খুব ভয়ের গল্প---বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (দ্বিতীয় পর্ব)
খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(দ্বিতীয় পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
ড্রইংরুমে কিছুক্ষণ বসেও কোনো শান্তি ও স্বস্তি না পাওয়ায় শায়লা আবার ফিরে এলো মায়ের রুমে। আবার সে মাকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে শায়লার মনের ভয়-ভয়-ভাব না কমলেও—তার স্নেহের পরশে সে কিছুটা আমোদিত হয়েছে। একসময় সে নিজে থেকে মাকে ছেড়ে দিলো। মায়ের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে একটু স্বাভাবিক-অবস্থায় ফিরিয়ে—সে মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। আসলে, সে খুব সুন্দর একটা মেয়ে। হাসলে তাকে আরও সুন্দর আরও মিষ্টি লাগে।
মেয়ের মনের ভয়-ভাবটা একটুখানি দূর হয়েছে—অনুমান করে রাশিদা বানু খুব খুশি হলেন। তারপর তিনি শায়লার দিকে গভীর মমতার চোখে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “চল তো মা, তোর রুমটা একবার দেখে আসি। আরও দেখে আসি—কোথায়-কোন্ ছায়ামূর্তি বসে আছে!”
আসলে, তিনি এভাবে ভয়ের বিষয়টিকে হালকা করে তুলতে চাইছেন। মেয়েটি যেন আর-কোনো ভয় না পায়—সেইজন্য এমন রসিকতার সুরে কথাগুলো বলেছেন। এমনিতে তাদের মধ্যে মধুর এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। সময়ে-অসময়ে তাদের মধ্যে হাসিঠাট্টাও চলে।
শায়লা মায়ের ভালোবাসায় খুব খুশি হয়ে বললো, “চলো, মামণি। তোমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিই।”
নিজের রুমটার কাছে এসে শায়লা খুব অবাক হলো—আর ঘাবড়ে গেল! আবার তার শরীরে ভয়ের কাঁপুনি দেখা দিলো! সে যা দেখলো—তাতে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না! তার বিছানার মাথার দিকের জানালাটা আবার কেউ খুলে রেখেছে! আর রুমের লাইটটাও এখন জ্বলছে না! কেউ যেন তা নিজের ইচ্ছায় বন্ধ করে রেখেছে!
সে খুব বিস্মিত হলো! কে তার রুমের লাইটটা বন্ধ করেছে! সে তো তখন ভয় পেয়ে একদৌড়ে মায়ের রুমে চলে গিয়েছিল। আর তখন তো লাইটটাও জ্বালানো অবস্থায় ছিল! আর তাদের কাজের মেয়ে মালেকার তো এদিকে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সে মাকে কিছু বলার আগে বিস্মিত হয়ে দৌড়ে ছোটভাই অর্ণবের রুমে ঢুকলো। সে হন্তদন্ত হয়ে ছোটভাইটিকে বললো, “ভাই, তুই কি একটু আগে আমার রুমে ঢুকেছিলি? আর কোনোকিছু খুঁজতে গিয়ে আমাকে না পেয়ে রুমের লাইটটা বন্ধ করেছিলি?”
বোনের মুখ থেকে এই কথাটা শুনে অর্ণব যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লো। আর সে হেসে বলে, “না, আপুনি, আমি তোমার রুমে একটু আগে কেন—আজ একবারও ঢুকিনি। আমি তো সেই কখন থেকে নিজের রুমে বসে পড়ছিলাম।”
তারপর সে বোনটিকে একটা বই দেখিয়ে বললো—এই দেখো, আমি এই বইটা পড়ছিলাম।
সে কী যেন ভেবেচিন্তে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বললো, “কিন্তু কেন? কী হয়েছে তোমার?”
শায়লা ও-কে আর-কিছু না বলে নিজের রুমে এসে দেখলো, ওর মামণি ওর রুমটা একটু গুছিয়ে দিচ্ছেন। আর মায়ের মমতার পরশে রুমটা খুব স্বল্পসময়ের মধ্যে সুন্দর ও ছিমছাম হয়ে উঠছে।
শায়লা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “মামণি, আমি সেই সময় ভয় পেয়ে দৌড়ে তোমার রুমে চলে গিয়েছিলাম, আর তখন আমার রুমের লাইটটা জ্বালানো-অবস্থায় ছিল। আর ওই জানালাটাও বন্ধ অবস্থায় ছিল। আর সেই ছায়ামূর্তিটাইতো ওটা বন্ধ করে দিয়েছিল! আর এখন দেখো—ওটা আবার হা-করে খোলা রয়েছে!
রাশিদা বানু এতোকিছু নিজের চোখে দেখেশুনেও খুব স্বাভাবিক থাকার ভান করে শায়লার দিকে তাকিয়ে আগের মতো হেসে বললেন, “হয়তো তুইই তাড়াহুড়ার সময়—আমার রুমে যাওয়ার আগে ভুল করে লাইটটা বন্ধ করেছিলি! আর এখন হয়তো তোর মনে নাই!”
শায়লা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললো, “আর জানালাটা? ওই জানালাটাও বুঝি আমি ভয় পেয়ে খুলে দিয়েছিলাম?”
মেয়ের কথা শুনে রাশিদা বানু বুঝলেন, তার ওপর মেয়েটির রাগ হয়েছে। সেইজন্য তিনি মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এই শহরে এতো ভয়ের কিছু নাই, মা। এখানে, কত আলো! কত মানুষ! এখানে, ওসব থাকে না।”
রাশিদা বানু আরও কিছুক্ষণ মেয়ের রুমে বসে থেকে বিদায় নিলেন।
শায়লার মনে হলো—তার মা যেন তার কাছ থেকে ইচ্ছে করে কোনোকিছু বা অনেককিছু লুকাচ্ছেন! কিন্তু কেন? আর মা কি কিছু জানেন নাকি? এসব ভেবে শায়লার মনে বিরাট এক প্রশ্নের উদ্রেক হলো। মায়ের আজ এইরকম ঠাণ্ডা ও নির্লিপ্তভাব দেখেই এটা তার মনে হচ্ছে।
রাশিদা বানু এই বাড়িটাতে ওঠার পর থেকে নিজেও অনেককিছু দেখেছেন। কিন্তু এসব জানাজানি হলে তার ছেলে-মেয়ে দুটো ভয় পেতে পারে মনে করে—এতোদিন তিনি কাউকে কিছুই বলেননি। এই বাড়িটা তার খুব পছন্দের। এতো সুন্দর বাড়ি তিনি আগে কখনো দেখেননি। মাঝে-মাঝে একটা ছায়া বা ছায়ামূর্তি বা মানুষের মতো একটা কাউকে তিনিও দেখেছেন। তবে তার কাছ থেকে তিনি এখনও কোনো হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখেননি। তবুও তিনি যখনই এই অশরীরী-আত্মাটাকে দেখেছেন—তখনই তার গায়ের সমস্ত লোমকে খাড়া হয়ে যেতে দেখেছেন। এজন্য তিনি একটা কাজের মেয়েকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন। এই বাড়িতে এখনও পর্যন্ত কারও-কোনো ক্ষতি না হলেও সবার যে সাবধানে থাকা উচিত—তা তিনিও মনে করেন। মেয়েটির বিষয় তাকে ভিতরে-ভিতরে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু তিনি এটা বাইরে প্রকাশ করলেন না।
নতুন বাড়িতে উঠে একদিন তিনি ভরদুপুরবেলা ছেলে-মেয়ে দুটোর জন্য কিছু ভাজাপিঠা বানাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন, ওরা বাড়িতে ফিরে বিকালে তা খেতে পারবে। বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। ছেলে-মেয়ে দুটো ছিল বাড়ির বাইরে—স্কুলে-ভার্সিটিতে। আর স্বামীও ব্যবসার কাজে। বাড়িতে তখন কাজের কোনো মানুষও ছিল না। এমন সময় পিঠা বানাতে-বানাতে হঠাৎ তার চোখদুটি রান্নাঘরের সামনের জানালাটা পেরিয়ে বাইরে গিয়ে পড়লো। আর তখনই তিনি দেখলেন, রান্নাঘরের সামনে খোলাজায়গাটায় চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটা যুবক দাঁড়িয়ে—তার দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে! যুবকটির দিকে তার চোখ পড়ামাত্র সে চোখের পলকে একটুকরা রোদের মতো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল! তিনি সঙ্গে-সঙ্গে জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, কোথাও কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না! সেই প্রথম—ভয়ে তিনি কেঁপে উঠেছিলেন। তারপর একটু পরে তিনি নিচে নেমে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—এইমাত্র বাড়ির ভিতরে কেউ ঢুকেছিল কিনা? দারোয়ান বলেছে—কেউ ঢোকেনি আম্মাজান। একথা শোনার পর ভয়ে তার গা-কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। আরও একদিন তিনি দেখেছিলেন—সেদিন অনেক রাত হয়ে গেলেও তার স্বামীর বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়েছিল—বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসময় তিনি স্বামীকে আসতে দেখে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছিলেন—হঠাৎ তার মনে হলো—কেউ যেন তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল! এসব কথা তিনি তার স্বামীকে এখনও বলেননি। তিনি এখন কী করবেন—আপনমনে শুধু তা-ই ভাবছেন—একটা সিদ্ধান্ত তিনি এখনও নিতে পারছেন না। এরই মধ্যে তার একমাত্র মেয়েটির সঙ্গে এমনকিছু ঘটছে—যা কোনোভাবেই অস্বীকার করবার কোনো জো নাই। এই বাড়িতে যে একটাকিছু আছে—সেটা তিনি বুঝতে পেরে কাউকে না-জানিয়ে—খুব গোপনে একটা হুজুর ডেকে এনে একদিন বাড়িটা বন্ধও করেছিলেন—তবুও এসব উৎপাত বন্ধ হচ্ছে না! হয়তো লোকটার আমল ভালো নয়। সেইজন্য তিনি আরেকটি হুজুর ডাকবার চিন্তাভাবনা করছেন।
রাশিদা বানু চলে যাওয়ার পর শায়লা নিজের পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আর সেখানে গিয়ে সে আরও বিস্মিত হলো! তার টেবিলে রাখা ‘দ্য টেমপেস্ট’ বইটার সাতাশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে! আর ওর মনে হলো—একটু আগে কেউ যেন এই বইটা পড়েছে! শায়লার বুকটা আবার ঢিপ-ঢিপ করতে থাকে! তবে এবার সে কাউকে ডাকলো না—কিংবা কারও কাছে আর ছুটেও গেল না। এইমুহূর্তে সে খুব নার্ভাস ও হতাশ হয়ে চেয়ারটা টেনে পড়ার টেবিলের সামনে বসে পড়লো। আর সে মনে করার চেষ্টা করলো—আজ বিকালে সে বইটি পড়েছিল কিনা!
মনের ভয় তাড়াবার জন্য—নিজের পড়ার টেবিলে বসে সে মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে লাগলো। কিন্তু অবাধ্য মন যেন আর পড়ায় বসতে চায় না। শুধু ওই ছায়ামূর্তিটার কথা তার মনে আসে!
নুসরাত হোসেন শায়লা ইংরেজি-সাহিত্যের ছাত্রী। তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড সায়েন্স। সে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বিজ্ঞানবিভাগের ছাত্রী ছিল। এখন আর বিজ্ঞানবিষয়ক বই তার তেমন-একটা পড়া হয় না। সে এখন বেশিরভাগ সময় হয় ইংরেজি-সাহিত্যের বই—আর নয়তো বাংলা বই পড়ে থাকে। সে এইমুহূর্তে শেক্সপীয়ারের ‘দ্য টেমপেস্ট’ পড়ায় খুব মনোসংযোগের চেষ্টা করছিল। পড়তে-পড়তে একসময় সে যেন একেবারে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল! আর নয়তো কেউ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল! কেমন-একটা মাতাল-মাতাল-ভাব লাগছিল তার!
এমন সময় তার বামদিকের—মানে, মাথার দিককার সেই জানালায় ‘ক্যাচ’ করে দুবার শব্দ হলো। আর সে চটজলদি বামদিকে ঘুরে দেখলো—তার সেই জানালার পাল্লা দুটো যেন আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে! সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে, কেউ যেন দুই হাত দিয়ে জানালার দুইটা পাল্লা খুলে দিচ্ছে! সেই সময় সে আবার দেখতে পেল ছায়ামূর্তিটাকে—আর সে জানালার ভিতর দিয়ে চোখের পলকে বাইরে চলে গেল! শায়লার পা-দুটো অবশ হয়ে আসার আগেই সে দৌড় শুরু করলো।
শায়লা এবার পড়ার টেবিল ছেড়ে পড়িমরি করে ভাইটার রুমে এসে ঢুকলো। কিন্তু সেখানে সে তার ছোটভাইটিকে পেল না। এতে সে ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে একদৌড়ে ড্রইংরুমে এসে দাঁড়ালো।
সে ড্রইংরুমের দেওয়ালের সঙ্গে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে ঘন-ঘন নিঃশ্বাস ফেলছিল। আর এইসময় তার ছোটভাই রাফসান হোসেন অর্ণব অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কী-একটা কাজ করছিল বলে—সে বোনের এই আতঙ্কগ্রস্ত চেহারাটা দেখতে পেল না। শায়লা যখন একটু শান্ত হয়ে সোফার ওপর বসতে যাচ্ছিলো—তখন অর্ণবের চোখ পড়লো তার ওপর।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(দ্বিতীয় পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
ড্রইংরুমে কিছুক্ষণ বসেও কোনো শান্তি ও স্বস্তি না পাওয়ায় শায়লা আবার ফিরে এলো মায়ের রুমে। আবার সে মাকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে শায়লার মনের ভয়-ভয়-ভাব না কমলেও—তার স্নেহের পরশে সে কিছুটা আমোদিত হয়েছে। একসময় সে নিজে থেকে মাকে ছেড়ে দিলো। মায়ের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে একটু স্বাভাবিক-অবস্থায় ফিরিয়ে—সে মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। আসলে, সে খুব সুন্দর একটা মেয়ে। হাসলে তাকে আরও সুন্দর আরও মিষ্টি লাগে।
মেয়ের মনের ভয়-ভাবটা একটুখানি দূর হয়েছে—অনুমান করে রাশিদা বানু খুব খুশি হলেন। তারপর তিনি শায়লার দিকে গভীর মমতার চোখে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “চল তো মা, তোর রুমটা একবার দেখে আসি। আরও দেখে আসি—কোথায়-কোন্ ছায়ামূর্তি বসে আছে!”
আসলে, তিনি এভাবে ভয়ের বিষয়টিকে হালকা করে তুলতে চাইছেন। মেয়েটি যেন আর-কোনো ভয় না পায়—সেইজন্য এমন রসিকতার সুরে কথাগুলো বলেছেন। এমনিতে তাদের মধ্যে মধুর এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। সময়ে-অসময়ে তাদের মধ্যে হাসিঠাট্টাও চলে।
শায়লা মায়ের ভালোবাসায় খুব খুশি হয়ে বললো, “চলো, মামণি। তোমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিই।”
নিজের রুমটার কাছে এসে শায়লা খুব অবাক হলো—আর ঘাবড়ে গেল! আবার তার শরীরে ভয়ের কাঁপুনি দেখা দিলো! সে যা দেখলো—তাতে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না! তার বিছানার মাথার দিকের জানালাটা আবার কেউ খুলে রেখেছে! আর রুমের লাইটটাও এখন জ্বলছে না! কেউ যেন তা নিজের ইচ্ছায় বন্ধ করে রেখেছে!
সে খুব বিস্মিত হলো! কে তার রুমের লাইটটা বন্ধ করেছে! সে তো তখন ভয় পেয়ে একদৌড়ে মায়ের রুমে চলে গিয়েছিল। আর তখন তো লাইটটাও জ্বালানো অবস্থায় ছিল! আর তাদের কাজের মেয়ে মালেকার তো এদিকে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সে মাকে কিছু বলার আগে বিস্মিত হয়ে দৌড়ে ছোটভাই অর্ণবের রুমে ঢুকলো। সে হন্তদন্ত হয়ে ছোটভাইটিকে বললো, “ভাই, তুই কি একটু আগে আমার রুমে ঢুকেছিলি? আর কোনোকিছু খুঁজতে গিয়ে আমাকে না পেয়ে রুমের লাইটটা বন্ধ করেছিলি?”
বোনের মুখ থেকে এই কথাটা শুনে অর্ণব যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লো। আর সে হেসে বলে, “না, আপুনি, আমি তোমার রুমে একটু আগে কেন—আজ একবারও ঢুকিনি। আমি তো সেই কখন থেকে নিজের রুমে বসে পড়ছিলাম।”
তারপর সে বোনটিকে একটা বই দেখিয়ে বললো—এই দেখো, আমি এই বইটা পড়ছিলাম।
সে কী যেন ভেবেচিন্তে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বললো, “কিন্তু কেন? কী হয়েছে তোমার?”
শায়লা ও-কে আর-কিছু না বলে নিজের রুমে এসে দেখলো, ওর মামণি ওর রুমটা একটু গুছিয়ে দিচ্ছেন। আর মায়ের মমতার পরশে রুমটা খুব স্বল্পসময়ের মধ্যে সুন্দর ও ছিমছাম হয়ে উঠছে।
শায়লা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “মামণি, আমি সেই সময় ভয় পেয়ে দৌড়ে তোমার রুমে চলে গিয়েছিলাম, আর তখন আমার রুমের লাইটটা জ্বালানো-অবস্থায় ছিল। আর ওই জানালাটাও বন্ধ অবস্থায় ছিল। আর সেই ছায়ামূর্তিটাইতো ওটা বন্ধ করে দিয়েছিল! আর এখন দেখো—ওটা আবার হা-করে খোলা রয়েছে!
রাশিদা বানু এতোকিছু নিজের চোখে দেখেশুনেও খুব স্বাভাবিক থাকার ভান করে শায়লার দিকে তাকিয়ে আগের মতো হেসে বললেন, “হয়তো তুইই তাড়াহুড়ার সময়—আমার রুমে যাওয়ার আগে ভুল করে লাইটটা বন্ধ করেছিলি! আর এখন হয়তো তোর মনে নাই!”
শায়লা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললো, “আর জানালাটা? ওই জানালাটাও বুঝি আমি ভয় পেয়ে খুলে দিয়েছিলাম?”
মেয়ের কথা শুনে রাশিদা বানু বুঝলেন, তার ওপর মেয়েটির রাগ হয়েছে। সেইজন্য তিনি মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এই শহরে এতো ভয়ের কিছু নাই, মা। এখানে, কত আলো! কত মানুষ! এখানে, ওসব থাকে না।”
রাশিদা বানু আরও কিছুক্ষণ মেয়ের রুমে বসে থেকে বিদায় নিলেন।
শায়লার মনে হলো—তার মা যেন তার কাছ থেকে ইচ্ছে করে কোনোকিছু বা অনেককিছু লুকাচ্ছেন! কিন্তু কেন? আর মা কি কিছু জানেন নাকি? এসব ভেবে শায়লার মনে বিরাট এক প্রশ্নের উদ্রেক হলো। মায়ের আজ এইরকম ঠাণ্ডা ও নির্লিপ্তভাব দেখেই এটা তার মনে হচ্ছে।
রাশিদা বানু এই বাড়িটাতে ওঠার পর থেকে নিজেও অনেককিছু দেখেছেন। কিন্তু এসব জানাজানি হলে তার ছেলে-মেয়ে দুটো ভয় পেতে পারে মনে করে—এতোদিন তিনি কাউকে কিছুই বলেননি। এই বাড়িটা তার খুব পছন্দের। এতো সুন্দর বাড়ি তিনি আগে কখনো দেখেননি। মাঝে-মাঝে একটা ছায়া বা ছায়ামূর্তি বা মানুষের মতো একটা কাউকে তিনিও দেখেছেন। তবে তার কাছ থেকে তিনি এখনও কোনো হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখেননি। তবুও তিনি যখনই এই অশরীরী-আত্মাটাকে দেখেছেন—তখনই তার গায়ের সমস্ত লোমকে খাড়া হয়ে যেতে দেখেছেন। এজন্য তিনি একটা কাজের মেয়েকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন। এই বাড়িতে এখনও পর্যন্ত কারও-কোনো ক্ষতি না হলেও সবার যে সাবধানে থাকা উচিত—তা তিনিও মনে করেন। মেয়েটির বিষয় তাকে ভিতরে-ভিতরে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু তিনি এটা বাইরে প্রকাশ করলেন না।
নতুন বাড়িতে উঠে একদিন তিনি ভরদুপুরবেলা ছেলে-মেয়ে দুটোর জন্য কিছু ভাজাপিঠা বানাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন, ওরা বাড়িতে ফিরে বিকালে তা খেতে পারবে। বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। ছেলে-মেয়ে দুটো ছিল বাড়ির বাইরে—স্কুলে-ভার্সিটিতে। আর স্বামীও ব্যবসার কাজে। বাড়িতে তখন কাজের কোনো মানুষও ছিল না। এমন সময় পিঠা বানাতে-বানাতে হঠাৎ তার চোখদুটি রান্নাঘরের সামনের জানালাটা পেরিয়ে বাইরে গিয়ে পড়লো। আর তখনই তিনি দেখলেন, রান্নাঘরের সামনে খোলাজায়গাটায় চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটা যুবক দাঁড়িয়ে—তার দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে! যুবকটির দিকে তার চোখ পড়ামাত্র সে চোখের পলকে একটুকরা রোদের মতো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল! তিনি সঙ্গে-সঙ্গে জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, কোথাও কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না! সেই প্রথম—ভয়ে তিনি কেঁপে উঠেছিলেন। তারপর একটু পরে তিনি নিচে নেমে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—এইমাত্র বাড়ির ভিতরে কেউ ঢুকেছিল কিনা? দারোয়ান বলেছে—কেউ ঢোকেনি আম্মাজান। একথা শোনার পর ভয়ে তার গা-কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। আরও একদিন তিনি দেখেছিলেন—সেদিন অনেক রাত হয়ে গেলেও তার স্বামীর বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়েছিল—বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসময় তিনি স্বামীকে আসতে দেখে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছিলেন—হঠাৎ তার মনে হলো—কেউ যেন তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল! এসব কথা তিনি তার স্বামীকে এখনও বলেননি। তিনি এখন কী করবেন—আপনমনে শুধু তা-ই ভাবছেন—একটা সিদ্ধান্ত তিনি এখনও নিতে পারছেন না। এরই মধ্যে তার একমাত্র মেয়েটির সঙ্গে এমনকিছু ঘটছে—যা কোনোভাবেই অস্বীকার করবার কোনো জো নাই। এই বাড়িতে যে একটাকিছু আছে—সেটা তিনি বুঝতে পেরে কাউকে না-জানিয়ে—খুব গোপনে একটা হুজুর ডেকে এনে একদিন বাড়িটা বন্ধও করেছিলেন—তবুও এসব উৎপাত বন্ধ হচ্ছে না! হয়তো লোকটার আমল ভালো নয়। সেইজন্য তিনি আরেকটি হুজুর ডাকবার চিন্তাভাবনা করছেন।
রাশিদা বানু চলে যাওয়ার পর শায়লা নিজের পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আর সেখানে গিয়ে সে আরও বিস্মিত হলো! তার টেবিলে রাখা ‘দ্য টেমপেস্ট’ বইটার সাতাশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে! আর ওর মনে হলো—একটু আগে কেউ যেন এই বইটা পড়েছে! শায়লার বুকটা আবার ঢিপ-ঢিপ করতে থাকে! তবে এবার সে কাউকে ডাকলো না—কিংবা কারও কাছে আর ছুটেও গেল না। এইমুহূর্তে সে খুব নার্ভাস ও হতাশ হয়ে চেয়ারটা টেনে পড়ার টেবিলের সামনে বসে পড়লো। আর সে মনে করার চেষ্টা করলো—আজ বিকালে সে বইটি পড়েছিল কিনা!
মনের ভয় তাড়াবার জন্য—নিজের পড়ার টেবিলে বসে সে মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে লাগলো। কিন্তু অবাধ্য মন যেন আর পড়ায় বসতে চায় না। শুধু ওই ছায়ামূর্তিটার কথা তার মনে আসে!
নুসরাত হোসেন শায়লা ইংরেজি-সাহিত্যের ছাত্রী। তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড সায়েন্স। সে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বিজ্ঞানবিভাগের ছাত্রী ছিল। এখন আর বিজ্ঞানবিষয়ক বই তার তেমন-একটা পড়া হয় না। সে এখন বেশিরভাগ সময় হয় ইংরেজি-সাহিত্যের বই—আর নয়তো বাংলা বই পড়ে থাকে। সে এইমুহূর্তে শেক্সপীয়ারের ‘দ্য টেমপেস্ট’ পড়ায় খুব মনোসংযোগের চেষ্টা করছিল। পড়তে-পড়তে একসময় সে যেন একেবারে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল! আর নয়তো কেউ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল! কেমন-একটা মাতাল-মাতাল-ভাব লাগছিল তার!
এমন সময় তার বামদিকের—মানে, মাথার দিককার সেই জানালায় ‘ক্যাচ’ করে দুবার শব্দ হলো। আর সে চটজলদি বামদিকে ঘুরে দেখলো—তার সেই জানালার পাল্লা দুটো যেন আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে! সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে, কেউ যেন দুই হাত দিয়ে জানালার দুইটা পাল্লা খুলে দিচ্ছে! সেই সময় সে আবার দেখতে পেল ছায়ামূর্তিটাকে—আর সে জানালার ভিতর দিয়ে চোখের পলকে বাইরে চলে গেল! শায়লার পা-দুটো অবশ হয়ে আসার আগেই সে দৌড় শুরু করলো।
শায়লা এবার পড়ার টেবিল ছেড়ে পড়িমরি করে ভাইটার রুমে এসে ঢুকলো। কিন্তু সেখানে সে তার ছোটভাইটিকে পেল না। এতে সে ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে একদৌড়ে ড্রইংরুমে এসে দাঁড়ালো।
সে ড্রইংরুমের দেওয়ালের সঙ্গে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে ঘন-ঘন নিঃশ্বাস ফেলছিল। আর এইসময় তার ছোটভাই রাফসান হোসেন অর্ণব অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কী-একটা কাজ করছিল বলে—সে বোনের এই আতঙ্কগ্রস্ত চেহারাটা দেখতে পেল না। শায়লা যখন একটু শান্ত হয়ে সোফার ওপর বসতে যাচ্ছিলো—তখন অর্ণবের চোখ পড়লো তার ওপর।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২২/১১/২০১৯অসাধারণ নিবেদন। চলতে থাকুক।