খুব ভয়ের গল্প---বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (প্রথম পর্ব)
খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(প্রথম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
বাসা থেকে আজও খুব তাড়াহুড়া করে বের হয়েছে শায়লা। আর তাদের বিল্ডিংয়ের গেইটটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতো সে তার ব্যাগের জিনিসপত্র দেখেশুনে নিচ্ছিলো—সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে কিনা। আজ তার খুব সকালে ক্লাস। এই আটটার ক্লাস ধরতে তার খুব কষ্ট হয়। আর প্রায় প্রতিদিনই তাকে এভাবে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটা ধরার জন্য ছুটতে হয়।
আর যেদিন সে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি হাতছাড়া করে, মানে ধরতে পারে না—সেদিন যাত্রাবাড়ির মতো একটা জায়গা থেকে শাহবাগে আসতে তাকে অনেকরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়। তবে সে এই দুই-বছরে এসবে কিছুটা অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
শায়লা বাসস্ট্যান্ডে আসার আগে বুঝলো: কেউ যেন তাকে ফলো করছে। সে আজ খুব ঘাবড়ে গেল। দুই-তিন সপ্তাহ যাবৎ সে এইরকম দেখছে। তার কাছে মনে হয়: কেউ-একজন তাকে সবসময় ফলো করছে। আর এটা হয় সে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই। আর সে যখন ক্লাস শেষ করে বিকালে কিংবা সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফেরে তখনও এইরকম হয়। আর তখন তার কেবলই মনে হয়: সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নামার পরপরই কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু সে এখনও তাকে দেখতে পায়নি। ইদানীং সে এইরকম কাণ্ডকারখানা দেখে একটু ভয়ই পাচ্ছে। আসলে, সত্য বলতে কী—তার মনে এখন ভয়ই ধরে গেছে। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারে না—কে যে তাকে নিয়মিত এভাবে ফলো করছে। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে—এই কিছুদিন হলো কেউ-একজন সবসময় ছায়ামূর্তির মতো তাকে অনুসরণ করছে। তার কাছাকাছিই সে হাঁটছে। এটা সে সজ্ঞানে স্পষ্টভাবে-অনুভবে বুঝতে পারে। কিন্তু তাকে সে কখনো দেখতে পায় না। আর সে তাকে এখনও ঝাপসা-মতো একবারও দেখতে পায়নি কিংবা অনুভবেও কিছুটা চিনতে পারেনি। এসব আজকাল কী অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হয় তার কাছে! সে আজ হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ পিছনফিরে একবার তাকালো—কিন্তু সে সে-রকম কাউকে আশেপাশে দেখলো না। কিন্তু সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো—কেউ তাকে এখন দেখছে বা অনুসরণ করছে। হঠাৎ তার মনে বিরাট এক প্রশ্ন জাগে: কে সে? আর সে কেনই-বা তার সঙ্গে এমনটি করছে? এসব ভাবতে-ভাবতে তার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তার একবার মনে হলো: সে বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যে তার গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস রয়েছে! শেষমেশ সে ভার্সিটিতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়।
শায়লা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসও চলে এলো। আর সে যখন বাসে উঠতে যাবে, তখন তার মনে হলো: কেউ-একজন তার গা-ঘেঁষে যেন দাঁড়িয়েছে! সে ঘাড় বেঁকিয়ে দ্রুত পিছনে তাকাতেই আগের মতো কাউকেই আর দেখতে পেল না। সে দ্রুত বাসে উঠে পড়লো। এখন তার মনে হলো: কেউ তাকে অনুসরণ করছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার সময় শায়লার কখনো এরকম মনে হয় না। তখন কেউ তার পাশে থাকে না। আর তখন সে বেশ নিরাপদেই থাকে। কিন্তু তাদের বাসার আশপাশটা জুড়ে কেউ-একজন যেন তাকে সবসময় অনুসরণ করে থাকে। ইদানীং এইরকম একটি অস্বস্তিতে ভুগছে শায়লা। বিষয়টি এখনও পর্যন্ত সে কাউকেই বলেনি। আর এটা তো বলার মতো কোনো ঘটনাও নয়। সে তো আজ পর্যন্ত কাউকে তার পিছনে আসতে দেখেনি—কিংবা ঘুর-ঘুর করতেও দেখেনি। এসব ভেবেই সে কাউকে কিছু না বলে নিজের মনে একটি হিসাব কষতে থাকে? কে হতে পারে সে? কে সে? আর কেনই-বা সে তার সঙ্গে এমনটি করছে?
শায়লারা যাত্রাবাড়ি-এলাকায় বাস করছে দুই বৎসর যাবৎ। তার বাবা এখানে ব্যবসা করেন। এই জায়গাটা তাদের ভালো না-লাগলেও এখন ভালো লাগাতেই হবে। কারণ, মাসখানেক আগে তার বাবা এই এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য একটি দোতলা-বাড়ি কিনে তাতে উঠে পড়েছেন। এর আগে তারা এই যাত্রাবাড়ির আশেপাশে ভাড়া থাকতো।
এই বাড়িটা এখন তাদের সবারই পছন্দ হয়েছে। এটি কোনো বহুতল ভাড়া-বাণিজ্যের বিল্ডিং নয়। এটি ভদ্রলোকের বসবাসের উপযোগী একটি মনোরম-ছিমছাম বাড়ি। এটি অনেক সুন্দর ডিজাইনের একটি ডুপ্লেক্স-বিল্ডিং। এর ভিতরের দিকটা অনেক বেশি সুন্দর। আর বাইরের দিকটা তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। এইজন্য বাড়িটা এখন ওদের সবার পছন্দের।
এতবড় একটা বাড়ি—কিন্তু মানুষজন একেবারেই কম! সর্বসাকুল্যে এই বাড়িটাতে মাত্র পাঁচজন মানুষ বসবাস করছে। শায়লা, তার একটিমাত্র ভাই, তার বাবা-মা, আর বারো-তোরো বছরের একটি কাজের মেয়ে। অবশ্য তাদের বাড়িটাতে একজন দারোয়ানও আছে। কিন্তু সে তো চব্বিশঘণ্টাই বাড়ির বাইরে থাকে। তাই, সবারই একটু ভয়-ভয় লাগার কথা। বিশেষত রাতের বেলা প্রথম-প্রথম ওদের সবারই কেমন যেন গা ছম ছম করতো। এখন অবশ্য কিছুটা সয়ে গেছে। তারপরও...।
শায়লার একমাত্র ছোট ভাইটি ক্লাস নাইনে পড়ে। বাড়ি থেকে তার স্কুলটাও খুব বেশি দূরে নয়। শায়লার বাবা মোসাদ্দেক হোসেনের ব্যবসাটাও এখানে। তাই, এখন তাদের মনটা পুরাপুরি এই বাড়িটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এতবড় একটা বাড়ি! আর তাদের মানুষজনও একেবারে কম। ওর বাবা প্রায় সারাটা দিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। ওদের একেকজনের সময় একভাবে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের মায়ের সময় আর কাটতে চাইতো না। তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়িটাতে একাই থাকতেন। তার ভয়-ভয় লাগলেও তিনি তা বাইরে কখনো প্রকাশ করতেন না। এতে তাদের ছেলে-মেয়ে দুটো আরও বেশি ভয় পাবে যে! কিন্তু বাড়িতে একটা কাজের মেয়েও দরকার। এজন্য তিনি সম্প্রতি গ্রাম থেকে একটি কিশোরীমেয়েকে কাজের জন্য এখানে এনেছেন। ওর বয়স বারো কি তেরো। গ্রামের মেয়ে তো—জন্মের সময় ওর বাপ-মা ওর জন্মতারিখটা লিখে রাখেনি। তাই, ওর বয়সের সঠিক হিসাবও নাই। এই মেয়েটি আসায় তবুও শায়লার মা রাশিদা বানু একজন কথা বলার মানুষ পেয়েছেন। নইলে তাকে আগের মতো সারাদিন বোবা হয়ে থাকতে হতো। এখন অবসরে তিনি টিভি দেখার পাশাপাশি বিশাল ছাদ-বাগানের পরিচর্যা করে সময় কাটান।
শায়লাদের এই নতুন বাড়িটা অনেক বড়। এখানে, দশ-কাঠারও একটু বেশি জমি আছে। আর বিল্ডিংটা তৈরি হয়েছে পুরো পাঁচ-কাঠার ওপরে। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, বাড়িটা কোনো খানদানি লোক তৈরি করেছিলেন—দীর্ঘদিন খুব আরামআয়েশে বসবাসের জন্য। আর নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ এটা বিক্রি করে না। বাড়িটার দামও উঠেছিল অনেক! প্রথমে আড়াই কোটি টাকা! পরে অনেক আপসরফার পরে শায়লার বাবা স্থানীয় একজন অধিবাসীর সহায়তায় এটি দুই কোটি টাকায় কিনে নেন। উপরের ছাদ আর বাইরের অংশটুকু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বিল্ডিংটা একেবারে দামি পাথরে মোজাইক করা। এর ভিতরটা এখনও একেবারে ঝকঝকে-তকতকে। আয়নার মতো পরিষ্কার। এটা দেখলে যে-কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে।
শায়লার মা রাশিদা বানু এই দুই মাসে যত্ন করে এটাকে আরও ঝকঝকে-তকতকে করে তুলেছেন। বাড়িটা কেনার সময় শায়লার বাবা শুনেছিলেন, বাড়িটা নাকি মাত্র দুই বছর আগে তৈরি করা হয়েছে। সেইজন্য তার আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাড়িটা একেবারে নতুন। ছেলে-মেয়েদের মতো বাড়িটার প্রতি এখন তারও খুব মায়া জন্মেছে।
আজ বিকালের একটু আগেই শায়লা বাসার কাছে বাস্ট্যান্ডে এসে নামলো। আর তখনই তার মনে হলো: কেউ-একজন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! এতে সে ভয়ানকভাবে চমকে উঠলো। সে খুব ভয় পেয়ে চারিদিকে তাকালো। কিন্তু সে কাউকে তার আশেপাশে দেখলো না। এতে তার ভয়ের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। এইমুহূর্তে একজন মানুষের বাস্তব-উপস্থিতি সে টের পেয়েছে। শুধু তাকে চোখে দেখতে পায়নি—এই যা। সে দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের বিল্ডিংয়ের কাছে আসতেই তাদের বাড়ির দারোয়ান ইসমাইল তাকে দেখে বেশ হাসি-হাসি মুখে গেইটটা খুলে দিলো। আর শায়লা তখন অনুভব করলো—এখনও কেউ-একজন তার পাশে আছে!
বাড়ির ভিতরে ঢুকে সে দ্রুত সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তারপর সে তাড়াতাড়ি হেঁটে নিজের রুমে এসে ঢুকলো। আর সে অস্থিরভাবে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এখন তার বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু ভয়টা মন থেকে একেবারে যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ পর সে বিছানা ছেড়ে নিজের বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। আর হয়তো ভাবলো: বিকালে শান্তস্নিগ্ধ বাতাসে দাঁড়ালে তার মনের অস্বস্তি-ভাবটাও কেটে যাবে। সে বারান্দায় প্রবেশের আগেই দেখলো: বারান্দাটা ভিজে। তার মনে পড়লো—দুপুর তিনটার দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আর তখন সে ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ক্লাসে ব্যস্ত ছিল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে আরও দেখলো—তার সকালের ভিজে কাপড়চোপড়গুলো শুকানোর পর বৃষ্টির আগেই ঘরে এনে খুব সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। সে মনে মনে খুশি হলো। আর সবিস্ময়ে ভাবলো: কাজের মেয়েটা তাহলে বেশ ভালো তো! কোনোকিছু বলার আগেই তার সবদিকে খেয়াল থাকে।
সে মায়ের রুমে ঢুকে দেখলো, তার মা কাজের মেয়েটার সঙ্গে রাতের রান্নার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। এমন সময় তাকে দেখে তারা দুজনেই হাসলো।
শায়লা কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বেশ স্নেহের সুরে বললো, “মালেকা, কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টির সময় আমার বারান্দার কাপড়চোপড়গুলো তুই রুমের ভিতরে এনে রেখেছিলি?”
কিন্তু সে কোনো কথা বললো না। শুধু মাথানিচু করে সভয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
এমন সময় তার মা বললেন, “বেচারী আজ দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর তখনই বৃষ্টিটা আসে। তাই, ও তোর কাপড়চোপড়গুলো আর ভিতরে আনতে পারেনি। তাই কী হয়েছে মা, একটু পরে ভিজে কাপড়গুলো বাতাসেই শুকিয়ে যাবে!”
মায়ের কথা শুনে শায়লা আরও ভয় পেয়ে যায়। তাদের বাড়িতে ওই বৃষ্টির সময় তার মা আর কাজের মেয়ে মালেকা নুরী ছাড়া তো আর কেউ ছিল না। তবে কে তার কাপড়চোপড়গুলো বৃষ্টি আসার আগে এমন সুন্দরভাবে ভাঁজ করে তার খাটের একপাশে রাখলো! এখন তার রুমে ঢুকতেও ভয় করছে। কিন্তু তবুও সে কাউকে কিছু বলতে পারলো না। সবাই কী ভাববে?
শায়লা ভাবছে—এটা বুঝি তার মনের কোনো ভুল। কিন্তু পরক্ষণেই তার স্পষ্টভাবে মনে হলো: আজ সকালে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মতো গোসল করেছে, নিজের হাতে তার ভিজা কাপড়চোপড়গুলো বারান্দার তারে ছড়ায়ে দিয়েছে! কী আশ্চর্য এখন তা একেবারে শুকনো অবস্থায় তার ঘরে! সে এখন বিস্মিত আর চিন্তিত। সে একটু ভয়ে-ভয়ে আবার নিজের রুমে এসে ঢুকলো। তারপর তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে ফোন করলো। তার এই বান্ধবীটি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী।
বান্ধবীকে ফোনে পেয়ে শায়লা একনাগাড়ে সব ঘটনা তাকে খুলে বললো। আর এসব শুনে ওপাশ থেকে তার সেই বান্ধবী প্রায় উচ্চশব্দে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড় করে বললো, “এসব তোর মনের ভুল। তুই হয়তো কোনো কারণে আজ খুব চিন্তিত—কিংবা এমন কোনো কারণে আপসেট। আর নয়তো অন্যকোনো কারণে তোর মনটা ভীষণ খারাপ। তাই, তোর এসব মনে হচ্ছে। আর তুই কিন্তু সকালে গোসল করিসনি। এটা তোর মনের ভুল। আর তোর কাপড়চোপড়গুলো তুই ভার্সিটিতি যাওয়ার আগে নিজেই ভাঁজ করে রেখে গিয়েছিস। তোর...।”
বান্ধবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো শায়লা। আর তার মনে হলো—তার এই বান্ধবীটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আহাম্মক! নইলে, সে এভাবে তার জীবনের সত্যকে মিথ্যা বানানোর গভীর একটা ষড়যন্ত্র করবে কেন? এখনও তার সুস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে: সে আজ সকালেও প্রতিদিনের মতো নিয়মমাফিক গোসল করেছে। আর সে নিজের হাতে তার পরিধানের ভিজা কাপড়চোপড়গুলো বারান্দায় শুকাতে দিয়ে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে। এখানে, ভুল হওয়ার তো কোনো সুযোগ নাই। আর সে কিনা বলছে—এটা তার মনের ভুল! সে তার এই বান্ধবীটাকে আদ্যিকালের কোনো-একটা গাধা মনে করলো।
শায়লার সেই বান্ধবী কিছুক্ষণ পর-পর বেশ কয়েকবার ফোন করলো তাকে—তার অসমাপ্ত কথা শোনাবার জন্য। কিন্তু শায়লা একটিবারের জন্যও তার ফোন রিসিভ করলো না। সে বুঝে গেছে: এর এসব আবোলতাবোল কথা শোনা মানে নিজের সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করা।
শায়লার এখন মনে হচ্ছে: এসব পাগলের সঙ্গে কথা বলা মানে বৃথা সময় নষ্ট। তার চেয়ে নিজে কিছু ভাবলে বরং একটা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যার একটু আগে আবার শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। আর সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি! আর শায়লার মনে হলো—এমন বৃষ্টির ফোঁটায় যেন জানালার কাচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে! সে শুয়ে-শুয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ পড়ছিল। আর সে পড়তে-পড়তে তন্ময় হয়ে কতকিছু ভাবছিল। এমন সময় বৃষ্টির ছ্যাঁচা তার মাথার দিকের জানালাভেদ করে আসছিল। সে বিছানা থেকে উঠে জানালাটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় সে স্পষ্টভাবে দেখলো—সে ওঠার আগেই একটি ছায়ামূর্তি জানালাটা আটকিয়ে দিলো। একনিমিষে তার চক্ষু দুটো একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। সে তার নিজের চোখ দুটোকে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কী ঘটলো! আর এটা কী হলো? এইমাত্র সে নিজের চোখে দেখেছে, একটি ছায়ামূর্তি তার রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিলো! সে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে—সে একজন যুবক। আর তারমধ্যে কোনো হিংস্রভাব ছিল না—যেন সেও এই ঘরের নিয়মিত বাসিন্দা—এমনইভাবে সে এসে তার রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
এমন তাজ্জব বনে যাওয়া ও বিস্ময়কর ঘটনা তার জীবনে এর আগে আর-কখনো ঘটেনি। সে কিছুক্ষণ একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।
ছায়ামূর্তিটা এখন আর নাই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে চলে গিয়েছে। কিন্তু শায়লা ভয়ে এখনও কাঁপছে। তার কণ্ঠ দিয়ে এইমুহূর্তে কোনো কথা বের হলো না। সে খুব ভয় পেয়েছে। আর মানুষ খুব ভয় পেলে নাকি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। শায়লারও এখন সেই অবস্থা।
ভাগ্যিস, এইসময় বজ্রপাত হওয়াসত্ত্বেও বিদ্যুৎ চলে যায়নি। তাইলে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে আরও অসহায় হয়ে পড়তো।
কিছুক্ষণ পরে শায়লা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। আস্তে-আস্তে সে কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে। আর সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই একদৌড়ে মায়ের রুমে ঢুকলো। তার মা তখন মাগরিবের নামাজ পড়ে সবেমাত্র জায়নামাজ গুছিয়ে উঠছেন। এইসময় সে তার মায়ের রুমে হুড়মুড় করে ঢুকে ছোট্ট শিশুর মতো মাকে জড়িয়ে ধরলো। তার মা ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতে না পেরে মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বেশ স্বাভাবিকণ্ঠেই বললেন, “কী হয়েছে মা? কী হয়েছে তোর? আর তোকে এত অস্থির লাগছে কেন?”
শায়লা আগের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, আমি হঠাৎ খুব ভয় পেয়েছি।”
রাশিদা বানু এবার সবিস্ময়ে বললেন, “কেন মা—কী হয়েছে? আমাকে সব খুলে বল তো। আর এক গেলাস পানি খা। ভয় পেলে পানি খেতে হয়।”
শায়লা মায়ের এনে দেওয়া এক গেলাস পানি শেষ করেও মাকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
শায়লা সবকিছু না বলে শুধু অস্ফুটস্বরে বললো, “মা, আমার রুমের উত্তরদিকের জানালার পাশে মানুষের একটা ছায়ার মতোন দেখেছি।”
একথা শুনে তার মা একটুখানি হেসে বললেন, “ও কিছু নয়। বৃষ্টির দিন তো—তাই এরকম মনে হয়। আর তোর মাথার কাছের ওই জানালাটার পাশে তো সবসময় একটু আঁধার-আঁধার থাকে।”
শায়লা আর-কিছু বলে না। সে এবার বুঝতে পেরেছে, সবাই হয়তো এসব এখনও টের পায়নি। তাই, এখন তাদের এসব বুঝাতে যাওয়াটাই বৃথা। সে মাকে ছেড়ে টিভির রুমে এসে বসলো। সেখানে ওর ছোটভাই অর্ণব বসে টিভি দেখছে আর পড়ছে।
সে সোফার একপাশে চুপচাপ বসে রইলো। তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। আর মনের মধ্যে বারবার সেই ছায়ামূর্তিটা উঁকি দিতে লাগলো।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(প্রথম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
বাসা থেকে আজও খুব তাড়াহুড়া করে বের হয়েছে শায়লা। আর তাদের বিল্ডিংয়ের গেইটটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতো সে তার ব্যাগের জিনিসপত্র দেখেশুনে নিচ্ছিলো—সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে কিনা। আজ তার খুব সকালে ক্লাস। এই আটটার ক্লাস ধরতে তার খুব কষ্ট হয়। আর প্রায় প্রতিদিনই তাকে এভাবে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটা ধরার জন্য ছুটতে হয়।
আর যেদিন সে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি হাতছাড়া করে, মানে ধরতে পারে না—সেদিন যাত্রাবাড়ির মতো একটা জায়গা থেকে শাহবাগে আসতে তাকে অনেকরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়। তবে সে এই দুই-বছরে এসবে কিছুটা অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
শায়লা বাসস্ট্যান্ডে আসার আগে বুঝলো: কেউ যেন তাকে ফলো করছে। সে আজ খুব ঘাবড়ে গেল। দুই-তিন সপ্তাহ যাবৎ সে এইরকম দেখছে। তার কাছে মনে হয়: কেউ-একজন তাকে সবসময় ফলো করছে। আর এটা হয় সে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই। আর সে যখন ক্লাস শেষ করে বিকালে কিংবা সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফেরে তখনও এইরকম হয়। আর তখন তার কেবলই মনে হয়: সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নামার পরপরই কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু সে এখনও তাকে দেখতে পায়নি। ইদানীং সে এইরকম কাণ্ডকারখানা দেখে একটু ভয়ই পাচ্ছে। আসলে, সত্য বলতে কী—তার মনে এখন ভয়ই ধরে গেছে। কিন্তু সে এখনও বুঝতে পারে না—কে যে তাকে নিয়মিত এভাবে ফলো করছে। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে—এই কিছুদিন হলো কেউ-একজন সবসময় ছায়ামূর্তির মতো তাকে অনুসরণ করছে। তার কাছাকাছিই সে হাঁটছে। এটা সে সজ্ঞানে স্পষ্টভাবে-অনুভবে বুঝতে পারে। কিন্তু তাকে সে কখনো দেখতে পায় না। আর সে তাকে এখনও ঝাপসা-মতো একবারও দেখতে পায়নি কিংবা অনুভবেও কিছুটা চিনতে পারেনি। এসব আজকাল কী অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হয় তার কাছে! সে আজ হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ পিছনফিরে একবার তাকালো—কিন্তু সে সে-রকম কাউকে আশেপাশে দেখলো না। কিন্তু সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো—কেউ তাকে এখন দেখছে বা অনুসরণ করছে। হঠাৎ তার মনে বিরাট এক প্রশ্ন জাগে: কে সে? আর সে কেনই-বা তার সঙ্গে এমনটি করছে? এসব ভাবতে-ভাবতে তার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তার একবার মনে হলো: সে বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যে তার গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস রয়েছে! শেষমেশ সে ভার্সিটিতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়।
শায়লা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসও চলে এলো। আর সে যখন বাসে উঠতে যাবে, তখন তার মনে হলো: কেউ-একজন তার গা-ঘেঁষে যেন দাঁড়িয়েছে! সে ঘাড় বেঁকিয়ে দ্রুত পিছনে তাকাতেই আগের মতো কাউকেই আর দেখতে পেল না। সে দ্রুত বাসে উঠে পড়লো। এখন তার মনে হলো: কেউ তাকে অনুসরণ করছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার সময় শায়লার কখনো এরকম মনে হয় না। তখন কেউ তার পাশে থাকে না। আর তখন সে বেশ নিরাপদেই থাকে। কিন্তু তাদের বাসার আশপাশটা জুড়ে কেউ-একজন যেন তাকে সবসময় অনুসরণ করে থাকে। ইদানীং এইরকম একটি অস্বস্তিতে ভুগছে শায়লা। বিষয়টি এখনও পর্যন্ত সে কাউকেই বলেনি। আর এটা তো বলার মতো কোনো ঘটনাও নয়। সে তো আজ পর্যন্ত কাউকে তার পিছনে আসতে দেখেনি—কিংবা ঘুর-ঘুর করতেও দেখেনি। এসব ভেবেই সে কাউকে কিছু না বলে নিজের মনে একটি হিসাব কষতে থাকে? কে হতে পারে সে? কে সে? আর কেনই-বা সে তার সঙ্গে এমনটি করছে?
শায়লারা যাত্রাবাড়ি-এলাকায় বাস করছে দুই বৎসর যাবৎ। তার বাবা এখানে ব্যবসা করেন। এই জায়গাটা তাদের ভালো না-লাগলেও এখন ভালো লাগাতেই হবে। কারণ, মাসখানেক আগে তার বাবা এই এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য একটি দোতলা-বাড়ি কিনে তাতে উঠে পড়েছেন। এর আগে তারা এই যাত্রাবাড়ির আশেপাশে ভাড়া থাকতো।
এই বাড়িটা এখন তাদের সবারই পছন্দ হয়েছে। এটি কোনো বহুতল ভাড়া-বাণিজ্যের বিল্ডিং নয়। এটি ভদ্রলোকের বসবাসের উপযোগী একটি মনোরম-ছিমছাম বাড়ি। এটি অনেক সুন্দর ডিজাইনের একটি ডুপ্লেক্স-বিল্ডিং। এর ভিতরের দিকটা অনেক বেশি সুন্দর। আর বাইরের দিকটা তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। এইজন্য বাড়িটা এখন ওদের সবার পছন্দের।
এতবড় একটা বাড়ি—কিন্তু মানুষজন একেবারেই কম! সর্বসাকুল্যে এই বাড়িটাতে মাত্র পাঁচজন মানুষ বসবাস করছে। শায়লা, তার একটিমাত্র ভাই, তার বাবা-মা, আর বারো-তোরো বছরের একটি কাজের মেয়ে। অবশ্য তাদের বাড়িটাতে একজন দারোয়ানও আছে। কিন্তু সে তো চব্বিশঘণ্টাই বাড়ির বাইরে থাকে। তাই, সবারই একটু ভয়-ভয় লাগার কথা। বিশেষত রাতের বেলা প্রথম-প্রথম ওদের সবারই কেমন যেন গা ছম ছম করতো। এখন অবশ্য কিছুটা সয়ে গেছে। তারপরও...।
শায়লার একমাত্র ছোট ভাইটি ক্লাস নাইনে পড়ে। বাড়ি থেকে তার স্কুলটাও খুব বেশি দূরে নয়। শায়লার বাবা মোসাদ্দেক হোসেনের ব্যবসাটাও এখানে। তাই, এখন তাদের মনটা পুরাপুরি এই বাড়িটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এতবড় একটা বাড়ি! আর তাদের মানুষজনও একেবারে কম। ওর বাবা প্রায় সারাটা দিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। ওদের একেকজনের সময় একভাবে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের মায়ের সময় আর কাটতে চাইতো না। তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়িটাতে একাই থাকতেন। তার ভয়-ভয় লাগলেও তিনি তা বাইরে কখনো প্রকাশ করতেন না। এতে তাদের ছেলে-মেয়ে দুটো আরও বেশি ভয় পাবে যে! কিন্তু বাড়িতে একটা কাজের মেয়েও দরকার। এজন্য তিনি সম্প্রতি গ্রাম থেকে একটি কিশোরীমেয়েকে কাজের জন্য এখানে এনেছেন। ওর বয়স বারো কি তেরো। গ্রামের মেয়ে তো—জন্মের সময় ওর বাপ-মা ওর জন্মতারিখটা লিখে রাখেনি। তাই, ওর বয়সের সঠিক হিসাবও নাই। এই মেয়েটি আসায় তবুও শায়লার মা রাশিদা বানু একজন কথা বলার মানুষ পেয়েছেন। নইলে তাকে আগের মতো সারাদিন বোবা হয়ে থাকতে হতো। এখন অবসরে তিনি টিভি দেখার পাশাপাশি বিশাল ছাদ-বাগানের পরিচর্যা করে সময় কাটান।
শায়লাদের এই নতুন বাড়িটা অনেক বড়। এখানে, দশ-কাঠারও একটু বেশি জমি আছে। আর বিল্ডিংটা তৈরি হয়েছে পুরো পাঁচ-কাঠার ওপরে। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, বাড়িটা কোনো খানদানি লোক তৈরি করেছিলেন—দীর্ঘদিন খুব আরামআয়েশে বসবাসের জন্য। আর নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ এটা বিক্রি করে না। বাড়িটার দামও উঠেছিল অনেক! প্রথমে আড়াই কোটি টাকা! পরে অনেক আপসরফার পরে শায়লার বাবা স্থানীয় একজন অধিবাসীর সহায়তায় এটি দুই কোটি টাকায় কিনে নেন। উপরের ছাদ আর বাইরের অংশটুকু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বিল্ডিংটা একেবারে দামি পাথরে মোজাইক করা। এর ভিতরটা এখনও একেবারে ঝকঝকে-তকতকে। আয়নার মতো পরিষ্কার। এটা দেখলে যে-কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে।
শায়লার মা রাশিদা বানু এই দুই মাসে যত্ন করে এটাকে আরও ঝকঝকে-তকতকে করে তুলেছেন। বাড়িটা কেনার সময় শায়লার বাবা শুনেছিলেন, বাড়িটা নাকি মাত্র দুই বছর আগে তৈরি করা হয়েছে। সেইজন্য তার আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাড়িটা একেবারে নতুন। ছেলে-মেয়েদের মতো বাড়িটার প্রতি এখন তারও খুব মায়া জন্মেছে।
আজ বিকালের একটু আগেই শায়লা বাসার কাছে বাস্ট্যান্ডে এসে নামলো। আর তখনই তার মনে হলো: কেউ-একজন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! এতে সে ভয়ানকভাবে চমকে উঠলো। সে খুব ভয় পেয়ে চারিদিকে তাকালো। কিন্তু সে কাউকে তার আশেপাশে দেখলো না। এতে তার ভয়ের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। এইমুহূর্তে একজন মানুষের বাস্তব-উপস্থিতি সে টের পেয়েছে। শুধু তাকে চোখে দেখতে পায়নি—এই যা। সে দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের বিল্ডিংয়ের কাছে আসতেই তাদের বাড়ির দারোয়ান ইসমাইল তাকে দেখে বেশ হাসি-হাসি মুখে গেইটটা খুলে দিলো। আর শায়লা তখন অনুভব করলো—এখনও কেউ-একজন তার পাশে আছে!
বাড়ির ভিতরে ঢুকে সে দ্রুত সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তারপর সে তাড়াতাড়ি হেঁটে নিজের রুমে এসে ঢুকলো। আর সে অস্থিরভাবে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এখন তার বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু ভয়টা মন থেকে একেবারে যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ পর সে বিছানা ছেড়ে নিজের বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। আর হয়তো ভাবলো: বিকালে শান্তস্নিগ্ধ বাতাসে দাঁড়ালে তার মনের অস্বস্তি-ভাবটাও কেটে যাবে। সে বারান্দায় প্রবেশের আগেই দেখলো: বারান্দাটা ভিজে। তার মনে পড়লো—দুপুর তিনটার দিকে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আর তখন সে ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ক্লাসে ব্যস্ত ছিল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে আরও দেখলো—তার সকালের ভিজে কাপড়চোপড়গুলো শুকানোর পর বৃষ্টির আগেই ঘরে এনে খুব সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। সে মনে মনে খুশি হলো। আর সবিস্ময়ে ভাবলো: কাজের মেয়েটা তাহলে বেশ ভালো তো! কোনোকিছু বলার আগেই তার সবদিকে খেয়াল থাকে।
সে মায়ের রুমে ঢুকে দেখলো, তার মা কাজের মেয়েটার সঙ্গে রাতের রান্নার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। এমন সময় তাকে দেখে তারা দুজনেই হাসলো।
শায়লা কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বেশ স্নেহের সুরে বললো, “মালেকা, কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টির সময় আমার বারান্দার কাপড়চোপড়গুলো তুই রুমের ভিতরে এনে রেখেছিলি?”
কিন্তু সে কোনো কথা বললো না। শুধু মাথানিচু করে সভয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
এমন সময় তার মা বললেন, “বেচারী আজ দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর তখনই বৃষ্টিটা আসে। তাই, ও তোর কাপড়চোপড়গুলো আর ভিতরে আনতে পারেনি। তাই কী হয়েছে মা, একটু পরে ভিজে কাপড়গুলো বাতাসেই শুকিয়ে যাবে!”
মায়ের কথা শুনে শায়লা আরও ভয় পেয়ে যায়। তাদের বাড়িতে ওই বৃষ্টির সময় তার মা আর কাজের মেয়ে মালেকা নুরী ছাড়া তো আর কেউ ছিল না। তবে কে তার কাপড়চোপড়গুলো বৃষ্টি আসার আগে এমন সুন্দরভাবে ভাঁজ করে তার খাটের একপাশে রাখলো! এখন তার রুমে ঢুকতেও ভয় করছে। কিন্তু তবুও সে কাউকে কিছু বলতে পারলো না। সবাই কী ভাববে?
শায়লা ভাবছে—এটা বুঝি তার মনের কোনো ভুল। কিন্তু পরক্ষণেই তার স্পষ্টভাবে মনে হলো: আজ সকালে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মতো গোসল করেছে, নিজের হাতে তার ভিজা কাপড়চোপড়গুলো বারান্দার তারে ছড়ায়ে দিয়েছে! কী আশ্চর্য এখন তা একেবারে শুকনো অবস্থায় তার ঘরে! সে এখন বিস্মিত আর চিন্তিত। সে একটু ভয়ে-ভয়ে আবার নিজের রুমে এসে ঢুকলো। তারপর তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে ফোন করলো। তার এই বান্ধবীটি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী।
বান্ধবীকে ফোনে পেয়ে শায়লা একনাগাড়ে সব ঘটনা তাকে খুলে বললো। আর এসব শুনে ওপাশ থেকে তার সেই বান্ধবী প্রায় উচ্চশব্দে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড় করে বললো, “এসব তোর মনের ভুল। তুই হয়তো কোনো কারণে আজ খুব চিন্তিত—কিংবা এমন কোনো কারণে আপসেট। আর নয়তো অন্যকোনো কারণে তোর মনটা ভীষণ খারাপ। তাই, তোর এসব মনে হচ্ছে। আর তুই কিন্তু সকালে গোসল করিসনি। এটা তোর মনের ভুল। আর তোর কাপড়চোপড়গুলো তুই ভার্সিটিতি যাওয়ার আগে নিজেই ভাঁজ করে রেখে গিয়েছিস। তোর...।”
বান্ধবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো শায়লা। আর তার মনে হলো—তার এই বান্ধবীটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আহাম্মক! নইলে, সে এভাবে তার জীবনের সত্যকে মিথ্যা বানানোর গভীর একটা ষড়যন্ত্র করবে কেন? এখনও তার সুস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে: সে আজ সকালেও প্রতিদিনের মতো নিয়মমাফিক গোসল করেছে। আর সে নিজের হাতে তার পরিধানের ভিজা কাপড়চোপড়গুলো বারান্দায় শুকাতে দিয়ে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে। এখানে, ভুল হওয়ার তো কোনো সুযোগ নাই। আর সে কিনা বলছে—এটা তার মনের ভুল! সে তার এই বান্ধবীটাকে আদ্যিকালের কোনো-একটা গাধা মনে করলো।
শায়লার সেই বান্ধবী কিছুক্ষণ পর-পর বেশ কয়েকবার ফোন করলো তাকে—তার অসমাপ্ত কথা শোনাবার জন্য। কিন্তু শায়লা একটিবারের জন্যও তার ফোন রিসিভ করলো না। সে বুঝে গেছে: এর এসব আবোলতাবোল কথা শোনা মানে নিজের সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করা।
শায়লার এখন মনে হচ্ছে: এসব পাগলের সঙ্গে কথা বলা মানে বৃথা সময় নষ্ট। তার চেয়ে নিজে কিছু ভাবলে বরং একটা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যার একটু আগে আবার শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। আর সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি! আর শায়লার মনে হলো—এমন বৃষ্টির ফোঁটায় যেন জানালার কাচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে! সে শুয়ে-শুয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ পড়ছিল। আর সে পড়তে-পড়তে তন্ময় হয়ে কতকিছু ভাবছিল। এমন সময় বৃষ্টির ছ্যাঁচা তার মাথার দিকের জানালাভেদ করে আসছিল। সে বিছানা থেকে উঠে জানালাটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় সে স্পষ্টভাবে দেখলো—সে ওঠার আগেই একটি ছায়ামূর্তি জানালাটা আটকিয়ে দিলো। একনিমিষে তার চক্ষু দুটো একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। সে তার নিজের চোখ দুটোকে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কী ঘটলো! আর এটা কী হলো? এইমাত্র সে নিজের চোখে দেখেছে, একটি ছায়ামূর্তি তার রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিলো! সে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে—সে একজন যুবক। আর তারমধ্যে কোনো হিংস্রভাব ছিল না—যেন সেও এই ঘরের নিয়মিত বাসিন্দা—এমনইভাবে সে এসে তার রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
এমন তাজ্জব বনে যাওয়া ও বিস্ময়কর ঘটনা তার জীবনে এর আগে আর-কখনো ঘটেনি। সে কিছুক্ষণ একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।
ছায়ামূর্তিটা এখন আর নাই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে চলে গিয়েছে। কিন্তু শায়লা ভয়ে এখনও কাঁপছে। তার কণ্ঠ দিয়ে এইমুহূর্তে কোনো কথা বের হলো না। সে খুব ভয় পেয়েছে। আর মানুষ খুব ভয় পেলে নাকি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। শায়লারও এখন সেই অবস্থা।
ভাগ্যিস, এইসময় বজ্রপাত হওয়াসত্ত্বেও বিদ্যুৎ চলে যায়নি। তাইলে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে আরও অসহায় হয়ে পড়তো।
কিছুক্ষণ পরে শায়লা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। আস্তে-আস্তে সে কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে। আর সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই একদৌড়ে মায়ের রুমে ঢুকলো। তার মা তখন মাগরিবের নামাজ পড়ে সবেমাত্র জায়নামাজ গুছিয়ে উঠছেন। এইসময় সে তার মায়ের রুমে হুড়মুড় করে ঢুকে ছোট্ট শিশুর মতো মাকে জড়িয়ে ধরলো। তার মা ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতে না পেরে মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বেশ স্বাভাবিকণ্ঠেই বললেন, “কী হয়েছে মা? কী হয়েছে তোর? আর তোকে এত অস্থির লাগছে কেন?”
শায়লা আগের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, আমি হঠাৎ খুব ভয় পেয়েছি।”
রাশিদা বানু এবার সবিস্ময়ে বললেন, “কেন মা—কী হয়েছে? আমাকে সব খুলে বল তো। আর এক গেলাস পানি খা। ভয় পেলে পানি খেতে হয়।”
শায়লা মায়ের এনে দেওয়া এক গেলাস পানি শেষ করেও মাকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
শায়লা সবকিছু না বলে শুধু অস্ফুটস্বরে বললো, “মা, আমার রুমের উত্তরদিকের জানালার পাশে মানুষের একটা ছায়ার মতোন দেখেছি।”
একথা শুনে তার মা একটুখানি হেসে বললেন, “ও কিছু নয়। বৃষ্টির দিন তো—তাই এরকম মনে হয়। আর তোর মাথার কাছের ওই জানালাটার পাশে তো সবসময় একটু আঁধার-আঁধার থাকে।”
শায়লা আর-কিছু বলে না। সে এবার বুঝতে পেরেছে, সবাই হয়তো এসব এখনও টের পায়নি। তাই, এখন তাদের এসব বুঝাতে যাওয়াটাই বৃথা। সে মাকে ছেড়ে টিভির রুমে এসে বসলো। সেখানে ওর ছোটভাই অর্ণব বসে টিভি দেখছে আর পড়ছে।
সে সোফার একপাশে চুপচাপ বসে রইলো। তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। আর মনের মধ্যে বারবার সেই ছায়ামূর্তিটা উঁকি দিতে লাগলো।
(চলবে)
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ০৬/০৬/২০১৬
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পি পি আলী আকবর ২৫/১১/২০১৯গল্পটা ভালোই
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২১/১১/২০১৯মন্দ নয়। আরও লিখুন।
-
নাসরীন আক্তার রুবি ২০/১১/২০১৯ভাল লাগল গল্পটি