয়েছে। আসলে বর্ষা বা বৃষ্টি দু'টোর প্রতিই আমার বেশ দুর্বলতা আছে। এর কারন বৃষ্টি সব সময়ই আমার কাছে আপন কোন বিষয় না। প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে ছিলাম ক্লাস এইটে। তার আগে বৃষ্টিতে ভেজার দুঃসাহস আমার হয়নি। যদিও এমনিতেই আমি বেশ ভিতু মানুষ। আত্নজীবনী বাদ দিয়ে মূল গল্পে যাই।
"মোঃপুর টু ধুপখোলা" লেখা মুড়ির টিন মার্কা লোকাল বাস গুলোতে আজিমপুর থেকে মোহাম্মদপুরের ভাড়া ছয় টাকা। মাঝে মাঝে পাঁচটাকা দিয়েও এমন ভাব নেয়া যায়, যেন পাঁচ হাজার টাকা বাস ভাড়া দিয়ে ফেলেছি। আমি সাধারনত এই বাসেই আজিমপুর যাই। ছয় টাকা ভাড়া দেই। মাঝে মাঝে পাঁচ হাজার টাকার ভাবও নিই।
আমার পাশে যে মানুষটা বসে আছে সে আসলে ছেলে না মেয়ে আমি বুঝতে পারছি না। ছেলে হলে আমি একটু আরামে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারি। প্রয়োজনে একটু ডেকে বলতে পারি,
-"ব্রাদার একটু চাপ দিয়া বসলে ভালো হয়!"
কনফিউসনের কারন ব্যাখ্যা করি। মাথায় ঘাড় পর্যন্ত চুল। একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। একটা জিন্সের প্যান্ট। অবিকল ওই রকম একটা প্যান্ট আমার আছে। গায়ে ফতুয়া জাতীয় একটা কিছু। গলায় একটা সবুজ গামছা পেচানো। আর পায়ে গাবদা এক জোড়া ছেলেদের স্যান্ডেল। একটা ছবি দিতে পারলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হতো।
আমি আড় চোখে তাঁকিয়ে ধারনা নিতে চেষ্টা করছি। আমি যখন মোটামুটি শিওর ইনি একজন পুরুষ, তখন মানুষটা আমার দিকে না তাঁকিয়ে স্পস্ট স্বরে বলল,
-"আপনার টেনশনের কোন কারন নাই। আমি মেয়ে। আমার নাম নিপা। বান্ধবীরা পানি নামেও ডাকে।"
আমি নিঃশব্দে একটা ঢোক গিললাম।
নিপা নামটা শোনার পর একটু স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। আমার একটা বোন আছে। হোম ইকোনমিকস কলেজে পড়ে। বেশ খটমটে নামের একটা সাবজেক্টে। এমনিতে দারুন হাসি খুশি। তবে ওর মত শক্ত টাইপ মেয়ে আমি আর দেখিনি।
এই নিপা নামের মেয়ে গুলোই যেন কেমন। অতএব এই মেয়েও যে ওই টাইপই হবে সেটাই স্বভাবিক।
ষোল কলা পূর্নতা পাবে যদি মেয়েটা এখন ফস করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে থাকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে। যদিও বাস ভর্তি লোকের মাঝে সে সম্ভাবনা একদমই কম। তবে উড়িয়ে দিচ্ছি না।
এবার আমি একটু আরাম করে বসলাম।
বাস নিউ মার্কেট পৌছানোর আগেই বৃষ্টি নামলো। আমি জানালার কাচ টেনে নিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে। সেই ছন্দ সবাই ধরতে পারে না। কিন্তু একবার যে ধরে সে হারিয়ে যায়। আমি পারিনি কোন দিন সেই ছন্দে হারিয়ে যেতে। আসলে চেষ্টাটুকুও করিনি কোন দিন।
নীলক্ষেত মোড়ের পেট্রোল পাম্পের সামনে আমাকে নামতে হবে। বাস দাড়িয়ে পড়েছে। পানি নামের অদ্ভুত মেয়েটা নামছে। আমিও নামলাম। নামতেই ভিজে গেলাম। পানিকে দেখলাম ছাতা বের করে মাথায় ধরেছে। আমি পেট্রোল পাম্পের ছাউনির নিচে দাড়ালাম। পানিকেও দেখলাম আমার থেকে একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজি। কিন্তু পরের কাহিনি আমার মুখস্ত। তিন দিনের জন্য বিছানাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে।
পানিকে দেখলাম খুব উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে ফোনে। আমি এগিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাড়ালাম। কিছুক্ষন পরেই মোবাইল নামিয়ে রাখলো। তারপর আমার দিকে তাঁকিয়ে অতি পরিচিত মানুষের মত বলল,
-আপনি কি আমাকে সমরিতা হাসপাতালে যাওয়ার একটা রিকশা ঠিক করে দেবেন?
আমি তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
-অবশ্যই।
আমি পানির ছাতাটা নিয়ে রিকশা আনতে গেলাম।
পানি রিকশায় উঠে বসল। আমি পানিকে বললাম,
-"রিকশা পিজিতে যাবে। যিনি আপনাকে খবর দিয়েছে তিনি উত্তেজনায় ভুলে গেছেন যে প্রথমে সমরিতায় যাওয়ার কথা থাকলেও পরে পিজিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পানি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে আমারর দিকে। আমি উল্টো ঘুরে হাটতে লাগলাম। মাথায় পানির ছাতা। এই বৃষ্টিতে ছাতাটা খুব প্রয়োজন। পানি হয়ত ডাকবে ছাতার জন্য। হয়ত না। চান্স ফরটি/সিক্সটি।
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে মিথিলার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ওকে ফোন দিলাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাথায় পানি'র ছাতা। পানি মানে নিপা। একটু আগে খেয়াল করেছি ছাতাটা মেয়েদের। পার্পল রঙের ছোট খাটো একটা ছাতা। মিথিলা আমাকে দেখেই প্রথমে যে কথাটা বলল,
-"মেয়ে মানুষের ছাতা তুই কই পেলি?"
আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে পানির কাহিনি বললাম। মিথিলা বলল,
-"তোর কি মনে হয় মেয়েটা পিজিতে গিয়ে খুজে পাবে? নিজেকে কি ভাবিস? ভবিষ্যৎ বক্তা?"
আমি মুচকি হাসলাম। মিথিলা বলে 'ভূবন ভোলানো হাসি!' যদিও ওর সামনে এই হাসি খুব কমই ডেলিভারি দেই।
মিথিলা আলতো করে আমার ডান হাত ধরল। আমার আঙুলের ফাঁকে ওর নিজের স্থান খুঁজে নিলো। তারপর আমাকে কাছে টেনে নিল।
আজ আমি আর মিথিলা, আমরা হাটবো। অনেক দূর। আর মাথার উপরে থাকবে 'পানি'র ছাতা। তার উপরে আকাশ। তীব্র বর্ষণের পর পরিস্কার আকাশ। নীল আকাশ।
প্রকৃতির খেয়াল বলা যেতে পারে। টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে পড়তে বৃষ্টি বেশ বেড়ে গিয়েছিল। আমি ছাতা খুলে মাথায় দিয়ে দিলাম। মিরপুর রোডের কলেজ গেট থেকে হাটতে হাটতে চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে চলে এসেছি। ইদানিং আমি প্রায়ই ছাতা নিয়ে বেরোই। বলা যেতে পারে ফ্রি পাওয়া ছাতার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করছি।
চন্দ্রিমা উদ্যান পার হয়ে বিজয় সরনীতে পৌছেই দেখি কঠিন সবুজ শাড়ি পড়া একটা মেয়ে দাড়িয়ে ভিজছে। একা। বোঝাই যাচ্ছে ছাতা না নিয়ে আসায় বিপদে পড়ে গেছে। আমি সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ছাতাটা বন্ধ করে মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা ভ্রু কুচকে এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে। আমি ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-ছাতাটা আমার না। কিভাবে যেন হাত ঘুরে আমার কাছে চলে এসেছে। আপনি এটা নিয়ে বাসায় চলে যান। আসল মালিকের খোঁজ পেলে দিয়ে দেবেন।
মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো। আমি উল্টো ঘুরে হাটা ধরলাম। আমার ছাতা যাপন কিছুটা শেষ হয়েছে ভেবে কিছুটা খারাপ লাগছিল সম্ভবত। পেছন থেকে মেয়েটা বলল,
-আসল মালিক আপনি পেয়ে গেছেন।
আমি উল্টো ঘুরে দাড়ালাম।
-ছাতাটা আমারই। আমি পানি। নিপা। আপনি আমাকে চিনতে পারেননি?
আমি হাসলাম। সেই হাসি।
-আপনি ইচ্ছে করেই না চেনার ভান করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে মনে রাখবো অনেক দিন।
আমি আবার হাসলাম।
-যে মানুষটা আমাকে এক বৃষ্টির দিনে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়েছিল। আর জন্ম দিয়ে ছিল একটা অদ্ভুত গল্পের। বাবা সেদিন পিজিতে ছিল না। আমি সেদিন পুরো পিজি হাসপাতাল ঘুরেছি। বাবাকে খুঁজেছি। কেন যেন মনে প্রানে চাইছিলাম আপনার কথা সত্যি হোক। আমি দেরিতে হলেও বুঝেছিলাম হিমুরা শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকে। বাস্তবে মাতাল করা জ্যোৎস্না রাতে পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে কেউ হাটে না। মাঝরাতে রূপাদের বাড়ির নিচে দাড়ায় না।
-আমার পাঞ্জাবীই নেই। আর পকেট ছাড়া আমি চলতে পারি না।
-সেই মানুষটা আবার আমার সামনে দাড়ালো। আমাকে চিনেও না চেনার ভান করলো। সেই বৃষ্টির দিনেই।
-আমি মাঝে মাঝে হিমু হতে চেষ্টা করি। বলা যায় হিমু চরিত্রে অভিনয় করি। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে তারা ঠকে। কারন সত্যিটা হলো আমরা কেউই ভবিষ্যত দেখতে পাই না। বলতে পারিনা। ভবিষ্যত তৈরী করতে পারি। ভবিষ্যত তৈরী করতে হয়।
একটু থেমে বললাম,
-যাই তাহলে। তবে আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে। প্রকৃতির খেয়াল। দান দান তিন দান। আমার এই কথাও আবার বিশ্বাস করে বসবেন না। আমি ভবিষ্যত তৈরীও করতে পারি না। বলা তো দূরের কথা।
-আচ্ছা আপনার নামকি হিমু?
আমি নিপার চোখের দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
-আমি হিমু না। আমি সৈকত।
হাটছি আমি। কাকভেজা হয়ে গেছি অনেক আগেই। বৃষ্টি থামার আগেই মিথিলার কাছে পৌছাতে হবে।
ভিজবো আজ।
একসাথে।
পাশাপাশি।
"গল্পটা শুরু করেছিলাম প্রায় তিন মাস আগে। শেষ করতে পারছিলাম না। সিন্দাবাদের ভূতের মত ঘাড়ে চেপে ছিল। তবে এই অনুভূতি আনন্দের।"
-তরীকুল ইসলাম
"মোঃপুর টু ধুপখোলা" লেখা মুড়ির টিন মার্কা লোকাল বাস গুলোতে আজিমপুর থেকে মোহাম্মদপুরের ভাড়া ছয় টাকা। মাঝে মাঝে পাঁচটাকা দিয়েও এমন ভাব নেয়া যায়, যেন পাঁচ হাজার টাকা বাস ভাড়া দিয়ে ফেলেছি। আমি সাধারনত এই বাসেই আজিমপুর যাই। ছয় টাকা ভাড়া দেই। মাঝে মাঝে পাঁচ হাজার টাকার ভাবও নিই।
আমার পাশে যে মানুষটা বসে আছে সে আসলে ছেলে না মেয়ে আমি বুঝতে পারছি না। ছেলে হলে আমি একটু আরামে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারি। প্রয়োজনে একটু ডেকে বলতে পারি,
-"ব্রাদার একটু চাপ দিয়া বসলে ভালো হয়!"
কনফিউসনের কারন ব্যাখ্যা করি। মাথায় ঘাড় পর্যন্ত চুল। একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। একটা জিন্সের প্যান্ট। অবিকল ওই রকম একটা প্যান্ট আমার আছে। গায়ে ফতুয়া জাতীয় একটা কিছু। গলায় একটা সবুজ গামছা পেচানো। আর পায়ে গাবদা এক জোড়া ছেলেদের স্যান্ডেল। একটা ছবি দিতে পারলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হতো।
আমি আড় চোখে তাঁকিয়ে ধারনা নিতে চেষ্টা করছি। আমি যখন মোটামুটি শিওর ইনি একজন পুরুষ, তখন মানুষটা আমার দিকে না তাঁকিয়ে স্পস্ট স্বরে বলল,
-"আপনার টেনশনের কোন কারন নাই। আমি মেয়ে। আমার নাম নিপা। বান্ধবীরা পানি নামেও ডাকে।"
আমি নিঃশব্দে একটা ঢোক গিললাম।
নিপা নামটা শোনার পর একটু স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। আমার একটা বোন আছে। হোম ইকোনমিকস কলেজে পড়ে। বেশ খটমটে নামের একটা সাবজেক্টে। এমনিতে দারুন হাসি খুশি। তবে ওর মত শক্ত টাইপ মেয়ে আমি আর দেখিনি।
এই নিপা নামের মেয়ে গুলোই যেন কেমন। অতএব এই মেয়েও যে ওই টাইপই হবে সেটাই স্বভাবিক।
ষোল কলা পূর্নতা পাবে যদি মেয়েটা এখন ফস করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে থাকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে। যদিও বাস ভর্তি লোকের মাঝে সে সম্ভাবনা একদমই কম। তবে উড়িয়ে দিচ্ছি না।
এবার আমি একটু আরাম করে বসলাম।
বাস নিউ মার্কেট পৌছানোর আগেই বৃষ্টি নামলো। আমি জানালার কাচ টেনে নিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে। সেই ছন্দ সবাই ধরতে পারে না। কিন্তু একবার যে ধরে সে হারিয়ে যায়। আমি পারিনি কোন দিন সেই ছন্দে হারিয়ে যেতে। আসলে চেষ্টাটুকুও করিনি কোন দিন।
নীলক্ষেত মোড়ের পেট্রোল পাম্পের সামনে আমাকে নামতে হবে। বাস দাড়িয়ে পড়েছে। পানি নামের অদ্ভুত মেয়েটা নামছে। আমিও নামলাম। নামতেই ভিজে গেলাম। পানিকে দেখলাম ছাতা বের করে মাথায় ধরেছে। আমি পেট্রোল পাম্পের ছাউনির নিচে দাড়ালাম। পানিকেও দেখলাম আমার থেকে একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজি। কিন্তু পরের কাহিনি আমার মুখস্ত। তিন দিনের জন্য বিছানাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে।
পানিকে দেখলাম খুব উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে ফোনে। আমি এগিয়ে ওর কাছে গিয়ে দাড়ালাম। কিছুক্ষন পরেই মোবাইল নামিয়ে রাখলো। তারপর আমার দিকে তাঁকিয়ে অতি পরিচিত মানুষের মত বলল,
-আপনি কি আমাকে সমরিতা হাসপাতালে যাওয়ার একটা রিকশা ঠিক করে দেবেন?
আমি তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
-অবশ্যই।
আমি পানির ছাতাটা নিয়ে রিকশা আনতে গেলাম।
পানি রিকশায় উঠে বসল। আমি পানিকে বললাম,
-"রিকশা পিজিতে যাবে। যিনি আপনাকে খবর দিয়েছে তিনি উত্তেজনায় ভুলে গেছেন যে প্রথমে সমরিতায় যাওয়ার কথা থাকলেও পরে পিজিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পানি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে আমারর দিকে। আমি উল্টো ঘুরে হাটতে লাগলাম। মাথায় পানির ছাতা। এই বৃষ্টিতে ছাতাটা খুব প্রয়োজন। পানি হয়ত ডাকবে ছাতার জন্য। হয়ত না। চান্স ফরটি/সিক্সটি।
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে মিথিলার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ওকে ফোন দিলাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাথায় পানি'র ছাতা। পানি মানে নিপা। একটু আগে খেয়াল করেছি ছাতাটা মেয়েদের। পার্পল রঙের ছোট খাটো একটা ছাতা। মিথিলা আমাকে দেখেই প্রথমে যে কথাটা বলল,
-"মেয়ে মানুষের ছাতা তুই কই পেলি?"
আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে পানির কাহিনি বললাম। মিথিলা বলল,
-"তোর কি মনে হয় মেয়েটা পিজিতে গিয়ে খুজে পাবে? নিজেকে কি ভাবিস? ভবিষ্যৎ বক্তা?"
আমি মুচকি হাসলাম। মিথিলা বলে 'ভূবন ভোলানো হাসি!' যদিও ওর সামনে এই হাসি খুব কমই ডেলিভারি দেই।
মিথিলা আলতো করে আমার ডান হাত ধরল। আমার আঙুলের ফাঁকে ওর নিজের স্থান খুঁজে নিলো। তারপর আমাকে কাছে টেনে নিল।
আজ আমি আর মিথিলা, আমরা হাটবো। অনেক দূর। আর মাথার উপরে থাকবে 'পানি'র ছাতা। তার উপরে আকাশ। তীব্র বর্ষণের পর পরিস্কার আকাশ। নীল আকাশ।
প্রকৃতির খেয়াল বলা যেতে পারে। টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে পড়তে বৃষ্টি বেশ বেড়ে গিয়েছিল। আমি ছাতা খুলে মাথায় দিয়ে দিলাম। মিরপুর রোডের কলেজ গেট থেকে হাটতে হাটতে চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে চলে এসেছি। ইদানিং আমি প্রায়ই ছাতা নিয়ে বেরোই। বলা যেতে পারে ফ্রি পাওয়া ছাতার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করছি।
চন্দ্রিমা উদ্যান পার হয়ে বিজয় সরনীতে পৌছেই দেখি কঠিন সবুজ শাড়ি পড়া একটা মেয়ে দাড়িয়ে ভিজছে। একা। বোঝাই যাচ্ছে ছাতা না নিয়ে আসায় বিপদে পড়ে গেছে। আমি সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ছাতাটা বন্ধ করে মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা ভ্রু কুচকে এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে। আমি ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-ছাতাটা আমার না। কিভাবে যেন হাত ঘুরে আমার কাছে চলে এসেছে। আপনি এটা নিয়ে বাসায় চলে যান। আসল মালিকের খোঁজ পেলে দিয়ে দেবেন।
মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো। আমি উল্টো ঘুরে হাটা ধরলাম। আমার ছাতা যাপন কিছুটা শেষ হয়েছে ভেবে কিছুটা খারাপ লাগছিল সম্ভবত। পেছন থেকে মেয়েটা বলল,
-আসল মালিক আপনি পেয়ে গেছেন।
আমি উল্টো ঘুরে দাড়ালাম।
-ছাতাটা আমারই। আমি পানি। নিপা। আপনি আমাকে চিনতে পারেননি?
আমি হাসলাম। সেই হাসি।
-আপনি ইচ্ছে করেই না চেনার ভান করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে মনে রাখবো অনেক দিন।
আমি আবার হাসলাম।
-যে মানুষটা আমাকে এক বৃষ্টির দিনে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়েছিল। আর জন্ম দিয়ে ছিল একটা অদ্ভুত গল্পের। বাবা সেদিন পিজিতে ছিল না। আমি সেদিন পুরো পিজি হাসপাতাল ঘুরেছি। বাবাকে খুঁজেছি। কেন যেন মনে প্রানে চাইছিলাম আপনার কথা সত্যি হোক। আমি দেরিতে হলেও বুঝেছিলাম হিমুরা শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকে। বাস্তবে মাতাল করা জ্যোৎস্না রাতে পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে কেউ হাটে না। মাঝরাতে রূপাদের বাড়ির নিচে দাড়ায় না।
-আমার পাঞ্জাবীই নেই। আর পকেট ছাড়া আমি চলতে পারি না।
-সেই মানুষটা আবার আমার সামনে দাড়ালো। আমাকে চিনেও না চেনার ভান করলো। সেই বৃষ্টির দিনেই।
-আমি মাঝে মাঝে হিমু হতে চেষ্টা করি। বলা যায় হিমু চরিত্রে অভিনয় করি। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে তারা ঠকে। কারন সত্যিটা হলো আমরা কেউই ভবিষ্যত দেখতে পাই না। বলতে পারিনা। ভবিষ্যত তৈরী করতে পারি। ভবিষ্যত তৈরী করতে হয়।
একটু থেমে বললাম,
-যাই তাহলে। তবে আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে। প্রকৃতির খেয়াল। দান দান তিন দান। আমার এই কথাও আবার বিশ্বাস করে বসবেন না। আমি ভবিষ্যত তৈরীও করতে পারি না। বলা তো দূরের কথা।
-আচ্ছা আপনার নামকি হিমু?
আমি নিপার চোখের দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
-আমি হিমু না। আমি সৈকত।
হাটছি আমি। কাকভেজা হয়ে গেছি অনেক আগেই। বৃষ্টি থামার আগেই মিথিলার কাছে পৌছাতে হবে।
ভিজবো আজ।
একসাথে।
পাশাপাশি।
"গল্পটা শুরু করেছিলাম প্রায় তিন মাস আগে। শেষ করতে পারছিলাম না। সিন্দাবাদের ভূতের মত ঘাড়ে চেপে ছিল। তবে এই অনুভূতি আনন্দের।"
-তরীকুল ইসলাম
এই "সৈকত" কে নিয়ে আগের গল্পের লিংক,
http://www.tarunyo.com/tariquulislam/blog/post20150513055803/
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রেনেসাঁ সাহা ১০/০৬/২০১৫
-
মিজান রহমান ২৮/০৫/২০১৫দারুন
শুভেচ্ছান্তে, আপনার গুণমুগ্ধ পাঠিকা।