দুজন দুই মন
১.
মাথায় ঝাঁকড়া চুল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চেহারা। শহরের বড় রাস্তার পাশ ধরে হেটে যাচ্ছে অসীম। একটু পরপর রাস্তার পাশে লাগানো গাছগুলো ছুঁয়ে দেখছে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাতে। তারপর জোরে একটা দম নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ছেড়ে দিচ্ছে। যেন গাছের নির্গত অক্সিজেন বাতাসে মিশে যাওয়ার আগেই প্রবেশ করানো চাই তার নাসারন্ধ্রে।
এই তিরিশ বছরের টগবগে যুবক কোনো কবি, সাহিত্যিক বা সাহিত্যানুরাগী নন । হাটতে ভালবাসা বৃক্ষপ্রেমি পথচারীও নন। সদ্য বিয়োগ হওয়া স্ত্রীর শোকে কাতর কোনো গৃহত্যাগী আদর্শ পতিও নন। বরং নিজের স্ত্রীকে হত্যার দায়ে সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। যিনি বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
অসীমের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখা মেলে এক অসীম লাবণ্যময়ী রূপসীর। তারপ্রতি এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে সে। স্কুল-কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একবছর অতিক্রান্ত হলেও এমনভাবে কোনো নারীকেই সে তার মানসপটে স্থান দিতে পারেনি। মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার হেসেছে বলে মনে হয় অসীমের। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেয়েটি তার বিভাগে পড়ে না, একই বর্ষের, নাম তার অনন্যা। অসীম মনে মনে বলে 'সত্যিই অনন্যা!' আলতো করে হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে। সেই হাসির অর্থ মেয়েটিকে বোঝানো চাই। বোঝাতে পেরেছিল সে। অনন্যা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়। সে স্বাবলম্বী হতে চায়। নির্ভরশীলতা সে কখনোই মেনে নিতে পারে না। শব্দটাই তার সাথে বেমানান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দুজনেই শুরু করে চাকরির খোঁজ। অসীম চাকরি পেলেও অনন্যার ভাগ্যে সে রেখা অস্পষ্ট থেকে যায়। তবে তা তাদের দুজনের একীকরণে কোনো প্রভাব ফেলে না। বরং সমাজ ব্যবস্থায় 'আদর্শ' জুটি বলা চলে। অসীমের চাকরি না হলে হয়তো সমীকরণ ভিন্ন হতে পারতো।
দুই পরিবারের সম্মতিতে মহাসমারোহে তাদের বিয়ে হয়।
২.
অসীমের আয়ে বেশ ভালো চলছিল তাদের সংসার। তবে অনন্যা চাকরির খোঁজ থামায়নি। সময় পেলেই সে খবরের কাগজ কিংবা ইন্টারনেটে নিজের একটা কর্মসংস্থান খুঁজে নেবার চেষ্টা করে। বিয়ের একবছরের মাথায় পেয়েও যায়। দুজনেই চাকরি করায় জীবন বদলে যায় তাদের। এক ধরনের অস্বচ্ছ ভাঙন দেখা দেয় দুজনের চিন্তার মিলনরেখায়। নিজেদের নিয়ে আলাদা করে চিন্তা শুরু করে দুজনেই। সেই চিন্তা আবার মিলিত হয় এক জায়গায় গিয়ে। অনন্যার কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে। তারা তার নাম রাখে বিন্দু। এই বিন্দুতেই আবার দুটি নদীর ধারা গিয়ে মিশেছে কীনা! দুটি নদী এক জায়গায় মিশলেও এক হতে পারে না। একে অপরকে ছাপিয়ে আরও উপরে উঠতে চায়। তাদের নিজস্বতা থেকেই যায়। অসীম আর অনন্যাও পারেনি। তাই একটা দূরত্ব থেকেই যায় দুজনের মাঝে। মানসিক দূরত্ব। এই দূরত্বের কারণ অবশ্য তারা নিজেরাও জানে না। মাঝামাঝেই ওদের মনে পড়ে পুরনো দিনগুলোর কথা। আচ্ছা, সবকিছু পাল্টে গেলো কেনো? পরিবর্তনই কি ধর্ম? ধর্ম কি মানতেই হয়? ওরা ভাবে। নিজেদের কাছে প্রশ্ন করে নিজেরাই। উত্তর পায় না।
৩.
মাস ছয়েক হলো অসীমের চাকরি চলে গেছে। তার অফিসের এক সহকর্মীর কারসাজিই নাকি এর জন্য দায়ী। অনন্যা একাই সামলে নিচ্ছে সব। অসীম সারাদিন বাসায়ই থাকে। বিন্দুর সাথে সময় কাটায়। বিন্দু এখন একটু একটু কথা বলতে পারে। আ-কার উচ্চারণ করতে পারে না। আ-কার হয়ে যায় উ-কার। পাপাকে ডাকে পুপু। মাম্মাকে ডাকে মুম্মু। এ নিয়ে অনন্যার সাথে নানান খুনসুটিও হয় অসীমের। কিছুদিনেই মেয়ে হয়ে যায় অসীমের পৃথিবী। এভাবেই চলছিল।
অসীমকে অনন্যা ভালবাসে, সে প্রশ্নে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অসীমের চাকরি না থাকা অনন্যাকে একপ্রকার মানসিক স্থিরতা দেয়। আর স্বাভাবিকভাবেই চাকরি না থাকা অসীমের মনস্তত্ত্বে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিছুদিন যেতেই অসীম একেবারেই অচেনা হয়ে ওঠে অনন্যার কাছে। অসীম খুব কম কথা বলে। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। অনন্যা হয়ে ওঠে তার প্রথম ও একমাত্র বিরক্তির কারণ। অনন্যার কাছে মনে হয় অসীমের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। সে তার পরিচিত একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করে। সে অসীমকে নিয়ে দেখা করতে বলে। অনন্যা ভেবে পায় না কীভাবে সে এই কথা অসীমকে বলবে। এক পর্যায়ে উপায় হিসেবে ভেবে বের করে, অসীমের এক বন্ধু রাজীবকে সে বলবে সবকিছু। বলার কাজটা সে-ই করবে। রাজীবকে জানাতেই সে রাজি হয় বন্ধুর উপকার করতে।
অসীমের সাথে রাজীব দেখা করে। তাকে জানায় সবকিছু। সাথেসাথেই অসীমের হাসিহাসি চেহারা পাল্টে যায়। সারাদেহের সব রক্ত যেন তার মুখমণ্ডলে এসে জমা হয়। রাজীবের শার্টের কলার চেপে ধরে। কিছু একটা ভেবে ছেড়েও দেয়। এরপর এক দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে রাজীব যতক্ষণে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
৪.
রাস্তায় হাটতে হাটতে অসীমের অনেক কথা মনে পড়ে। এরকম কোনো একটা গাছের নিচেই সে প্রথম দেখেছিল অনন্যাকে। অনন্যার শরীরের গন্ধ খুঁজে ফেরে গাছের শরীরে।
মাথায় ঝাঁকড়া চুল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চেহারা। শহরের বড় রাস্তার পাশ ধরে হেটে যাচ্ছে অসীম। একটু পরপর রাস্তার পাশে লাগানো গাছগুলো ছুঁয়ে দেখছে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাতে। তারপর জোরে একটা দম নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ছেড়ে দিচ্ছে। যেন গাছের নির্গত অক্সিজেন বাতাসে মিশে যাওয়ার আগেই প্রবেশ করানো চাই তার নাসারন্ধ্রে।
এই তিরিশ বছরের টগবগে যুবক কোনো কবি, সাহিত্যিক বা সাহিত্যানুরাগী নন । হাটতে ভালবাসা বৃক্ষপ্রেমি পথচারীও নন। সদ্য বিয়োগ হওয়া স্ত্রীর শোকে কাতর কোনো গৃহত্যাগী আদর্শ পতিও নন। বরং নিজের স্ত্রীকে হত্যার দায়ে সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। যিনি বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
অসীমের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখা মেলে এক অসীম লাবণ্যময়ী রূপসীর। তারপ্রতি এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে সে। স্কুল-কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একবছর অতিক্রান্ত হলেও এমনভাবে কোনো নারীকেই সে তার মানসপটে স্থান দিতে পারেনি। মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার হেসেছে বলে মনে হয় অসীমের। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেয়েটি তার বিভাগে পড়ে না, একই বর্ষের, নাম তার অনন্যা। অসীম মনে মনে বলে 'সত্যিই অনন্যা!' আলতো করে হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে। সেই হাসির অর্থ মেয়েটিকে বোঝানো চাই। বোঝাতে পেরেছিল সে। অনন্যা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়। সে স্বাবলম্বী হতে চায়। নির্ভরশীলতা সে কখনোই মেনে নিতে পারে না। শব্দটাই তার সাথে বেমানান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দুজনেই শুরু করে চাকরির খোঁজ। অসীম চাকরি পেলেও অনন্যার ভাগ্যে সে রেখা অস্পষ্ট থেকে যায়। তবে তা তাদের দুজনের একীকরণে কোনো প্রভাব ফেলে না। বরং সমাজ ব্যবস্থায় 'আদর্শ' জুটি বলা চলে। অসীমের চাকরি না হলে হয়তো সমীকরণ ভিন্ন হতে পারতো।
দুই পরিবারের সম্মতিতে মহাসমারোহে তাদের বিয়ে হয়।
২.
অসীমের আয়ে বেশ ভালো চলছিল তাদের সংসার। তবে অনন্যা চাকরির খোঁজ থামায়নি। সময় পেলেই সে খবরের কাগজ কিংবা ইন্টারনেটে নিজের একটা কর্মসংস্থান খুঁজে নেবার চেষ্টা করে। বিয়ের একবছরের মাথায় পেয়েও যায়। দুজনেই চাকরি করায় জীবন বদলে যায় তাদের। এক ধরনের অস্বচ্ছ ভাঙন দেখা দেয় দুজনের চিন্তার মিলনরেখায়। নিজেদের নিয়ে আলাদা করে চিন্তা শুরু করে দুজনেই। সেই চিন্তা আবার মিলিত হয় এক জায়গায় গিয়ে। অনন্যার কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে। তারা তার নাম রাখে বিন্দু। এই বিন্দুতেই আবার দুটি নদীর ধারা গিয়ে মিশেছে কীনা! দুটি নদী এক জায়গায় মিশলেও এক হতে পারে না। একে অপরকে ছাপিয়ে আরও উপরে উঠতে চায়। তাদের নিজস্বতা থেকেই যায়। অসীম আর অনন্যাও পারেনি। তাই একটা দূরত্ব থেকেই যায় দুজনের মাঝে। মানসিক দূরত্ব। এই দূরত্বের কারণ অবশ্য তারা নিজেরাও জানে না। মাঝামাঝেই ওদের মনে পড়ে পুরনো দিনগুলোর কথা। আচ্ছা, সবকিছু পাল্টে গেলো কেনো? পরিবর্তনই কি ধর্ম? ধর্ম কি মানতেই হয়? ওরা ভাবে। নিজেদের কাছে প্রশ্ন করে নিজেরাই। উত্তর পায় না।
৩.
মাস ছয়েক হলো অসীমের চাকরি চলে গেছে। তার অফিসের এক সহকর্মীর কারসাজিই নাকি এর জন্য দায়ী। অনন্যা একাই সামলে নিচ্ছে সব। অসীম সারাদিন বাসায়ই থাকে। বিন্দুর সাথে সময় কাটায়। বিন্দু এখন একটু একটু কথা বলতে পারে। আ-কার উচ্চারণ করতে পারে না। আ-কার হয়ে যায় উ-কার। পাপাকে ডাকে পুপু। মাম্মাকে ডাকে মুম্মু। এ নিয়ে অনন্যার সাথে নানান খুনসুটিও হয় অসীমের। কিছুদিনেই মেয়ে হয়ে যায় অসীমের পৃথিবী। এভাবেই চলছিল।
অসীমকে অনন্যা ভালবাসে, সে প্রশ্নে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অসীমের চাকরি না থাকা অনন্যাকে একপ্রকার মানসিক স্থিরতা দেয়। আর স্বাভাবিকভাবেই চাকরি না থাকা অসীমের মনস্তত্ত্বে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিছুদিন যেতেই অসীম একেবারেই অচেনা হয়ে ওঠে অনন্যার কাছে। অসীম খুব কম কথা বলে। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। অনন্যা হয়ে ওঠে তার প্রথম ও একমাত্র বিরক্তির কারণ। অনন্যার কাছে মনে হয় অসীমের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। সে তার পরিচিত একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করে। সে অসীমকে নিয়ে দেখা করতে বলে। অনন্যা ভেবে পায় না কীভাবে সে এই কথা অসীমকে বলবে। এক পর্যায়ে উপায় হিসেবে ভেবে বের করে, অসীমের এক বন্ধু রাজীবকে সে বলবে সবকিছু। বলার কাজটা সে-ই করবে। রাজীবকে জানাতেই সে রাজি হয় বন্ধুর উপকার করতে।
অসীমের সাথে রাজীব দেখা করে। তাকে জানায় সবকিছু। সাথেসাথেই অসীমের হাসিহাসি চেহারা পাল্টে যায়। সারাদেহের সব রক্ত যেন তার মুখমণ্ডলে এসে জমা হয়। রাজীবের শার্টের কলার চেপে ধরে। কিছু একটা ভেবে ছেড়েও দেয়। এরপর এক দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে রাজীব যতক্ষণে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
৪.
রাস্তায় হাটতে হাটতে অসীমের অনেক কথা মনে পড়ে। এরকম কোনো একটা গাছের নিচেই সে প্রথম দেখেছিল অনন্যাকে। অনন্যার শরীরের গন্ধ খুঁজে ফেরে গাছের শরীরে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৭/১১/২০২০চমৎকার
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ০৬/১১/২০২০Very Nice.
-
ফয়জুল মহী ০৬/১১/২০২০চমৎকার এবং মনোমুগ্ধকর লেখা।