www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সাহিত্য কি এতই সস্তা

সাহিত্য কি এতই সস্তা?
সাইয়িদ রফিকুল হক

আজকাল সাহিত্য তেমন একটা সৃষ্টি হচ্ছে না। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য একটা গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। শক্তিমান কিংবা জাত কবি, লেখক তথা সাহিত্যিকের অভাব সর্বত্র দৃশ্যমান। বর্তমানে শক্তিমান কবি-লেখকের সংখ্যা একেবারে নগন্য। কিন্তু এরই মাঝে সাহিত্যসৃষ্টির ডামাডোল অনেক বেশি! আয়োজন হচ্ছে বটে, কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টি হচ্ছে না। এখন অনেকেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের সাহিত্যকর্মের জানান দিচ্ছেন। তিনি খুব বাহাদুরি-সহকারে নিজের রচিত যেকোনো গদ্য-পদ্য তথা ‘কবিতা-গল্প-উপন্যাস’কে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সামগ্রী মনে করে তা লোকজনকে খাওয়ার জন্য একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর খুব উঠেপড়ে লেগেছেন! এর থেকে পাঠকের আর নিস্তার নাই! এদের ভাব দেখলে মনে হয়: পৃথিবীতে আগে কখনো-কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি! কিংবা তাদের চেয়ে বড় কোনো কবি, লেখক ও সাহিত্যিকের আবির্ভাবও হয়নি ইতঃপূর্বে!

সমকালীন জীবনে আমাদের অনেককিছু দেখতে হচ্ছে। আর দেখতে না-চাইলেও তা চোখের সামনে এসে পড়ছে। এগুলো তখন আর না-দেখে উপায়ও থাকে না। কিন্তু এইসব অখাদ্য খাওয়ানোর অপচেষ্টাকে কোনোভাবেই সুস্থ-মানসিকতা বলে গ্রহণ করা যায় না। এরা সম্ভবত শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব পীড়িত। তাই, এমনটি করতে কোনো লজ্জাবোধ করছে না।

একশ্রেণির অতিসস্তা ও অর্থলোভী প্রকাশক-নামের স্রেফ ধান্দাবাজ, মুনাফালোভী ও ব্যবসায়ী এখন বাজারে ‘বয়লার মুরগী’ সাপ্লাইয়ের মতো বইয়ের ব্যবসায় নেমেছে। এদের যেমন রুচিবোধ নাই―ঠিক তেমনি এদের কাছে এসে যারা টাকার বিনিময়ে বই নামক অখাদ্য-কুখাদ্য প্রকাশ করছে―তাদেরও কোনো রুচির বালাই নাই। প্রকাশনাশিল্প এখন রুচি-সংকটে পড়েছে। আবার যাদের একটু রুচিবোধ আছে তারা আবার ভয়াবহ আঁতেল! এদের আঁতলামির যেন কোনো শেষ নাই! এরা একেকজন নিজেদের কী ভাবে―তা এই স্বল্পপরিসরে লিখে বোঝানো যাবে না। এদের আঁতলামির কারণে দেশে যোগ্য ও প্রতিভাবান লেখকের সৃষ্টি হচ্ছে না। এরা শুধু ব্যবসায়িক কারণে বই ছাপায়। যাদের বই পাঠক একটু খায়―তাদের বইই শুধু ছাপায়। এরা তেলে মাথায় তেল দিতে ব্যস্ত। ফলে, সাহিত্যসৃষ্টি হচ্ছে না। সত্যিকারের প্রতিভাবান ও নবীন লেখকের আবির্ভাবও ঘটছে না। এই আঁতেল-প্রকাশকরা সাহিত্য পড়ে না, বোঝে না, আর এগুলো প্রকাশও করে না। তারা দেখে শুধু বাজারদর। বাজারে কে কী খাচ্ছে, কী চাচ্ছে, আর কী খেতে চাচ্ছে―তা-ই শুধু এরা পরিবেশন করে থাকে।

বাংলাদেশে বইমেলার আগে এইধরনের অর্বাচীনদের আধিক্য সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এরা যে সাহিত্যের চরম শত্রু তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এদের লোভের কারণে উন্নতমানের বই থেকে পাঠকশ্রেণি বঞ্চিত হচ্ছে। পাঠকের রুচি বিনষ্ট হচ্ছে নিম্নমানের বইপাঠ করে।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে কয়েকটি ‘অনলাইন বুক ডট কমে’র একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম, অমুক লেখকের তমুক বই কিনলে অমুক ফ্রি, তমুক ফ্রি! আরও দেখলাম, একটা ‘বই-প্রকাশনী’ তাদের সংস্থার লেখকের বই বিক্রির জন্য বইয়ের সঙ্গে ১২০টাকা মূল্যের একটা গামছা ফ্রি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে! তাছাড়া, ইদানীং একটি বইয়ের সঙ্গে আরেকটি বই কিংবা কলম কিংবা নোটবুক ফ্রি দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে সদম্ভে! বইয়ের সঙ্গেও এখন ইত্যাদি ফ্রি দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে! আরেক তথাকথিত লেখককে প্রচার করতে দেখলাম, তার বই কিনলে লটারির মাধ্যমে ভাগ্যবান দশজনকে তার সঙ্গে ফাইভ-স্টার হোটেলে ডিনারের সুযোগ দেওয়া হবে! সুন্দরীদের হাতে তার বই তুলে দিয়ে তার ছবিপ্রকাশ করা হচ্ছে। আবার তা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেদারসে প্রকাশ করা হচ্ছে! এইরকম লোভনীয় সুযোগ থাকলে সাধারণ তরুণ-বয়সি পাঠকেরা কী করে ভালো বই চিনবে বা কিনবে? এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত। এতে দেশ-জাতি ও আমাদের সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে চরমভাবে। অখ্যাদ্যকে খাওয়ানোর জন্য নানারকম প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে। এইসব অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে একশ্রেণির বিকৃতমনা পাঠকের জন্ম হবে। এরা আমাদের ক্লাসিক ও নান্দনিক সাহিত্যকে একসময় অবজ্ঞা করা শিখতে পারে! জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এদের এখনই মূল সাহিত্যধারায় ফেরাতে হবে।

যারা একশ্রেণির সস্তা পাঠককে বিভিন্ন পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে বইকেনায় আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য একেবারে অসৎ। এদের এইসব বই বিক্রির জন্য এখন একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। আর এদের কাজ হলো যেকোনোভাবে তাদের মনোনীত লেখকদের বইগুলো মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া। এগুলো বই হয়েছে কিনা―তা দেখারও এদের কোনো দরকার নাই। এদের চাই অর্থ আর নিজেদের মতাদর্শের বই বিক্রি করা। একশ্রেণির সস্তা পাঠকও তৈরি হয়েছে আজকাল।

বইপ্রকাশ হচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু তার তো একটা মান থাকতে হবে। আর থাকতে হবে জাতধর্ম ও চেহারা। এখন প্রকাশনাশিল্প আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে যথেষ্ট অগ্রসর ও আধুনিকতার মানদণ্ডে উৎকর্ষমণ্ডিত। তাই, এইসময়ে ছাপাখানার গুণে অখাদ্য-কুখাদ্য বইয়েরও চেহারা দেখতে ভালো মনে হয়। সবই প্রচ্ছদের, মেকাপের, কাগজের ও রঙের খেলা। কিন্তু ভিতরটাতে দেখা যায় বানান-ভুল, বাক্য-ভুল, ভাষাগত ত্রুটি আর ভাষাগত কোনো উৎকর্ষতা নাই! আর এইজাতীয় বইয়ে সাহিত্যভাষা আসবে কোত্থেকে? কবিতার ক্ষেত্রেও তা-ই। সেখানে, ছন্দ নাই, কাব্যগুণ নাই, অলংকার নাই! এমনকি ভাবসম্পদও নাই! তবুও এসব বই ছাপা হচ্ছে দেদারসে। টাকার লোভে সস্তা-প্রকাশনীগুলো আজ যেন এই রাজ্যের মাফিয়া হয়ে উঠেছে!

নতুনদের বইপ্রকাশে আরও বেশি-বেশি সুযোগ দিতে হবে। তবে বইপ্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি যাচাইবাছাই করার পক্ষে মদীয় অভিমত। এক্ষেত্রে যেন নতুন বা নবীন লেখকেরা কোনোপ্রকার আঁতেল-দ্বারা শরবিদ্ধ না-হয় সেদিকেও সবার দৃষ্টিনিবদ্ধ রাখতে হবে। আঁতেলরা তরুণদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত বা সহমত হতে পারবে না। সেইজন্য এক্ষেত্রে যথার্থ বুদ্ধিজীবীদের হস্তক্ষেপ অতীব জরুরি। তবেই আমাদের সাহিত্য আবার সুদিনে ফিরতে পারবে।

আমাদের দেশের একশ্রেণির অতি-উৎসাহী মানুষ এখন জোর করে কবি, লেখক ও সাহিত্যিক হতে চাচ্ছেন। এজন্য তারা বিজ্ঞাপন বা পাবলিসিটিকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। এ যেন একটা যুদ্ধ! তারা নিজেদের প্রকাশের জন্য রীতিমতো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন! এই লড়াইয়ে তাকে যেকোনোমূল্যেই যেন জিততে হবে! তাই, আজকাল সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচারযন্ত্র ফেসবুকসহ অন্যান্য প্রচারমাধ্যমেও লক্ষ করলে দেখা যায়, কীভাবে মানুষ নিজেকে লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নিয়োজিত! এই লড়াইয়ে আজ একজন গৃহবধূ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যের বা ইউরোপের যেকোনো দেশে থাকা প্রবাসীরাও সর্বাধিক এগিয়ে রয়েছেন। আর মাঝখানে যারা রয়েছেন―তাদের কথা নাহয় বাদই দিলাম।

নিজেকে লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একশ্রেণির মানুষ এখন এতই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের কাণ্ডকারখানা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বই আর নিজেকে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য এইরকম বাতুলতা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এভাবে কখনো সাহিত্যসৃষ্টিও হতে পারে না। আর সাহিত্য কি এতই সস্তা?


সাইয়িদ রফিকুল হক
০৬/০১/২০২১
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩৭৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০২/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast