মুকুটপুর এক্সপ্রেস
ট্রেন চলছে। মধ্যরাত।
শীত ক্রমেই বাড়ছে। অন্ধকারের উপর জ্যোছনার ভয়াবহ প্রভাবে চারপাশ অনেকটাই আলোকিত। পুরো পরিবেশটায় কেমন জানি একটা ভেজা ভেজা ভাব রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ আচমকা এক বাতাস ট্রেনের প্রত্যেককেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর বাতাসে ভেজার অন্যরকম একটা ব্যাপার থাকে। মৃদু বাতাস শুধু মানুষের শরীর নয়,মনটাকেও ভিজিয়ে দিয়ে যায় ক্ষানিকটা।
রাহাত। প্রচন্ড বইপোঁকা স্বভাবের।বইপোকা টাইপের মানুষগুলোর সবসময় একটি চশমা আর চেহারায় বোকা বোকা ভাব এদুটোই থাকা চাই।কিন্তু, রাহাতই আমার দেখা একমাত্র বইপোঁকা যার এ দুটোর একটিও নেই।কলেজে পড়তে বিন্দু নামে একটা বন্ধু ছিলো বইপোকা। ওর চশমা না থাকলেও চেহারায় ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না টাইপের বোকা বোকা ভাব ছিলো।যার জন্যে ইউনি’র প্রায় প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিই বিন্দুর প্রতি বায়াসড ছিলো।
রাহাত এই মুহূর্তে রবী ঠাকুরের অমিত আর লাবন্যের শেষ সন্ধ্যায় ডুবে আছে।রাহাত বুঝতে পারছে এই মুহুর্তে সে যতই পাতা উল্টোবে তার মন ততই খারাপ হতে থাকবে। রাহাত পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছে। এত আয়োজন করে দুঃখ পেতে এর আগে আমি কাউকে দেখি নি।
সুপ্রীতি প্রায় দুঘন্টা যাবত রাহাতের মোবাইলটা বন্ধ পাচ্ছে।বিছানায় এপাশ ওপাশ করে এক অসহ্য যন্ত্রনায় সময় কাটাচ্ছে মেয়েটা।
সুপ্রীতি আর রাহাত-এরা দু’জনেই দুজনকে ছাড়া থাকতে পারে না।অথচ যতক্ষনই এরা একসাথে থাকে দুঃখ ছাড়া কেউই কিছু পায় নি। রাহাত এখন শেষের কবিতায় লাবন্যের আবৃত্তিতে বিভোড়ঃ
“সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া
এনেছ অশ্রুজল।
এনেছ তোমার বক্ষে ধরিয়
দুঃসহ হোমানল।
দুঃখ যে তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে,
মুগ্ধ প্রাণের আবেশবন্ধ টুটে,
এ তাপে শ্বসিয়া উঠে বিকশিয়া
বিচ্ছেদশতদল......।”
ট্রেন চলছে।নীচে প্রকট এক নদীর বুকচিড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে মুকুটপুর এক্সপ্রেস। এই মধ্যরাতে নদীর রূপটা সত্যিই ভয়াবহ। দূরে দেখা যাচ্ছে মৃদুমৃদু জ্বলছে কয়েকটি ভবনের লাইট। ভবনগুলো সরকারী ভবনই হবে। কারন সরকার অপচয় রোধের কথা বলে নিজেই পাইকারী দরে বিদ্যুত অপচয় করে।
অপু চিপসের প্যাকেটটা ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেললো। নদীতে পড়েছে কি না তা দেখার আগেই মুকুটপুর এক্সপেস অনেকদুর এগিয়ে গেলো।
মনোজ চক্রবর্তী, অপুর বাবা। প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা। এসব লোকদের প্রায় সবারই একটা কমন বিষয় থাকে। আর তা হচ্ছে, আরলি টু বেড, আরলি টু রাইজ। প্রায় প্রতিরাতেই মনোজ সাহেব ১১টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর ১২ টার পর তাকে কখনো সচেতন থাকতে দেখা যায়নি। অবশ্য এর জন্যে তাকে বেগও কম পেতে হয় না। ছুটির দিনগুলোতে তিনি চাইলেও সকাল ৮ টার পর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন না। ঘুমতো আসেই না, উল্টো তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়।
মনোজ সাহেবের মন প্রচন্ড খারাপ।নতুন কর্মস্থল মুকুটপুর যাচ্ছেন কোয়ার্টার রিভিও-এ। স্থায়ীভাবে উঠার আগে নিজে একবার দেখতে যাচ্ছেন। আর বাবার চাকুরীর পুরো প্রভাবটা পড়ে অপুর উপর। ক্লাশ ফাইভের এইটুকুন এক ছেলে এখন পর্যন্ত স্কুল পাল্টিয়েছে চারবার।এর একটিই ভালো সংবাদ। অপুর বন্ধু সংখ্যা ইতিমধ্যেই দু’অংক ছাড়িয়েছে। মনোজ সাহেবের আসার আগেও ঝগড়া হয়েছে মিসেস মনোজের সাথে।অফিসে যতটা শক্ত মনোজ সাহেব, তার স্ত্রীর কাছে ততটাই নরম তিনি।মাঝে মাঝে কাঁদার অভ্যেসটাও হয়ে গেছে বিয়ের পর।মনোজ সাহেব ভালো করেই জানেন, কোয়ার্টার রিভিও অকে হবার পরবর্তী সপ্তাহখানেক তাকে ফ্লোরিং করতে হবে।এসব ভেবে ঘুমোতেও পারছেন না তিনি।
এককাপ চাঁ খেতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু সরকারী কর্মকর্তারা খুব দরকার হলেও নিজের চেঁয়ার ছেড়ে উঠেন না। তারা শুধু অর্ডার করতেই ইয়ুসড টু। মনোজ সাহেব অর্ডার করার মতই কাউকে খুজছেন। অপেক্ষারত মনোজ সাহেবের চোঁখ হঠাত ম্লান হয়ে গেলো। তিনি অপুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করলেন সেই দিনটির কথা। ঢাঃবিঃ’র ছাত্র থাকা অবস্থায় যেই দিনটাতে তার সাথে তার স্ত্রীর দেখা হয়েছিলো, আর পরের দিনগুলোতে ক্যাফেটেরিয়া, কার্জন হলের সবুজ ঘাসে কাটানো মুহূর্তগুলি...।
ট্রেন চলছে। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে ট্রেনের গতি এখন শব্দে পরিনত হয়ে গেছে।
জ্যোতি’র অতিরিক্ত স্নিগ্ধতা তার নিজেকেই মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়।এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তার সবটাই জ্যোতি’র কাছে স্বর্গদৃশ্য মনে হচ্ছে। ২১ এ পাঁ দেয়া এ মেয়ের এটাই প্রথম ট্রেন জার্নি। জ্যোতি ছোটবেলায় পড়েছিলো “এ জার্নি বাই ট্রেন.” তখন খুব কষ্ট করে এক পাতা লিখতে হয়েছিলো। এই মুহুর্তে তাকে লিখতে দেয়া হলে আমি নিশ্চিত সে হয়তো মিনিটেই লিখে ফেলবে কয়েক পাতা।
জ্যোতির বিয়ে হল ৬ মাস হতে চলল। অথচ এখনও মাঝে মাঝে সে ভুলেই যায় যে সে ম্যারিড! কানে এই একটা গানই কখন থেকে বেজে যাচ্ছে ‘you fill up my senses......’
শুভ্র’র অনেক পছন্দের একটি গান। এতক্ষন একসাথেই শুনছিলো। শুভ্র গিয়েছে ডাইনিং এ, চা আনতে। জ্যোতি’র অপেক্ষা শুভ্রের জন্য।
শুভ্রের গা জমে যাচ্ছে প্রায়। চাঁ হাতে এক কাঁমড়া থেকে নিজ কাঁমড়ার পথে শুভ্র ভাবছে, জ্যোতির সাথে হেডফোনের সাথে তার চাদরটাও শেয়ার করতে হবে এখন। পছন্দের গান, সাথে প্রিয়জন এই মধ্যরাতের মুকুটপুর এক্সপ্রেস কে অনেকটা কল্পনার মতই লাগছে শুভ্র’র।
হঠাৎ ট্রেনের গতি কমছে। ততক্ষনে ট্রেন খানিকটা শহরাঞ্চলে। পাশ দিয়েই সমান্তরাল হাইওয়ে। পুরো হাইওয়েটাই একেবারে ফাঁকা। খানিকটা পথ বেকে গিয়ে সোডিয়াম আলোর হলুদ রঙ টাকেও বাঁকতে দেখলাম।
মুকুটপুর এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে থেমে পরলো। নিচে নেমে খানিকটা অবাক হলাম। ষ্টেশনহীন এ স্থানটায় ট্রেন থামাটা আসলেই অন্যরকম। খানিকের জন্য মনে হচ্ছিলো
মুকুটপুর এক্সপ্রেস তা’র যাত্রী সহ জিম্মি হয়েছে। ততক্ষনে আমার সামনে গলায় সিগারেটের বাক্স ঝোলানো মধ্যবয়স্ক এক চাঁ ওয়ালা। এখানে প্রচন্ড শীত। চারপাশের নিরবতায় নিজেকেই অচেনা লাগছে। নিচ থেকে দেখা পুরো ট্রেনটাকে ভালোই ভয়ানক মনে হচ্ছে।
চা’টা বেশ গরম। আদাঁ আর লেবুর মিক্সড একটা কেমিস্ট্রি। মুহুর্তেই কালো পরিবেশটা ঘন হয়ে উঠলো। আকাশে মৃদু গর্জন। নিজেকে স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা মনে হচ্ছে। ততক্ষনে দু’এক ফোটা আমার চাঁয়ের কাপে। আর পরক্ষনেই সেই ফোটা বর্ষনে রুপ নিলো।
আমি ভিজছি, সাথে চাঁয়ের কাপটাও।
এর আগেও বৃষ্টিতে ভিজে চাঁ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো।এর একটা বিশেষ দিক হল যতই চাঁয়ের কাপে চুমুক দেয়া হোক, চা কমবে না। এই মুহুর্তে সব কিছুই কল্পনা মনে হচ্ছে। বাস্তবে কল্পনা দেখা টা সবার জন্যে না। সবাই এটা সহ্য করতে পারে না। আমি বিল দিবো এ শর্তে চা ওয়ালাকেও এক কাপ চাঁ খেতে বললাম। বিলের টাকা হালাল করার জন্য সেও নিলো এক কাপ চাঁ। আমি আর চাঁ ওয়ালা মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজে চাঁয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।
আজ অনুর জন্মদিন। অনুর সাথে দেখা করতেই আমার মুকুটপুর যাওয়া। দু’বার অনুকে লালশাড়ি পড়ে ষ্টেশনে বসে থাকতে দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে। দু’বারই দেখেছি অনুর লালটিপ টা অনেকটাই বাঁ দিকে সড়ে গেছে । আজ অনুকে বলেছি আমার স্বপ্নের কথা। ভোরবেলায় আমি অনুকে দেখবো।লালশাড়ি পড়া একটা মেয়ে লালটিপ পড়ে ষ্টেশনে বসে থাকবে। মেয়েটার টিপ খানিকটা বাঁ দিকে সড়ে গেছে। আমি টিপটায় হাত দিতেই লজ্জায় অনু আরো টুকটুকে হবে।
বৃষ্টি ঝরছেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ ।হঠাৎ মৃদু শব্দে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। মাঝকামড়া থেকে কেউ একজন সবুজ পতাকা উড়াচ্ছেন। যেকোন মুহুর্তেই এগোবে মুকুটপুর এক্সপ্রেস।
আমি মধ্যবয়স্ক লোকটিকে আরেক কাপ চাঁ দিতে বললাম। আদা আর লেবুর কম্বাইন্ড চাঁ। ধীরে ধীরে চাঁকা ঘুরতে শুরু করলো মুকুটপুর এক্সপ্রেস’র।
বৃষ্টি খানিকটা বেড়েছে। আমি চাঁ এ দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবছি, আর একটা গর্জন হোক, আর একবার আলোকিত হোক চারপাশ!
রাহাত, মনোজ সাহেব, জ্যোতি আর শুভ্র প্রত্যে্কেই একেকটা ভিন্ন গল্প।এতগুলো ভিন্ন গল্প নিয়ে মুকুটপুর এক্সপ্রেসের এখন একটাই গল্প-
যেতে হবে মুকুটপুর.........।।
পুনশ্চঃ ঢাকায় ব্যস্ত ওয়াল স্ট্রীট এর ধাঁরঘেষে অনেক মানুষের ভীড়। টিভি তে সংবাদ সর্বশেষঃ মুকুটপুরগামী “মুকুটপুর এক্সপ্রেস” আজ ভোরে আয়ানালয় নামক এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান কমপক্ষে ২০ জন। নিহতদের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এরা হলেন- রাহাত খান(২৪), মনোজ চক্রবর্তী(৪৫), অপু চক্রবর্তী(১০), জ্যোতি সায়হাম(২১) ও শুভ্র সায়হাম(২৫)।
.
.
.
.
.
.
.
‘অনুকে আরেকবার দেখার ইচ্ছে নিয়ে আমি আজো স্বপ্ন খুজছি। জানালার পাশ দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবছি, আর একটা গর্জন হোক, আর একবার আলোকিত হোক চারপাশ!!’
শীত ক্রমেই বাড়ছে। অন্ধকারের উপর জ্যোছনার ভয়াবহ প্রভাবে চারপাশ অনেকটাই আলোকিত। পুরো পরিবেশটায় কেমন জানি একটা ভেজা ভেজা ভাব রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ আচমকা এক বাতাস ট্রেনের প্রত্যেককেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর বাতাসে ভেজার অন্যরকম একটা ব্যাপার থাকে। মৃদু বাতাস শুধু মানুষের শরীর নয়,মনটাকেও ভিজিয়ে দিয়ে যায় ক্ষানিকটা।
রাহাত। প্রচন্ড বইপোঁকা স্বভাবের।বইপোকা টাইপের মানুষগুলোর সবসময় একটি চশমা আর চেহারায় বোকা বোকা ভাব এদুটোই থাকা চাই।কিন্তু, রাহাতই আমার দেখা একমাত্র বইপোঁকা যার এ দুটোর একটিও নেই।কলেজে পড়তে বিন্দু নামে একটা বন্ধু ছিলো বইপোকা। ওর চশমা না থাকলেও চেহারায় ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না টাইপের বোকা বোকা ভাব ছিলো।যার জন্যে ইউনি’র প্রায় প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিই বিন্দুর প্রতি বায়াসড ছিলো।
রাহাত এই মুহূর্তে রবী ঠাকুরের অমিত আর লাবন্যের শেষ সন্ধ্যায় ডুবে আছে।রাহাত বুঝতে পারছে এই মুহুর্তে সে যতই পাতা উল্টোবে তার মন ততই খারাপ হতে থাকবে। রাহাত পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছে। এত আয়োজন করে দুঃখ পেতে এর আগে আমি কাউকে দেখি নি।
সুপ্রীতি প্রায় দুঘন্টা যাবত রাহাতের মোবাইলটা বন্ধ পাচ্ছে।বিছানায় এপাশ ওপাশ করে এক অসহ্য যন্ত্রনায় সময় কাটাচ্ছে মেয়েটা।
সুপ্রীতি আর রাহাত-এরা দু’জনেই দুজনকে ছাড়া থাকতে পারে না।অথচ যতক্ষনই এরা একসাথে থাকে দুঃখ ছাড়া কেউই কিছু পায় নি। রাহাত এখন শেষের কবিতায় লাবন্যের আবৃত্তিতে বিভোড়ঃ
“সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া
এনেছ অশ্রুজল।
এনেছ তোমার বক্ষে ধরিয়
দুঃসহ হোমানল।
দুঃখ যে তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে,
মুগ্ধ প্রাণের আবেশবন্ধ টুটে,
এ তাপে শ্বসিয়া উঠে বিকশিয়া
বিচ্ছেদশতদল......।”
ট্রেন চলছে।নীচে প্রকট এক নদীর বুকচিড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে মুকুটপুর এক্সপ্রেস। এই মধ্যরাতে নদীর রূপটা সত্যিই ভয়াবহ। দূরে দেখা যাচ্ছে মৃদুমৃদু জ্বলছে কয়েকটি ভবনের লাইট। ভবনগুলো সরকারী ভবনই হবে। কারন সরকার অপচয় রোধের কথা বলে নিজেই পাইকারী দরে বিদ্যুত অপচয় করে।
অপু চিপসের প্যাকেটটা ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেললো। নদীতে পড়েছে কি না তা দেখার আগেই মুকুটপুর এক্সপেস অনেকদুর এগিয়ে গেলো।
মনোজ চক্রবর্তী, অপুর বাবা। প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা। এসব লোকদের প্রায় সবারই একটা কমন বিষয় থাকে। আর তা হচ্ছে, আরলি টু বেড, আরলি টু রাইজ। প্রায় প্রতিরাতেই মনোজ সাহেব ১১টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর ১২ টার পর তাকে কখনো সচেতন থাকতে দেখা যায়নি। অবশ্য এর জন্যে তাকে বেগও কম পেতে হয় না। ছুটির দিনগুলোতে তিনি চাইলেও সকাল ৮ টার পর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন না। ঘুমতো আসেই না, উল্টো তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়।
মনোজ সাহেবের মন প্রচন্ড খারাপ।নতুন কর্মস্থল মুকুটপুর যাচ্ছেন কোয়ার্টার রিভিও-এ। স্থায়ীভাবে উঠার আগে নিজে একবার দেখতে যাচ্ছেন। আর বাবার চাকুরীর পুরো প্রভাবটা পড়ে অপুর উপর। ক্লাশ ফাইভের এইটুকুন এক ছেলে এখন পর্যন্ত স্কুল পাল্টিয়েছে চারবার।এর একটিই ভালো সংবাদ। অপুর বন্ধু সংখ্যা ইতিমধ্যেই দু’অংক ছাড়িয়েছে। মনোজ সাহেবের আসার আগেও ঝগড়া হয়েছে মিসেস মনোজের সাথে।অফিসে যতটা শক্ত মনোজ সাহেব, তার স্ত্রীর কাছে ততটাই নরম তিনি।মাঝে মাঝে কাঁদার অভ্যেসটাও হয়ে গেছে বিয়ের পর।মনোজ সাহেব ভালো করেই জানেন, কোয়ার্টার রিভিও অকে হবার পরবর্তী সপ্তাহখানেক তাকে ফ্লোরিং করতে হবে।এসব ভেবে ঘুমোতেও পারছেন না তিনি।
এককাপ চাঁ খেতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু সরকারী কর্মকর্তারা খুব দরকার হলেও নিজের চেঁয়ার ছেড়ে উঠেন না। তারা শুধু অর্ডার করতেই ইয়ুসড টু। মনোজ সাহেব অর্ডার করার মতই কাউকে খুজছেন। অপেক্ষারত মনোজ সাহেবের চোঁখ হঠাত ম্লান হয়ে গেলো। তিনি অপুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করলেন সেই দিনটির কথা। ঢাঃবিঃ’র ছাত্র থাকা অবস্থায় যেই দিনটাতে তার সাথে তার স্ত্রীর দেখা হয়েছিলো, আর পরের দিনগুলোতে ক্যাফেটেরিয়া, কার্জন হলের সবুজ ঘাসে কাটানো মুহূর্তগুলি...।
ট্রেন চলছে। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে ট্রেনের গতি এখন শব্দে পরিনত হয়ে গেছে।
জ্যোতি’র অতিরিক্ত স্নিগ্ধতা তার নিজেকেই মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়।এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তার সবটাই জ্যোতি’র কাছে স্বর্গদৃশ্য মনে হচ্ছে। ২১ এ পাঁ দেয়া এ মেয়ের এটাই প্রথম ট্রেন জার্নি। জ্যোতি ছোটবেলায় পড়েছিলো “এ জার্নি বাই ট্রেন.” তখন খুব কষ্ট করে এক পাতা লিখতে হয়েছিলো। এই মুহুর্তে তাকে লিখতে দেয়া হলে আমি নিশ্চিত সে হয়তো মিনিটেই লিখে ফেলবে কয়েক পাতা।
জ্যোতির বিয়ে হল ৬ মাস হতে চলল। অথচ এখনও মাঝে মাঝে সে ভুলেই যায় যে সে ম্যারিড! কানে এই একটা গানই কখন থেকে বেজে যাচ্ছে ‘you fill up my senses......’
শুভ্র’র অনেক পছন্দের একটি গান। এতক্ষন একসাথেই শুনছিলো। শুভ্র গিয়েছে ডাইনিং এ, চা আনতে। জ্যোতি’র অপেক্ষা শুভ্রের জন্য।
শুভ্রের গা জমে যাচ্ছে প্রায়। চাঁ হাতে এক কাঁমড়া থেকে নিজ কাঁমড়ার পথে শুভ্র ভাবছে, জ্যোতির সাথে হেডফোনের সাথে তার চাদরটাও শেয়ার করতে হবে এখন। পছন্দের গান, সাথে প্রিয়জন এই মধ্যরাতের মুকুটপুর এক্সপ্রেস কে অনেকটা কল্পনার মতই লাগছে শুভ্র’র।
হঠাৎ ট্রেনের গতি কমছে। ততক্ষনে ট্রেন খানিকটা শহরাঞ্চলে। পাশ দিয়েই সমান্তরাল হাইওয়ে। পুরো হাইওয়েটাই একেবারে ফাঁকা। খানিকটা পথ বেকে গিয়ে সোডিয়াম আলোর হলুদ রঙ টাকেও বাঁকতে দেখলাম।
মুকুটপুর এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে থেমে পরলো। নিচে নেমে খানিকটা অবাক হলাম। ষ্টেশনহীন এ স্থানটায় ট্রেন থামাটা আসলেই অন্যরকম। খানিকের জন্য মনে হচ্ছিলো
মুকুটপুর এক্সপ্রেস তা’র যাত্রী সহ জিম্মি হয়েছে। ততক্ষনে আমার সামনে গলায় সিগারেটের বাক্স ঝোলানো মধ্যবয়স্ক এক চাঁ ওয়ালা। এখানে প্রচন্ড শীত। চারপাশের নিরবতায় নিজেকেই অচেনা লাগছে। নিচ থেকে দেখা পুরো ট্রেনটাকে ভালোই ভয়ানক মনে হচ্ছে।
চা’টা বেশ গরম। আদাঁ আর লেবুর মিক্সড একটা কেমিস্ট্রি। মুহুর্তেই কালো পরিবেশটা ঘন হয়ে উঠলো। আকাশে মৃদু গর্জন। নিজেকে স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা মনে হচ্ছে। ততক্ষনে দু’এক ফোটা আমার চাঁয়ের কাপে। আর পরক্ষনেই সেই ফোটা বর্ষনে রুপ নিলো।
আমি ভিজছি, সাথে চাঁয়ের কাপটাও।
এর আগেও বৃষ্টিতে ভিজে চাঁ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো।এর একটা বিশেষ দিক হল যতই চাঁয়ের কাপে চুমুক দেয়া হোক, চা কমবে না। এই মুহুর্তে সব কিছুই কল্পনা মনে হচ্ছে। বাস্তবে কল্পনা দেখা টা সবার জন্যে না। সবাই এটা সহ্য করতে পারে না। আমি বিল দিবো এ শর্তে চা ওয়ালাকেও এক কাপ চাঁ খেতে বললাম। বিলের টাকা হালাল করার জন্য সেও নিলো এক কাপ চাঁ। আমি আর চাঁ ওয়ালা মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজে চাঁয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।
আজ অনুর জন্মদিন। অনুর সাথে দেখা করতেই আমার মুকুটপুর যাওয়া। দু’বার অনুকে লালশাড়ি পড়ে ষ্টেশনে বসে থাকতে দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে। দু’বারই দেখেছি অনুর লালটিপ টা অনেকটাই বাঁ দিকে সড়ে গেছে । আজ অনুকে বলেছি আমার স্বপ্নের কথা। ভোরবেলায় আমি অনুকে দেখবো।লালশাড়ি পড়া একটা মেয়ে লালটিপ পড়ে ষ্টেশনে বসে থাকবে। মেয়েটার টিপ খানিকটা বাঁ দিকে সড়ে গেছে। আমি টিপটায় হাত দিতেই লজ্জায় অনু আরো টুকটুকে হবে।
বৃষ্টি ঝরছেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ ।হঠাৎ মৃদু শব্দে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। মাঝকামড়া থেকে কেউ একজন সবুজ পতাকা উড়াচ্ছেন। যেকোন মুহুর্তেই এগোবে মুকুটপুর এক্সপ্রেস।
আমি মধ্যবয়স্ক লোকটিকে আরেক কাপ চাঁ দিতে বললাম। আদা আর লেবুর কম্বাইন্ড চাঁ। ধীরে ধীরে চাঁকা ঘুরতে শুরু করলো মুকুটপুর এক্সপ্রেস’র।
বৃষ্টি খানিকটা বেড়েছে। আমি চাঁ এ দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবছি, আর একটা গর্জন হোক, আর একবার আলোকিত হোক চারপাশ!
রাহাত, মনোজ সাহেব, জ্যোতি আর শুভ্র প্রত্যে্কেই একেকটা ভিন্ন গল্প।এতগুলো ভিন্ন গল্প নিয়ে মুকুটপুর এক্সপ্রেসের এখন একটাই গল্প-
যেতে হবে মুকুটপুর.........।।
পুনশ্চঃ ঢাকায় ব্যস্ত ওয়াল স্ট্রীট এর ধাঁরঘেষে অনেক মানুষের ভীড়। টিভি তে সংবাদ সর্বশেষঃ মুকুটপুরগামী “মুকুটপুর এক্সপ্রেস” আজ ভোরে আয়ানালয় নামক এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান কমপক্ষে ২০ জন। নিহতদের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এরা হলেন- রাহাত খান(২৪), মনোজ চক্রবর্তী(৪৫), অপু চক্রবর্তী(১০), জ্যোতি সায়হাম(২১) ও শুভ্র সায়হাম(২৫)।
.
.
.
.
.
.
.
‘অনুকে আরেকবার দেখার ইচ্ছে নিয়ে আমি আজো স্বপ্ন খুজছি। জানালার পাশ দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবছি, আর একটা গর্জন হোক, আর একবার আলোকিত হোক চারপাশ!!’
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১১/০৩/২০১৮অসাধারণ গল্প, চালিয়ে যান।
-
অনন্য দুর্জয় ১১/০৩/২০১৮বাব্বাহ, বেশ লাগলো
-
কামরুজ্জামান সাদ ১০/০৩/২০১৮সুন্দর লিখলেন।ভাল লেখাইতো আশা করি।
-
রাহিদ ০৮/০৩/২০১৮গর্জন হবেই,,,
-
জসিম মাহমুদ ০৮/০৩/২০১৮চালিয়ে যান