যে মানুষটা সমুদ্রের খুব কাছের
মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে চমকে উঠি। টানা টানা চোখ। এখন ঘুমচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত মেয়েটা যখন হাসে দু গালে খুব সুন্দর দু'টো টোল পড়ে। আর মাতিয়ে দেয় সবাইকে।
মেয়েটা শুয়ে আছে দেশের সবচে দামী হাসপাতালের সাদা চাদর বিছানো বেডে। এই একটা যায়গায় সবাই এক। ধনী হোক বা গরীব। প্রকৃতির কাছে নিঃস্ব। হেরে যায় একদম লজ্জাকর ভাবে।
মনে মনে একটু অহংকার চলে আসে। যাক আমিও তাহলে কম হনু নই। আরো কি সব ভাবছিলাম কিন্তু ব্যাঘাত ঘটলো। যন্ত্র-মানবীর কড়া নিষেধাজ্ঞায়। হাসপাতালে যন্ত্র-মানবী এক মাত্র নার্সরাই। দেখলেই মনে হয় অ্যাপ্রনের পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘুরছে। উল্টোপাল্টা কিছু দেখলেই হয়তো মুখের ভেতর থার্মোমিটার ঢুকিয়ে সাদা চাদর বিছানো বেডে শুইয়ে দেবে। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে এদের মাথা দু'ভাগ করলে হলুদ পদার্থ পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে মাদারবোর্ড টাইপ কিছু।
লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই তাঁকিয়ে আছে। তার তাঁকানোর ভঙ্গি বেশ মজার। হঠাৎ হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। তখন দুই ভ্রু এক সাথে মিশে যায়। মনে হয় উনার জোড়া ভ্রু। কিন্তু উনার ভ্রু জোড়া খুব সুন্দর। দেখলে মনে হয় প্লাক করা। তিনি কোন পার্লারের গদি আটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছেন। আর পার্লারের কর্মী তার ভ্রু তে চিত্র একেছে। কিন্তু উনার যা বয়স তাতে উনি পার্লারে গিয়েছেন বলে মনে হয় না। উনার বয়সের কোন মহিলা হলে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকতো।
আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে উনি অল্প বিস্তর লেখালেখি করেন। তাই উনার উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনাতে ব্যবহারের জন্য আমার চেহারার খুঁটিনাটি সব ব্রেনের একটা অংশে জমা করে নিচ্ছেন। তারপর সময় মত সেটা লিখে বই ছাপাবেন। বইয়ের মলাটে থাকবে বাংলা ছবির কোন বিশাল বক্ষা নায়িকার ছবি। পাশে একটা গোলাপ। আর লাল কালিতে লেখা থাকবে উপন্যাসের নাম। 'কি ভুল করেছিলাম ছাত্র জীবনে তোমায় ভালোবেসে?'
অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হয়। উনার ওই তাঁকিয়ে থাকার সময়টা অনেকক্ষন মনে হলেও বাস্তবে পার হয়েছে মিনিট তিনেক।
-আমার নাম আজিজুর রহমান। আমি ম্যানেজার।
-পত্রিকার বিজ্ঞাপনে তাহলে আপনার নামই দেয়া ছিল?
-হ্যা। স্যার নিজের নাম পত্রিকায় ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না। আপনার নাম?
-আমার নাম আগে একবার বলা হয়েছে। সমুদ্রের খুব কাছের লোক আমি।
-কোন সমুদ্র?
-সাগর যা সমুদ্র তাই। বাংলাদদেশে যেহেতু বাস করি তাই বঙ্গোপসাগর।
-ও। আপনার নাম তাহলে সৈকত। ভুলে গিয়েছিলাম।
-আপনি সমুদ্র ভালোবাসেন?
ম্যানেজার সাহেব প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অবশ্য আমার এইই প্রশ্ন যাদেরকেই করেছি তারাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁকিয়েছে। এবং বেশির ভাগই উত্তর দেয়নি। বিশেষ করে নারী জাতি।
ম্যানেজার সাহেব বললেন,
-বিকাল চারটায় স্যারের সাথে দেখা করবেন। আর ফাইজলামি আমার সাথে করছেন ভালো। স্যারের সাথে করবেন না।
-উনি কোথায় থাকবেন?
আমার প্রশ্নের পর উনি যে দৃষ্টি দিলেন তাতে উনি কোন দেবতা হলে আমিমি ভষ্ম হয়ে যেতাম। স্যার কোথায় আছেন তা না জানার অপরাধে।
-বাসায়।
ম্যানেজার চলে গেলেন। আমি অফিসের বেয়ারা কে ডেকে চা দিতে বললাম। আলম সাহেবের অফিসের চা খুবই ভালো হয়। চা শেষ করে আমি সোলায়মান সাহেব কে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। সোলায়মান সাহেব আমার বয়সী। মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন পান। আর আমি ভিক্ষাবৃত্তি করি। অন্তত আমার কাছে উনি সাহেব ডাকের সন্মান টুকু পাওনা।
ম্যানেজার সাহেবের উল্লেখিত 'স্যারে'র অপেক্ষায় বসে আছি। এটা তার বাড়ির 'ওয়েটিং রুম!' এই ঘর দেখলেই বোঝা যায় এই দেশের কিছু মানুষ টাকা খরচ করার যায়গা খুজে পায় না। আমি আসার পর টোটাল ছয় কাপ চা খেয়েছি। আলম সাহেবের অফিসের মত বাসার চাও অসাধারন।
একটু পরেই আমার ডাক পড়ল। মানে বাড়ির কাজের লোক এসে ডেকে নিয়ে গেল। আলম সাহেব তার লাইব্রেরীতে আছে। লাইব্রেরীততে ঢোকার আগে আমি এই বাড়ির যতটুকু দেখেছি তাতে ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেয়েছি। হিন্দি সিনেমায় বড়লোকদের বাড়ি হিসেবে যে সব বাড়ি দেখানো হয় তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু। যদিও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ভিতর দিয়া ফিটফাট উপ্রে দিয়া সদর ঘাট। বাংলা প্রবাদটা একদম উল্টে দিয়েছে এই বাড়ি।
আলম সাহেবকে দেখে আমি হকচকিয়ে গেলাম। কারো সাথে প্রথম দেখার আগে মানুষের মন সেই মানুষটার একটা পোট্রেট তৈরি করে। আমার মনের তৈরি করা পোট্রেটের একদম উল্টো। বয়স বেশি হলে বিয়াল্লিশ। একটা চুলেও পাক ধরেনি। সেটা কলপের কারসাজিও হতে পারে। নিখুত ব্যাক ব্রাশ করা। সুঠাম দেহ।
-হ্যালো মিস্টার সৈকত। আমি জাহাঙ্গীর আলম। তবে অফিসে আমার একটা নাম প্রচলিত আছে। আমার পেছলে সে নামে ডাকা হয়। জানোয়ার আলম।
বলেই আলম সাহেব প্রচন্ড ভাবে হেসে উঠলেন। তারপর মুচকি একটা হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বললেন,
-আপনি এখন ভাবছেন 'বাহ আলম সাহেবের হাসি তো বেশ সুন্দর!'
আমি আলতো করে মাথা নাড়লাম।
-প্রচুর টাকা থাকলে কি হয় জানেন মানুষের মনের কথা জানা যায়। বিশেষত নিজের সম্পর্কে ভালো কথা গুলো। কিভাবে জানেন?
-না!
-ধরুন আমি আমার অফিসের এক কর্মচারী কে জিজ্ঞেস করলাম, 'রশীদ সাহেব বলুন তো আমাকে আজ অনেক কম বয়স লাগছে না?'
রশীদ সাহেব বলবেন, 'ঠিক স্যার। আপনি একদম আমার মনের কথাটা বলেছেন। মনে হচ্ছে আজকে আপনার বয়স দশ বছর কমে গেছে।' যদিও ওই দিন আমার চুলে কলপ না দেয়ায় সাদা চুল দেখা যাচ্ছে।
একটু থামলেন আলম সাহেব। জানোয়ার আলম। তারপর আবার শুরু করলেন।
-আসলে এরা ভাবে যে আমাকে খুশি রাখলেই বেতন বাড়বে। বোনাস বাড়বে। কিন্তু তারা জানেনা বেতন বোনাস বাড়ে কর্মের উপর। কর্মই সব। কর্মই মানব ধর্ম। যাই হোক আপনি কত টাকা চান?
আমি নির্বিকার ভাবে বললাম,
-চার লাখ বাইশ হাজার দুইশ তের টাকা।
জানোয়ার আলম আবার হাসলেন। উনার হাসি আসলেই খুব সুন্দর।
-আপনি জানেন আপনার যা চেয়েছেন তার তিন ভাগের এক ভাগে আমার চাহিদা পূরন সম্ভব?
-তাহলে তিন ভাগের এক ভাগেই চাহিদা পূরন করুন। আমি উঠি।
জানোয়ার সাহেব আবার হাসলেন। এ হাসি ধূর্ততার হাসি।
-আপনি পাকা ব্যবসায়ী। নিজের শরীর নিয়েও ব্যবসা করেন। আপনি টাকা পাবেন।
-একটা শর্ত আছে।
-কি শর্ত বলুন।
-অর্ধেক মানি অ্যাডভান্স দিতে হবে।
-শর্ত গ্রান্টেড।
আপনার শর্ত মানলাম কেন জানেন?
-প্রয়োজন বোধ করছি না।
-মানুষ অপ্রয়োজনেও অনেক কিছু জানে। এটা মানুষের ধর্ম!
-আচ্ছা বলুন।
-আমার মেয়েটার রক্তের গ্রুপ ছিল এ নেগেটিভ। ওরও দু'টা কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল। মাত্র সাত বছর বয়স ছিল ওর। আমার কোলে মারা গেছে 'লিন।' আমি চাই না আজিজ সাহেবের মেয়েটাও মারা যাক।
হাটতে ইচ্ছে করছে না। কয়েকদিনের মধ্যেই যে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার মালিক হবে তার হাটতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি হুমায়ুন স্যারের হিমু না। আমি সমুদ্রের খুব কাছের লোক।
এখুনি একটা হিসাব দাড় করিয়ে ফেলতে হবে। নইলে অতত গুলো টাকা এক সাথে পেয়ে মাথা ঠিক থাকবে না। পরে টাকার হিসাব পাবো না। প্রথমেই ধার গুলো শোধ করে ফেলতে হবে। রমজান টাকা পায় এক হাজার। প্রায় দু'মাস আগের দেনা। ওর সামনে দু'টা এক হাজার টাকার নোট ফেলে বলা যেতে পারে,
-"এই নে সুদ সহ ফেরত দিলাম!"
দ্রুত হিসাবের কাজটা সেরে ফেলতে হবে।
সকালে ঘুম ভাঙলো বিড়ালের ডাকে। মানব বিড়াল। আমার মেস মালিক। "কতা হুনলে মনে লয় 'বিলাই চিল্লায়।"
এই মহান বানী আমাদের মেসের কাজের ছেলে আকবর। এদেশের মোগল সম্রাট গন মনে হয় পরের জন্মে চাকর শ্রেণিগত হয়ে জন্মেছেন। বেশির ভাগ হোটেলের বয়, চায়ের দোকানের ছেলে এদের নাম হয় মোঘল সম্রাট গনের নামানুসারে। পরের জন্মে নাম পরিবর্তনের কি বিধান জানা নাই। দ্বিতীয় জন্মের ব্যাপারেও জানা নাই।
বিড়াল মানব বললেন আমার অতিথি এসেছে। আমি একটা ছেড়া স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বাইরে গিয়ে দেখি আজিজুর রহমান সাহেব। উনি কোন কথা না বলে আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজ খুলে দেখি হাতে লেখা চিঠি।
"মিস্টার সৈকত,
ভালো আছেন নিশ্চই। এই মুহুর্তে আপনার ভালো থাকার আমাদের জন্য একান্ত জরুরী।
তাই আপনি ম্যানেজার সাহেবের সাথে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে চলে আসবেন। আপনার অপারেশনের তারিখ পাঁচ দিন পর।
শুভ কামনা রইল।
পুনশ্চঃ টাকার ব্যাপারে ম্যানেজার সাহেবকে কিছু বলবেন না।
ইতি
জানোয়ার আলম।"
আলম সাহেবের হাসির মত হাতের লেখাও চমৎকার।
আলম সাহেব আমাকে শেষ চমক দিলেন অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে।
চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকা মাত্র লেখা একটা চেক আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-পুরো টাকাটাই দিয়ে দিলাম। আপনার শর্তের চেয়েও এক লাইন এগিয়ে থাকলাম। হা হা হা হা হা!!!!
আলম সাহেব প্রায় হাসপাতাল কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন।
অপারেশনের সাত দিন পর ডাক্টার বললেন কাল আমাকে রিলিজ করা হবে। এই সাতটা দিন সারাক্ষন আমার পকেটে হাত ছিল। আর ছিল চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকার একটা চেক।
ডাক্টার রিলিজ করার আগেই আমি রিলিজ হয়ে গেলাম। সহজ কথায় পালালাম। পকেটে হাত দিয়েই। কিন্তু পকেটে শুধু আমার হাতই ছিল। আর চার লক্ষ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকার চেকটা আমি অত্যন্ত যত্নের সাথে পঞ্চাশ টুকরো করে আমার বেডে ছড়িয়ে রেখে এসেছি। আর বালিশের নিচে একটা ভাজ করা কাগজ।
"আলম সাহেব,
এই ব্যস্ত নগরীতে আমাকে না খুঁজে আমার ঠিকানায় খুঁজুন আমাকে। সমুদ্রের খুব কাছের লোক আমি।
আমি সৈকত।"
হাটছি। আজ সম্ভবত অমাবশ্যা। নয়তো আকাশে মেঘ খুব। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজবো। খুব ইচ্ছে করছে।
নিজেকে কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে। আচ্ছা একটা কিডনী কম থাকলে কত কেজি ওজন কমে?
হাটতে খুব সমস্যা হচ্ছে। বা পায়ের স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় দেখলাম এ বেচারাকে বিদায় দেয়ার সময় হয়ে গেছে। স্যান্ডেল জোড়া রাস্তায় রেখে হিমু হয়ে গেলাম। আচ্ছা চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকায় কত জোড়া স্যান্ডেল কেনা যায়?
বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে। তবে জোর নেই তেমন। তবে যখন তখন জোড়ে নামতে পারে। আমি ফুটপাতে দাড়িয়ে পড়লাম জোড়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষায়।
মেয়েটা শুয়ে আছে দেশের সবচে দামী হাসপাতালের সাদা চাদর বিছানো বেডে। এই একটা যায়গায় সবাই এক। ধনী হোক বা গরীব। প্রকৃতির কাছে নিঃস্ব। হেরে যায় একদম লজ্জাকর ভাবে।
মনে মনে একটু অহংকার চলে আসে। যাক আমিও তাহলে কম হনু নই। আরো কি সব ভাবছিলাম কিন্তু ব্যাঘাত ঘটলো। যন্ত্র-মানবীর কড়া নিষেধাজ্ঞায়। হাসপাতালে যন্ত্র-মানবী এক মাত্র নার্সরাই। দেখলেই মনে হয় অ্যাপ্রনের পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘুরছে। উল্টোপাল্টা কিছু দেখলেই হয়তো মুখের ভেতর থার্মোমিটার ঢুকিয়ে সাদা চাদর বিছানো বেডে শুইয়ে দেবে। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে এদের মাথা দু'ভাগ করলে হলুদ পদার্থ পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে মাদারবোর্ড টাইপ কিছু।
লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই তাঁকিয়ে আছে। তার তাঁকানোর ভঙ্গি বেশ মজার। হঠাৎ হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। তখন দুই ভ্রু এক সাথে মিশে যায়। মনে হয় উনার জোড়া ভ্রু। কিন্তু উনার ভ্রু জোড়া খুব সুন্দর। দেখলে মনে হয় প্লাক করা। তিনি কোন পার্লারের গদি আটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছেন। আর পার্লারের কর্মী তার ভ্রু তে চিত্র একেছে। কিন্তু উনার যা বয়স তাতে উনি পার্লারে গিয়েছেন বলে মনে হয় না। উনার বয়সের কোন মহিলা হলে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকতো।
আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে উনি অল্প বিস্তর লেখালেখি করেন। তাই উনার উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনাতে ব্যবহারের জন্য আমার চেহারার খুঁটিনাটি সব ব্রেনের একটা অংশে জমা করে নিচ্ছেন। তারপর সময় মত সেটা লিখে বই ছাপাবেন। বইয়ের মলাটে থাকবে বাংলা ছবির কোন বিশাল বক্ষা নায়িকার ছবি। পাশে একটা গোলাপ। আর লাল কালিতে লেখা থাকবে উপন্যাসের নাম। 'কি ভুল করেছিলাম ছাত্র জীবনে তোমায় ভালোবেসে?'
অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হয়। উনার ওই তাঁকিয়ে থাকার সময়টা অনেকক্ষন মনে হলেও বাস্তবে পার হয়েছে মিনিট তিনেক।
-আমার নাম আজিজুর রহমান। আমি ম্যানেজার।
-পত্রিকার বিজ্ঞাপনে তাহলে আপনার নামই দেয়া ছিল?
-হ্যা। স্যার নিজের নাম পত্রিকায় ব্যবহার করতে পছন্দ করেন না। আপনার নাম?
-আমার নাম আগে একবার বলা হয়েছে। সমুদ্রের খুব কাছের লোক আমি।
-কোন সমুদ্র?
-সাগর যা সমুদ্র তাই। বাংলাদদেশে যেহেতু বাস করি তাই বঙ্গোপসাগর।
-ও। আপনার নাম তাহলে সৈকত। ভুলে গিয়েছিলাম।
-আপনি সমুদ্র ভালোবাসেন?
ম্যানেজার সাহেব প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অবশ্য আমার এইই প্রশ্ন যাদেরকেই করেছি তারাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁকিয়েছে। এবং বেশির ভাগই উত্তর দেয়নি। বিশেষ করে নারী জাতি।
ম্যানেজার সাহেব বললেন,
-বিকাল চারটায় স্যারের সাথে দেখা করবেন। আর ফাইজলামি আমার সাথে করছেন ভালো। স্যারের সাথে করবেন না।
-উনি কোথায় থাকবেন?
আমার প্রশ্নের পর উনি যে দৃষ্টি দিলেন তাতে উনি কোন দেবতা হলে আমিমি ভষ্ম হয়ে যেতাম। স্যার কোথায় আছেন তা না জানার অপরাধে।
-বাসায়।
ম্যানেজার চলে গেলেন। আমি অফিসের বেয়ারা কে ডেকে চা দিতে বললাম। আলম সাহেবের অফিসের চা খুবই ভালো হয়। চা শেষ করে আমি সোলায়মান সাহেব কে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। সোলায়মান সাহেব আমার বয়সী। মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন পান। আর আমি ভিক্ষাবৃত্তি করি। অন্তত আমার কাছে উনি সাহেব ডাকের সন্মান টুকু পাওনা।
ম্যানেজার সাহেবের উল্লেখিত 'স্যারে'র অপেক্ষায় বসে আছি। এটা তার বাড়ির 'ওয়েটিং রুম!' এই ঘর দেখলেই বোঝা যায় এই দেশের কিছু মানুষ টাকা খরচ করার যায়গা খুজে পায় না। আমি আসার পর টোটাল ছয় কাপ চা খেয়েছি। আলম সাহেবের অফিসের মত বাসার চাও অসাধারন।
একটু পরেই আমার ডাক পড়ল। মানে বাড়ির কাজের লোক এসে ডেকে নিয়ে গেল। আলম সাহেব তার লাইব্রেরীতে আছে। লাইব্রেরীততে ঢোকার আগে আমি এই বাড়ির যতটুকু দেখেছি তাতে ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেয়েছি। হিন্দি সিনেমায় বড়লোকদের বাড়ি হিসেবে যে সব বাড়ি দেখানো হয় তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু। যদিও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ভিতর দিয়া ফিটফাট উপ্রে দিয়া সদর ঘাট। বাংলা প্রবাদটা একদম উল্টে দিয়েছে এই বাড়ি।
আলম সাহেবকে দেখে আমি হকচকিয়ে গেলাম। কারো সাথে প্রথম দেখার আগে মানুষের মন সেই মানুষটার একটা পোট্রেট তৈরি করে। আমার মনের তৈরি করা পোট্রেটের একদম উল্টো। বয়স বেশি হলে বিয়াল্লিশ। একটা চুলেও পাক ধরেনি। সেটা কলপের কারসাজিও হতে পারে। নিখুত ব্যাক ব্রাশ করা। সুঠাম দেহ।
-হ্যালো মিস্টার সৈকত। আমি জাহাঙ্গীর আলম। তবে অফিসে আমার একটা নাম প্রচলিত আছে। আমার পেছলে সে নামে ডাকা হয়। জানোয়ার আলম।
বলেই আলম সাহেব প্রচন্ড ভাবে হেসে উঠলেন। তারপর মুচকি একটা হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বললেন,
-আপনি এখন ভাবছেন 'বাহ আলম সাহেবের হাসি তো বেশ সুন্দর!'
আমি আলতো করে মাথা নাড়লাম।
-প্রচুর টাকা থাকলে কি হয় জানেন মানুষের মনের কথা জানা যায়। বিশেষত নিজের সম্পর্কে ভালো কথা গুলো। কিভাবে জানেন?
-না!
-ধরুন আমি আমার অফিসের এক কর্মচারী কে জিজ্ঞেস করলাম, 'রশীদ সাহেব বলুন তো আমাকে আজ অনেক কম বয়স লাগছে না?'
রশীদ সাহেব বলবেন, 'ঠিক স্যার। আপনি একদম আমার মনের কথাটা বলেছেন। মনে হচ্ছে আজকে আপনার বয়স দশ বছর কমে গেছে।' যদিও ওই দিন আমার চুলে কলপ না দেয়ায় সাদা চুল দেখা যাচ্ছে।
একটু থামলেন আলম সাহেব। জানোয়ার আলম। তারপর আবার শুরু করলেন।
-আসলে এরা ভাবে যে আমাকে খুশি রাখলেই বেতন বাড়বে। বোনাস বাড়বে। কিন্তু তারা জানেনা বেতন বোনাস বাড়ে কর্মের উপর। কর্মই সব। কর্মই মানব ধর্ম। যাই হোক আপনি কত টাকা চান?
আমি নির্বিকার ভাবে বললাম,
-চার লাখ বাইশ হাজার দুইশ তের টাকা।
জানোয়ার আলম আবার হাসলেন। উনার হাসি আসলেই খুব সুন্দর।
-আপনি জানেন আপনার যা চেয়েছেন তার তিন ভাগের এক ভাগে আমার চাহিদা পূরন সম্ভব?
-তাহলে তিন ভাগের এক ভাগেই চাহিদা পূরন করুন। আমি উঠি।
জানোয়ার সাহেব আবার হাসলেন। এ হাসি ধূর্ততার হাসি।
-আপনি পাকা ব্যবসায়ী। নিজের শরীর নিয়েও ব্যবসা করেন। আপনি টাকা পাবেন।
-একটা শর্ত আছে।
-কি শর্ত বলুন।
-অর্ধেক মানি অ্যাডভান্স দিতে হবে।
-শর্ত গ্রান্টেড।
আপনার শর্ত মানলাম কেন জানেন?
-প্রয়োজন বোধ করছি না।
-মানুষ অপ্রয়োজনেও অনেক কিছু জানে। এটা মানুষের ধর্ম!
-আচ্ছা বলুন।
-আমার মেয়েটার রক্তের গ্রুপ ছিল এ নেগেটিভ। ওরও দু'টা কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল। মাত্র সাত বছর বয়স ছিল ওর। আমার কোলে মারা গেছে 'লিন।' আমি চাই না আজিজ সাহেবের মেয়েটাও মারা যাক।
হাটতে ইচ্ছে করছে না। কয়েকদিনের মধ্যেই যে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার মালিক হবে তার হাটতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি হুমায়ুন স্যারের হিমু না। আমি সমুদ্রের খুব কাছের লোক।
এখুনি একটা হিসাব দাড় করিয়ে ফেলতে হবে। নইলে অতত গুলো টাকা এক সাথে পেয়ে মাথা ঠিক থাকবে না। পরে টাকার হিসাব পাবো না। প্রথমেই ধার গুলো শোধ করে ফেলতে হবে। রমজান টাকা পায় এক হাজার। প্রায় দু'মাস আগের দেনা। ওর সামনে দু'টা এক হাজার টাকার নোট ফেলে বলা যেতে পারে,
-"এই নে সুদ সহ ফেরত দিলাম!"
দ্রুত হিসাবের কাজটা সেরে ফেলতে হবে।
সকালে ঘুম ভাঙলো বিড়ালের ডাকে। মানব বিড়াল। আমার মেস মালিক। "কতা হুনলে মনে লয় 'বিলাই চিল্লায়।"
এই মহান বানী আমাদের মেসের কাজের ছেলে আকবর। এদেশের মোগল সম্রাট গন মনে হয় পরের জন্মে চাকর শ্রেণিগত হয়ে জন্মেছেন। বেশির ভাগ হোটেলের বয়, চায়ের দোকানের ছেলে এদের নাম হয় মোঘল সম্রাট গনের নামানুসারে। পরের জন্মে নাম পরিবর্তনের কি বিধান জানা নাই। দ্বিতীয় জন্মের ব্যাপারেও জানা নাই।
বিড়াল মানব বললেন আমার অতিথি এসেছে। আমি একটা ছেড়া স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বাইরে গিয়ে দেখি আজিজুর রহমান সাহেব। উনি কোন কথা না বলে আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। কাগজ খুলে দেখি হাতে লেখা চিঠি।
"মিস্টার সৈকত,
ভালো আছেন নিশ্চই। এই মুহুর্তে আপনার ভালো থাকার আমাদের জন্য একান্ত জরুরী।
তাই আপনি ম্যানেজার সাহেবের সাথে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে চলে আসবেন। আপনার অপারেশনের তারিখ পাঁচ দিন পর।
শুভ কামনা রইল।
পুনশ্চঃ টাকার ব্যাপারে ম্যানেজার সাহেবকে কিছু বলবেন না।
ইতি
জানোয়ার আলম।"
আলম সাহেবের হাসির মত হাতের লেখাও চমৎকার।
আলম সাহেব আমাকে শেষ চমক দিলেন অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে।
চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকা মাত্র লেখা একটা চেক আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-পুরো টাকাটাই দিয়ে দিলাম। আপনার শর্তের চেয়েও এক লাইন এগিয়ে থাকলাম। হা হা হা হা হা!!!!
আলম সাহেব প্রায় হাসপাতাল কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন।
অপারেশনের সাত দিন পর ডাক্টার বললেন কাল আমাকে রিলিজ করা হবে। এই সাতটা দিন সারাক্ষন আমার পকেটে হাত ছিল। আর ছিল চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকার একটা চেক।
ডাক্টার রিলিজ করার আগেই আমি রিলিজ হয়ে গেলাম। সহজ কথায় পালালাম। পকেটে হাত দিয়েই। কিন্তু পকেটে শুধু আমার হাতই ছিল। আর চার লক্ষ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকার চেকটা আমি অত্যন্ত যত্নের সাথে পঞ্চাশ টুকরো করে আমার বেডে ছড়িয়ে রেখে এসেছি। আর বালিশের নিচে একটা ভাজ করা কাগজ।
"আলম সাহেব,
এই ব্যস্ত নগরীতে আমাকে না খুঁজে আমার ঠিকানায় খুঁজুন আমাকে। সমুদ্রের খুব কাছের লোক আমি।
আমি সৈকত।"
হাটছি। আজ সম্ভবত অমাবশ্যা। নয়তো আকাশে মেঘ খুব। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজবো। খুব ইচ্ছে করছে।
নিজেকে কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে। আচ্ছা একটা কিডনী কম থাকলে কত কেজি ওজন কমে?
হাটতে খুব সমস্যা হচ্ছে। বা পায়ের স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় দেখলাম এ বেচারাকে বিদায় দেয়ার সময় হয়ে গেছে। স্যান্ডেল জোড়া রাস্তায় রেখে হিমু হয়ে গেলাম। আচ্ছা চার লাখ বাইশ হাজার দুইশত তের টাকায় কত জোড়া স্যান্ডেল কেনা যায়?
বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে। তবে জোর নেই তেমন। তবে যখন তখন জোড়ে নামতে পারে। আমি ফুটপাতে দাড়িয়ে পড়লাম জোড়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষায়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রেনেসাঁ সাহা ১২/০৬/২০১৫দারুণ সুন্দর লেখনী। মনোমুগ্ধকর।
-
সবুজ আহমেদ কক্স ১৫/০৪/২০১৫ভেরি নাইস লিখনী
মুগ্ধকর