www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্প---রক্তবাঁধন

গল্প: রক্তবাঁধন
সাইয়িদ রফিকুল হক

জসিম মাহমুদ এবার গ্রামে এসে বুঝলেন, তাকে দীর্ঘদিন এখানে থাকতে হবে। কিছুদিন নিয়মিত বসবাসও করতে হবে। তা-না-হলে তিনি গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবনচিত্র ভালোভাবে অবলোকন করতে পারবেন না। শহর থেকে হঠাৎ-হঠাৎ কয়দিনের জন্য গ্রামে এসে গ্রামীণ জনজীবনের চিত্র অঙ্কন করাটা এত সহজ নয়। আগে সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে হবে। তাদের সঙ্গে উদারভাবে মিশতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গে একটা সখ্যভাব গড়ে তুলে তারপর তাদের মনমানসিকতার চিত্র-অঙ্কনের কাজে নিয়োজিত হতে হবে। গণমানুষের ওপর একটা ভালো ও উন্নতমানের গবেষণাধর্মী বই লিখতে গেলে সবার আগে তাকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে হবে।
এতে এখন তার তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না। বর্তমানে তার ভাণ্ডারে রয়েছে অজস্র সময়। কিন্তু অসুবিধা অন্য জায়গায়। গ্রামে তার থাকা-খাওয়ায় বিরাট অসুবিধা হচ্ছিলো।
অধ্যাপক জসিম মাহমুদ সরকারি কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন বছর দুয়েক হলো।
তাঁর ইচ্ছে ছিল অবসর-জীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু গ্রাম-বাংলায় ঘুরে বেড়াবেন। তারপর গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হাসি-কান্না, পেশা ও জীবিকার বিচিত্র পন্থা স্বচক্ষে দেখবেন। এরপর তাদের ‘জীবন ও জীবিকা’ নিয়ে বড়সড় একটা গ্রন্থ রচনা করবেন।
এজন্য তিনি চাকরিকালীন সময় থেকেই মাঝেমাঝে গ্রামে যাওয়া-আসা করতেন। এখন ভাবছেন, এটা নিয়মিত করবেন। আর নিজের জেলাটা সবার আগে ঘুরেফিরে-দেখে শেষ করতে চান। এজন্য তিনি ইদানীং নিয়মিত গ্রামে আসতে শুরু করেছেন।
তিনি বিয়েথা করেননি। এজন্য তাঁর কোনো পরিবার নেই। এতদিন তিনি শহরে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাসায় থাকতেন। সেখানে তিনি তাদের সঙ্গে পরিবারের একজন সদস্য’র মতো বছরের-পর-বছর সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করেছেন। তার এই বন্ধুটি খুব ভালোমানুষ। তিনি অধ্যাপক-বন্ধুকে কখনো একা ছেড়ে দিতে চাননি। এমনকি অধ্যাপক সাহেব গ্রামে আসার সময় সেই বন্ধুটি বলে দিয়েছেন, এখানে তোমার আসন থাকবে আমৃত্যু। যখনই কোনো অসুবিধা মনে করবে—চলে আসবে নির্দ্বিধায়। এখানে কেউ তোমাকে কখনো কিছু বলবে না। এটাকে তোমার নিজের বাড়ি মনে করে বসবাস করবে।
কিন্তু জসিম মাহমুদ গ্রামে এসে পড়লেন বিপাকে। এখানে, তার ওই বন্ধুটির মতো কোনো হৃদয়বান স্বজন নেই। যে তাকে দুবেলা দুমুঠো ভাত দিবে। প্রথম-প্রথম তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এখানে, তার খাওয়া-দাওয়ার কোনো গ্যারান্টি ছিল না। তবু একটা শেষরক্ষা হয়েছে। তিনি গ্রামে এসে কয়েকদিনের মধ্যে দুঃসম্পর্কীয় এক চাচাতো ভাইয়ের সন্ধান পেয়েছেন। সেখানেই তিনি এখন খাওয়া-দাওয়া করেন। এরা তার মতোই মানুষ।
গ্রামে অবশ্য তার আপন ছোটভাই আছে একটা। সে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। কিন্তু এরা তাকে আদরযত্ন করে না। তবু তিনি আগে গ্রামে এলে নিতান্ত দায়ঠেকে এদের বাড়িতে উঠতেন। কয়েকদিন মুখঠাসা দিয়ে পড়ে থাকতেন। এজন্য তিনি তাদের মোটা অঙ্কের টাকাও দিতেন। তবু এদের মন পেতেন না! আগে তিনি গ্রামে এলে শত কষ্টের মধ্যেও এই বাড়িতে শুধু থাকতেন। মানে, রাত্রিযাপন করতেন। আর খাওয়া-দাওয়া করতেন অন্যত্র। তবু এই বাড়িতে থাকতেন। হাজার হলেও সে তার মায়ের পেটের ছোটভাই। তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে চাইতেন না।
বর্তমানে বই লিখতে গিয়ে তিনি ভারি বিপদে পড়েছেন। মানুষের লোভ ও লাভের হিসাবনিকাশ তাকে সীমাহীন ব্যথিত করেছে।
গ্রামে তার অনেক জমিজমা রয়েছে। সেসব এখন ছোটভাইটি লোকমারফত চাষাবাদ করে খুব ভালোভাবে খাচ্ছে। তবু তার আপন বড়ভাইকে দুবেলা দুমুঠো ভাত দিতে এত কার্পণ্য! এজন্য তিনি আপনমনে বারবার লজ্জিত ও ব্যথিত হন। তবে তিনি এই নিয়ে কাউকে কখনো কিছু বলেন না। কিন্তু গ্রামের লোকজন কেমন করে যেন এসব জেনে গেছে। সব শুনে তারা আফসোস করেছে অধ্যাপক সাহেবের জন্য।
জমিজমার বাইরে অধ্যাপক সাহেবের নামে এখনও ব্যাংকে রিটারমেন্টের পুরো টাকাটা আছে। তা প্রায় দেড় কোটিখানেক হবে। এই টাকাটার ওপর লোভ জন্মেছে তার ছোটভাই মতলব মাস্টারের ও তদীয় পত্নী জান্নাতি বেগমের। টাকাটা তারা দ্রুত হস্তগত করতে চায়। তারা ভেবেছে, বাষট্টি বছরের অধ্যাপক সাহেব হুট করে মরে গেলে টাকাটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সবই জানেন ও বোঝেন অধ্যাপক সাহেব। কিন্তু জীবন থাকতে তিনি আগেই পথের ফকির হতে চান না।
এজন্য ছোটভাই ও তার বউটি তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু অধ্যাপক সাহেব তাদের এড়াতে চান না। রক্তের বাঁধন তো কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। তিনি ছোট ভাইটির স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেমেয়ের জন্য নানারকম উপহারসহ তাদের মাসিক বেতন-ভাতা ও স্কুলের যাবতীয় দেনা-পাওনা পরিশোধ করেন হাসিমুখে, নীরবে। তবু তাদের মন পান না। তাদের মন পড়ে রয়েছে ওই দেড় কোটি টাকার সন্ধানে। এরই মধ্যে তিনি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। আর লিখেও ফেলেছেন অনেকদূর পর্যন্ত।
অধ্যাপক সাহেব গ্রামে ফিরে আসায় প্রায় সবাই খুশি। তার সঙ্গে কথা বলে লোকজন প্রভূত আনন্দলাভ করে থাকে। গ্রামে তার জনপ্রিয়তা দিন-দিন বাড়ছে। তিনি যে বাড়িতে এখন আশ্রয় নিয়েছেন—প্রয়োজনে গ্রামের লোকজন বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য সেখানেও যায় আজকাল। এতে ওই বাড়ির লোকেরা কখনো বিরক্ত হয় না। বরং তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। কেউ-কেউ আজকাল তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। গ্রামে এমন একজন মানুষ বসবাস করায় তাদের মনে যারপরনাই আনন্দ।
অধ্যাপক সাহেবের ছোটভাই মতলব অবশ্য এসব সহ্য করতে পারে না।
সে প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়, “বুইড়া বয়সে এসব তার ভীমরতি! নইলে বিয়েশাদি-সংসার না-করে খামোখা জনসেবার ভান করতিছে! আর কী-সব লিখতিছে!”
লোকজন অবশ্য আজকাল তার কথায় তেমন-একটা সায় দেয় না। তার এসব কথাবার্তার জন্য তাকে পছন্দও করে না।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে চায়ের দোকানে বসে মতলব আরও বলে, “বুইড়া হইছে লোকটা। কখন মরবি তার নাই কোনো ঠিকঠিকানা। কিন্তু বুইড়া এখনও টাকাপয়সা সব বগলদাবা কইরে রাখছে। মনে হয়, মরার সময় এসব সাথে করে কবরে নিয়ে যাবে!”
আপন বড়ভাই-সম্পর্কে তার এহেন কথাবার্তায় গ্রামের লোকজন তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। সে এসব বুঝতে পেরে বড়ভাইটির প্রতি আরও রাগান্বিত হয়। আর ভিতরে-বাইরে তার বিরুদ্ধে আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পারলে তাকে তখনই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয় আরকি!
অধ্যাপক সাহেবের কানে এসব কথা মাঝেমাঝে ভেসে আসে। তিনি সবই শোনেন। কিন্তু বলেন না কিছুই। দুই-এক সময় তিনি হাসিমুখে বলেন, “ভাই কখনো পর হয় না। পানি কাটলে দুই হয় না। আর ভাইকে কখনো পর করে দিতে হয় না। ভাই পরম ধন।”
গ্রামের মানুষ এজন্য তাকে আরও বেশি ভালোবাসে। তার ভদ্রতা ও জ্ঞান মানুষকে আকৃষ্ট করে। তারা শ্রদ্ধা করে অধ্যাপক সাহেবকে।
আগে অধ্যাপক সাহেব প্রায় প্রতিদিন গ্রামের চায়ের দোকানটাতে সকাল-সন্ধ্যায় একটু বসতেন। ছোটভাইটির এসব কথা শুনে বেদনাহত হয়ে তাও আর করেন না। নিজের লেখালেখি ও গবেষণা নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তবে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটি কখনোই বন্ধ করেননি।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার মেলামেশার ক্ষমতা ও যোগ্যতাটি অসাধারণ। সবাই এটা অর্জন করতে পারে না। গ্রামের লোকজনও প্রায়শ তা-ই বলাবলি করে থাকে। তার আন্তরিকতায় সকলেই মুগ্ধ।
মনের দুঃখে অধ্যাপক সাহেব অনেকদিন ছোটভাইটির বাড়িতেও যাননি। তবে তার দুই সন্তানের বেতন-ভাতা তিনি স্কুলে গিয়ে স্বহস্তে পরিশোধ করে দিতেন। শোনা যায়, তিনি নাকি ছেলেমেয়ে দুটোর বেতন-ভাতা অগ্রিম দিয়ে রাখতেন। গ্রামে অধ্যাপক সাহেবের এমনই সুনাম রটেছে। তা সত্ত্বেও, ছোটভাইটি কখনো তার কাছে আসেনি। এমনকি তিনি কোথায়-কেমন আছেন—তা জানতে সে একবার কারও কাছে গিয়ে তা জিজ্ঞাসা করেনি!
অধ্যাপক সাহেবের বইটি লেখা প্রায় শেষ। এজন্য তার মনে খুব আনন্দ। গবেষণার কাজে ফাঁকে-ফাঁকে তিনি পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায়ও ভ্রমণ করেছেন। আর এতে অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সে-সব তিনি সযত্নে তাঁর গবেষণা-গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন।
এক সন্ধ্যায় তিনি মনের আনন্দে একটুখানি আড্ডা দিতে গেলেন গ্রামের সেই চায়ের দোকানে। সেখানে অনেকদিন পরে গ্রামের লোকেরা তাকে পেয়ে নানান কথা বলতে লাগলো। তিনি শোনেন বেশি আর বলেন খুব কম। মানুষের অকপট কথা শুনে, সরলতা দেখে, আর জানার আগ্রহ দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হন। মানুষের কথা শুনে আজও তা-ই হতে লাগলেন।
কথাবার্তার এক ফাঁকে মুন্সীবাড়ির জাবেদ মুন্সী তাকে কাছে পেয়ে বললেন, “বাবাজি, একটা খবর কি শুনেছেন?”
অধ্যাপক সাহেব বললেন, “কী খবর?”
জাবেদ মুন্সী তখন আপনজনের মতো করে দরদমাখাসুরে বললেন, “আপনার ছোটভাই মতলবের ছেলেটার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। তাকে বাঁচানো দায়। ছেলেটার রক্তের গ্রুপও আবার ‘ও নেগেটিভ’। খুব নাকি রেয়ার। কিডনি পাওয়াটা খুবই মুশকিল। তবে আশার কথা হলো—এই গ্রামের একজনের সঙ্গে ছেলেটার কিডনি ম্যাচ করেছে। কিন্তু সে কিডনির দাম হেঁকেছে ৫০ লক্ষ টাকা! এত টাকা মতলব পাবে কোথায়? বলা যায়, ওর তো নতুন চাকরি। টাকাপয়সা খুব একটা বেশি জমাতে পারেনি এখনও। তা-ই পড়েছে বিপদে। তবে ব্যাংকে তার দুই-চার লাখ টাকা হয়তো আছে। কিন্তু..।”
অধ্যাপক সাহেব জাবেদ মুন্সীর হাতটা অমনি চেপে ধরে বললেন, “চাচা, টাকার কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি কিডনি-দাতাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন। আমরা দ্রুত একটা লেখাজোকা করে নিই। আর আমি তাকে যেকোনো সময় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার একটা চেক কেটে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার বংশধর, আমার রক্তের বাঁধন যেন শেষ না-হয়ে যায়।”
অধ্যাপক সাহেবের এমন মহৎ-কথা শুনে অবাকবিস্ময়ে কিছুসময়ের জন্য একেবারে স্তম্ভিত হলেন জাবেদ মুন্সী! তার মুখের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ! তিনি যেন একজন ফেরেশতাকে দেখছেন!


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৮৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০৪/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast