খুব ভয়ের গল্প---বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (তৃতীয় পর্ব)
খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(তৃতীয় পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
শায়লাকে হঠাৎ এভাবে বিধ্বস্ত-অবস্থায় সোফার ওপর বসতে দেখে তার ছোটভাই অর্ণব প্রথমে তাকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো। এরপর সে আরও কয়েকবার বোনের দিকে ক্রমাগত তাকাতে লাগলো। সে কী যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
অর্ণব ক্লাস নাইনে পড়লেও তার আই.কিউ. অনেক শার্প। সে সবসময় বুদ্ধিবিষয়ক পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার বুদ্ধিমত্তা ইন্টারমিডিয়েটে পড়া ছাত্রদের লেভেলে। সে যেকোনো একটা ভালোছাত্রের মতো মেধার অধিকারী। আর এই বয়সে অন্যান্যদের তুলনায় সে খুব মেধাবী। বোনের মতো তারও বইপড়ার ভয়ানক অভ্যাস। ইতোমধ্যে সে কয়েক হাজার বইপড়ে ফেলেছে। এগুলোর মধ্যে ভৌতিক, আধাভৌতিক, রহস্য, গোয়েন্দা তথা সাসপেন্স-থ্রিলার অন্যতম। এর বাইরেও সে নির্ভেজাল সাহিত্য পড়েছে। আর এখনও সে মনোযোগসহকারে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত। সে বাংলাভাষার ক্ল্যাসিক-সাহিত্য পুরোটাই পড়ার ইচ্ছা রাখে। আর বইপড়তে তার কোনো আলসেমি নাই।
সে আরও কিছুক্ষণ তার একমাত্র বড়বোনটিকে মনোনিবেশসহকারে পর্যবেক্ষণ করে—শেষে পড়া রেখে তার পাশে বসে বললো, “কোনো সমস্যা হয়েছে, আপুনি?”
শায়লা ভাইটির এতো কাছে বসেও যেন ওর কথাটা শুনতে পেল না। অর্ণব এটা লক্ষ্য করে আবার বললো, “আপুনি, তুমি কি কোনো বিষয়ে খুব আপসেট? আর কী হয়েছে তোমার?”
এবার যেন কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেল শায়লা। সে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার মতো করে বলতে থাকে, “নাহ্, তেমনকিছু না রে। আমার এই একটু জ্বর-জ্বর-ভাব।”
অর্ণব তখনই শায়লার কপালে হাত রেখে বলে, “কই, তোমার তো কোনো জ্বর হয়নি! সবকিছু একেবারে নরমাল। তবে কেন আজ-এখন হঠাৎ মিথ্যা বলছো, আপুনি?”
শায়লা যেন এবার ধরা পড়ে গেছে—সে ছোটভাইটির একটা হাত ধরে বলে, “আচ্ছা ভাই, তুই কি জানিস শহরে কোনো ভূতপ্রেত থাকে? মানে, আমাদের এই শহরে কোনো ভূতপ্রেত আছে কিনা?”
অর্ণব এবার হেসে ফেললো। আর বললো, “হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে যে! কিছু হয়েছে নাকি? তুমি কি ইদানীং ভূতটুত দেখেছো নাকি? আপুনি, আমাকে খুলে বলো তো।”
শায়লা এবার খুব সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে বলতে লাগলো, “তুই তো ভূতের বইটই আমার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছিস। আসলে, আমি বলতে চাচ্ছি কি—শহরে কখনো ভূতের কথা শুনেছিস কিংবা এই শহরে কেউ-কখনো ভূতটুত দেখেছে কিনা? কারও কাছে ভূতের কথা ইদানীং শুনেছিস কখনো? এই বিষয়ে কিছু জানলে আমাকে বল তো।”
অর্ণব সব শুনে হেসে বলে, “শুনবো না কেন? এই তো গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধুর মা নাকি বাথরুমে ভূত দেখে সেখানেই পড়ে গিয়ে ফিট—মানে, একদম অজ্ঞান। তারপর তাকে সুস্থ করতে হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়েছিল! রাত তিনটার সময় তিনি নিজেদের বাসার বাথরুমে একটা ভূত না আত্মা—কিছু-একটা দেখেছিলেন। ওদের বাসাটা আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে—এই তো শনির আখড়ার কাছে। তুমি চাইলে একদিন তোমাকে সেখানে নিয়েও যেতে পারি। তারপর খালাম্মার মুখেই সবকথা শুনে নিবে।”
শায়লা এবার যেন উৎসাহিত হয়ে উঠলো। আর সে খুশিমনে বলে, “তার দরকার হবে না। শুধু বল, কী দেখেছিলেন তোর ওই বন্ধুর মা? আমাকে একটু খুলে বল না, ভাই।”
অর্ণব বলে, “না, তেমনকিছু না। এই তিনি নাকি দেখেছিলেন, কে যেন তাদের বাসার বাথরুমে মাঝরাতে গোসল করছে! তিনি মনে করলেন, এটা বুঝি তার একমাত্র ছেলে—মানে, আমাদের বন্ধু সিফাতের কাজ। এইটা ভেবে তিনি তা দেখার জন্য বাথরুমের দিকে এগুতে লাগলেন। এইসময় বাথরুমের দরজাটা একটু খোলা ছিল। তিনি কাছে গিয়ে দরজাটার আরও কিছুটা খুলে ভিতরে উঁকি দিতেই দেখলেন, সেখানে বসে আছে একটা মাঝবয়সী মহিলা। আর সেই মহিলা তাদের বাসার বাথরুমের হাই-কমোডের ওপর বসে রয়েছে! আর তার গলা দিয়ে সমানে রক্ত ঝরছে! মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য। তারপর আর-কিছু তার মনে নাই। মানে, এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। শুনেছি, ওরা নাকি এই বাসাটা ছেড়ে দিবে। খালাম্মা কিছুতেই এই বাসাটাতে আর থাকতে চাচ্ছেন না।”
“কেন? কেন?”—খুব উদ্বিগ্নভাবে শায়লা জানতে চায়।
অর্ণব কিছুটা হাসতে-হাসতে বলে, “কেন আবার? ওই গলাকাটা ভূতুড়ে মহিলা যদি আবার ওদের বাসায় ফিরে আসে। মাঝে-মাঝে আবার যদি দেখা দিতে থাকে। তাই, ওরা বাসা বদলাচ্ছে। কিন্তু আমি হলে তা করতাম না। এই রহস্যটার আরও গভীরে যেতাম। আর বাসাটা ছাড়তাম না।”
শায়লা একটু হেসে বলে, “থাক-থাক, তোকে আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। এবার আসল কথাটা বল না ভাই। আসলে, কেন এমন হয়েছিল?”
তারপর অর্ণব একটুখানি ভেবেচিন্তে বলতে লাগলো, “এবার তোমাকে মূল ঘটনাটা বলি। আর এই ঘটনাটার মূলরহস্য পরে আমরা জেনেছি। তুমি আবার সবটা শুনে ভয় পেয়ো না যেন।”
শায়লা ঘটনাটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বলে, “আরে, না-না, আমি কোনো ভয় পাবো না। তুই একনাগাড়ে সবটা বলে যা তো।”
একথা শোনার পর অর্ণব বলতে থাকে, “পরে আমার বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি, এই বাসাটাতে কয়েক বৎসর আগে অন্য একটা ভাড়াটিয়া থাকতো। এই বাসাটা বহু আগে যে-লোকটা ভাড়া নিয়েছিল—তার মা তাদের সঙ্গে থাকতো। হঠাৎ সেই মহিলা তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে যায়। ভদ্রলোক তার মায়ের অনেক চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মহিলার পাগলামিটা একসময় আরও বেড়ে যায়। তারপর একদিন রাতে সেই মহিলা ওই বাথরুমে নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে গলাকেট আত্মহত্যা করে। মহিলা রাত তিনটার সময় নিজের গলাকেটে সুইসাইড করেছিল। সেই থেকে মাঝে-মাঝে ওই বাসাটাতে ঠিক রাত তিনটার সময় সেই মহিলাকে দেখা যায়। সেইজন্য ওই বসাটাতে ভাড়াটিয়া বেশিদিন থাকে না। থাকতে পারে না। আর নতুন ভাড়াটিয়া যারাই ঘটনাটা জানতে পারে—তারাই দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়ে। আর বাড়িওয়ালাটাও এমন একটা রামছাগল যে—সে কোনো ভাড়াটিয়াকে আগে থেকে এসব বলে সাবধান করে না। ভাড়ার সামান্য কয়টা টাকার জন্য সে মানুষের জীবন নিয়ে আজ ছিনিমিনি খেলছে।”
অর্ণব কথা শেষ করে বোনের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বলে, “আপুনি, তুমি আজ হঠাৎ এসব জিজ্ঞাসা করছো! কোনোকিছু হয়েছে নাকি? আমাকে সবটা খুলে বলো তো।”
শায়লা এবার খুব ইতস্ততঃ করতে থাকে। আর কীভাবে সে শুরু করবে। তার জীবনে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিশ্বস্ত-বন্ধু এই ভাইটি। আর সে খুব বুদ্ধিমান ও সাহসী। ওর পরামর্শ তার জীবনে অনেক কাজে লাগতে পারে। শেষে শায়লা ভাইকে সবকিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ওর হাবভাব দেখে অর্ণব বলে, “আরে, আপুনি, আমি এসবে এতো ভয় পাই না। আর জানো, আমি হলে আমার বন্ধুদের মতো ওই বাসাটা ছাড়তাম না। এটা আমার জন্য দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হতো। কাজেই তুমি আমাকে সবটা খুলে বলতে পারো।”
শায়লা এরপর কোনোকিছু গোপন না করে তার সঙ্গে অবস্থানরত এতদিনের একটা ছায়ামানব থেকে শুরু করে আজকের বৃষ্টি-সন্ধ্যার সময়কার জানালা বন্ধের সেই ঘটনাটা পর্যন্ত একনিঃশ্বাসে বলে ফেললো। এতে সে যেন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন।
আর সব শুনে অর্ণব কিছুক্ষণ যেন গুম হয়ে বসে রইলো। সে কোনো কথা বললো না—যেন সে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। এইসময় তাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় শার্লক হোমসের মতো মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এই ঘটনাটা তো শার্লক হোমসের সমাধান করার কথা নয়। এটি তার কোনো বিষয় নয়। এখানে, একজন আত্মাবিশেষজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। আর এইজাতীয় ব্যাপারে যার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি বা ঈর্ষণীয়—তাকেই শুধু এদের প্রয়োজন।
সোফার এককোণে চুপচাপ বসে দীর্ঘসময় চিন্তাভাবনা করে গম্ভীরমুখে অর্ণব বললো, “তোমার প্রতিটি কথা আজ-এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, আপুনি। আজ আমি বুঝতে পারছি—একদিন আমার সঙ্গেও একটাকিছু ঘটেছিল সিঁড়িতে। সেদিন, আমি স্কুল থেকে একটুখানি দেরি করে ফিরেছিলাম। আর সেদিন, আমার বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে নেমে এসেছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর তখন লোডশেডিংয়ের জন্য সিঁড়িতে কোনো লাইটও জ্বলছিল না। আমি একাকী দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল—কারও সঙ্গে যেন আমার একটা ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু আমি সেই সময় আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখিনি। ঘটনাটিকে আমি তখন নিজের সাহসিকতার জন্য কোনো পাত্তাও দিইনি। তখন আমাদের দারোয়ান-চাচা ছিলেন বাড়ির মেইন গেইটের কাছে পাহারারত। আর সেদিন সেই মুহূর্তে বাবাও বাড়িতে ছিলেন না। দোতলায় উঠে দেখি তুমি, মামণি, আর মালেকা মিলে ড্রইংরুমে টিভি দেখছো! তাহলে, আমার সঙ্গে সিঁড়িতে ধাক্কা লেগেছিল কার? পরে অবশ্য আমি নিজের চঞ্চলতার কারণে বিষয়টা নিয়ে এতোটা ভাবিনি। নিজের অন্য ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। এখন দেখছি, আমি ভুলই করেছি। আর আজ বুঝতে পারছি, সেটি কোনো ছায়ামানবই হবে। কিন্তু কে সে? তবে সে কিন্তু আমাকে ইচ্ছা করে সজোরে কিংবা ক্রোধান্বিত হয়ে ধাক্কাটা দেয়নি—হঠাৎ একটা ধাক্কা লেগেছিল যেন! আমার এখন আরও মনে হচ্ছে—এই বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে। আর সেও হয়তো আমাদের মতো সময়-সময় চলাফেরা করে থাকে। আর চলাফেরার সময় সে আচমকা আমাদের সামনে এসে পড়ে—এজন্য তার সঙ্গে আমাদের একটুআধটু দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যাচ্ছে আরকি!”
ছোটভাইটির কথা শুনে শায়লা যেন ভিতরে-ভিতরে শিউরে উঠলো। তাহলে, এতোদূর ঘটনাটা! আর সে এতোদিন বিষয়টা নিয়ে আপনমনে চুপচাপ বসে ছিল!
শায়লার ভাবগতিক বুঝতে পেরে অর্ণব দৃঢ়চিত্তে বলতে লাগলো, “আমি এসবে ভয় পাই না। তুমিও ভয় পেয়ো না, আপুনি। ভয় পেলেই ভয় আরও অন্তরে বাসা বাঁধে। মনে সাহস রাখো। আর এসব বিষয়ে মা-বাবাকে এখনই সবটা বলার দরকার নাই। তারা অহেতুক এই নিয়ে একটা টেনশন করবেন। তারচে আমি বলি কি...।”
“কিন্তু আমি যে মাকে আজকের-সন্ধ্যার ঘটনাটা বলে দিয়েছি!”—শায়লা ভাইকে বাধা দিয়ে কথাটা বলে ফেললো।
অর্ণব বলে, “কোনো অসুবিধা নাই। আর-কিছু বলবে না। ব্যাপারটা আমরাই হ্যান্ডেল করবো। আর যদি আমরা না-পারি তখন না-হয় মা-বাবাকে জানাবো।”
কথাটা শায়লারও মনঃপুত হলো। সেও বিষয়টা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতে লাগলো।
এমন সময় ওদের বাবা ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। ওদের কথার কিছুটা তার কানে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তিনি বাড়িতে ফিরে ওদের আশেপাশেই ছিলেন। আর নিজের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করছিলেন। ওরা নিজেদের কথায় এতোটাই নিমগ্ন ছিল যে, অন্যান্য দিনের মতো তাদের বাবার আগমনের সংবাদটাও পায়নি। মোসাদ্দেকসাহেব ছেলে-মেয়ে দুটোর ভালো একজন বন্ধু। ওদের সঙ্গে তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুক্তআলোচনা হয়। আজও তিনি হাসি-হাসি-মুখে ওদের কাছে এসে বসলেন। আর বললেন, “তোমরা কী নিয়ে কথা বলছিলে?”
একথা শুনে শায়লা একটু কাঁচুমাচুভাব করে বসে রইলো। কিন্তু অর্ণব খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, “তেমনকিছু নয় বাবা, এই... শহরে ভূতপ্রেত থাকে কিনা—তা-ই নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম।”
এবার মোসাদ্দেকসাহেব আগের মতো হাসিমুখ নিয়ে বললেন, “শহরে ভূতপ্রেত কিংবা জীন-পরী কিছু থাকে কিনা—আমি জানি না। তবে গ্রামেগঞ্জের অনেক জায়গায় এখনও এদের উপস্থিতি রয়েছে। এটা আমি বিশ্বাস করেছি। আর তা এখনও করি।”
একথা শুনে প্রায় লাফিয়ে ওঠে অর্ণব। আর সে প্রবল আগ্রহভরে বলে, “বাবা, তুমি কখনো কিছু দেখেছো? এই মানে—সচল-আত্মা-জাতীয় কিছু।”
মোসাদ্দেকসাহেব হেসে বললেন, “আমি কখনো কিছু দেখেছি কিনা—সে-কথা পরে বলি। কিন্তু তোমাদের মরহুম দাদাজান একবার একটা ভয়ংকর জীনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই কথাটা আজ আগে বলি, শোনো।”
বাবার মুখ থেকে এইরকম একটা দমফাটানো রোমাঞ্চকর কথা শোনার আগে শায়লা সভয়ে বাবার গাঁ-ঘেষে পাশে গিয়ে বসলো। আর তা দেখে মুখটিপে হাসে অর্ণব। যেন সে বুঝাতে চাইছে—তুমি ভয় পেয়েছো—আর তাই, বাবার কোলঘেঁষে বসেছো।
শায়লা ভাইকে পাল্টা আর-কিছু বললো না। সে এখন ঘটনাটা শুনতে চায়।
মোসাদ্দেকসাহেব ধীরেসুস্থে বলতে লাগলেন:
“তোমাদের দাদাজান খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি দিবারাত্রির অনেকটা সময় মসজিদে গিয়ে পড়ে থাকতেন। তাছাড়া, আমাদের বাড়ির নামডাক ও বিষয়সম্পদের পরিমাণ ছিল বেশি। সেইজন্য গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাবাকে গ্রামের মসজিদের সভাপতি বানিয়ে দিলো। বাবা একাই সবকিছু করতেন। আমাদের গ্রামের মসজিদটা প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরানো হবে। এই মসজিদের সামনে ছিল একটা বড়সড় আমগাছ। এটাকে প্রাচীন আমগাছও বলা যেতে পারে। এটার বয়স কত আমার আজ আর জানা নাই। তবে বাবার মুখে শুনেছিলাম—এটার বয়স নাকি কমপক্ষে দেড়শ’ বছর হবে! গ্রামের মসজিদটা খুব ছোট্ট ও সুন্দর ছিল। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে এটা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না। তাই, গ্রামের লোক বাবাকে ধরে বসলো—মসজিদটা এবার বড় করতে হবে। বাবা এজন্য একাই প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা দিতে রাজী হলেন। গ্রামবাসীও খুব খুশি হলেন। শুরু হলো মসজিদ তৈরির কাজ। কিন্ত মসজিদ বড় করতে হলে মসজিদের সামনের প্রাচীন আমগাছটাকে কাটতে হয়। এটি ছিল একটা বটগাছের মতো বিশাল বৃক্ষ। শেষে গ্রামবাসীর সঙ্গে পরামর্শ করে বাবা আমগাছটাকে কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামবাসী আমগাছটাকে কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিলো। এখনকার মতো তখনকার দিনে কোনো সমিল বা ইলেকট্রিক করাত ছিল না। তাই, গ্রামবাসী নিজেদের সামান্য করাত, দা-কুড়াল নিয়ে আমগাছটাকে কাটতে লাগলো। সাতদিনের মধ্যে গাছটা টুকরা-টুকরা হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো মসজিদের কাজ। একদিন বাবা এশার নামাজ পড়ে জিকির ও তাসবিহ-তাহলিল শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন—এমন সময় তিনি আমাদের বাড়ির মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাবার মনে হলো: রাস্তার মাঝখানে দুটো লালবাতি জ্বলছে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। রাস্তার মাঝখানে ল্যাম্পপোস্টের মতো এতো উঁচুতে লাইট জ্বলবে কীভাবে? বাবা এটার কাছে একটু এগিয়ে যেতেই বিষয়টি তার গোচরীভূত হলো—তিনি দেখলেন, একটা দুষ্টু জীন রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে কী ভয়ংকর চেহারা তার! বাবা বলেছিলেন তার উচ্চতা নাকি কমপক্ষে পঁচিশ-ত্রিশ ফুট হবে। আর সেইরকম মোটাতাজা ছিল জীনটা! আর দেখতে এটা খুব কালো কুচকুচে ছিল। সেইজন্য অন্ধকার-রাতে বাবা তাকে দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাননি। বাবা একটু কাছে এগিয়ে যেতেই সে বাবার নাম ধরে বললো, ‘শোন আব্দুস সাদেক, আজ তোর রেহাই নাই। তুই আমাদের আমগাছ কেটেছিস। তোকে আমি আজ এই মসজিদের পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে-চুবিয়ে মারবো। তার কারণ, তুই আমাদের থাকার জায়গাটা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিস। তোর কোনো ক্ষমা নাই। তোর কোনো রক্ষা নাই। এমনকি তোর বংশধরদেরও নিস্তার নাই। সবাইকে আমি মেরে ফেলবো।’ বাবা, তবুও সাহসের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘কেন ভাই, আমি কী করেছি? আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নাই। আল্লাহর ঘর মসজিদ বানানোর জন্য আমগাছটা কেটেছি। আশেপাশে তো আরও কত গাছ আছে। তোমরা সেখানে আস্তানা বানাও। আমি তোমাদের কিছুই বলতে যাবো না। কিন্তু আমগাছটা কাটা ছাড়া আমাদের আর-কোনো উপায় ছিল না। আর আমি তো গ্রামবাসীর সঙ্গে পরামর্শ করেই কাজটি করেছি। দোষ তো আমার একার নয়।’
তবুও সেই জীনটি গোঁ-গোঁ করতে-করতে বলতে লাগলো, ‘আমি অতসব বুঝি না। তুই মসজিদের মাতবর। এই মসজিদের নেতা হয়েছিস তুই। তোকে আমি ছাড়বো না। তোর জন্য আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে।’ বাবা সবসময় নানারকম দোয়া-দরুদ পড়ে নিজের শরীর বন্ধ করে রাখতেন। যাতে দুষ্টু জীন বা দুষ্টুলোকের কোনোপ্রকার কুফরি-কালামে তার কোনো ক্ষতি না-হয়। আজও তিনি তা-ই করে রেখেছিলেন। বাবা সাহসের সঙ্গে দেখলেন, এই জীনটা বাবার কাছে এগুতে আর সাহস পাচ্ছে না। তখন বাবা পুনরায় আয়াতুল কুরসীসহ চারকুল পড়ে যখন ওই জীনটার দিকে খুব ভালোভাবে দম করলেন—তখন সে একনিমিষে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল! তারপর থেকে সে আর কখনো বাবার সামনে আসেনি। এরপর থেকে বাবা একা কখনো রাত-বিরাতে চলাফেরা করতেন না। পরে বাবার জন্য একজন দেহরক্ষী নিযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আমার মা-ই এই কাজটি করেছিলেন। কারণ, তিনি আমাদের বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। এতো গেল একটা ঘটনা। আরেকবার বাবা হাট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন—তখন বাবার বয়সটাও কম। সবেমাত্র মাকে বিয়ে করেছেন। একদিন রাতে তিনি গ্রামের হাট থেকে ফিরছিলেন—গ্রাম-হিসাবে সেদিন খুব বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল। আর বাবা সেদিন খুব শখ করে কিনেছিলেন দুইটা বড়সড় ইলিশমাছ। এই মাছ নিয়ে বাবাকে প্রায় মাইল দেড়েক হেঁটে তারপর বাড়ি ফিরতে হবে। তোমরা তো জানো, তখন আমাদের দেশের যোগাযোগব্যবস্থা এতো উন্নত ও আধুনিক ছিল না। রিক্সা-ভ্যান পাওয়া তো দূরের কথা—এগুলো তখন কখনো চোখেও দেখা যেত না। আর তাই, বাবা মাছ দুটো সঙ্গে করে আপনমনে হাঁটছিলেন। আর বাবা তখন একেবারে যুবকমানুষ। তার সাহসও খুব বেশি ছিল। তাই, কোনোকিছুর পরোয়া না করে—আর কারও ধার না ধেরে তিনি নিজের শক্তিবলে একাকী এতো রাতে দুই-দুইটা বড়সড় ইলিশমাছ সঙ্গে করে তখনকার দিনের গ্রামের অন্ধকারপথে হাঁটতে লাগলেন। বাবার কাছে সেদিন কোনো টর্চলাইটও ছিল না। হয়তো তিনি তা ভুল করে সঙ্গে রাখতে পারেননি। বাবা বলেছিলেন, ‘আধাঘণ্টা পথ চলেও কোনো সমস্যা হয়নি। বড় তেঁতুলগাছটার কাছে এসে একটা বিপদে পড়লাম।’ বাড়ির কাছাকাছি এসে—গ্রামের তেমাথা বলে—তার পাশে মঈনুদ্দীনের ভিটায় একটা বড় তেঁতুলগাছ ছিল। সেখানে বাবা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আর তিনি দেখলেন, গাছ থেকে একটা ছায়ামূর্তি নেমে এলো! আবার সেটা চোখের পলকে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল! বাবার শরীরটা এইসময় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। তবে তিনি ভয় পাননি। সাহসিকতার সঙ্গে এটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করলেন। একটু পরে তিনি যখন আবার হাঁটতে শুরু করলেন তখন দেখলেন, কোত্থেকে যেন একটা বিড়াল তার পিছু নিয়েছে! আর বিড়ালটা তার পিছনে-পিছনে হাঁটছিল। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, এভাবে পথ-চললে সামনে তার বিপদ হবে। তাই, তিনি দ্রুত নিজের শরীরটা পুনরায় বন্ধ করে ফেললেন। তারপর সবুদ্ধিতে বুকপকেটের ম্যাচটা বের করে আগুন জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। অমনি কাজের কাজ হলো। সেই অপআত্মাটা সভয়ে পালিয়ে গেল। তবে সে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে গিয়েছিল, ‘যা, তুই আজকের মতো বেঁচে গেলি রে! আগুনটা তোর সঙ্গে ছিল বলে বেঁচে গেলি!’ সেই থেকে তোমাদের দাদাজান আর-কখনো রাতের বেলা একাকী সহজে বাড়ির বাইরে বের হতেন না।”
মোসাদ্দেকসাহেবের মুখ থেকে এইরকম ভয়ানক কাহিনী শুনে শায়লা ভিতরে-ভিতরে ভয়ে কিছুটা জড়োসড় হয়ে রয়েছে। কিন্তু বাইরে সে কাউকে তা বুঝতে দিচ্ছে না।
আর অর্ণব একেবারে স্বাভাবিক। সে তার বাবাকে মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করে আরও অনেককিছু জেনে নিচ্ছে। ওদের-আত্মাদের ব্যাপারে তার ভীষণ আগ্রহ। ভবিষ্যতে সে আত্মাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করতে চায়। এজন্য সে ভিতরে-বাইরে একটা বিরাট প্রস্তুতিগ্রহণ করছে।
ওরা এতোক্ষণ তন্ময় হয়ে ওদের বাবার কথা শুনছিল। তা দেখে উৎসাহিত হয়ে মোসাদ্দেকসাহেব বললেন, “তোমরা যদি আত্মাবিষয়ে আরও বেশি জানতে চাও—তাইলে আমাদের একজন গুরুজী আছেন—একদিন তাঁকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো। তাঁর নাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ। কিন্তু তিনি সুধীসমাজে অধ্যাপক লিটু মিয়া নামে পরিচিত। তিনি একজন তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, সাহিত্যিক ও দার্শনিক ব্যক্তি। একজন খুব ভালোমানুষ হিসাবেও তিনি সুপরিচিত। আত্মাবিষয়ে তাঁর মতো এতো পড়ালেখা জানা মানুষ আমি আর দেখি নাই।”
কথাটা শোনামাত্র ওরা দুই ভাই-বোন যেন সমস্বরে বলে উঠলো, “বাবা, তোমাদের গুরুজীকে একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে। আমরা তাঁর কথা শুনতে চাই।”
মোসাদ্দেকসাহেব ছেলে-মেয়ের আগ্রহ দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, “আচ্ছা, সময়-সুযোগমতো একদিন তাঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। তাঁর কাছ থেকে তোমরা অনেককিছু জানতে পারবে। আমাদের জানামতে, তিনি আত্মাবিষয়ক একজন শ্রেষ্ঠ গবেষক।”
শায়লা কিছুক্ষণ উসখুস করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা, আয়াতুল কুরসী পড়লে নাকি ভূতের ভয় থাকে না?”
মোসাদ্দেকসাহেব প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। আয়াতুল কুরসী পড়লে শয়তান পালায়। আয়াতুল কুরসীর অনেক শক্তি। আর সবচেয়ে ভালো হয় যদি তোমরা ফজর থেকে মাগরিব-এশার নামাজের পর আয়াতুল কুরসীসহ চারকুল পড়ে শরীর বন্ধ করে নাও।”
“সেটা কীভাবে বাবা।”—শায়লা খুব আগ্রহভরে তা জানতে চাইলো।
মোসাদ্দেকসাহেব বলতে লাগলেন, “চারটি সুরা একসঙ্গে পাঠকরাকে চারকুলপাঠ বলা হয়। আর এই চারটি সুরার শুরুটা ‘কুল’ শব্দ দিয়ে বলেই একে চারকুল বলা হয়। এগুলো হচ্ছে—সুরা কাফিরুন, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস। এগুলো একসঙ্গে পড়ে শরীরে দম করলে শয়তান ও তার অনুসারীরা পাঠকারীর আর-কোনো ক্ষতি করতে পারে না।”
বাবার মুখ থেকে এসব শুনে শায়লা যেন সব মুখস্থ করে নিতে থাকে। সে আপনমনে ভাবছে—এখন থেকে সে সবসময় নিজের শরীর বন্ধ করে রাখবে।
এমন সময় রাশিদা বানু সবাইকে খাবার-টেবিলে ডাকলেন।
শায়লা বাবার সঙ্গে ডাইনিং-রুমে প্রবেশ করলো। অর্ণব একটু পরে গেল।
রাতে খাবার-টেবিলে এই বিষয়ে আর-কোনো কথা হলো না।
রাশিদা বানু খাওয়ার একফাঁকে মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে খুব আস্তে শুধু বললেন, “তোমার ভয়-ভয় লাগলে আজ রাতে আমাদের সঙ্গে ঘুমাতে পারো।”
একথা শুনে শায়লা একটু হেসে বলে, “না মা, তার আর দরকার হবে না। আমি একাই থাকতে পারবো।”
মাকে অভয় দিয়ে শায়লা নিজের রুমেই ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে ভেবে দেখেছে, বেশি ভয়টয় পেলে বিষয়টা লোকজনের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে। কথাটা সবার কাছে পৌঁছুতে বেশি সময় লাগবে না। এসব শুনলে তার আত্মীয়স্বজনেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়বে না। সে সহজে কারও কাছে হাসির পাত্র হতে রাজী নয়। সেইজন্য সে অর্ণবের কথামতো মাকে তার সন্ধ্যার সময়কার ঘটনাটা আর-কাউকে বলতে নিষেধ করলো। ওর কথা শুনে মা হেসে বলেছেন, ‘দূর পাগলী, এসব কথা বুঝি মায়েরা সবাইকে বলে দেয়!’ এতে শায়লার হৃদয়যন্ত্রণা খানিকটা কমেছে।
রাত এগারোটার পরে শায়লা নিজের বিছানায় শোয়ার জোগাড় করছিল। এমন সময় তার রুমে প্রবেশ করলো অর্ণব। সে কোনোপ্রকার দুষ্টুমি না করে বোনকে বললো, “আপুনি, আমি কি তোমার রুমে থাকবো? তোমার ভয় করবে নাতো? তুমি বললে আমি তোমার রুমে ফ্লোরিং করবো।”
ভাইটার দরদ দেখে শায়লা হেসে বলে, “তার আর দরকার হবে না। আমি এতো ভয় পাচ্ছি না তো। আর কোনো দরকার হলে তুই তো আমার পাশের রুমেই রয়েছিস। তোকে তখন ডাকবো।”
একথা শোনার পর অর্ণব হেসে চলে যায়।
রাতে ঘুমানোর আগে শায়লা ওর মাথার দিককার সেই জানালাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই সে খোলা রাখতে রাজী নয়।
এই জানালাটার পাশে—চারফুট দূরে আট-দশটি ছোট-বড় ফুলের গাছ রয়েছে। কয়েকটি বকুল ও গন্ধরাজের গাছ ওর রুমের দোতলার জানালা ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে গেছে। আর এই গাছগুলোর বেশ কয়েকটি ডালপালা ওর জানালাটা ঘেঁষে অবস্থান করছে। এতোদিন এগুলো দেখে ওর কোনো ভয় করেনি। কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর থেকে সেই ছায়ামূর্তির হঠাৎ জানালা আটকিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা সে এখনও ভুলতে পারছে না।
শায়লা বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। এমন সময় অর্ণব কোনো কথা না বলে ওর রুমে ঢুকে মাইনাস পাওয়ারের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। এতে খুব সময়ের মধ্যে শায়লার রুমটা হালকা নীলাভ আলোয় ভরে উঠলো। ভাইটার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল।
শায়লা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা সে জানে না। হঠাৎ রাত আড়াইটার দিকে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে সবকিছু বুঝার চেষ্টা করছিল। তার মনে হলো—কেউ যেন তার পাশে এসে অনেকক্ষণ বসে ছিল! সে ভাবছে—তার মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ থাকার পরও এতো জোরে বৃষ্টির শব্দ আসছে কেন! সে বুঝতে পারলো, বাইরে এখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। একটু শীত-শীত লাগছে যেন! আর সে তখন দেখলো, কে যেন পরম মমতায় তার গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে দিয়েছে! ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। আরেকটি বড় ঘটনা সে দেখতে পেল—তার মাথার দিকের জানালাটা এখন একদম খোলা। আর সেখান থেকে হু-হু করে মুক্ত বাতাস আসছে!
ভয়ে শায়লা তাড়াতাড়ি চাদরটা মাথার দিকে আরেকটু টেনে একেবারে চাদরমুড়ি দিলো। কিন্তু তার মন থেকে ভয়টা কিছুতেই কাটছে না। সে চাদরের নিচে শুয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে সে চাদরের নিচ থেকে মুখটা একটুখানি বের করলো। আর ভয়ে-ভয়ে রুমের চারিদিকে বারবার তাকাতে লাগলো। ভয়ে তার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। সে এতো ভয় পেয়েছে যে, পাশের রুমে থাকা অর্ণবকে পর্যন্ত ডাকতে ভুলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে সে একটু সাহস সঞ্চয় করে বিছানার ওপর উঠে বসলো। আর মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ করার ইচ্ছা করলো।
সে জানতো না যে, তার জন্য এরচেয়ে বড় একটি ঘটনা অপেক্ষা করছে। সে অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে মাথার দিককার জানালাটা আবার বন্ধ করে ঘুমাতে যাওয়ার চিন্তা করলো। সে মনের ভিতরে অনেক সাহস সঞ্চয় করে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। একসময় সে জানালাটার একদম কাছে চলে এলো। এমন সময় বাইরে বিদ্যুৎ চমকালো। আর তাতে তার চোখদুটি হঠাৎ চলে গেল জানালার বাইরে—বড় বকুলগাছটার নিচে। আর সে দেখলো—সেখানে একজন তরতাজা যুবক বসে রয়েছে! আর তার পরনে একেবারে সাদা ধবধবে পোশাক! সেই যু্বককে মাত্র একনজর দেখেই তার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে কোনোমতে জানালার গ্রিলটা ধরে নিজেকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলো। আবার বিদ্যুৎ চমকালো সে আবার চোখ মেলে তাকালো সেই বকুলগাছটার নিচে—আর দেখলো, তখনও সেই যু্বক একইভাবে উদাসভঙ্গিতে বসে রয়েছে সেখানে! আর সে বসে-বসে বৃষ্টিতে ভিজছে!
শায়লার শরীরটা এখন থর-থর করে কাঁপছে। জানালার পাশ থেকে সরে আসার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তার হাত-পা সব যেন অবশ-বিবশ হয়ে পড়েছে! মৃত-পাথরের মতো সে যেন এখন স্থবির! তবুও সে কোনোমতে জীবনের সেরা সাহস সঞ্চয় করে শরীরটাকে কোনো একভাবে টেনেহিঁচড়ে অর্ণবের রুমে ঢুকে পড়লো। অর্ণব তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তবুও শায়লা তার গায়ে আস্তে-আস্তে ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুললো।
সে ঘুম থেকে আচমকা জেগে চোখদুটি কচলিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে থাকে, “কী হয়েছে, আপুনি? খারাপ কোনোকিছু?”
শায়লা অনেক চেষ্টায় শুধু বলতে পারলো, “আমার সেই জানালাটা সে আবার খুলে দিয়েছে! আর সে এখন আমার জানালার বড় বকুলগাছটার নিচে বসে রয়েছে!”
অর্ণব তেমন-একটা ভয় না পেয়ে বললো, “চল তো তোমার রুমে গিয়ে দেখি।”
ওরা দুজন পা-টিপে-টিপে রুমটাতে প্রবেশ করলো। তারপর দুজনে খুব চুপিসারে রুমের লাইট না জ্বালিয়ে জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শায়লার এখন জানালার নিচে তাকানোর মতো কোনো সাহস অবশিষ্ট নাই। শুধু অর্ণব খুব সাবধানে জানালার কাছে গিয়ে চোখ মেললো—আর সে আবছা আঁধারেও দেখলো, সত্যি একটা লোক বসে রয়েছে বকুলগাছটার নিচে! আর তার পরনে সাদা ধবধবে পোশাক!
সেও কিছুটা ঘাবড়ে গেল। আর-একবার তাকে দেখার সাহস পেল না। এতো রাতে এখানে কোনো মানুষজনের আসার প্রশ্নই ওঠে না। তার কারণ, ওদের পুরা বাড়িটা দশফুট প্রাচীরে ঘেরা। এখানে, এতো রাতে মানুষ আসবে কীভাবে? চোর-ডাকাতের প্রবেশ করাটাও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ওরা দুজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই জানালাটার পাশে। আর এখান থেকে এইমুহূর্তে ওদের যে সরে যাওয়া উচিত—সেই হুঁশটুকু পর্যন্ত ওদের কারও নাই।
আবার খুব প্রচণ্ডভাবে বিদ্যুৎ চমকালো—আর তাতে দুই ভাইবোন একসঙ্গে এবার দেখলো—সেই যুবকটি তখনও সেখানে বসে রয়েছে। আর সে যেন খুব বিমর্ষ! আর তার শরীরটা যেন আলোর মতো! সে যেন এখন ঠিক রক্তমাংসের মানুষ নয়! আস্তে-আস্তে তার শরীরটা যেন ছায়ায় পরিণত হতে চলেছে!
আর তখনই বাইরে কোথাও প্রচণ্ড শব্দে একটা বাজ পড়লো। আর প্রচণ্ড বাজ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই এলাকার বিদ্যুৎ চলে গেল।
আর সেই সময় একটা ছায়ামূর্তি ওদের প্রায় গা-ঘেঁষে জানালা গলে প্রবেশ করলো শায়লার রুমে। এতে শায়লা চিৎকার না দিলেও ভয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওরা দেখলো—ছায়ামূর্তিটা দরজা পেরিয়ে প্যাসেজ অতিক্রম করে কোথায় যেন চলে গেল!
শায়লা ভয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। অর্ণব তবুও কিছুটা সাহসের সঙ্গে রুমের লাইটটা জ্বেলে দিলো। তারপর শায়লাকে পানি পান করালো। সবশেষে তাকে শুইয়ে দিলো ওর বিছানায়।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(তৃতীয় পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
শায়লাকে হঠাৎ এভাবে বিধ্বস্ত-অবস্থায় সোফার ওপর বসতে দেখে তার ছোটভাই অর্ণব প্রথমে তাকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো। এরপর সে আরও কয়েকবার বোনের দিকে ক্রমাগত তাকাতে লাগলো। সে কী যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
অর্ণব ক্লাস নাইনে পড়লেও তার আই.কিউ. অনেক শার্প। সে সবসময় বুদ্ধিবিষয়ক পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার বুদ্ধিমত্তা ইন্টারমিডিয়েটে পড়া ছাত্রদের লেভেলে। সে যেকোনো একটা ভালোছাত্রের মতো মেধার অধিকারী। আর এই বয়সে অন্যান্যদের তুলনায় সে খুব মেধাবী। বোনের মতো তারও বইপড়ার ভয়ানক অভ্যাস। ইতোমধ্যে সে কয়েক হাজার বইপড়ে ফেলেছে। এগুলোর মধ্যে ভৌতিক, আধাভৌতিক, রহস্য, গোয়েন্দা তথা সাসপেন্স-থ্রিলার অন্যতম। এর বাইরেও সে নির্ভেজাল সাহিত্য পড়েছে। আর এখনও সে মনোযোগসহকারে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত। সে বাংলাভাষার ক্ল্যাসিক-সাহিত্য পুরোটাই পড়ার ইচ্ছা রাখে। আর বইপড়তে তার কোনো আলসেমি নাই।
সে আরও কিছুক্ষণ তার একমাত্র বড়বোনটিকে মনোনিবেশসহকারে পর্যবেক্ষণ করে—শেষে পড়া রেখে তার পাশে বসে বললো, “কোনো সমস্যা হয়েছে, আপুনি?”
শায়লা ভাইটির এতো কাছে বসেও যেন ওর কথাটা শুনতে পেল না। অর্ণব এটা লক্ষ্য করে আবার বললো, “আপুনি, তুমি কি কোনো বিষয়ে খুব আপসেট? আর কী হয়েছে তোমার?”
এবার যেন কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেল শায়লা। সে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার মতো করে বলতে থাকে, “নাহ্, তেমনকিছু না রে। আমার এই একটু জ্বর-জ্বর-ভাব।”
অর্ণব তখনই শায়লার কপালে হাত রেখে বলে, “কই, তোমার তো কোনো জ্বর হয়নি! সবকিছু একেবারে নরমাল। তবে কেন আজ-এখন হঠাৎ মিথ্যা বলছো, আপুনি?”
শায়লা যেন এবার ধরা পড়ে গেছে—সে ছোটভাইটির একটা হাত ধরে বলে, “আচ্ছা ভাই, তুই কি জানিস শহরে কোনো ভূতপ্রেত থাকে? মানে, আমাদের এই শহরে কোনো ভূতপ্রেত আছে কিনা?”
অর্ণব এবার হেসে ফেললো। আর বললো, “হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে যে! কিছু হয়েছে নাকি? তুমি কি ইদানীং ভূতটুত দেখেছো নাকি? আপুনি, আমাকে খুলে বলো তো।”
শায়লা এবার খুব সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে বলতে লাগলো, “তুই তো ভূতের বইটই আমার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছিস। আসলে, আমি বলতে চাচ্ছি কি—শহরে কখনো ভূতের কথা শুনেছিস কিংবা এই শহরে কেউ-কখনো ভূতটুত দেখেছে কিনা? কারও কাছে ভূতের কথা ইদানীং শুনেছিস কখনো? এই বিষয়ে কিছু জানলে আমাকে বল তো।”
অর্ণব সব শুনে হেসে বলে, “শুনবো না কেন? এই তো গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধুর মা নাকি বাথরুমে ভূত দেখে সেখানেই পড়ে গিয়ে ফিট—মানে, একদম অজ্ঞান। তারপর তাকে সুস্থ করতে হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়েছিল! রাত তিনটার সময় তিনি নিজেদের বাসার বাথরুমে একটা ভূত না আত্মা—কিছু-একটা দেখেছিলেন। ওদের বাসাটা আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে—এই তো শনির আখড়ার কাছে। তুমি চাইলে একদিন তোমাকে সেখানে নিয়েও যেতে পারি। তারপর খালাম্মার মুখেই সবকথা শুনে নিবে।”
শায়লা এবার যেন উৎসাহিত হয়ে উঠলো। আর সে খুশিমনে বলে, “তার দরকার হবে না। শুধু বল, কী দেখেছিলেন তোর ওই বন্ধুর মা? আমাকে একটু খুলে বল না, ভাই।”
অর্ণব বলে, “না, তেমনকিছু না। এই তিনি নাকি দেখেছিলেন, কে যেন তাদের বাসার বাথরুমে মাঝরাতে গোসল করছে! তিনি মনে করলেন, এটা বুঝি তার একমাত্র ছেলে—মানে, আমাদের বন্ধু সিফাতের কাজ। এইটা ভেবে তিনি তা দেখার জন্য বাথরুমের দিকে এগুতে লাগলেন। এইসময় বাথরুমের দরজাটা একটু খোলা ছিল। তিনি কাছে গিয়ে দরজাটার আরও কিছুটা খুলে ভিতরে উঁকি দিতেই দেখলেন, সেখানে বসে আছে একটা মাঝবয়সী মহিলা। আর সেই মহিলা তাদের বাসার বাথরুমের হাই-কমোডের ওপর বসে রয়েছে! আর তার গলা দিয়ে সমানে রক্ত ঝরছে! মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য। তারপর আর-কিছু তার মনে নাই। মানে, এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। শুনেছি, ওরা নাকি এই বাসাটা ছেড়ে দিবে। খালাম্মা কিছুতেই এই বাসাটাতে আর থাকতে চাচ্ছেন না।”
“কেন? কেন?”—খুব উদ্বিগ্নভাবে শায়লা জানতে চায়।
অর্ণব কিছুটা হাসতে-হাসতে বলে, “কেন আবার? ওই গলাকাটা ভূতুড়ে মহিলা যদি আবার ওদের বাসায় ফিরে আসে। মাঝে-মাঝে আবার যদি দেখা দিতে থাকে। তাই, ওরা বাসা বদলাচ্ছে। কিন্তু আমি হলে তা করতাম না। এই রহস্যটার আরও গভীরে যেতাম। আর বাসাটা ছাড়তাম না।”
শায়লা একটু হেসে বলে, “থাক-থাক, তোকে আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। এবার আসল কথাটা বল না ভাই। আসলে, কেন এমন হয়েছিল?”
তারপর অর্ণব একটুখানি ভেবেচিন্তে বলতে লাগলো, “এবার তোমাকে মূল ঘটনাটা বলি। আর এই ঘটনাটার মূলরহস্য পরে আমরা জেনেছি। তুমি আবার সবটা শুনে ভয় পেয়ো না যেন।”
শায়লা ঘটনাটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বলে, “আরে, না-না, আমি কোনো ভয় পাবো না। তুই একনাগাড়ে সবটা বলে যা তো।”
একথা শোনার পর অর্ণব বলতে থাকে, “পরে আমার বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি, এই বাসাটাতে কয়েক বৎসর আগে অন্য একটা ভাড়াটিয়া থাকতো। এই বাসাটা বহু আগে যে-লোকটা ভাড়া নিয়েছিল—তার মা তাদের সঙ্গে থাকতো। হঠাৎ সেই মহিলা তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে যায়। ভদ্রলোক তার মায়ের অনেক চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মহিলার পাগলামিটা একসময় আরও বেড়ে যায়। তারপর একদিন রাতে সেই মহিলা ওই বাথরুমে নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে গলাকেট আত্মহত্যা করে। মহিলা রাত তিনটার সময় নিজের গলাকেটে সুইসাইড করেছিল। সেই থেকে মাঝে-মাঝে ওই বাসাটাতে ঠিক রাত তিনটার সময় সেই মহিলাকে দেখা যায়। সেইজন্য ওই বসাটাতে ভাড়াটিয়া বেশিদিন থাকে না। থাকতে পারে না। আর নতুন ভাড়াটিয়া যারাই ঘটনাটা জানতে পারে—তারাই দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়ে। আর বাড়িওয়ালাটাও এমন একটা রামছাগল যে—সে কোনো ভাড়াটিয়াকে আগে থেকে এসব বলে সাবধান করে না। ভাড়ার সামান্য কয়টা টাকার জন্য সে মানুষের জীবন নিয়ে আজ ছিনিমিনি খেলছে।”
অর্ণব কথা শেষ করে বোনের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বলে, “আপুনি, তুমি আজ হঠাৎ এসব জিজ্ঞাসা করছো! কোনোকিছু হয়েছে নাকি? আমাকে সবটা খুলে বলো তো।”
শায়লা এবার খুব ইতস্ততঃ করতে থাকে। আর কীভাবে সে শুরু করবে। তার জীবনে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিশ্বস্ত-বন্ধু এই ভাইটি। আর সে খুব বুদ্ধিমান ও সাহসী। ওর পরামর্শ তার জীবনে অনেক কাজে লাগতে পারে। শেষে শায়লা ভাইকে সবকিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ওর হাবভাব দেখে অর্ণব বলে, “আরে, আপুনি, আমি এসবে এতো ভয় পাই না। আর জানো, আমি হলে আমার বন্ধুদের মতো ওই বাসাটা ছাড়তাম না। এটা আমার জন্য দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হতো। কাজেই তুমি আমাকে সবটা খুলে বলতে পারো।”
শায়লা এরপর কোনোকিছু গোপন না করে তার সঙ্গে অবস্থানরত এতদিনের একটা ছায়ামানব থেকে শুরু করে আজকের বৃষ্টি-সন্ধ্যার সময়কার জানালা বন্ধের সেই ঘটনাটা পর্যন্ত একনিঃশ্বাসে বলে ফেললো। এতে সে যেন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন।
আর সব শুনে অর্ণব কিছুক্ষণ যেন গুম হয়ে বসে রইলো। সে কোনো কথা বললো না—যেন সে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। এইসময় তাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় শার্লক হোমসের মতো মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এই ঘটনাটা তো শার্লক হোমসের সমাধান করার কথা নয়। এটি তার কোনো বিষয় নয়। এখানে, একজন আত্মাবিশেষজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। আর এইজাতীয় ব্যাপারে যার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি বা ঈর্ষণীয়—তাকেই শুধু এদের প্রয়োজন।
সোফার এককোণে চুপচাপ বসে দীর্ঘসময় চিন্তাভাবনা করে গম্ভীরমুখে অর্ণব বললো, “তোমার প্রতিটি কথা আজ-এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, আপুনি। আজ আমি বুঝতে পারছি—একদিন আমার সঙ্গেও একটাকিছু ঘটেছিল সিঁড়িতে। সেদিন, আমি স্কুল থেকে একটুখানি দেরি করে ফিরেছিলাম। আর সেদিন, আমার বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে নেমে এসেছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর তখন লোডশেডিংয়ের জন্য সিঁড়িতে কোনো লাইটও জ্বলছিল না। আমি একাকী দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল—কারও সঙ্গে যেন আমার একটা ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু আমি সেই সময় আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখিনি। ঘটনাটিকে আমি তখন নিজের সাহসিকতার জন্য কোনো পাত্তাও দিইনি। তখন আমাদের দারোয়ান-চাচা ছিলেন বাড়ির মেইন গেইটের কাছে পাহারারত। আর সেদিন সেই মুহূর্তে বাবাও বাড়িতে ছিলেন না। দোতলায় উঠে দেখি তুমি, মামণি, আর মালেকা মিলে ড্রইংরুমে টিভি দেখছো! তাহলে, আমার সঙ্গে সিঁড়িতে ধাক্কা লেগেছিল কার? পরে অবশ্য আমি নিজের চঞ্চলতার কারণে বিষয়টা নিয়ে এতোটা ভাবিনি। নিজের অন্য ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। এখন দেখছি, আমি ভুলই করেছি। আর আজ বুঝতে পারছি, সেটি কোনো ছায়ামানবই হবে। কিন্তু কে সে? তবে সে কিন্তু আমাকে ইচ্ছা করে সজোরে কিংবা ক্রোধান্বিত হয়ে ধাক্কাটা দেয়নি—হঠাৎ একটা ধাক্কা লেগেছিল যেন! আমার এখন আরও মনে হচ্ছে—এই বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে। আর সেও হয়তো আমাদের মতো সময়-সময় চলাফেরা করে থাকে। আর চলাফেরার সময় সে আচমকা আমাদের সামনে এসে পড়ে—এজন্য তার সঙ্গে আমাদের একটুআধটু দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যাচ্ছে আরকি!”
ছোটভাইটির কথা শুনে শায়লা যেন ভিতরে-ভিতরে শিউরে উঠলো। তাহলে, এতোদূর ঘটনাটা! আর সে এতোদিন বিষয়টা নিয়ে আপনমনে চুপচাপ বসে ছিল!
শায়লার ভাবগতিক বুঝতে পেরে অর্ণব দৃঢ়চিত্তে বলতে লাগলো, “আমি এসবে ভয় পাই না। তুমিও ভয় পেয়ো না, আপুনি। ভয় পেলেই ভয় আরও অন্তরে বাসা বাঁধে। মনে সাহস রাখো। আর এসব বিষয়ে মা-বাবাকে এখনই সবটা বলার দরকার নাই। তারা অহেতুক এই নিয়ে একটা টেনশন করবেন। তারচে আমি বলি কি...।”
“কিন্তু আমি যে মাকে আজকের-সন্ধ্যার ঘটনাটা বলে দিয়েছি!”—শায়লা ভাইকে বাধা দিয়ে কথাটা বলে ফেললো।
অর্ণব বলে, “কোনো অসুবিধা নাই। আর-কিছু বলবে না। ব্যাপারটা আমরাই হ্যান্ডেল করবো। আর যদি আমরা না-পারি তখন না-হয় মা-বাবাকে জানাবো।”
কথাটা শায়লারও মনঃপুত হলো। সেও বিষয়টা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতে লাগলো।
এমন সময় ওদের বাবা ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। ওদের কথার কিছুটা তার কানে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তিনি বাড়িতে ফিরে ওদের আশেপাশেই ছিলেন। আর নিজের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করছিলেন। ওরা নিজেদের কথায় এতোটাই নিমগ্ন ছিল যে, অন্যান্য দিনের মতো তাদের বাবার আগমনের সংবাদটাও পায়নি। মোসাদ্দেকসাহেব ছেলে-মেয়ে দুটোর ভালো একজন বন্ধু। ওদের সঙ্গে তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুক্তআলোচনা হয়। আজও তিনি হাসি-হাসি-মুখে ওদের কাছে এসে বসলেন। আর বললেন, “তোমরা কী নিয়ে কথা বলছিলে?”
একথা শুনে শায়লা একটু কাঁচুমাচুভাব করে বসে রইলো। কিন্তু অর্ণব খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, “তেমনকিছু নয় বাবা, এই... শহরে ভূতপ্রেত থাকে কিনা—তা-ই নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম।”
এবার মোসাদ্দেকসাহেব আগের মতো হাসিমুখ নিয়ে বললেন, “শহরে ভূতপ্রেত কিংবা জীন-পরী কিছু থাকে কিনা—আমি জানি না। তবে গ্রামেগঞ্জের অনেক জায়গায় এখনও এদের উপস্থিতি রয়েছে। এটা আমি বিশ্বাস করেছি। আর তা এখনও করি।”
একথা শুনে প্রায় লাফিয়ে ওঠে অর্ণব। আর সে প্রবল আগ্রহভরে বলে, “বাবা, তুমি কখনো কিছু দেখেছো? এই মানে—সচল-আত্মা-জাতীয় কিছু।”
মোসাদ্দেকসাহেব হেসে বললেন, “আমি কখনো কিছু দেখেছি কিনা—সে-কথা পরে বলি। কিন্তু তোমাদের মরহুম দাদাজান একবার একটা ভয়ংকর জীনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই কথাটা আজ আগে বলি, শোনো।”
বাবার মুখ থেকে এইরকম একটা দমফাটানো রোমাঞ্চকর কথা শোনার আগে শায়লা সভয়ে বাবার গাঁ-ঘেষে পাশে গিয়ে বসলো। আর তা দেখে মুখটিপে হাসে অর্ণব। যেন সে বুঝাতে চাইছে—তুমি ভয় পেয়েছো—আর তাই, বাবার কোলঘেঁষে বসেছো।
শায়লা ভাইকে পাল্টা আর-কিছু বললো না। সে এখন ঘটনাটা শুনতে চায়।
মোসাদ্দেকসাহেব ধীরেসুস্থে বলতে লাগলেন:
“তোমাদের দাদাজান খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি দিবারাত্রির অনেকটা সময় মসজিদে গিয়ে পড়ে থাকতেন। তাছাড়া, আমাদের বাড়ির নামডাক ও বিষয়সম্পদের পরিমাণ ছিল বেশি। সেইজন্য গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাবাকে গ্রামের মসজিদের সভাপতি বানিয়ে দিলো। বাবা একাই সবকিছু করতেন। আমাদের গ্রামের মসজিদটা প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরানো হবে। এই মসজিদের সামনে ছিল একটা বড়সড় আমগাছ। এটাকে প্রাচীন আমগাছও বলা যেতে পারে। এটার বয়স কত আমার আজ আর জানা নাই। তবে বাবার মুখে শুনেছিলাম—এটার বয়স নাকি কমপক্ষে দেড়শ’ বছর হবে! গ্রামের মসজিদটা খুব ছোট্ট ও সুন্দর ছিল। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে এটা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না। তাই, গ্রামের লোক বাবাকে ধরে বসলো—মসজিদটা এবার বড় করতে হবে। বাবা এজন্য একাই প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা দিতে রাজী হলেন। গ্রামবাসীও খুব খুশি হলেন। শুরু হলো মসজিদ তৈরির কাজ। কিন্ত মসজিদ বড় করতে হলে মসজিদের সামনের প্রাচীন আমগাছটাকে কাটতে হয়। এটি ছিল একটা বটগাছের মতো বিশাল বৃক্ষ। শেষে গ্রামবাসীর সঙ্গে পরামর্শ করে বাবা আমগাছটাকে কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামবাসী আমগাছটাকে কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিলো। এখনকার মতো তখনকার দিনে কোনো সমিল বা ইলেকট্রিক করাত ছিল না। তাই, গ্রামবাসী নিজেদের সামান্য করাত, দা-কুড়াল নিয়ে আমগাছটাকে কাটতে লাগলো। সাতদিনের মধ্যে গাছটা টুকরা-টুকরা হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো মসজিদের কাজ। একদিন বাবা এশার নামাজ পড়ে জিকির ও তাসবিহ-তাহলিল শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন—এমন সময় তিনি আমাদের বাড়ির মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাবার মনে হলো: রাস্তার মাঝখানে দুটো লালবাতি জ্বলছে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। রাস্তার মাঝখানে ল্যাম্পপোস্টের মতো এতো উঁচুতে লাইট জ্বলবে কীভাবে? বাবা এটার কাছে একটু এগিয়ে যেতেই বিষয়টি তার গোচরীভূত হলো—তিনি দেখলেন, একটা দুষ্টু জীন রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে কী ভয়ংকর চেহারা তার! বাবা বলেছিলেন তার উচ্চতা নাকি কমপক্ষে পঁচিশ-ত্রিশ ফুট হবে। আর সেইরকম মোটাতাজা ছিল জীনটা! আর দেখতে এটা খুব কালো কুচকুচে ছিল। সেইজন্য অন্ধকার-রাতে বাবা তাকে দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাননি। বাবা একটু কাছে এগিয়ে যেতেই সে বাবার নাম ধরে বললো, ‘শোন আব্দুস সাদেক, আজ তোর রেহাই নাই। তুই আমাদের আমগাছ কেটেছিস। তোকে আমি আজ এই মসজিদের পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে-চুবিয়ে মারবো। তার কারণ, তুই আমাদের থাকার জায়গাটা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিস। তোর কোনো ক্ষমা নাই। তোর কোনো রক্ষা নাই। এমনকি তোর বংশধরদেরও নিস্তার নাই। সবাইকে আমি মেরে ফেলবো।’ বাবা, তবুও সাহসের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘কেন ভাই, আমি কী করেছি? আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নাই। আল্লাহর ঘর মসজিদ বানানোর জন্য আমগাছটা কেটেছি। আশেপাশে তো আরও কত গাছ আছে। তোমরা সেখানে আস্তানা বানাও। আমি তোমাদের কিছুই বলতে যাবো না। কিন্তু আমগাছটা কাটা ছাড়া আমাদের আর-কোনো উপায় ছিল না। আর আমি তো গ্রামবাসীর সঙ্গে পরামর্শ করেই কাজটি করেছি। দোষ তো আমার একার নয়।’
তবুও সেই জীনটি গোঁ-গোঁ করতে-করতে বলতে লাগলো, ‘আমি অতসব বুঝি না। তুই মসজিদের মাতবর। এই মসজিদের নেতা হয়েছিস তুই। তোকে আমি ছাড়বো না। তোর জন্য আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে।’ বাবা সবসময় নানারকম দোয়া-দরুদ পড়ে নিজের শরীর বন্ধ করে রাখতেন। যাতে দুষ্টু জীন বা দুষ্টুলোকের কোনোপ্রকার কুফরি-কালামে তার কোনো ক্ষতি না-হয়। আজও তিনি তা-ই করে রেখেছিলেন। বাবা সাহসের সঙ্গে দেখলেন, এই জীনটা বাবার কাছে এগুতে আর সাহস পাচ্ছে না। তখন বাবা পুনরায় আয়াতুল কুরসীসহ চারকুল পড়ে যখন ওই জীনটার দিকে খুব ভালোভাবে দম করলেন—তখন সে একনিমিষে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল! তারপর থেকে সে আর কখনো বাবার সামনে আসেনি। এরপর থেকে বাবা একা কখনো রাত-বিরাতে চলাফেরা করতেন না। পরে বাবার জন্য একজন দেহরক্ষী নিযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আমার মা-ই এই কাজটি করেছিলেন। কারণ, তিনি আমাদের বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। এতো গেল একটা ঘটনা। আরেকবার বাবা হাট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন—তখন বাবার বয়সটাও কম। সবেমাত্র মাকে বিয়ে করেছেন। একদিন রাতে তিনি গ্রামের হাট থেকে ফিরছিলেন—গ্রাম-হিসাবে সেদিন খুব বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল। আর বাবা সেদিন খুব শখ করে কিনেছিলেন দুইটা বড়সড় ইলিশমাছ। এই মাছ নিয়ে বাবাকে প্রায় মাইল দেড়েক হেঁটে তারপর বাড়ি ফিরতে হবে। তোমরা তো জানো, তখন আমাদের দেশের যোগাযোগব্যবস্থা এতো উন্নত ও আধুনিক ছিল না। রিক্সা-ভ্যান পাওয়া তো দূরের কথা—এগুলো তখন কখনো চোখেও দেখা যেত না। আর তাই, বাবা মাছ দুটো সঙ্গে করে আপনমনে হাঁটছিলেন। আর বাবা তখন একেবারে যুবকমানুষ। তার সাহসও খুব বেশি ছিল। তাই, কোনোকিছুর পরোয়া না করে—আর কারও ধার না ধেরে তিনি নিজের শক্তিবলে একাকী এতো রাতে দুই-দুইটা বড়সড় ইলিশমাছ সঙ্গে করে তখনকার দিনের গ্রামের অন্ধকারপথে হাঁটতে লাগলেন। বাবার কাছে সেদিন কোনো টর্চলাইটও ছিল না। হয়তো তিনি তা ভুল করে সঙ্গে রাখতে পারেননি। বাবা বলেছিলেন, ‘আধাঘণ্টা পথ চলেও কোনো সমস্যা হয়নি। বড় তেঁতুলগাছটার কাছে এসে একটা বিপদে পড়লাম।’ বাড়ির কাছাকাছি এসে—গ্রামের তেমাথা বলে—তার পাশে মঈনুদ্দীনের ভিটায় একটা বড় তেঁতুলগাছ ছিল। সেখানে বাবা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আর তিনি দেখলেন, গাছ থেকে একটা ছায়ামূর্তি নেমে এলো! আবার সেটা চোখের পলকে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল! বাবার শরীরটা এইসময় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। তবে তিনি ভয় পাননি। সাহসিকতার সঙ্গে এটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করলেন। একটু পরে তিনি যখন আবার হাঁটতে শুরু করলেন তখন দেখলেন, কোত্থেকে যেন একটা বিড়াল তার পিছু নিয়েছে! আর বিড়ালটা তার পিছনে-পিছনে হাঁটছিল। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, এভাবে পথ-চললে সামনে তার বিপদ হবে। তাই, তিনি দ্রুত নিজের শরীরটা পুনরায় বন্ধ করে ফেললেন। তারপর সবুদ্ধিতে বুকপকেটের ম্যাচটা বের করে আগুন জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। অমনি কাজের কাজ হলো। সেই অপআত্মাটা সভয়ে পালিয়ে গেল। তবে সে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে গিয়েছিল, ‘যা, তুই আজকের মতো বেঁচে গেলি রে! আগুনটা তোর সঙ্গে ছিল বলে বেঁচে গেলি!’ সেই থেকে তোমাদের দাদাজান আর-কখনো রাতের বেলা একাকী সহজে বাড়ির বাইরে বের হতেন না।”
মোসাদ্দেকসাহেবের মুখ থেকে এইরকম ভয়ানক কাহিনী শুনে শায়লা ভিতরে-ভিতরে ভয়ে কিছুটা জড়োসড় হয়ে রয়েছে। কিন্তু বাইরে সে কাউকে তা বুঝতে দিচ্ছে না।
আর অর্ণব একেবারে স্বাভাবিক। সে তার বাবাকে মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করে আরও অনেককিছু জেনে নিচ্ছে। ওদের-আত্মাদের ব্যাপারে তার ভীষণ আগ্রহ। ভবিষ্যতে সে আত্মাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করতে চায়। এজন্য সে ভিতরে-বাইরে একটা বিরাট প্রস্তুতিগ্রহণ করছে।
ওরা এতোক্ষণ তন্ময় হয়ে ওদের বাবার কথা শুনছিল। তা দেখে উৎসাহিত হয়ে মোসাদ্দেকসাহেব বললেন, “তোমরা যদি আত্মাবিষয়ে আরও বেশি জানতে চাও—তাইলে আমাদের একজন গুরুজী আছেন—একদিন তাঁকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো। তাঁর নাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ। কিন্তু তিনি সুধীসমাজে অধ্যাপক লিটু মিয়া নামে পরিচিত। তিনি একজন তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, সাহিত্যিক ও দার্শনিক ব্যক্তি। একজন খুব ভালোমানুষ হিসাবেও তিনি সুপরিচিত। আত্মাবিষয়ে তাঁর মতো এতো পড়ালেখা জানা মানুষ আমি আর দেখি নাই।”
কথাটা শোনামাত্র ওরা দুই ভাই-বোন যেন সমস্বরে বলে উঠলো, “বাবা, তোমাদের গুরুজীকে একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে। আমরা তাঁর কথা শুনতে চাই।”
মোসাদ্দেকসাহেব ছেলে-মেয়ের আগ্রহ দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, “আচ্ছা, সময়-সুযোগমতো একদিন তাঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। তাঁর কাছ থেকে তোমরা অনেককিছু জানতে পারবে। আমাদের জানামতে, তিনি আত্মাবিষয়ক একজন শ্রেষ্ঠ গবেষক।”
শায়লা কিছুক্ষণ উসখুস করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা, আয়াতুল কুরসী পড়লে নাকি ভূতের ভয় থাকে না?”
মোসাদ্দেকসাহেব প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। আয়াতুল কুরসী পড়লে শয়তান পালায়। আয়াতুল কুরসীর অনেক শক্তি। আর সবচেয়ে ভালো হয় যদি তোমরা ফজর থেকে মাগরিব-এশার নামাজের পর আয়াতুল কুরসীসহ চারকুল পড়ে শরীর বন্ধ করে নাও।”
“সেটা কীভাবে বাবা।”—শায়লা খুব আগ্রহভরে তা জানতে চাইলো।
মোসাদ্দেকসাহেব বলতে লাগলেন, “চারটি সুরা একসঙ্গে পাঠকরাকে চারকুলপাঠ বলা হয়। আর এই চারটি সুরার শুরুটা ‘কুল’ শব্দ দিয়ে বলেই একে চারকুল বলা হয়। এগুলো হচ্ছে—সুরা কাফিরুন, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস। এগুলো একসঙ্গে পড়ে শরীরে দম করলে শয়তান ও তার অনুসারীরা পাঠকারীর আর-কোনো ক্ষতি করতে পারে না।”
বাবার মুখ থেকে এসব শুনে শায়লা যেন সব মুখস্থ করে নিতে থাকে। সে আপনমনে ভাবছে—এখন থেকে সে সবসময় নিজের শরীর বন্ধ করে রাখবে।
এমন সময় রাশিদা বানু সবাইকে খাবার-টেবিলে ডাকলেন।
শায়লা বাবার সঙ্গে ডাইনিং-রুমে প্রবেশ করলো। অর্ণব একটু পরে গেল।
রাতে খাবার-টেবিলে এই বিষয়ে আর-কোনো কথা হলো না।
রাশিদা বানু খাওয়ার একফাঁকে মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে খুব আস্তে শুধু বললেন, “তোমার ভয়-ভয় লাগলে আজ রাতে আমাদের সঙ্গে ঘুমাতে পারো।”
একথা শুনে শায়লা একটু হেসে বলে, “না মা, তার আর দরকার হবে না। আমি একাই থাকতে পারবো।”
মাকে অভয় দিয়ে শায়লা নিজের রুমেই ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে ভেবে দেখেছে, বেশি ভয়টয় পেলে বিষয়টা লোকজনের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে। কথাটা সবার কাছে পৌঁছুতে বেশি সময় লাগবে না। এসব শুনলে তার আত্মীয়স্বজনেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়বে না। সে সহজে কারও কাছে হাসির পাত্র হতে রাজী নয়। সেইজন্য সে অর্ণবের কথামতো মাকে তার সন্ধ্যার সময়কার ঘটনাটা আর-কাউকে বলতে নিষেধ করলো। ওর কথা শুনে মা হেসে বলেছেন, ‘দূর পাগলী, এসব কথা বুঝি মায়েরা সবাইকে বলে দেয়!’ এতে শায়লার হৃদয়যন্ত্রণা খানিকটা কমেছে।
রাত এগারোটার পরে শায়লা নিজের বিছানায় শোয়ার জোগাড় করছিল। এমন সময় তার রুমে প্রবেশ করলো অর্ণব। সে কোনোপ্রকার দুষ্টুমি না করে বোনকে বললো, “আপুনি, আমি কি তোমার রুমে থাকবো? তোমার ভয় করবে নাতো? তুমি বললে আমি তোমার রুমে ফ্লোরিং করবো।”
ভাইটার দরদ দেখে শায়লা হেসে বলে, “তার আর দরকার হবে না। আমি এতো ভয় পাচ্ছি না তো। আর কোনো দরকার হলে তুই তো আমার পাশের রুমেই রয়েছিস। তোকে তখন ডাকবো।”
একথা শোনার পর অর্ণব হেসে চলে যায়।
রাতে ঘুমানোর আগে শায়লা ওর মাথার দিককার সেই জানালাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই সে খোলা রাখতে রাজী নয়।
এই জানালাটার পাশে—চারফুট দূরে আট-দশটি ছোট-বড় ফুলের গাছ রয়েছে। কয়েকটি বকুল ও গন্ধরাজের গাছ ওর রুমের দোতলার জানালা ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে গেছে। আর এই গাছগুলোর বেশ কয়েকটি ডালপালা ওর জানালাটা ঘেঁষে অবস্থান করছে। এতোদিন এগুলো দেখে ওর কোনো ভয় করেনি। কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর থেকে সেই ছায়ামূর্তির হঠাৎ জানালা আটকিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা সে এখনও ভুলতে পারছে না।
শায়লা বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। এমন সময় অর্ণব কোনো কথা না বলে ওর রুমে ঢুকে মাইনাস পাওয়ারের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। এতে খুব সময়ের মধ্যে শায়লার রুমটা হালকা নীলাভ আলোয় ভরে উঠলো। ভাইটার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল।
শায়লা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা সে জানে না। হঠাৎ রাত আড়াইটার দিকে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে সবকিছু বুঝার চেষ্টা করছিল। তার মনে হলো—কেউ যেন তার পাশে এসে অনেকক্ষণ বসে ছিল! সে ভাবছে—তার মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ থাকার পরও এতো জোরে বৃষ্টির শব্দ আসছে কেন! সে বুঝতে পারলো, বাইরে এখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। একটু শীত-শীত লাগছে যেন! আর সে তখন দেখলো, কে যেন পরম মমতায় তার গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে দিয়েছে! ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। আরেকটি বড় ঘটনা সে দেখতে পেল—তার মাথার দিকের জানালাটা এখন একদম খোলা। আর সেখান থেকে হু-হু করে মুক্ত বাতাস আসছে!
ভয়ে শায়লা তাড়াতাড়ি চাদরটা মাথার দিকে আরেকটু টেনে একেবারে চাদরমুড়ি দিলো। কিন্তু তার মন থেকে ভয়টা কিছুতেই কাটছে না। সে চাদরের নিচে শুয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে সে চাদরের নিচ থেকে মুখটা একটুখানি বের করলো। আর ভয়ে-ভয়ে রুমের চারিদিকে বারবার তাকাতে লাগলো। ভয়ে তার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। সে এতো ভয় পেয়েছে যে, পাশের রুমে থাকা অর্ণবকে পর্যন্ত ডাকতে ভুলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে সে একটু সাহস সঞ্চয় করে বিছানার ওপর উঠে বসলো। আর মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ করার ইচ্ছা করলো।
সে জানতো না যে, তার জন্য এরচেয়ে বড় একটি ঘটনা অপেক্ষা করছে। সে অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে মাথার দিককার জানালাটা আবার বন্ধ করে ঘুমাতে যাওয়ার চিন্তা করলো। সে মনের ভিতরে অনেক সাহস সঞ্চয় করে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। একসময় সে জানালাটার একদম কাছে চলে এলো। এমন সময় বাইরে বিদ্যুৎ চমকালো। আর তাতে তার চোখদুটি হঠাৎ চলে গেল জানালার বাইরে—বড় বকুলগাছটার নিচে। আর সে দেখলো—সেখানে একজন তরতাজা যুবক বসে রয়েছে! আর তার পরনে একেবারে সাদা ধবধবে পোশাক! সেই যু্বককে মাত্র একনজর দেখেই তার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে কোনোমতে জানালার গ্রিলটা ধরে নিজেকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলো। আবার বিদ্যুৎ চমকালো সে আবার চোখ মেলে তাকালো সেই বকুলগাছটার নিচে—আর দেখলো, তখনও সেই যু্বক একইভাবে উদাসভঙ্গিতে বসে রয়েছে সেখানে! আর সে বসে-বসে বৃষ্টিতে ভিজছে!
শায়লার শরীরটা এখন থর-থর করে কাঁপছে। জানালার পাশ থেকে সরে আসার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তার হাত-পা সব যেন অবশ-বিবশ হয়ে পড়েছে! মৃত-পাথরের মতো সে যেন এখন স্থবির! তবুও সে কোনোমতে জীবনের সেরা সাহস সঞ্চয় করে শরীরটাকে কোনো একভাবে টেনেহিঁচড়ে অর্ণবের রুমে ঢুকে পড়লো। অর্ণব তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তবুও শায়লা তার গায়ে আস্তে-আস্তে ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুললো।
সে ঘুম থেকে আচমকা জেগে চোখদুটি কচলিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে থাকে, “কী হয়েছে, আপুনি? খারাপ কোনোকিছু?”
শায়লা অনেক চেষ্টায় শুধু বলতে পারলো, “আমার সেই জানালাটা সে আবার খুলে দিয়েছে! আর সে এখন আমার জানালার বড় বকুলগাছটার নিচে বসে রয়েছে!”
অর্ণব তেমন-একটা ভয় না পেয়ে বললো, “চল তো তোমার রুমে গিয়ে দেখি।”
ওরা দুজন পা-টিপে-টিপে রুমটাতে প্রবেশ করলো। তারপর দুজনে খুব চুপিসারে রুমের লাইট না জ্বালিয়ে জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শায়লার এখন জানালার নিচে তাকানোর মতো কোনো সাহস অবশিষ্ট নাই। শুধু অর্ণব খুব সাবধানে জানালার কাছে গিয়ে চোখ মেললো—আর সে আবছা আঁধারেও দেখলো, সত্যি একটা লোক বসে রয়েছে বকুলগাছটার নিচে! আর তার পরনে সাদা ধবধবে পোশাক!
সেও কিছুটা ঘাবড়ে গেল। আর-একবার তাকে দেখার সাহস পেল না। এতো রাতে এখানে কোনো মানুষজনের আসার প্রশ্নই ওঠে না। তার কারণ, ওদের পুরা বাড়িটা দশফুট প্রাচীরে ঘেরা। এখানে, এতো রাতে মানুষ আসবে কীভাবে? চোর-ডাকাতের প্রবেশ করাটাও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ওরা দুজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই জানালাটার পাশে। আর এখান থেকে এইমুহূর্তে ওদের যে সরে যাওয়া উচিত—সেই হুঁশটুকু পর্যন্ত ওদের কারও নাই।
আবার খুব প্রচণ্ডভাবে বিদ্যুৎ চমকালো—আর তাতে দুই ভাইবোন একসঙ্গে এবার দেখলো—সেই যুবকটি তখনও সেখানে বসে রয়েছে। আর সে যেন খুব বিমর্ষ! আর তার শরীরটা যেন আলোর মতো! সে যেন এখন ঠিক রক্তমাংসের মানুষ নয়! আস্তে-আস্তে তার শরীরটা যেন ছায়ায় পরিণত হতে চলেছে!
আর তখনই বাইরে কোথাও প্রচণ্ড শব্দে একটা বাজ পড়লো। আর প্রচণ্ড বাজ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই এলাকার বিদ্যুৎ চলে গেল।
আর সেই সময় একটা ছায়ামূর্তি ওদের প্রায় গা-ঘেঁষে জানালা গলে প্রবেশ করলো শায়লার রুমে। এতে শায়লা চিৎকার না দিলেও ভয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওরা দেখলো—ছায়ামূর্তিটা দরজা পেরিয়ে প্যাসেজ অতিক্রম করে কোথায় যেন চলে গেল!
শায়লা ভয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। অর্ণব তবুও কিছুটা সাহসের সঙ্গে রুমের লাইটটা জ্বেলে দিলো। তারপর শায়লাকে পানি পান করালো। সবশেষে তাকে শুইয়ে দিলো ওর বিছানায়।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
নুর হোসেন ২৪/১১/২০১৯
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২৩/১১/২০১৯লিখে যান।
জীন দেখার খুব ইচ্ছা আছে দেখা হলে জিঞ্জাসা করতাম লোকে তোমায় এত ভয় পায় কেন?