অদ্ভুত প্রতিঘাত
ছোটগল্প: অদ্ভুত প্রতিঘাত
সাইয়িদ রফিকুল হক
লোকটি হাঁটছিল আর বিড়-বিড় করে কাকে যেন অনবরত গালি দিচ্ছিলো।
তার চারপাশে অবশ্য মানুষজন তেমন ছিল না। রাস্তাটা একদম ফাঁকা না হলেও কিছুটা ফাঁকা ছিল। সে একাকী আপনমনে হাঁটছিল—আর কাকে যেন মুষলধারে বৃষ্টির মতো গালি দিচ্ছিলো!
আর খুব গরম পড়েছিল সেদিন। তবুও লোকটি একটুও ঘামছিল না। তার যেন খুব শীত-শীত লাগছিল! তাই, সে গায়ে চাপিয়েছে একটা সুতির কালো রঙের চাদর। প্রতিটি খুনের আগে তার সবসময় এমনই মনে হয়।
আজও সে একজনকে খুন করতে যাচ্ছে। এইজন্য সে গায়ে চাপিয়েছে কালো রঙের চাদরটা। রাতের আঁধারের সঙ্গে এই রঙটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এই সুযোগে সে নির্বিঘ্নে তার কর্মসম্পাদন করতে পারবে। খুন করার ইচ্ছে অবশ্য তার মোটেও ছিল না। তার কারণ, সে ইদানীং খুনখারাবি করতে চাচ্ছে না। তার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের বিয়েশাদীর একটা ব্যাপার আছে। হঠাৎ সে যদি ধরা পড়ে যায়—তাহলে, বিরাট লোকলজ্জার বিষয়। এইজন্য সে আগে থেকে সাবধান হতে চাচ্ছে। কিন্তু তার বড়ভাইগণ তাকে সেই সুযোগ দিলো না।
যে-লোকটিকে সে আজ খুন করতে যাচ্ছে—তাকে সে আগে থেকে একবারও দেখেনি। তার ছবিটা শুধু পকেটে আছে। আজ বিকালের মধ্যেই সে তাকে নিজের চোখে দেখবে—আর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিবে—তারপর রাতের আঁধারে যেকোনো একটা সময়ে তাকে হত্যা করবে। সম্পূর্ণ অচেনা একটি লোক—তার সঙ্গে তার কোনো বিবাদ কিংবা শত্রুতা নাই। তবুও আজ রাতে তাকেই খুন করতে হবে। এই খুনটা তাকে করতে হবে নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য একটা গ্রামে গিয়ে। সে এখন সেখানেই যাচ্ছে। এই গ্রামটা তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তবে এতদাঞ্চলের সবজায়গা তার চেনা। আর সব মানুষই তার পরিচিত। এইজন্য খুন করতে তার খুব সুবিধা হয়। সে যেখানে-সেখানে যাতায়াত করলেও লোকজন তেমনকিছু মনে করে না। সে সবাইকে মানিয়ে নিতে পারে। তার পকেটে সবসময় দামি সিগারেট থাকে। নগদ টাকাপয়সাও থাকে কিছু। যাকে যে-ভাবে ম্যানেজ করার দরকার—তাকে সে সেভাবেই ম্যানেজ করে থাকে। খুনের জগতে সে একটা বড়সড় ম্যানেজার!
আগে সে টাকার জন্য মানুষখুন করতো। ইদানীং সে ভালো হতে চাইছিল। কিন্তু সেই সুযোগ সে পাচ্ছে না। এখন তার টাকার প্রয়োজন না থাকলেও—খুন করতে হচ্ছে এক বড়ভাইয়ের আদেশে। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার শক্তি এই আলমাসের নাই।
সে আগে থেকে ছিল একটা ভাড়াটিয়া খুনী। এখনও তা-ই আছে। এই জীবনে বহু মানুষকে সে খুন করেছে—টাকার জন্য। আর এখন খুন করছে—আগের খুনগুলো যেন বড়ভাই প্রকাশ না করে—তার আত্মরক্ষার জন্য। সে এখন নিরুপায়। এভাবে তাকে নিয়মিত খুন করে যেতেই হবে। আসলে, সে যে খুনী! খুনীরা কখনো ভালো হতে পারে না। সেই সুযোগ তারা পায় না।
তাকে দেখলে কেউ খুনী মনে করে না। তার স্বাস্থ্য ভালো—তবে নাদুসনুদুস নয়। সে দেখতেও ভালো। আর সে নিয়মিত পান খায়। আর পান খেয়ে সে ঠোঁট দুটোকে একেবারে লাল করে রাখে। এইসময় তার চেহারায় ফুটে ওঠে ভালোমানুষির একটা ছাপ আর জৌলুস!
মাঝে-মাঝে পানের সঙ্গে সিগারেটও খায় সে। তার পরনে থাকে সবসময় সাদা ধবধবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। তাকে দেখলে যেকেউই মনে করবে—সে বুঝি কোনো অঞ্চলের সাধুপুরুষ। সে যে-সমস্ত মানুষদের খুন করেছে—তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছে—হত্যা করার আগে। হত্যা করার আগে সে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে। কারও শেষইচ্ছে থাকলে সে তা পূরণ করারও চেষ্টা করে থাকে। একবার শিমুলতলী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের আগে আফজাল-মাস্টারকে খুন করতে যায় সে। মাস্টারের প্রতিপক্ষ তাকে নগদ দুই লক্ষ টাকা দিয়ে খুশি করেছিল। সে ইউপি-নির্বাচন জমে ওঠার আগেই আফজাল-মাস্টারকে খুন করে। আর খুন করার আগে গভীর রাতে সে মাস্টারের কাছে গিয়ে বলেছিল, “স্যার, আপনার কী করতে মনে চায়?”
মাস্টার তাকে বলেছিলেন, “এলাকার মানুষের সেবা করতে মনে চায়। তাই, চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে এই জনসেবার পথ বেছে নিয়েছি।”
তারপর সে বলেছিল, “আপনার কিছু খেতে মনে চায়?”
আফজাল-মাস্টার তখন তাকে বলেছিলেন, “আমার খুব টাটকা দই খেতে মনে চায়।”
তারপর আলমাস, মাস্টারবাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর সেই রাতে খুন হন এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ—আফজাল-মাস্টার! বৈঠকখানার ঘরে তার লাশের পাশে পড়ে ছিল অর্ধখাওয়া দইয়ের পাত্র! কেউ সন্দেহ করেনি আলমাসকে।
মানুষখুন করার কৌশলগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে আলমাস। এলাকায় সে সবসময় নিরীহ ও ভালোমানুষ সেজে থাকে। তার চেহারায় কখনো হিংস্রতা বুঝা যায় না।
আজ সে খুন করতে যাচ্ছে—আহমেদপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শাহাবুদ্দীনকে। তিনি আহমেদপুর ইউনিয়নপরিষদের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি নির্বাচিত ও জনপ্রিয় উপজেলাচেয়ারম্যান। তিনি কখনো কিছু হওয়ার জন্য কাউকে জোরজবরদস্তি করেন না। সামনের নির্বাচনেও লোকজন তাকে ভোট দিবে—এটা তার প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ একেবারে নিশ্চিত। তাই, এবার তারা আলমাসকে পাঁচলাখ টাকায় ভাড়া করেছে। শেষমেশ আলমাসও ভেবে দেখেছে, টাকার অঙ্কটা অনেকবড়!
আলমাস আজ দুপুরে খুব ভালো-ভালো খাবার খেয়েছে। মানুষখুন করার আগে সে এরকম করে থাকে। এতে নাকি মনের জোশ বাড়ে। পেটে ক্ষুধা থাকলে মানুষখুন করা যায় না। এতে নাকি নিজেকে দুর্বল লাগে! এসব সূত্র খুনী-আলমাসের আবিষ্কার! তার মতে, মনকে শান্ত রাখতে হয় এইসময়। সে এইজন্য সকাল থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আর লোকটিকে কীভাবে মারবে সে—তারও একটা মহাপরিকল্পনা করেছে মনে মনে। এইব্যাপারে আলমাস খুব সিদ্ধহস্ত।
শাহাবুদ্দীনসাহেব নিজের বাড়িতেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। বিরাট বাড়ি তার। কেউ দেখলে মনে করবে—এটা বিরাট একটা খামারবাড়ি! উপজেলার কাজ সকালের দিকে শেষ করে তিনি দুপুরের দিকে বাড়িতে চলে আসেন—তারপর আর বাইরে বের হন না। এটা তার মায়ের নিষেধাজ্ঞা। তিনি স্বপ্বযোগে দেখেছেন, তার পুত্রের অনেক আপদবিপদ। সেইজন্য তিনি ছেলেকে শপথ করিয়ে নিয়েছেন যে, সে কোনোভাবেই দুপুরের পর বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। আর যদি কোনোখানে কোনো বিপদ হয়—তাহলে, সে যেন কয়েকজন বডিগার্ড সঙ্গে করে তারপর সেখানে যায়। তার একা চলাফেরা করা একেবারে নিষিদ্ধ। শাহাবুদ্দীনসাহেব আজকাল খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হন না বলে লোকজন তাকে তেমন-একটা চেনে না। কিন্তু তার ছবি দেখলে সবাই চেনে। তিনি তার এলাকার পূজনীয় ব্যক্তিত্ব।
শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব শৌখিন মানুষ। তার কাজকর্মে কোনো ফাঁকফোকড় নাই। সবকিছু তার কাছে নিখুঁতভাবে হওয়া চাই। জীবনটা তিনি দারুণভাবে উপভোগ করার জন্য নিজের হালাল টাকায় বানিয়েছেন এই বিশাল বাগানবাড়ি।
দুপুরে মায়ের সঙ্গে খাবার খেয়ে তিনি একটু বিশ্রাম নেন। তারপর বিকালের আগেই তার প্রিয় শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে এসে বসেন। এইসময় তিনি পুকুরের পাশে সংরক্ষিত সিমেন্টের বড় ছাতার নিচে—সিমেন্টের চেয়ার-টেবিলে বসে একনাগাড়ে শুধু বই পড়তে থাকেন। যতক্ষণ দিনের আলো ভালোভাবে থাকে—ততক্ষণ তিনি বইয়ের জগতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকেন। আর এইসময় তার সঙ্গে কারও কথা বলা একেবারে নিষিদ্ধ। এই অভ্যাস তার দীর্ঘদিনের।
প্রতিদিন তিনি বইপড়া শেষ করে শেষবিকালে পুকুরের মাছগুলোকে খাবার দেন। তারপর বসে থাকেন পুকুরের শান-বাঁধানো সিঁড়িতে। এইসময় পুকুরের জলে কতকগুলো হাঁস মনের আনন্দে জলকেলি করে থাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও তিনি মাঝে-মাঝে এখানেই বসে থাকেন। আবার কখনো-কখনো গভীর রাত পর্যন্ত তিনি এখানে বসে নিস্তব্ধ নিসর্গ দেখেন। তার নিরাপত্তার কথা ভেবে—তার মা তার জন্য খুব বিশ্বস্ত, সাহসী, দেহধারী ও শক্তিশালী দুইজন বডিগার্ড রেখেছেন। এরা প্রায় দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা শাহাবুদ্দীনসাহেবের সঙ্গে লেগে থাকে।
আজও বইপড়া শেষ করে পড়ন্ত বিকালে মাছগুলোকে খাবার দিচ্ছিলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। পুকুরপাড়ে বসে থাকতে তার কী যে ভালো লাগে! ছোট্ট শিশুর মতো তিনি হাঁসের সাঁতারকাটা দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হন। আর কথা বলতে ভালোবাসেন মাছেদের সঙ্গে।
তার এখানে কাছাকাছি দুটো পুকুর রয়েছে। একটি বড়—অপরটি তুলনামূলকভাবে ছোট। বড়পুকুরের পাড়েই তিনি বেশিরভাগ সময় বসেন। ছোটটিতে নানাজাতের রাক্ষুসে মাছের চাষ করেন। সেখানে তিনি খুব একটা যান না। এই পুকুরটা সহজে কারও নজরেও পড়ে না। ঘন গাছপালার আড়ালে এই ছোট্টপুকুরটার অবস্থান। এখানে, তিনি মাঝে-মাঝে জ্যোৎস্নারাতে এসে বসে থাকেন। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য এটা চমৎকার একটা জায়গা। এমন সুন্দর নিরিবিলি জায়গা তার আশেপাশে আর-কোথাও আছে কিনা—তা শাহাবুদ্দীনসাহেবের জানা নাই।
আজ তিনি সূর্যাস্তের একটু আগে এই ছোট্ট-নির্জন পুকুরটার পাড়ে-সিঁড়িতে গিয়ে বসলেন। তার সঙ্গে রয়েছে দুই বডিগার্ড—আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ। দুজনেই একসময় লাঠিয়াল ছিল। ওরা বয়সে একেবারে যুবক না হলেও—খুব তরতাজা পালোয়ানগোছের মানুষ।। ওদের দুজনের সামনে দাঁড়াবার মতো সাহসীমানুষ এই তল্লাটে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
মাগরিবের আজান শুনে শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে অজু করলেন। আজ তিনি অজুর কাজে মনোযোগের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অজুশেষে গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে জায়নামাজে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে মসজিদের আজান শেষ। তার পিছনে দুই বডিগার্ডও দাঁড়িয়ে পড়লো।
খুব মনোযোগ দিয়ে মাগরিবের তিন রাকাআত ফরজ-নামাজ শেষ করলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। তারপর নফল-নামাজ আদায়ে মনোসংযোগ করলেন। নামাজশেষে তিনি বসলেন মোরাকাবায়। তিনি সন্ধ্যার পরে এভাবে নিয়মিত মোরাকাবায় বসেন। নিজের রুহানীশক্তিবৃদ্ধির জন্য ইদানীং তিনি যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোরাকাবা-মোশাহেদায় আজকাল আরও বেশি আনন্দ পাচ্ছেন তিনি। এই মহৎগুণটি তিনি পৈতৃকসূত্রে অর্জন করেছেন। তার পিতা আফাজউদ্দীন এই এলাকায় অনেকবড় সাধক ছিলেন। শোনা যায়—তিনি নাকি মোরাকাবায় বসে নিজের রুহ ছেড়ে দিতেন বাইরে—আর সেই রুহ নাকি বহু জায়গা ঘুরে আবার তার দেহে ফিরে আসতো! তিনি এক কামেল সাধকের নিকট থেকে এই শক্তিশালী রুহানীশক্তি অর্জন করেছিলেন। তার স্ত্রী আশরাফুন্নেসাও যথেষ্ট ধার্মিকা ও সুশীলা। পিতামাতার নিকট থেকে ধর্মবিষয়ে বিরাট সাহায্য-সহযোগিতা-লাভ করে শাহাবুদ্দীনসাহেব আজ নিজেও একজন সাধকে পরিণত হয়েছেন। এতোদিন তার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি উপজেলানির্বাচনে অংশগ্রহণের পর থেকে তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাণ্বিত হয়ে দুষ্টুলোকেরা তার পিছু নিয়েছে। নির্বাচনের আগেও এরা তাকে অনেকরকম হুমকিধমকি দিয়েছিল—কিন্তু তিনি ওদের কোনোকিছুকে পরোয়া না করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। আর শেষপর্যন্ত জয়লাভ করে ওদের বাড়াভাতে ছাই দিয়েছেন। এখনও তিনি কাউকে ভয় পান না—তবে সাবধানে চলাফেরা করেন। এটা যে তার মায়ের আদেশ।
নামাজশেষে দুই বডিগার্ড আবার নিজের অবস্থানে সজাগ ও সতর্ক রয়েছে। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে শাহাবুদ্দীনসাহেবের আশেপাশে হাজির হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আলমাস যে ভয়ংকর খুনী!
মোরাকাবার আসনে বসে অনেকটা সময় পরে হঠাৎ শাহাবুদ্দীনসাহেব যেন কাঁপতে লাগলেন। তিনি কিছুক্ষণ পরে চোখমেলে তাকালেন আশেপাশে। দেখলেন, তার দুই বডিগার্ড উদ্বিগ্নভাবে তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দেখে তিনি যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি আধ্যাত্মিক মানুষ। তবুও আজ-এইমুহূর্তে এই অভাবিত ঘটনা দেখে তিনি ভয়ানকভাবে বিস্মিত!
প্রধান দেহরক্ষী আমজাদ তার আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বললো, “হুজুর, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আপনার শরীরটা হঠাৎ কয়েকবার কেঁপে উঠেছে!”
শাহাবুদ্দীনসাহেব একটু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, বিরাট একটা সমস্যা হয়েছে। আমি এইমাত্র মোরাকাবার ধ্যানে দেখেছি—অন্য গ্রামের একটা লোক আমাকে খুন করতে আসছে! ওর বাড়ি কাশীনাথপুরে। আর ওর নামটা হলো আলমাস। আর সে খুব ভয়ংকর খুনী।”
আমজাদ খুব চিন্তিত হয়ে বললো, “হুজুর, একথা কি এখনই ভিতরবাড়িতে আম্মাজানকে জানাবো?”
“না, তার জানানোর দরকার নাই। তিনি এমনিতে বয়স্ক মানুষ। শেষে, আমার জন্য চিন্তাভাবনা করে আজ রাতের ঘুম কামাই করবেন। তার ঘুমের বড় প্রয়োজন। যা করার আমি আর তুমি মিলেই করবো।”—কথাটা শেষ করে শাহাবুদ্দীনসাহেব এদিক-ওদিক কয়েকবার তাকালেন।
“হুজুর, তাকে জানানোই ভালো। আম্মাজানও অনেকবড় কামেল মানুষ। তিনি আপনার নিরাপত্তার জন্য দোয়াদরুদ করতে পারবেন।”—আমজাদ অনুরোধের সুরে কথাগুলো বললো।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এবার জোর দিয়ে বললেন, “তার দরকার নাই। এবার শোনো—আমার কথা এখনও শেষ হয় নাই। লোকটার নাম আলমাস সেখ। ওর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কোঠায়। কিন্তু খুব শক্তিশালী। আর সে দেখতে শান্তশিষ্ট, স্বাস্থ্যবান, ফর্সা, সবসময় পান খায়। আর তার গায়ে সুতির একটা কালোচাদর আছে। সে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে চাইলে—তুমি তাকে ঢুকতে দিবে। তারপর আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর তাকে কোনোকিছু বুঝতে দিবে না।”
আমজাদ মাথানেড়ে সম্মতি জানালো। আর সে তখনই নুর মোহাম্মদকে ইশারায় বাড়ির সিংহদ্বারের দারোয়ানদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলো।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এতদাঞ্চলের মানুষের কাছে শুধু একজন সৎ, বিশ্বস্ত, আদর্শবান-রাজনীতিবিদ, আর একজন ভালোমানুষই নন—তিনি একজন আধ্যাত্মিকসাধক হিসাবেও সুপরিচিত। তিনি বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন—ততক্ষণ ব্যক্তিগত কিছু কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাকি সময়টা মোরাকাবা-মোশাহেদায় সময় ব্যয় করেন। বাইরের রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে তার রুহানীশক্তি অনেক বেশি।
আলমাস শেষবিকালের একটু আগে থেকে শাহাবুদ্দীনসাহেবের বাড়ির সামনে একটা চায়ের দোকানে বসে রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে সে খাতির জমাচ্ছে। সে কথায়-কথায় বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছে—তাদের নিকট থেকে। ইতোমধ্যে সে পুরা বাড়িটা ঘুরে দেখেছে। রাতের বেলা কোনদিক দিয়ে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকবে—তার একটা নকশাও তার করা হয়েছে। সে এবার মনের সুখে একটা চায়ের অর্ডার দিলো। সঙ্গে দামি সিগারেটও ধরালো একটা।
এইসময় আলমাস একটা লোকের নিকট থেকে জানতে পারলো, শাহাবুদ্দীনসাহেব প্রায় প্রতিদিন রাত দশটা পর্যন্ত পুকুরপাড়ে একাকী বসে থাকেন। মাছেদের সঙ্গে কথা বলেন। নফল-নামাজ পড়েন সেখানে। তারপর অনেক রাতে ঘুমাতে যান তিনি।
সব শুনে আলমাসের দেহমন আনন্দে ভরে উঠলো। এমন সুযোগ সে আজ রাতে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
শাহাবুদ্দীনসাহেবের পুরা বাড়িটা চক্কর দিয়ে আলমাস বুঝতে পেরেছে—তার এই কাজটি অন্যান্য কাজের চেয়ে একটু কঠিন হবে। এইজন্য সে আগের পরিকল্পনা থেকে কিছুটা সরে এসেছে। সে বাড়ির সীমানার মধ্যে কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছিল। এর চারিদিকে এখনও প্রাচীর দেওয়া হয় নাই। শুধু তিনদিকে শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া রয়েছে। আর একদিকে তার বাসভবন ও অন্যান্য বসতঘর থাকায় এদিকটা বেড়ার মতো। আলমাস শিকারী-কুকুরের মতো একটা ফাঁক গলে বুকে হেঁটে একেবারে পুকুরের কাছে গিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে শাহাবুদ্দীনসাহেবের চেহারাটা মিলিয়ে নিয়েছে। এবার তাকে খুন করতে তার আর বাধা নাই। সে যেকোনো একটা সময়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে কিংবা একটু ফাঁকফোকড় পেলে পুকুরপাড়েই তাকে খতম করে দিবে। মানুষখুন করতে তার খুব একটা বেশি সময় লাগে না। তবে আজকের কাজটা সে খুব সাবধানে করার চেষ্টা করছে। তার সঙ্গে রয়েছে বড় একটা ছোরা আর জানালার গ্রিল-কাটার ছোট্ট মেশিন। এই দুটি অস্ত্র আজ তার সঙ্গী। কাজটা নির্বিঘ্নে করতে পারলে সে অস্ত্র দুটো পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে নিরাপদে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। রাত-ভোরের আগেই সে গোসল করে মসজিদে যাবে। তারপর নামাজ পড়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবে। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে সে বিকালে আড্ডা দিবে—নিজেদের বাজারের চায়ের দোকানে। সবশেষে সে ভুলে যাবে খুনের কথা! আর পুলিশ এই মামলার তদন্ত বেশি করবে না—তার পিছনে যে রয়েছে তার বড়ভাই!
রাতে এশার নামাজ পড়লেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। এবার নামাজে তার মনোযোগ যেন আগের চেয়ে আরও বেশি ছিল। তিনি নিজেকে একজন মৃত মানুষ ভেবে সর্বশক্তিমানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি ভক্তি, প্রেম, ভয় ও ভালোবাসা ঢেলে দিলেন। নামাজশেষে তিনি মায়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন। তারপর বেরিয়ে এলেন বাইরে। আবার গিয়ে বসলেন—সেই ছোট্ট পুকুরের পাড়ে। আজও জ্যোৎস্নারাত যে! তবে কিছুক্ষণ পরে তিনি সেখান থেকে আবার উঠে পড়লেন।
বড়পুকুরটার পাড়ে শাহাবুদ্দীনসাহেবের জামাকাপড় পরিয়ে ঠিক তার মূর্তির মতো একটাকিছু বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু দূর থেকে এটাকে যেকেউই মানুষ বলে ভুল করবে। আর এই আলোআঁধারিতে মানুষের ভুল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। আজ জ্যোৎস্নারাত হলেও এখানে গাছের ছায়ায় চারিদিকে বেশ আলোআঁধারির খেলা জমে উঠেছে। আর ইচ্ছে করে গাছের ছায়ায়—একটু অন্ধকারে সেই মূর্তিটাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
এই অদ্ভুত মূর্তিটার ঠিক পিছনদিকে কয়েকটি ঘন-গাছের আড়ালে-অন্ধকারে মিশে লাঠিহাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহাবুদ্দীনসাহেবের আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ। ওরা যেন এখন অন্ধকারের যমদূত!
রাত তখন কত হবে—বড়জোর সাড়ে নয়টা—এমন সময় এই নিস্তব্ধ-বিশাল বাগানবাড়িতে একটা ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল! সে যে তারকাঁটার বেড়া গলে এখানে এসেছে—তা দেখলেই বুঝা যায়। তার পরনের সাদা লুঙ্গিটা শুধু দেখা যাচ্ছে। আর যেখানে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে—সেখানে লোকটাকেও দেখা যাচ্ছে। একটু দূর থেকেই আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে—এটা আলমাস। ওরা আরও সতর্ক হয়ে যায়।
ছায়ামূর্তিটা এগিয়ে আসতে-আসতে একসময় শাহাবুদ্দীনসাহেবের ডামি’র কাছে চলে এলো। তারপর সে কোমর থেকে বের করলো বড় ছোরাটা। চাঁদের আলোয় ছোরাটা একবার ঝলমল করে উঠলো। তারপর সে সামনের দিকে ঝুঁকে বসা ডামিটার ঘাড়ে বসিয়ে দেয় একটা বড়সড় ঘা। কিন্তু ততক্ষণে তার বুঝতে দেরি হয়ে গিয়েছে। সে বুঝতে পারলো—সে তার জীবনে একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। ঘুরে সে একটু পিছনে ফেরার আগেই আমজাদের লাঠি গিয়ে পড়লো তার মাথায়। আর একআঘাতে নুর মোহাম্মদ তার দুই-পা ভেঙে ফেলেছে।
সে মাটিতে শুয়ে একটা অসহায় বাচ্চা-কুকুরের মতো শুধু কুঁই কুঁই করছিল। আমজাদ দ্রুত তার দুইহাতও ভেঙে দিলো—দুইটা শক্ত মোচড়ে। সে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো—ঠিক প্যারালাইজড ব্যক্তির মতো।
এই লোকটা আর জীবনে কখনো-কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আর কাউকে খুন করা তো দূরের কথা।
আমজাদ আলগোছে আলমাসের বড় ছোরাটা আগেই সরিয়ে ফেলেছে। এবার সে পুকুরঘাটে একটা লাইট জ্বালিয়ে দিলো। এতবড় একটা ঘটনা—তবুও কারও মধ্যে কোনো হৈচৈ নাই!
আমজাদ একটু এগিয়ে শাহাবুদ্দীনসাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আর সে খুব খুশি হয়ে বিনীতভাবে বললো, “হুজুর, ও-কে আমরা ঘায়েল করেছি। সে এখনও জীবিত।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব নিরাপদ একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন।
আলমাস এবার চোখমেলে তাকায়। আর সে দেখে—তার সামনে আসল শাহাবুদ্দীনসাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন! সে কাঁচুমাচু হয়ে তাকে সালাম দেয়।
শাহাবুদ্দীনসাহেব বললেন, “তোমাকে কে পাঠিয়েছিল—আমাকে মারতে?”
আলমাস চুপ করে থাকে। তার ভাবখানা এমন—যেন সে কিছুই জানে না।
আমজাদ রাগে ফুঁসছিল। অনুমতি পেলে সে লাঠির একটা আঘাতেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবে।
কিন্তু শাহাবুদ্দীনসাহেব এর মূল রহস্যটা জানতে চান।
তিনি শান্তভাবে আলমাসের পাশে ঘাসের ওপর বসে পড়লেন। তারপর খুব ঘনিষ্ঠ আপনজনের মতো তার কাছে জানতে চাইলেন, “ভাই, তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছিল? তার নামটি বলো? আমি জানি, তুমি আসল খুনী নও।”
এতে কাজ হলো। সে একটু নড়েচড়ে শোওয়ার চেষ্টা করে যেন। শেষে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো—কাশীনাথপুরের আউয়াল শিকদার আপনাকে খুনের আদেশ করেছিলেন। এজন্য আমাকে পাঁচলক্ষ টাকা দেওয়ার কথা। তিনলক্ষ টাকা আমি নগদ হাতে পেয়েছি। আর বাকিটা আপনাকে খুন করার পর দেওয়ার কথা রয়েছে।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব ঠাণ্ডাগলায় বললেন, “তুমি কি আমাকে এখন খুন করে ওই বাকি দুইলক্ষ টাকা পেতে চাও? তোমার মনের ইচ্ছাটা কী?”
আলমাস মাথানিচু করে রইলো। সে আর কোনো কথা বলে না।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, “সে আমাকে কেন খুন করতে চেয়েছিল?”
আলমাস বুঝতে পারে তার এখন কিছুই করার নাই। সে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “আপনারা একই উপজেলার লোক। আপনি মারা গেলে সে এলাকায় সহজে প্রভাববিস্তার করতে পারবে। আপনে ভালোমানুষ। তাই, সে আপনার সঙ্গে বুদ্ধিতে পারে না। তাছাড়া, গতবছর কাশীনাথপুর-কলেজে এইচএসসি পরীক্ষাচলাকালে—আপনে হলপরিদর্শনের সময় তার একমাত্র ছেলেকে নকলসহ হাতেনাতে ধরেছিলেন। এজন্য শিক্ষাবোর্ড ছেলেটিকে দুই-বছরের জন্য এক্সফেল করে দেয়। এতে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়—এইজন্য তিনি...। আর আমি এতোকিছু জানি না, স্যার। আমাকে খুনের আদেশ দিয়েছেন—আমি তা-ই করছিলাম।”
“তুমি এ-পর্যন্ত কতগুলো মানুষখুন করেছো?”—শাহাবুদ্দীনসাহেব আস্তে জানতে চাইলেন।
“তা এগারোজন তো হবেই।”—খুব স্বাভাবিককণ্ঠ আলমাসের।
আঁতকে উঠলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। আজ তিনি এর হাতে মারা গেলে এর খুনের ডজন পূর্ণ হতো!
একটু পরে কী যেন ভাবতে-ভাবতে শাহাবুদ্দীনসাহেব উঠে দাঁড়িয়ে আলমাসের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি এখন কী করতে চাও?”
“আমাকে এবার ছেড়ে দিন হুজুর। আমি তো এখন পঙ্গু। আর প্রয়োজনে আমি ভিক্ষা করে খাবো। তবুও আমাকে বাঁচতে দিন! আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার!”—আলমাসের কণ্ঠে গভীর আকুতি।
শাহাবুদ্দীনসাহেব সেই এগারোজন নিহত মানুষের নাম জেনে নিলেন আলমাসের নিকট থেকে—যাদের সে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর যারা তাকে দিয়ে এই হত্যাগুলো করিয়েছে—তাদের নামধামও ভালোভাবে জেনে নিলেন। আর কথা বলার একফাঁকে তিনি আলমাসের সমস্ত বক্তব্য ভিডিও-রেকর্ড করতেও ভুল করেননি।
তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমাকে এখনই ছেড়ে দিচ্ছি।”—কথাটা বলে তিনি আমজাদকে বললেন, “ও-কে আমাদের ছোটপুকুরে ছেড়ে দাও।”
আলমাস চিৎকার করে উঠলো এবার। আর সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কিন্তু আমজাদ আর নুর মোহাম্মদ কোনোকিছুতেই থামলো না—তারা দুজন আলমাসকে একেবারে চ্যাংদোলা করে—টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো ছোটপুকুরে। সেখানে আছে বড়-বড় পাঙ্গাস আর আফ্রিকান মাগুর। একটা আলমাসকে হজম করতে ওদের খুব একটা বেশি সময় লাগবে না।
আমজাদ আর নুর মোহাম্মদ কাজটি শেষ করে হাসিমুখে শাহাবুদ্দীনসাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো। তাদের মনে এখন ভীষণ আনন্দ। আবার কিছুটা দুশ্চিন্তাও রয়েছে—আলমাসদের হুকুমদাতা যে এখনও রয়ে গেছে!
তিনি ওদের দিকে চেয়ে বললেন, “ও-কে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আবার কাকে-না-কাকে সে খুন করবে—তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। এই ধরনের অমানুষকে আমাদের পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখাটাই অপরাধ। এরা সমগ্র মানবজাতির চিরশত্রু। এদের শাস্তি দিতে কোনোরকম কার্পণ্য করা উচিত নয়। এরা পৃথিবীর সকল ধর্মের সকল মানুষের শত্রু। টাকার বিনিময়ে, স্বার্থের জন্য, ঈর্ষাণ্বিত হয়ে যারা মানুষখুন করে—তাদের মতো নিম্নজাতের শুয়োর এই পৃথিবীতে আর নাই। এদের দেখামাত্র হত্যা করা উচিত। এদের জন্য কত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! এই পাপীদের তোমরা কখনো ক্ষমা করবে না। এবার এদের নির্দেশদাতাদের ধরতে হবে। এরাই হলো বড় শয়তান। আমাদের এলাকাটা আগাছামুক্ত করতে হলে এদের নিশ্চিহ্ন না-করে কোনো উপায় নাই। আমার এলাকায় কোনো খুনীকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।”
আমজাদ খুশি হয়ে বলে, “হুজুর, আপনি শুধু আমাদের হুকুম করবেন—আর আমরা ওদের ধরে এনে ছোটপুকুরে ফেলে দিবো।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব বললেন, “ঠিকই বলেছো। এদের কোনো ক্ষমা নাই। সবক’টাকে এবার ছোটপুকুরে ফেলতে হবে।”
[এই পৃথিবীর মানুষগুলো কখনো মনে রাখে না—ভুল করলে, মানুষের ক্ষতি করলে, আর যেকোনো পাপ করলে—তার মাশুল দিতে হবে গুনে-গুনে। আর কথায় আছে না—যেমন কর্ম তেমন ফল! এর থেকে কারও পরিত্রাণ নাই। তবুও মানুষগুলোর কোনো শিক্ষা হয় না।]
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২১/১১/২০১৯
সাইয়িদ রফিকুল হক
লোকটি হাঁটছিল আর বিড়-বিড় করে কাকে যেন অনবরত গালি দিচ্ছিলো।
তার চারপাশে অবশ্য মানুষজন তেমন ছিল না। রাস্তাটা একদম ফাঁকা না হলেও কিছুটা ফাঁকা ছিল। সে একাকী আপনমনে হাঁটছিল—আর কাকে যেন মুষলধারে বৃষ্টির মতো গালি দিচ্ছিলো!
আর খুব গরম পড়েছিল সেদিন। তবুও লোকটি একটুও ঘামছিল না। তার যেন খুব শীত-শীত লাগছিল! তাই, সে গায়ে চাপিয়েছে একটা সুতির কালো রঙের চাদর। প্রতিটি খুনের আগে তার সবসময় এমনই মনে হয়।
আজও সে একজনকে খুন করতে যাচ্ছে। এইজন্য সে গায়ে চাপিয়েছে কালো রঙের চাদরটা। রাতের আঁধারের সঙ্গে এই রঙটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এই সুযোগে সে নির্বিঘ্নে তার কর্মসম্পাদন করতে পারবে। খুন করার ইচ্ছে অবশ্য তার মোটেও ছিল না। তার কারণ, সে ইদানীং খুনখারাবি করতে চাচ্ছে না। তার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের বিয়েশাদীর একটা ব্যাপার আছে। হঠাৎ সে যদি ধরা পড়ে যায়—তাহলে, বিরাট লোকলজ্জার বিষয়। এইজন্য সে আগে থেকে সাবধান হতে চাচ্ছে। কিন্তু তার বড়ভাইগণ তাকে সেই সুযোগ দিলো না।
যে-লোকটিকে সে আজ খুন করতে যাচ্ছে—তাকে সে আগে থেকে একবারও দেখেনি। তার ছবিটা শুধু পকেটে আছে। আজ বিকালের মধ্যেই সে তাকে নিজের চোখে দেখবে—আর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিবে—তারপর রাতের আঁধারে যেকোনো একটা সময়ে তাকে হত্যা করবে। সম্পূর্ণ অচেনা একটি লোক—তার সঙ্গে তার কোনো বিবাদ কিংবা শত্রুতা নাই। তবুও আজ রাতে তাকেই খুন করতে হবে। এই খুনটা তাকে করতে হবে নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য একটা গ্রামে গিয়ে। সে এখন সেখানেই যাচ্ছে। এই গ্রামটা তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তবে এতদাঞ্চলের সবজায়গা তার চেনা। আর সব মানুষই তার পরিচিত। এইজন্য খুন করতে তার খুব সুবিধা হয়। সে যেখানে-সেখানে যাতায়াত করলেও লোকজন তেমনকিছু মনে করে না। সে সবাইকে মানিয়ে নিতে পারে। তার পকেটে সবসময় দামি সিগারেট থাকে। নগদ টাকাপয়সাও থাকে কিছু। যাকে যে-ভাবে ম্যানেজ করার দরকার—তাকে সে সেভাবেই ম্যানেজ করে থাকে। খুনের জগতে সে একটা বড়সড় ম্যানেজার!
আগে সে টাকার জন্য মানুষখুন করতো। ইদানীং সে ভালো হতে চাইছিল। কিন্তু সেই সুযোগ সে পাচ্ছে না। এখন তার টাকার প্রয়োজন না থাকলেও—খুন করতে হচ্ছে এক বড়ভাইয়ের আদেশে। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার শক্তি এই আলমাসের নাই।
সে আগে থেকে ছিল একটা ভাড়াটিয়া খুনী। এখনও তা-ই আছে। এই জীবনে বহু মানুষকে সে খুন করেছে—টাকার জন্য। আর এখন খুন করছে—আগের খুনগুলো যেন বড়ভাই প্রকাশ না করে—তার আত্মরক্ষার জন্য। সে এখন নিরুপায়। এভাবে তাকে নিয়মিত খুন করে যেতেই হবে। আসলে, সে যে খুনী! খুনীরা কখনো ভালো হতে পারে না। সেই সুযোগ তারা পায় না।
তাকে দেখলে কেউ খুনী মনে করে না। তার স্বাস্থ্য ভালো—তবে নাদুসনুদুস নয়। সে দেখতেও ভালো। আর সে নিয়মিত পান খায়। আর পান খেয়ে সে ঠোঁট দুটোকে একেবারে লাল করে রাখে। এইসময় তার চেহারায় ফুটে ওঠে ভালোমানুষির একটা ছাপ আর জৌলুস!
মাঝে-মাঝে পানের সঙ্গে সিগারেটও খায় সে। তার পরনে থাকে সবসময় সাদা ধবধবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। তাকে দেখলে যেকেউই মনে করবে—সে বুঝি কোনো অঞ্চলের সাধুপুরুষ। সে যে-সমস্ত মানুষদের খুন করেছে—তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছে—হত্যা করার আগে। হত্যা করার আগে সে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে। কারও শেষইচ্ছে থাকলে সে তা পূরণ করারও চেষ্টা করে থাকে। একবার শিমুলতলী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের আগে আফজাল-মাস্টারকে খুন করতে যায় সে। মাস্টারের প্রতিপক্ষ তাকে নগদ দুই লক্ষ টাকা দিয়ে খুশি করেছিল। সে ইউপি-নির্বাচন জমে ওঠার আগেই আফজাল-মাস্টারকে খুন করে। আর খুন করার আগে গভীর রাতে সে মাস্টারের কাছে গিয়ে বলেছিল, “স্যার, আপনার কী করতে মনে চায়?”
মাস্টার তাকে বলেছিলেন, “এলাকার মানুষের সেবা করতে মনে চায়। তাই, চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে এই জনসেবার পথ বেছে নিয়েছি।”
তারপর সে বলেছিল, “আপনার কিছু খেতে মনে চায়?”
আফজাল-মাস্টার তখন তাকে বলেছিলেন, “আমার খুব টাটকা দই খেতে মনে চায়।”
তারপর আলমাস, মাস্টারবাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর সেই রাতে খুন হন এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ—আফজাল-মাস্টার! বৈঠকখানার ঘরে তার লাশের পাশে পড়ে ছিল অর্ধখাওয়া দইয়ের পাত্র! কেউ সন্দেহ করেনি আলমাসকে।
মানুষখুন করার কৌশলগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে আলমাস। এলাকায় সে সবসময় নিরীহ ও ভালোমানুষ সেজে থাকে। তার চেহারায় কখনো হিংস্রতা বুঝা যায় না।
আজ সে খুন করতে যাচ্ছে—আহমেদপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শাহাবুদ্দীনকে। তিনি আহমেদপুর ইউনিয়নপরিষদের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি নির্বাচিত ও জনপ্রিয় উপজেলাচেয়ারম্যান। তিনি কখনো কিছু হওয়ার জন্য কাউকে জোরজবরদস্তি করেন না। সামনের নির্বাচনেও লোকজন তাকে ভোট দিবে—এটা তার প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ একেবারে নিশ্চিত। তাই, এবার তারা আলমাসকে পাঁচলাখ টাকায় ভাড়া করেছে। শেষমেশ আলমাসও ভেবে দেখেছে, টাকার অঙ্কটা অনেকবড়!
আলমাস আজ দুপুরে খুব ভালো-ভালো খাবার খেয়েছে। মানুষখুন করার আগে সে এরকম করে থাকে। এতে নাকি মনের জোশ বাড়ে। পেটে ক্ষুধা থাকলে মানুষখুন করা যায় না। এতে নাকি নিজেকে দুর্বল লাগে! এসব সূত্র খুনী-আলমাসের আবিষ্কার! তার মতে, মনকে শান্ত রাখতে হয় এইসময়। সে এইজন্য সকাল থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আর লোকটিকে কীভাবে মারবে সে—তারও একটা মহাপরিকল্পনা করেছে মনে মনে। এইব্যাপারে আলমাস খুব সিদ্ধহস্ত।
শাহাবুদ্দীনসাহেব নিজের বাড়িতেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। বিরাট বাড়ি তার। কেউ দেখলে মনে করবে—এটা বিরাট একটা খামারবাড়ি! উপজেলার কাজ সকালের দিকে শেষ করে তিনি দুপুরের দিকে বাড়িতে চলে আসেন—তারপর আর বাইরে বের হন না। এটা তার মায়ের নিষেধাজ্ঞা। তিনি স্বপ্বযোগে দেখেছেন, তার পুত্রের অনেক আপদবিপদ। সেইজন্য তিনি ছেলেকে শপথ করিয়ে নিয়েছেন যে, সে কোনোভাবেই দুপুরের পর বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। আর যদি কোনোখানে কোনো বিপদ হয়—তাহলে, সে যেন কয়েকজন বডিগার্ড সঙ্গে করে তারপর সেখানে যায়। তার একা চলাফেরা করা একেবারে নিষিদ্ধ। শাহাবুদ্দীনসাহেব আজকাল খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হন না বলে লোকজন তাকে তেমন-একটা চেনে না। কিন্তু তার ছবি দেখলে সবাই চেনে। তিনি তার এলাকার পূজনীয় ব্যক্তিত্ব।
শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব শৌখিন মানুষ। তার কাজকর্মে কোনো ফাঁকফোকড় নাই। সবকিছু তার কাছে নিখুঁতভাবে হওয়া চাই। জীবনটা তিনি দারুণভাবে উপভোগ করার জন্য নিজের হালাল টাকায় বানিয়েছেন এই বিশাল বাগানবাড়ি।
দুপুরে মায়ের সঙ্গে খাবার খেয়ে তিনি একটু বিশ্রাম নেন। তারপর বিকালের আগেই তার প্রিয় শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে এসে বসেন। এইসময় তিনি পুকুরের পাশে সংরক্ষিত সিমেন্টের বড় ছাতার নিচে—সিমেন্টের চেয়ার-টেবিলে বসে একনাগাড়ে শুধু বই পড়তে থাকেন। যতক্ষণ দিনের আলো ভালোভাবে থাকে—ততক্ষণ তিনি বইয়ের জগতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকেন। আর এইসময় তার সঙ্গে কারও কথা বলা একেবারে নিষিদ্ধ। এই অভ্যাস তার দীর্ঘদিনের।
প্রতিদিন তিনি বইপড়া শেষ করে শেষবিকালে পুকুরের মাছগুলোকে খাবার দেন। তারপর বসে থাকেন পুকুরের শান-বাঁধানো সিঁড়িতে। এইসময় পুকুরের জলে কতকগুলো হাঁস মনের আনন্দে জলকেলি করে থাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও তিনি মাঝে-মাঝে এখানেই বসে থাকেন। আবার কখনো-কখনো গভীর রাত পর্যন্ত তিনি এখানে বসে নিস্তব্ধ নিসর্গ দেখেন। তার নিরাপত্তার কথা ভেবে—তার মা তার জন্য খুব বিশ্বস্ত, সাহসী, দেহধারী ও শক্তিশালী দুইজন বডিগার্ড রেখেছেন। এরা প্রায় দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা শাহাবুদ্দীনসাহেবের সঙ্গে লেগে থাকে।
আজও বইপড়া শেষ করে পড়ন্ত বিকালে মাছগুলোকে খাবার দিচ্ছিলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। পুকুরপাড়ে বসে থাকতে তার কী যে ভালো লাগে! ছোট্ট শিশুর মতো তিনি হাঁসের সাঁতারকাটা দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হন। আর কথা বলতে ভালোবাসেন মাছেদের সঙ্গে।
তার এখানে কাছাকাছি দুটো পুকুর রয়েছে। একটি বড়—অপরটি তুলনামূলকভাবে ছোট। বড়পুকুরের পাড়েই তিনি বেশিরভাগ সময় বসেন। ছোটটিতে নানাজাতের রাক্ষুসে মাছের চাষ করেন। সেখানে তিনি খুব একটা যান না। এই পুকুরটা সহজে কারও নজরেও পড়ে না। ঘন গাছপালার আড়ালে এই ছোট্টপুকুরটার অবস্থান। এখানে, তিনি মাঝে-মাঝে জ্যোৎস্নারাতে এসে বসে থাকেন। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য এটা চমৎকার একটা জায়গা। এমন সুন্দর নিরিবিলি জায়গা তার আশেপাশে আর-কোথাও আছে কিনা—তা শাহাবুদ্দীনসাহেবের জানা নাই।
আজ তিনি সূর্যাস্তের একটু আগে এই ছোট্ট-নির্জন পুকুরটার পাড়ে-সিঁড়িতে গিয়ে বসলেন। তার সঙ্গে রয়েছে দুই বডিগার্ড—আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ। দুজনেই একসময় লাঠিয়াল ছিল। ওরা বয়সে একেবারে যুবক না হলেও—খুব তরতাজা পালোয়ানগোছের মানুষ।। ওদের দুজনের সামনে দাঁড়াবার মতো সাহসীমানুষ এই তল্লাটে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
মাগরিবের আজান শুনে শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে অজু করলেন। আজ তিনি অজুর কাজে মনোযোগের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অজুশেষে গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে জায়নামাজে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে মসজিদের আজান শেষ। তার পিছনে দুই বডিগার্ডও দাঁড়িয়ে পড়লো।
খুব মনোযোগ দিয়ে মাগরিবের তিন রাকাআত ফরজ-নামাজ শেষ করলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। তারপর নফল-নামাজ আদায়ে মনোসংযোগ করলেন। নামাজশেষে তিনি বসলেন মোরাকাবায়। তিনি সন্ধ্যার পরে এভাবে নিয়মিত মোরাকাবায় বসেন। নিজের রুহানীশক্তিবৃদ্ধির জন্য ইদানীং তিনি যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোরাকাবা-মোশাহেদায় আজকাল আরও বেশি আনন্দ পাচ্ছেন তিনি। এই মহৎগুণটি তিনি পৈতৃকসূত্রে অর্জন করেছেন। তার পিতা আফাজউদ্দীন এই এলাকায় অনেকবড় সাধক ছিলেন। শোনা যায়—তিনি নাকি মোরাকাবায় বসে নিজের রুহ ছেড়ে দিতেন বাইরে—আর সেই রুহ নাকি বহু জায়গা ঘুরে আবার তার দেহে ফিরে আসতো! তিনি এক কামেল সাধকের নিকট থেকে এই শক্তিশালী রুহানীশক্তি অর্জন করেছিলেন। তার স্ত্রী আশরাফুন্নেসাও যথেষ্ট ধার্মিকা ও সুশীলা। পিতামাতার নিকট থেকে ধর্মবিষয়ে বিরাট সাহায্য-সহযোগিতা-লাভ করে শাহাবুদ্দীনসাহেব আজ নিজেও একজন সাধকে পরিণত হয়েছেন। এতোদিন তার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি উপজেলানির্বাচনে অংশগ্রহণের পর থেকে তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাণ্বিত হয়ে দুষ্টুলোকেরা তার পিছু নিয়েছে। নির্বাচনের আগেও এরা তাকে অনেকরকম হুমকিধমকি দিয়েছিল—কিন্তু তিনি ওদের কোনোকিছুকে পরোয়া না করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। আর শেষপর্যন্ত জয়লাভ করে ওদের বাড়াভাতে ছাই দিয়েছেন। এখনও তিনি কাউকে ভয় পান না—তবে সাবধানে চলাফেরা করেন। এটা যে তার মায়ের আদেশ।
নামাজশেষে দুই বডিগার্ড আবার নিজের অবস্থানে সজাগ ও সতর্ক রয়েছে। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে শাহাবুদ্দীনসাহেবের আশেপাশে হাজির হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আলমাস যে ভয়ংকর খুনী!
মোরাকাবার আসনে বসে অনেকটা সময় পরে হঠাৎ শাহাবুদ্দীনসাহেব যেন কাঁপতে লাগলেন। তিনি কিছুক্ষণ পরে চোখমেলে তাকালেন আশেপাশে। দেখলেন, তার দুই বডিগার্ড উদ্বিগ্নভাবে তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দেখে তিনি যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি আধ্যাত্মিক মানুষ। তবুও আজ-এইমুহূর্তে এই অভাবিত ঘটনা দেখে তিনি ভয়ানকভাবে বিস্মিত!
প্রধান দেহরক্ষী আমজাদ তার আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বললো, “হুজুর, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আপনার শরীরটা হঠাৎ কয়েকবার কেঁপে উঠেছে!”
শাহাবুদ্দীনসাহেব একটু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, বিরাট একটা সমস্যা হয়েছে। আমি এইমাত্র মোরাকাবার ধ্যানে দেখেছি—অন্য গ্রামের একটা লোক আমাকে খুন করতে আসছে! ওর বাড়ি কাশীনাথপুরে। আর ওর নামটা হলো আলমাস। আর সে খুব ভয়ংকর খুনী।”
আমজাদ খুব চিন্তিত হয়ে বললো, “হুজুর, একথা কি এখনই ভিতরবাড়িতে আম্মাজানকে জানাবো?”
“না, তার জানানোর দরকার নাই। তিনি এমনিতে বয়স্ক মানুষ। শেষে, আমার জন্য চিন্তাভাবনা করে আজ রাতের ঘুম কামাই করবেন। তার ঘুমের বড় প্রয়োজন। যা করার আমি আর তুমি মিলেই করবো।”—কথাটা শেষ করে শাহাবুদ্দীনসাহেব এদিক-ওদিক কয়েকবার তাকালেন।
“হুজুর, তাকে জানানোই ভালো। আম্মাজানও অনেকবড় কামেল মানুষ। তিনি আপনার নিরাপত্তার জন্য দোয়াদরুদ করতে পারবেন।”—আমজাদ অনুরোধের সুরে কথাগুলো বললো।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এবার জোর দিয়ে বললেন, “তার দরকার নাই। এবার শোনো—আমার কথা এখনও শেষ হয় নাই। লোকটার নাম আলমাস সেখ। ওর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কোঠায়। কিন্তু খুব শক্তিশালী। আর সে দেখতে শান্তশিষ্ট, স্বাস্থ্যবান, ফর্সা, সবসময় পান খায়। আর তার গায়ে সুতির একটা কালোচাদর আছে। সে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে চাইলে—তুমি তাকে ঢুকতে দিবে। তারপর আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর তাকে কোনোকিছু বুঝতে দিবে না।”
আমজাদ মাথানেড়ে সম্মতি জানালো। আর সে তখনই নুর মোহাম্মদকে ইশারায় বাড়ির সিংহদ্বারের দারোয়ানদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলো।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এতদাঞ্চলের মানুষের কাছে শুধু একজন সৎ, বিশ্বস্ত, আদর্শবান-রাজনীতিবিদ, আর একজন ভালোমানুষই নন—তিনি একজন আধ্যাত্মিকসাধক হিসাবেও সুপরিচিত। তিনি বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন—ততক্ষণ ব্যক্তিগত কিছু কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাকি সময়টা মোরাকাবা-মোশাহেদায় সময় ব্যয় করেন। বাইরের রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে তার রুহানীশক্তি অনেক বেশি।
আলমাস শেষবিকালের একটু আগে থেকে শাহাবুদ্দীনসাহেবের বাড়ির সামনে একটা চায়ের দোকানে বসে রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে সে খাতির জমাচ্ছে। সে কথায়-কথায় বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছে—তাদের নিকট থেকে। ইতোমধ্যে সে পুরা বাড়িটা ঘুরে দেখেছে। রাতের বেলা কোনদিক দিয়ে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকবে—তার একটা নকশাও তার করা হয়েছে। সে এবার মনের সুখে একটা চায়ের অর্ডার দিলো। সঙ্গে দামি সিগারেটও ধরালো একটা।
এইসময় আলমাস একটা লোকের নিকট থেকে জানতে পারলো, শাহাবুদ্দীনসাহেব প্রায় প্রতিদিন রাত দশটা পর্যন্ত পুকুরপাড়ে একাকী বসে থাকেন। মাছেদের সঙ্গে কথা বলেন। নফল-নামাজ পড়েন সেখানে। তারপর অনেক রাতে ঘুমাতে যান তিনি।
সব শুনে আলমাসের দেহমন আনন্দে ভরে উঠলো। এমন সুযোগ সে আজ রাতে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
শাহাবুদ্দীনসাহেবের পুরা বাড়িটা চক্কর দিয়ে আলমাস বুঝতে পেরেছে—তার এই কাজটি অন্যান্য কাজের চেয়ে একটু কঠিন হবে। এইজন্য সে আগের পরিকল্পনা থেকে কিছুটা সরে এসেছে। সে বাড়ির সীমানার মধ্যে কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছিল। এর চারিদিকে এখনও প্রাচীর দেওয়া হয় নাই। শুধু তিনদিকে শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া রয়েছে। আর একদিকে তার বাসভবন ও অন্যান্য বসতঘর থাকায় এদিকটা বেড়ার মতো। আলমাস শিকারী-কুকুরের মতো একটা ফাঁক গলে বুকে হেঁটে একেবারে পুকুরের কাছে গিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে শাহাবুদ্দীনসাহেবের চেহারাটা মিলিয়ে নিয়েছে। এবার তাকে খুন করতে তার আর বাধা নাই। সে যেকোনো একটা সময়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে কিংবা একটু ফাঁকফোকড় পেলে পুকুরপাড়েই তাকে খতম করে দিবে। মানুষখুন করতে তার খুব একটা বেশি সময় লাগে না। তবে আজকের কাজটা সে খুব সাবধানে করার চেষ্টা করছে। তার সঙ্গে রয়েছে বড় একটা ছোরা আর জানালার গ্রিল-কাটার ছোট্ট মেশিন। এই দুটি অস্ত্র আজ তার সঙ্গী। কাজটা নির্বিঘ্নে করতে পারলে সে অস্ত্র দুটো পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে নিরাপদে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। রাত-ভোরের আগেই সে গোসল করে মসজিদে যাবে। তারপর নামাজ পড়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবে। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে সে বিকালে আড্ডা দিবে—নিজেদের বাজারের চায়ের দোকানে। সবশেষে সে ভুলে যাবে খুনের কথা! আর পুলিশ এই মামলার তদন্ত বেশি করবে না—তার পিছনে যে রয়েছে তার বড়ভাই!
রাতে এশার নামাজ পড়লেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। এবার নামাজে তার মনোযোগ যেন আগের চেয়ে আরও বেশি ছিল। তিনি নিজেকে একজন মৃত মানুষ ভেবে সর্বশক্তিমানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি ভক্তি, প্রেম, ভয় ও ভালোবাসা ঢেলে দিলেন। নামাজশেষে তিনি মায়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন। তারপর বেরিয়ে এলেন বাইরে। আবার গিয়ে বসলেন—সেই ছোট্ট পুকুরের পাড়ে। আজও জ্যোৎস্নারাত যে! তবে কিছুক্ষণ পরে তিনি সেখান থেকে আবার উঠে পড়লেন।
বড়পুকুরটার পাড়ে শাহাবুদ্দীনসাহেবের জামাকাপড় পরিয়ে ঠিক তার মূর্তির মতো একটাকিছু বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু দূর থেকে এটাকে যেকেউই মানুষ বলে ভুল করবে। আর এই আলোআঁধারিতে মানুষের ভুল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। আজ জ্যোৎস্নারাত হলেও এখানে গাছের ছায়ায় চারিদিকে বেশ আলোআঁধারির খেলা জমে উঠেছে। আর ইচ্ছে করে গাছের ছায়ায়—একটু অন্ধকারে সেই মূর্তিটাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
এই অদ্ভুত মূর্তিটার ঠিক পিছনদিকে কয়েকটি ঘন-গাছের আড়ালে-অন্ধকারে মিশে লাঠিহাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহাবুদ্দীনসাহেবের আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ। ওরা যেন এখন অন্ধকারের যমদূত!
রাত তখন কত হবে—বড়জোর সাড়ে নয়টা—এমন সময় এই নিস্তব্ধ-বিশাল বাগানবাড়িতে একটা ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল! সে যে তারকাঁটার বেড়া গলে এখানে এসেছে—তা দেখলেই বুঝা যায়। তার পরনের সাদা লুঙ্গিটা শুধু দেখা যাচ্ছে। আর যেখানে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে—সেখানে লোকটাকেও দেখা যাচ্ছে। একটু দূর থেকেই আমজাদ ও নুর মোহাম্মদ স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে—এটা আলমাস। ওরা আরও সতর্ক হয়ে যায়।
ছায়ামূর্তিটা এগিয়ে আসতে-আসতে একসময় শাহাবুদ্দীনসাহেবের ডামি’র কাছে চলে এলো। তারপর সে কোমর থেকে বের করলো বড় ছোরাটা। চাঁদের আলোয় ছোরাটা একবার ঝলমল করে উঠলো। তারপর সে সামনের দিকে ঝুঁকে বসা ডামিটার ঘাড়ে বসিয়ে দেয় একটা বড়সড় ঘা। কিন্তু ততক্ষণে তার বুঝতে দেরি হয়ে গিয়েছে। সে বুঝতে পারলো—সে তার জীবনে একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। ঘুরে সে একটু পিছনে ফেরার আগেই আমজাদের লাঠি গিয়ে পড়লো তার মাথায়। আর একআঘাতে নুর মোহাম্মদ তার দুই-পা ভেঙে ফেলেছে।
সে মাটিতে শুয়ে একটা অসহায় বাচ্চা-কুকুরের মতো শুধু কুঁই কুঁই করছিল। আমজাদ দ্রুত তার দুইহাতও ভেঙে দিলো—দুইটা শক্ত মোচড়ে। সে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো—ঠিক প্যারালাইজড ব্যক্তির মতো।
এই লোকটা আর জীবনে কখনো-কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আর কাউকে খুন করা তো দূরের কথা।
আমজাদ আলগোছে আলমাসের বড় ছোরাটা আগেই সরিয়ে ফেলেছে। এবার সে পুকুরঘাটে একটা লাইট জ্বালিয়ে দিলো। এতবড় একটা ঘটনা—তবুও কারও মধ্যে কোনো হৈচৈ নাই!
আমজাদ একটু এগিয়ে শাহাবুদ্দীনসাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আর সে খুব খুশি হয়ে বিনীতভাবে বললো, “হুজুর, ও-কে আমরা ঘায়েল করেছি। সে এখনও জীবিত।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব নিরাপদ একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন।
আলমাস এবার চোখমেলে তাকায়। আর সে দেখে—তার সামনে আসল শাহাবুদ্দীনসাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন! সে কাঁচুমাচু হয়ে তাকে সালাম দেয়।
শাহাবুদ্দীনসাহেব বললেন, “তোমাকে কে পাঠিয়েছিল—আমাকে মারতে?”
আলমাস চুপ করে থাকে। তার ভাবখানা এমন—যেন সে কিছুই জানে না।
আমজাদ রাগে ফুঁসছিল। অনুমতি পেলে সে লাঠির একটা আঘাতেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবে।
কিন্তু শাহাবুদ্দীনসাহেব এর মূল রহস্যটা জানতে চান।
তিনি শান্তভাবে আলমাসের পাশে ঘাসের ওপর বসে পড়লেন। তারপর খুব ঘনিষ্ঠ আপনজনের মতো তার কাছে জানতে চাইলেন, “ভাই, তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছিল? তার নামটি বলো? আমি জানি, তুমি আসল খুনী নও।”
এতে কাজ হলো। সে একটু নড়েচড়ে শোওয়ার চেষ্টা করে যেন। শেষে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো—কাশীনাথপুরের আউয়াল শিকদার আপনাকে খুনের আদেশ করেছিলেন। এজন্য আমাকে পাঁচলক্ষ টাকা দেওয়ার কথা। তিনলক্ষ টাকা আমি নগদ হাতে পেয়েছি। আর বাকিটা আপনাকে খুন করার পর দেওয়ার কথা রয়েছে।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব খুব ঠাণ্ডাগলায় বললেন, “তুমি কি আমাকে এখন খুন করে ওই বাকি দুইলক্ষ টাকা পেতে চাও? তোমার মনের ইচ্ছাটা কী?”
আলমাস মাথানিচু করে রইলো। সে আর কোনো কথা বলে না।
শাহাবুদ্দীনসাহেব এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, “সে আমাকে কেন খুন করতে চেয়েছিল?”
আলমাস বুঝতে পারে তার এখন কিছুই করার নাই। সে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “আপনারা একই উপজেলার লোক। আপনি মারা গেলে সে এলাকায় সহজে প্রভাববিস্তার করতে পারবে। আপনে ভালোমানুষ। তাই, সে আপনার সঙ্গে বুদ্ধিতে পারে না। তাছাড়া, গতবছর কাশীনাথপুর-কলেজে এইচএসসি পরীক্ষাচলাকালে—আপনে হলপরিদর্শনের সময় তার একমাত্র ছেলেকে নকলসহ হাতেনাতে ধরেছিলেন। এজন্য শিক্ষাবোর্ড ছেলেটিকে দুই-বছরের জন্য এক্সফেল করে দেয়। এতে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়—এইজন্য তিনি...। আর আমি এতোকিছু জানি না, স্যার। আমাকে খুনের আদেশ দিয়েছেন—আমি তা-ই করছিলাম।”
“তুমি এ-পর্যন্ত কতগুলো মানুষখুন করেছো?”—শাহাবুদ্দীনসাহেব আস্তে জানতে চাইলেন।
“তা এগারোজন তো হবেই।”—খুব স্বাভাবিককণ্ঠ আলমাসের।
আঁতকে উঠলেন শাহাবুদ্দীনসাহেব। আজ তিনি এর হাতে মারা গেলে এর খুনের ডজন পূর্ণ হতো!
একটু পরে কী যেন ভাবতে-ভাবতে শাহাবুদ্দীনসাহেব উঠে দাঁড়িয়ে আলমাসের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি এখন কী করতে চাও?”
“আমাকে এবার ছেড়ে দিন হুজুর। আমি তো এখন পঙ্গু। আর প্রয়োজনে আমি ভিক্ষা করে খাবো। তবুও আমাকে বাঁচতে দিন! আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার!”—আলমাসের কণ্ঠে গভীর আকুতি।
শাহাবুদ্দীনসাহেব সেই এগারোজন নিহত মানুষের নাম জেনে নিলেন আলমাসের নিকট থেকে—যাদের সে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর যারা তাকে দিয়ে এই হত্যাগুলো করিয়েছে—তাদের নামধামও ভালোভাবে জেনে নিলেন। আর কথা বলার একফাঁকে তিনি আলমাসের সমস্ত বক্তব্য ভিডিও-রেকর্ড করতেও ভুল করেননি।
তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমাকে এখনই ছেড়ে দিচ্ছি।”—কথাটা বলে তিনি আমজাদকে বললেন, “ও-কে আমাদের ছোটপুকুরে ছেড়ে দাও।”
আলমাস চিৎকার করে উঠলো এবার। আর সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কিন্তু আমজাদ আর নুর মোহাম্মদ কোনোকিছুতেই থামলো না—তারা দুজন আলমাসকে একেবারে চ্যাংদোলা করে—টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো ছোটপুকুরে। সেখানে আছে বড়-বড় পাঙ্গাস আর আফ্রিকান মাগুর। একটা আলমাসকে হজম করতে ওদের খুব একটা বেশি সময় লাগবে না।
আমজাদ আর নুর মোহাম্মদ কাজটি শেষ করে হাসিমুখে শাহাবুদ্দীনসাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো। তাদের মনে এখন ভীষণ আনন্দ। আবার কিছুটা দুশ্চিন্তাও রয়েছে—আলমাসদের হুকুমদাতা যে এখনও রয়ে গেছে!
তিনি ওদের দিকে চেয়ে বললেন, “ও-কে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আবার কাকে-না-কাকে সে খুন করবে—তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। এই ধরনের অমানুষকে আমাদের পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখাটাই অপরাধ। এরা সমগ্র মানবজাতির চিরশত্রু। এদের শাস্তি দিতে কোনোরকম কার্পণ্য করা উচিত নয়। এরা পৃথিবীর সকল ধর্মের সকল মানুষের শত্রু। টাকার বিনিময়ে, স্বার্থের জন্য, ঈর্ষাণ্বিত হয়ে যারা মানুষখুন করে—তাদের মতো নিম্নজাতের শুয়োর এই পৃথিবীতে আর নাই। এদের দেখামাত্র হত্যা করা উচিত। এদের জন্য কত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! এই পাপীদের তোমরা কখনো ক্ষমা করবে না। এবার এদের নির্দেশদাতাদের ধরতে হবে। এরাই হলো বড় শয়তান। আমাদের এলাকাটা আগাছামুক্ত করতে হলে এদের নিশ্চিহ্ন না-করে কোনো উপায় নাই। আমার এলাকায় কোনো খুনীকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।”
আমজাদ খুশি হয়ে বলে, “হুজুর, আপনি শুধু আমাদের হুকুম করবেন—আর আমরা ওদের ধরে এনে ছোটপুকুরে ফেলে দিবো।”
শাহাবুদ্দীনসাহেব বললেন, “ঠিকই বলেছো। এদের কোনো ক্ষমা নাই। সবক’টাকে এবার ছোটপুকুরে ফেলতে হবে।”
[এই পৃথিবীর মানুষগুলো কখনো মনে রাখে না—ভুল করলে, মানুষের ক্ষতি করলে, আর যেকোনো পাপ করলে—তার মাশুল দিতে হবে গুনে-গুনে। আর কথায় আছে না—যেমন কর্ম তেমন ফল! এর থেকে কারও পরিত্রাণ নাই। তবুও মানুষগুলোর কোনো শিক্ষা হয় না।]
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২১/১১/২০১৯
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ বুলবুল হোসেন ২৭/১১/২০১৯ভালো লাগলো
-
জসিম বিন ইদ্রিস ২৭/১১/২০১৯ভালো লাগা অভিরাম...