www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

খুব ভয়ের গল্প--বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (সপ্তম পর্ব)

খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(সপ্তম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক

অর্ণবও সোৎসাহে বললো, “জ্বি, গুরুজী, আরেকটি ঘটনা বলুন। আমরা এতো ভয়টয় পাবো না। হয়তো রাতের বেলা একটু গা-টা ছম-ছম করবে আরকি!”
ওর কথা শুনে রুমের সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণের জন্য যেন রুমের ভিতরে হাসাহাসির একটা রোল পড়ে গেল! অর্ণবও হাসে আর বলে, “এইসব আত্মার গল্প আমার খুব ভালো লাগে।”

এখনও সন্ধ্যা হতে কিছুটা সময় বাকি আছে। এমন সময় অধ্যাপক লিটু মিয়া আবার বলতে শুরু করলেন, “এটাও আমার গ্রামজীবনের একটি ঘটনা। তখন আমি সবেমাত্র দশমশ্রেণীর ছাত্র। মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতেই থাকি। আমার বাবা পুলিশবিভাগে চাকরি করতেন। হঠাৎ তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় আমাদের বাসাবদল করতে হয়। কিন্তু নতুনভাবে হঠাৎ করে ঢাকা-শহরে আর-একটি বাসাভাড়া নেওয়া আমার বাবার পক্ষে সম্ভব না হওয়ায়—আমার বড় ভাইবোনেরা শহরে বাবার ছোটভাই—কাকার বাসায় থেকে যায়। আমি আর আমার দুই ভাই মায়ের সঙ্গে গ্রামে চলে আসি। সেই সময় গ্রামে আমার বুনোজীবন শুরু হলো। কিন্তু প্রথম-প্রথম গ্রামে আমার কিছুতেই মন টিকতো না। গ্রামের ছেলেছোকরাদের মোটেও ভালো লাগতো না আমার। কিন্তু একটা সময় কেমন করে যেন এদের সঙ্গেই আমার বিরাট একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো! এরপর থেকে আমি গ্রামের ছেলেছোকরাদের সঙ্গে যেখানেসেখানে ঘোরাফেরা করে সময় কাটাতে লাগলাম। আর হঠাৎ করেই গ্রামীণ বুনোজীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়লাম।
সময়টা ছিল ফাল্গুন মাস। আশেপাশের গ্রামগুলোতে তখন পুরাদমে আখমাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের গ্রামেও কারও-কারও বাড়িতে এগুলো শুরু হয়েছে। এইসময় গ্রামে আখের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কিন্তু আমরা শহরের মানুষ। তারউপরে আমাদের চোদ্দোপুরুষের কেউ কখনো কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাই, আমরা এই আখের রসআস্বাদন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। একদিন স্কুলে কথায়-কথায় ক্লাসের একফাঁকে গ্রাম্যবন্ধুদের কাছে ঘটনাটা বললাম। সঙ্গে-সঙ্গে আমার ক্লাসের এক বন্ধু বলে উঠলো, ‘তুমি যত খুশি আখের রস খেতে পারবে। শুধু কষ্ট করে আমাদের গ্রামে যেতে হবে। তুমি চাইলে প্রতিদিনও তা খেতে পারবে। কিন্তু শর্ত হলো—তোমাকে আমাদের গ্রামে যেতে হবে। আর এই রস তৈরির কাজটি শুরু হয় বিকালের পর থেকে। আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা-নামের গ্রামে থাকতো আমার সেই বন্ধুটি। ওর নাম আব্দুস সালাম। সবাই ও-কে জামাত-ডাক্তারের ছেলে বলতো। ওর বাবা গ্রাম-ডাক্তার ছিল। নাম ছিল মোহাম্মদ জামাত আলী। আমরা এক-স্কুলে একইসঙ্গে একই বিভাগে পড়তাম।
বন্ধুটির এতোবড় দাওয়াত পেয়ে আমি একদিন বিকালে বাড়ি থেকে সেই গ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিলাম। আমার পরনে ছিল শুধু একটা ফুলশার্ট আর চেক-লুঙ্গি! গ্রামে আমার ফুলপ্যান্ট পড়ার অভ্যাস ছিল। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ ছেলে তখনও জীবনে একবারও ফুলপ্যান্ট পড়েনি! তখন তাদের সঙ্গে থাকতে-থাকতে আমিও মাঝে-মাঝে লুঙ্গি পরে যত্রতত্র চলাফেরা করতাম। আমি ঘর থেকে বেরিয়েছি—এমন সময় আমার সেই বৃদ্ধা ফুপু বললেন, ‘বাজান, কোথায় যাচ্ছো?’
আমি বললাম, ‘পাশের গ্রামে আখের রস খেতে।’
তিনি বললেন, ‘যাও। কিন্তু তোমার জ্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে যাও।’
বিকালে দেখি, তখনও প্রচণ্ড রোদ! শীতের তেমন-কোনো প্রকোপ নাই!
কিন্তু ফুপুআম্মা আবার বললেন, ‘বাজান, এখন ফালগুন-মাস। সন্ধ্যার একটু পরেই দেখবে—কী শীত পড়ে!’
মুরুব্বি মানুষের কথা ভেবে ঘরে ফিরে জ্যাকেটটা কাঁধে নিয়ে নিলাম। তারপর আপনমনে হাঁটতে লাগলাম কুশিয়ারা গ্রামের দিকে।
একটা বড়সড় মাঠ পাড়ি দিলে সেই গ্রাম। আর সঙ্গে রয়েছে নিজেদের গ্রামের কিছুটা রাস্তা। সন্ধ্যার আগেই সেই গ্রামে পৌঁছুনোর জন্য আমি খুব দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।
ফাল্গুন-মাস। চারিদিকের মাঠে ফসলের আর খুব সবুজের ছড়াছড়ি। আর একমাস পরেই কৃষকের ঘরে উঠবে চৈতালী। জমির সরু আইলের ওপর দিয়ে একটা স্যান্ডেল পায়ে সমানে হেঁটে চলেছি আমি। মাঠের মাঝামাঝি একজায়গায় এসে পড়তেই আমার ডানদিকের দুইশ’ গজ দূরে চোখে পড়লো শতবর্ষের পুরানো বিশাল বটগাছটা। দিনের বেলায় এটাকে দেখে গা-টা কেমন যেন ছম-ছম করে উঠলো! সেদিকে আর একবারও না তাকিয়ে আবার একমনে হাঁটতে লাগলাম।
একসময় দেখি, বড় একটা ডিমের কুসুমের মতো লাল হয়ে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। তখন আমি মাঠটা পাড়ি দিয়ে সবেমাত্র বন্ধুর গ্রামে ঢুকেছি। এখনও কিছুটা পথ বাকি। সন্ধ্যার আজানের পরে বন্ধুর বাড়িতে হাজির হলাম। দেখি, বন্ধুটি আরও কয়েকজনের সঙ্গে রস-ভাঙানো সেই খোলার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখে সে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘খুব খুশি হলাম, বন্ধু।’ তারপর সে আমাকে একটা বাঁশের বেঞ্চে বসতে দিলো। সেই সময় গ্রামে এরচেয়ে ভালো ব্যবস্থা খুব কম বাড়িতেই ছিল। সেখানে বসে সেই অল্পবয়সে আমরা নানান গল্পে মেতে উঠলাম। আমাদের ক্লাসের আরও কয়েক বন্ধু সেদিন সালামদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। ওরা একই গ্রামের ছেলে। এর মধ্যে এক বন্ধু ইচ্ছে করে যেন আমাকে বারবার ভূতের গল্প শোনাতে লাগলো। তারপর সে বারবার আমাকে ইঙ্গিত করে বলতে লাগলো, ‘মাঠের ভিতরে সেই বটগাছটাতে সন্ধ্যার পর থেকে অনবরত বাতি জ্বলতে থাকে!’ আর এসব কথা শুনে আমার তখন খুব খারাপ অবস্থা। কিন্তু আমি কোনো মনোবল হারালাম না। তবে এইসময় সালাম ওদের খুব ধমকালো। সে যে খুব আন্তরিক ছিল—তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু ওরা কয়েকজন বারবার সেই সময় শুধু ভূতের গল্প বলতে লাগলো! সালাম আরও কয়েকবার ওদের বাধা দিয়েও থামাতে পারলো না।
খানিকক্ষণ পরে রস-ভাঙানোর কাজ শুরু হলো। সালাম ঘর থেকে দুইটা বড় কাঁসার গেলাস নিয়ে এলো। সেই সময় খুব শিক্ষিত-পরিবার ছাড়া কেউই কাচের গেলাস ব্যবহার করতো না। একটা বড় সিলভারের জগে করে রস-ভাঙানোর খোলা থেকে সালাম অনেক রস নিয়ে এলো। এই জগটা প্রায় একটা কলসের মতো! খুব রস খেলাম! বড় গেলাসটার চার গেলাস রস খেয়ে আর খেতে পারলাম না। পল্লীগ্রামের অতি সুস্বাদু রস! খুব মিষ্টি! অনেকে এক গেলাসের বেশি খেতে পারে না। তার কারণ, কাঁসার গেলাস দুটো ছিল অনেক বড়! এককথায় বলতে গেলে, ছোট একটা জগের সমান! তবুও চার গেলাস খেয়েছি।
একটু পরে বুঝতে পারলাম, শীত পরেছে খুব। ঠাণ্ডারস খেয়ে শীতের মাত্রা আরও যেন বেড়ে গেল। আগে তো জ্যাকেটটা কোনোরকমে গায়ে রেখেছিলাম। এখন তার চেইনও আটকিয়ে দিলাম। তবুও দেখি, ভয়ানক শীত! আমার গায়ে ভারী-মোটা জ্যাকেট—তবুও শীত মানছে না! তখন ফাল্গুন মাস! ভাগ্যিস, ওরা পৌষ-মাঘে আখের রস ভাঙায়নি! তাইলে, মনে হয় আর বাড়ি ফিরতে পারতাম না! সালাম সেদিন রাতে ওর সঙ্গে থাকার জন্য আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল। কিন্তু থাকতে পারিনি। কারণ, বাড়িতে একটুও বলে আসিনি। সেখানে একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তার ঝড় বয়ে যাবে। রাত বাড়ছিল। তাই, সালামও আমাকে বিদায় জানাতে উঠে পড়লো। তাকে আসতে বারণ করলাম—তবুও সে কিছুতেই আমার বারণ শুনলো না। সে তাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুদূর আমাকে এগিয়ে দিলো। সে টর্চলাইট হাতে তাদের বাড়ির কাছে বড় মাঠটার মাথা পর্যন্ত আমার সঙ্গে এলো। এবার আমাকে একাকী এই বড় মাঠটা পাড়ি দিতে হবে।
মাঠে নেমে বুঝলাম, শীত কাকে বলে! আর তখন আপনা-আপনি মন থেকে শ্রদ্ধা জাগলো আমার ফুপুআম্মার প্রতি। পথ চলছিলাম আর ভাবছিলাম, আজ এই জ্যাকেটটা সঙ্গে না থাকলে আমার কিছুতেই বাড়িফেরা হতো না। শীতে জমে রাস্তায় হয়তো কোনোখানে মরে পড়ে থাকতাম! মাঠের ভিতরে এমন জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল যে, মনে হচ্ছিলো—এটা রাশিয়ার সাইবেরিয়া! কয়েক মিনিট পথচলার পর হঠাৎ আমার মনে হলো—আমার ওই বন্ধুগুলো আমাকে রাস্তার যেকোনোস্থানে ভয় দেখাতে পারে। ওরা হয়তো রাস্তার কোনোখানে আমার জন্য ওঁতপেতে আছে! তার কারণ, আমি যখন রস খাচ্ছিলাম তখন ওরা চলে গেল! এখন কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে। ওরা আমাদের গ্রামের রাস্তাটাও চেনে। এটা ভেবে আমি রাস্তাপরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এজন্য আমাকে একটু বেশি হাঁটতে হবে। তা-ই মনস্থির করলাম। আর জ্যাকেটটা প্রবলভাবে গায়ে চেপে ধরে হাঁটতে লাগলাম।
মাঠের চারিদিকে হালকা কুয়াশাও পড়েছে! একসময় মাঠের প্রায় মাঝামাঝি এসে আমার মনে হলো: এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নাই! চারিদিকে কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এইসময় গ্রামের মানুষগুলো হয়তো ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর নয়তো তারা রসের খোলায় কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাই বলে মাঠেঘাটে কেউই নাই! সেদিন অমাবস্যাও ছিল না। আবার আকাশে ভরাজোছনার পূর্ণিমাও ছিল না। তবুও কুয়াশার চাদরভেদ করে একটুকরো চাঁদের আলো এসে মাঠটাকে একটু আলোকিত করেছে! মাঠের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ দেখি একটা লোক! আমার নিকট থেকে একশ’ গজ দূরে! যেটুকু চাঁদের আলো আছে তাতে সে যে একজন মানুষ তা স্পষ্ট। লোকটাকে দেখে মনে একটুখানি সাহসও হলো। যাক, কিছুটা দূরে হলেও পাশাপাশি একটা লোক আছে। লোকটার গায়ে একটা সাদা চাদরের মতো কিছু-একটা জড়ানো। আরেকটু দূরে এসে লক্ষ্য করলাম, লোকটা যেন আমার কাছে আসার চেষ্টা করছে! একবার ভাবলাম, ডাকাতটাকাত নয়তো! কারণ, এই শীতের মৌসুমে গ্রামে ডাকাতি হয় বেশি। কিন্তু যতবার তার দিকে তাকাই আর দেখি, সেও আমার মতো একাকী! মনে আবার সাহস হলো যে, সে ডাকাত নয়। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, সে ডাকাতের চেয়ে বড়! আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে হঠাৎ আমার মনে হলো—এই লোকটাকে তো আমার আগেপিছে আগে দেখি নাই! সে হঠাৎ করে মাঠের মাঝামাঝি এলো কীভাবে? বাইরে এখন যে শীত! তাতে তো কারও পক্ষে আগে থেকে মাঠে বসে থাকা সম্ভব নয়। আর তখনই আমার গা-টা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো! মনে হলো—সে মানুষ না অন্যকিছু? কথাটা ভাবতেই আমার হাতের মোটা লম্বা আখটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম। এখানে, তোমাদের আগে বলা হয়নি যে, আমি বন্ধুর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার সময়—সে আমার হাতে বড় একখণ্ড আখ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘কাল সকালে খেয়ো।’ সেটি এখনও আমার হাতে। কিছুটা দূরের সেই লোকটার আচরণ আমার ভালো মনে হচ্ছিলো না। সে যেন আমার কাছে এগিয়ে আসার জন্য একেবারে মরীয়া হয়ে দৌড়াচ্ছে। আমিও দ্রুত হেঁটে আমাদের গ্রামের সীমার মধ্যে এসে পড়লাম। আমার সামনে এখন একটা বিরাট শ্মশান! এটার আরও অনেক পরে আমাদের পাড়া। আমি আরও দ্রুত হেঁটে শ্মশানটা পার হচ্ছিলাম—আর তখনই দেখলাম—সেই লোকটা—মানে, আত্মাটা আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ভয়ংকরভাবে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডাগলায় যেন বললো, ‘যা বড় বাঁচা বেঁচে গেলি! আজ তোকে ধরতে পারলাম না। হাতের লাঠিটা তোকে...।’ তারপর সে ভোজবাজির মতো আমার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল! আমি তখন প্রায় একদৌড়ে শ্মশানটা পার হয়ে নিজের গ্রামের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।
এইটা আত্মা ছিল? নাকি জ্বীন ছিল? তা আজও আমি বুঝতে পারি নাই। তবে ভাগ্যক্রমে যে সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম—তা জানি। আরও একটা কারণ ছিল—ওই বয়সটাতে আমার পকেটে সবসময় একটা লোহার বহনযোগ্য ছুরি থাকতো। আর সেদিনও এটা ছিল আমার জ্যাকেটের পকেটে। সেই সময়কার মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি, কারও সঙ্গে লোহালক্কড় থাকলে নাকি জ্বীন-ভূত কাছে ঘেঁষে না। এখন মনে হয়—সেদিন আমার বেঁচে যাওয়ার এইটাও একটা কারণ হতে পারে। তারউপরে আমার হাতে ছিল লাঠির মতো একটা আখ।”
অর্ণব হেসে বললো, “গুরুজী, আমার মনে হয়, আত্মাটা আপনাদের গ্রামের ওই বড় বটগাছটা থেকেই এসেছিল।”
অধ্যাপক লিটু মিয়া বললেন, “আমারও তা-ই মনে হয়। আবার নাও হতে পারে। অন্য কোথাও থেকে হয়তো এসেছিল। গ্রামে তো আত্মাদের থাকার অনেক জায়গা আছে। বটগাছ, তেঁতুলগাছ, তালগাছ, শ্যাওড়াগাছ ইত্যাদিতে ওরা থাকে।”
অর্ণব বলে, “গুরুজী, আত্মারা কি সবসময় অদৃশ্য হয়ে থাকে?”
তিনি বললেন, “না। তা ঠিক নয়। ওরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে থাকে। সেটা ওদের চলাফেরার ওপর নির্ভর করে।”
শায়লা বললো, “গুরুজী, প্লিজ, আপনার জীবনের আরেকটি কাহিনী বলুন। আর-একটা অনুরোধ: মলির সঙ্গে আপনার আর-কখনো দেখা হয়েছিল কিনা—তাও বলবেন।”
অধ্যাপকসাহেব এবার হেসে বললেন, “মলির সঙ্গে আমার আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আর এসব এতো গুনে রাখিনি। মলি আমাকে খুব পছন্দ করতো। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। সেই শৈশব থেকে আমরা একসঙ্গে চলাফেরা করেছি তো! তাই, হয়তো সে আমাকে এখনও ভুলতে পারেনি! তবে, এখন আমি মলির আর-একটিমাত্র ঘটনা বলবো। তারপর আমাকে আত্মার কথা বলতে হবে। তাছাড়া, তোমাদের বাড়িটাতে এখনও আমার অনেক তদন্ত বাকি রয়েছে।”
শায়লা এবার ছোট্ট মেয়ের মতো বলে, “ঠিক আছে, এখন একটি বলুন। কিন্তু পরে সময় পেলে আপনাকে আবার মলির আরও গল্প বলতে হবে।”
অধ্যাপকসাহেব হেসে বলতে লাগলেন, “আমি আমাদের গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে আবার ঢাকায় চলে এলাম। অনেক চেষ্টায় আমার বাবা এবার একটা সরকারি কোয়ার্টার অ্যালোট করাতে পেরেছেন। ঢাকায় এসে সেই যে আবার বসবাস শুরু করলাম—আর কখনো গ্রামে ফিরে যাইনি। অবশ্য মাঝে-মাঝে বেড়াতে গিয়েছি গ্রামে। সেবার এইচএসসি পাসের পর কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গেলাম। এখন আমি একটু বড় হয়েছি। কিন্তু আগের মতো সেই সাহস যেন আর নাই। মাত্র দুই বছরে আবার একেবারে শহুরে হয়ে গিয়েছি। তাই, গ্রামে গিয়ে রাতের বেলা বাড়ির বাইরে বের হতে আগের মতো আর সাহস পেতাম না। তবুও একটুআধটু ঘোরাফেরার চেষ্টা করতাম। তবে দিনের বেলায় এই কাজটা বেশি করি।
গ্রামে তখনও শীত শুরু হয়নি। সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষের দিক হবে। দিনের বেলাটা খুব গরম থাকে। এজন্য নিয়মিত গোসল করতে হয়। গ্রামে কুয়োর জলে গোসল করা যায় না। এতে মাথার চুল আঠা হয়ে যায়। আবার টিউবওয়েলের জলেও গোসল করা যায় না। এতেও মাথা আঠা হয়ে যায়। তাই, গোসলের পানির উৎস হিসাবে একমাত্র অবলম্বন হলো পুকুর।
একদিন নিজেদের পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখি, সেখানকার পানির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। গ্রামের বাড়িতে এখন তেমন-কেউ থাকে না বলে পুকুরের জল একেবারে মজে গেছে! তখন আমার সেই ফুপুআম্মা বললেন, ‘বাজান, তোমার হাজি-দাদার পুকুরে যাও।’ তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের শরীকআত্মীয় সেই দাদিজানের কথা। আমাদের পাশের বাড়ির সেই দাদিজানদের পুকুরটা খুব গভীর ও তার জলও পরিষ্কার। সেখানে গোসল করতে গিয়েছি। একেবারে ভরদুপুরবেলা! পুকুরে তখন আর-কেউ ছিল না। গ্রামের অধিকাংশ লোকই নিজেদের বা অন্য কারও পুকুরে গোসল করে। কিন্তু এই পুকুরে সহজে আসার সাহস কেউ পায় না। এইজন্য এই পুকুরটা প্রায় সময় খুব নিরিবিলি থাকে। পুকুরের অর্ধেকের বেশি অংশটা একেবারে ছায়ায় ঢাকা! রোদের আলো এদিকটা কম পড়ে বলে এই পুকুরের জল খুব শীতল।
পুকুরে নেমে প্রথমে সাঁতারটা একটু প্রাকটিস করলাম। দেখি, এখনও তা ভুলি নাই! আরও কিছুক্ষণ সাঁতার কাটতে লাগলাম। পুকুরের চারিদিক ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ। দিনের বেলায়ও কেমন যেন গা ছমছম করে! হঠাৎ যেন একটু ভয় পেয়ে গেলাম। বিরাট পুকুর! আর মানুষজনও নাই! তারউপরে আবার ভরদুপুর! তাই, তাড়াতাড়ি আরও কয়েকটা ডুব দিয়ে নিজেদের বাড়ির এপারে উঠে এলাম। গামছা দিয়ে গা মুছে হঠাৎ পুকুরের ওপারের তাকিয়েছি—এমন সময় দেখি—ওপারে একটা পেয়ারা গাছের ডালে বসে রয়েছে মলি! নিজের চোখকে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! তবুও তা বিশ্বাস করতে হচ্ছে! কারণ, তখন আমার নিজের চোখের সামনেই তা দেখতে পাচ্ছিলাম! তার চোখেমুখে সেই হাসি! মাথায় কোঁকড়ানো সেই কালোচুল! সেই ফর্সা অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানি! ভারি মায়া লেগেছিল সেই মুখে! আগের মতো সে নিচু ডালটাতে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসেছে! সেদিন একটু ভয় পেয়েছিলাম যেন! আবার ভাবলাম, ওটা বুঝি মলি নয়—মলির ছোট বোন জলি! আমি তাকে কিছু-একটা বলতে যাবো—অমনি দেখি, সে মাছরাঙা-পাখির মতো ঝুপ করে নেমে গেল পানিতে! আর উঠলো না! তাকে আর কোথাও উঠতে দেখলাম না! আমি বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম—তা জানি না। হঠাৎ হাজিবাড়ির একটি ছেলের ডাকে আমার যেন সম্বিৎ ফিরে এলো! সে আমাকে দেখে বলেছিল, ‘ভাই, গোসল কি শেষ করেছেন?’ আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি বলে—আমি তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারিনি। মলি পানিতে নেমে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই ছেলেটা এসেছিল পুকুরপাড়ে। মলি হয়তো তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই পানিতে নেমে পড়েছিল। অনেক আত্মা আছে—সবার সামনে আসে না—সবাইকে দেখাও দেয় না—অন্য কারও নজরে পড়ার আগেই উধাও হয়ে যায়। গোসলশেষে বাড়িফেরার পথে আমার সামান্য একটু ভয়-ভয় লাগছিল! হঠাৎ একবার মনে হলো—এটা মলির ছোটবোন জলি নয়তো! আর সে পুকুরে অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে থেকে বিস্ময়ে আমার ঘোরলাগার সুযোগে অন্য কোনোদিক দিয়ে পুকুর থেকে উঠে বাড়িতে ফিরে যায়নি তো! তোমাদের কাছে আরেকটি কথা বলে রাখি: এই পুকুরেই কয়েক বছর আগে মলি ডুবে মরেছিল!
বিকালে তাই সেই দাদিজানকে কাছে পেয়ে বললাম, মলির বোন জলি কি এখানে বেড়াতে এসেছে? তিনি খুব মনখারাপ করে বললেন, ‘না ভাই, সে আসে না প্রায় একবছর হয়ে গেল! মলির মৃত্যুর পর ওরা এখন কম আসে।’ সবটা শুনে হয়তো আমি ধপাস করে পড়ে যেতাম—যদি আমার আগের সাহসটা না থাকতো!”

দিনের আলোশেষে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে—কেউ তা টের পায়নি। অবশেষে রাশিদা বানু উঠে বাড়ির দোতলার প্রায় সব লাইট জ্বেলে দিতে লাগলেন। আর তখনই মসজিদ থেকে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের আজান!
মোসাদ্দেকসাহেব বললেন, “তোমরা, আমার গুরুজীকে আর বিরক্ত করবে না। এখন আমরা সবাই মিলে মাগরিবের নামাজআদায় করবো। তারপর কিছুক্ষণ জিকির করার পর গুরুজী আমাদের উদ্দেশ্যে শুরু করবেন আত্মাবিষয়ক আলোচনা।”

এবার সবাই কিছুক্ষণের জন্য ড্রইংরুম ছেড়ে উঠে পড়লো। তবে সবার মন পড়ে রয়েছে এখানে। একটু আড়মোড়া ভেঙে আবার ফিরে আসবে আত্মাবিষয়ক আলোচনায়।


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ২২/১২/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৮০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast