গল্প ভোঁতা অস্ত্র
গল্প:
ভোঁতা অস্ত্র
সাইয়িদ রফিকুল হক
সামনে পূজা।
পাড়ার হিন্দু ছেলেমেয়েরা প্যান্ডেল সাজাবার জন্য শখ করে চাঁদা তুলছে।
বছরে ওরা এক-আধবার এমন করেই থাকে। তবে এতে কেউ কখনো বিরক্ত হয় না।
ওরা এসময় হিন্দু-মুসলমান কোনো বাছবিচার করছে না। যে-কেউ দিতে চাচ্ছে—অমনি তারটাই নিয়ে নিচ্ছে। তবে এই নিয়ে কোথাও কোনো জোরজবরদস্তির চাঁদাবাজি হচ্ছে না।
শেষ বিকেলে অফিস থেকে ফিরছিল লাল্টু। তার সামনেও পড়লো শৌখিন চাঁদাবাজরা।
লাল্টু হাসিমুখে ওদের হাতে একশ’ টাকার দুটো নোট তুলে দিলো।
এটা দেখে ফেললো লাল্টুর মায়ের পেটের আপন ছোটভাই পল্টু। সে তখন বাসার কাছাকাছি চায়ের দোকানটাতে বসে পান-চা-সিগারেটসহ সবই খাচ্ছিলো।
বড়ভাইকে পূজার তহবিলে চাঁদা দিতে দেখে সে যারপরনাই চমকিত ও বিস্মিত! তার কাছে ব্যাপারটা গুরুতর অপরাধ মনে হলো। সে বিষয়টি মনে মনে নোট করে রাখলো।
সে খুব সাম্প্রদায়িক। এসব সহজে মেনে নিতে পারে না। উদারনীতি তার ধাঁতে নেই।
সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরলো পল্টু।
এইসময় ওদের বাসায় চা-নাশতার আয়োজন করা হয়।
সবাই এতে হাসিখুশিভাবে যোগ দেয়।
লাল্টুরা দুই ভাই এক বোন।
ওরা দুই ভাই পড়ালেখা শেষ করেছে। লাল্টু চাকরিও করেছে।
ওদের একমাত্র বোনটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স থার্ড-ইয়ারের ছাত্রী। লাল্টুর মতো সেও খুব উদার আর অসাম্প্রদায়িক। সেইজন্য পল্টুর সঙ্গে তাদের খুব একটা বনিবনা হয় না।
আর সদ্যো এমএ পাশ পল্টু এখনও চাকরিতে যোগদান করেনি। সে বুঝে উঠতে পারছে না—তার মতো বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকের চাকরি করা উচিত কি-না—নাকি রাজনীতি করে দেশের বড়সড় একটা উপকার করা উচিত। এই নিয়ে সে বিরাট ভাবনায় ডুবে রয়েছে। তার মন এখনও কোনোকিছুতে পুরোপুরি সায় দেয়নি বলে সে চাকরি করতে পারছে না। নইলে তার মতো ব্রিলিয়্যান্ট ছেলের চাকরির অভাব! সে নিজেকে অনেকসময় এই যুগের আইনস্টাইনও ভাবে! এতে সায় দেয় তার তোষামোদকারী বন্ধুরাও।
পল্টু নিজেকে খুব বড় ভাবে। আর সবসময় লাল্টুকে দমিয়ে রাখতে চায়। তবে পল্টুর বুদ্ধি কতখানি আছে তা পরিমাপ করা না-গেলেও তার চাপার জোর অবশ্যই পরিমাপযোগ্য। আর তাতে সে লাল্টুর চেয়ে সবসময় এগিয়ে।
লাল্টু অবশ্য তার মতো চাপাবাজি করে না। আর সে একটু ঠোঁটকাটা। অন্যায় দেখলে আর সইতে পারে না। এজন্য তার বন্ধু-সংখ্যাও কম।
সন্ধ্যার পরে নাশতার টেবিলে পল্টু সবার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “হিন্দুর পূজায় চাঁদা দিলে কারও মুসলমানিত্ব থাকে কি-না? বিষয়টা জানতে ইচ্ছুক!”
কথাটা শুনে ওদের বাবা আশরাফ খন্দকার একটুখানি মুখ তুললেন। তারপর পল্টুর দিকে তির্যকভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, “কেন কী হয়েছে? তুমি কোন্ মতলবে কথাটা বলছো, সেটা আগে বলো?”
পল্টু তখন সাহস পেয়ে হড়বড় করে বললো, “আজ বিকালে ভাইজান অফিস থেকে ফেরার সময় হিন্দুদের পূজায় দুশ’ টাকা দান করেছেন। এটা কি জায়েজ?”
খন্দকারসাহেব একটু হেসে বললেন, “লাল্টু উৎপাদনমুখী মানুষ। সে চাকরি করছে। মাস গেলে বেতন পাচ্ছে। সমাজে বসবাস করছে। একেবারে সামাজিক জীব সে। আর সমাজের মানুষ হিসাবে পূজায়, এতিমখানায়, বন্যার্ত-তহবিলে কিংবা অন্য যেকোনো জনহিতকর-কাজে কিছু টাকাপয়সা দান করতেই পারে। এসব নিয়ে সমালোচনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু তুমি অনুৎপাদনশীল জীব। পড়ালেখা শিখেও কোনো চাকরিবাকরি করছো না। কাজের মধ্যে মানুষের সমালোচনা আর দিনের মধ্যে কয়েক বেলা পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডাবাজি করা। আর দিনে-রাতে পান-চা-সিগারেট খাচ্ছো সমানে। এবার তুমিই বলো কোনটি ভালো?”
পল্টুর খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এমন একটা নিরুত্তাপ অথচ ঝাঁঝালো উত্তর শুনে সে বেশ মনখারাপ করে উঠে যাচ্ছিলো।
সে বুঝতে পারছে, আজকাল রাজনীতির হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। আর যারা মানুষ—তারা এখন পশুত্বকে প্রশ্রয় দেয় না। এবার থেকে তাকে একটা চাকরি নিতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে মানুষ হওয়ার।
লাল্টু কিছু বলতে চাইলো না। শুধু একটু অনুযোগ করে বললো, “অস্ত্র ভোঁতা হলে কোনো কাজে লাগে না। ভোঁতা অস্ত্র আর কতদিন ব্যবহার করবে?”
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
ভোঁতা অস্ত্র
সাইয়িদ রফিকুল হক
সামনে পূজা।
পাড়ার হিন্দু ছেলেমেয়েরা প্যান্ডেল সাজাবার জন্য শখ করে চাঁদা তুলছে।
বছরে ওরা এক-আধবার এমন করেই থাকে। তবে এতে কেউ কখনো বিরক্ত হয় না।
ওরা এসময় হিন্দু-মুসলমান কোনো বাছবিচার করছে না। যে-কেউ দিতে চাচ্ছে—অমনি তারটাই নিয়ে নিচ্ছে। তবে এই নিয়ে কোথাও কোনো জোরজবরদস্তির চাঁদাবাজি হচ্ছে না।
শেষ বিকেলে অফিস থেকে ফিরছিল লাল্টু। তার সামনেও পড়লো শৌখিন চাঁদাবাজরা।
লাল্টু হাসিমুখে ওদের হাতে একশ’ টাকার দুটো নোট তুলে দিলো।
এটা দেখে ফেললো লাল্টুর মায়ের পেটের আপন ছোটভাই পল্টু। সে তখন বাসার কাছাকাছি চায়ের দোকানটাতে বসে পান-চা-সিগারেটসহ সবই খাচ্ছিলো।
বড়ভাইকে পূজার তহবিলে চাঁদা দিতে দেখে সে যারপরনাই চমকিত ও বিস্মিত! তার কাছে ব্যাপারটা গুরুতর অপরাধ মনে হলো। সে বিষয়টি মনে মনে নোট করে রাখলো।
সে খুব সাম্প্রদায়িক। এসব সহজে মেনে নিতে পারে না। উদারনীতি তার ধাঁতে নেই।
সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরলো পল্টু।
এইসময় ওদের বাসায় চা-নাশতার আয়োজন করা হয়।
সবাই এতে হাসিখুশিভাবে যোগ দেয়।
লাল্টুরা দুই ভাই এক বোন।
ওরা দুই ভাই পড়ালেখা শেষ করেছে। লাল্টু চাকরিও করেছে।
ওদের একমাত্র বোনটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স থার্ড-ইয়ারের ছাত্রী। লাল্টুর মতো সেও খুব উদার আর অসাম্প্রদায়িক। সেইজন্য পল্টুর সঙ্গে তাদের খুব একটা বনিবনা হয় না।
আর সদ্যো এমএ পাশ পল্টু এখনও চাকরিতে যোগদান করেনি। সে বুঝে উঠতে পারছে না—তার মতো বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকের চাকরি করা উচিত কি-না—নাকি রাজনীতি করে দেশের বড়সড় একটা উপকার করা উচিত। এই নিয়ে সে বিরাট ভাবনায় ডুবে রয়েছে। তার মন এখনও কোনোকিছুতে পুরোপুরি সায় দেয়নি বলে সে চাকরি করতে পারছে না। নইলে তার মতো ব্রিলিয়্যান্ট ছেলের চাকরির অভাব! সে নিজেকে অনেকসময় এই যুগের আইনস্টাইনও ভাবে! এতে সায় দেয় তার তোষামোদকারী বন্ধুরাও।
পল্টু নিজেকে খুব বড় ভাবে। আর সবসময় লাল্টুকে দমিয়ে রাখতে চায়। তবে পল্টুর বুদ্ধি কতখানি আছে তা পরিমাপ করা না-গেলেও তার চাপার জোর অবশ্যই পরিমাপযোগ্য। আর তাতে সে লাল্টুর চেয়ে সবসময় এগিয়ে।
লাল্টু অবশ্য তার মতো চাপাবাজি করে না। আর সে একটু ঠোঁটকাটা। অন্যায় দেখলে আর সইতে পারে না। এজন্য তার বন্ধু-সংখ্যাও কম।
সন্ধ্যার পরে নাশতার টেবিলে পল্টু সবার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “হিন্দুর পূজায় চাঁদা দিলে কারও মুসলমানিত্ব থাকে কি-না? বিষয়টা জানতে ইচ্ছুক!”
কথাটা শুনে ওদের বাবা আশরাফ খন্দকার একটুখানি মুখ তুললেন। তারপর পল্টুর দিকে তির্যকভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, “কেন কী হয়েছে? তুমি কোন্ মতলবে কথাটা বলছো, সেটা আগে বলো?”
পল্টু তখন সাহস পেয়ে হড়বড় করে বললো, “আজ বিকালে ভাইজান অফিস থেকে ফেরার সময় হিন্দুদের পূজায় দুশ’ টাকা দান করেছেন। এটা কি জায়েজ?”
খন্দকারসাহেব একটু হেসে বললেন, “লাল্টু উৎপাদনমুখী মানুষ। সে চাকরি করছে। মাস গেলে বেতন পাচ্ছে। সমাজে বসবাস করছে। একেবারে সামাজিক জীব সে। আর সমাজের মানুষ হিসাবে পূজায়, এতিমখানায়, বন্যার্ত-তহবিলে কিংবা অন্য যেকোনো জনহিতকর-কাজে কিছু টাকাপয়সা দান করতেই পারে। এসব নিয়ে সমালোচনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু তুমি অনুৎপাদনশীল জীব। পড়ালেখা শিখেও কোনো চাকরিবাকরি করছো না। কাজের মধ্যে মানুষের সমালোচনা আর দিনের মধ্যে কয়েক বেলা পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডাবাজি করা। আর দিনে-রাতে পান-চা-সিগারেট খাচ্ছো সমানে। এবার তুমিই বলো কোনটি ভালো?”
পল্টুর খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এমন একটা নিরুত্তাপ অথচ ঝাঁঝালো উত্তর শুনে সে বেশ মনখারাপ করে উঠে যাচ্ছিলো।
সে বুঝতে পারছে, আজকাল রাজনীতির হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। আর যারা মানুষ—তারা এখন পশুত্বকে প্রশ্রয় দেয় না। এবার থেকে তাকে একটা চাকরি নিতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে মানুষ হওয়ার।
লাল্টু কিছু বলতে চাইলো না। শুধু একটু অনুযোগ করে বললো, “অস্ত্র ভোঁতা হলে কোনো কাজে লাগে না। ভোঁতা অস্ত্র আর কতদিন ব্যবহার করবে?”
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৮/১১/২০২৩ভোঁতা অস্ত্র আর কতদিন ব্যবহার করবে? সময়টা শেষের দিকে অথবা এটা চলতেই থাকবে।
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ২৯/১০/২০২৩বেশ!
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২৮/১০/২০২৩বেশ
-
ফয়জুল মহী ২৮/১০/২০২৩অপূর্ব উপস্থাপন
-
ফয়েজ উল্লাহ রবি ২৭/১০/২০২৩বেশ লিখেছেন।