জীবনটাতো কচুপাতার পানি
জীবনটাতো কচুপাতার পানি
সাইয়িদ রফিকুল হক
শৈশবে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতাম, কিছুদিন সেখানে থাকতাম, মানুষের সঙ্গে মিশতাম, তখন গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ মুরুব্বিদের মুখে শুধু শুনতাম—জীবনটাতো কচুপাতার পানি! খুব সহজ আর সাধারণ কথা এটি। কিন্তু, তখন এ-কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারতাম না। এসব শুনে শুধু বড়দের মুখের দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন বুঝি, আর এখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি: এর মতো নিরেট, দামি ও ধ্রুব সত্য পৃথিবীতে আর নাই। এটি ধর্মগ্রন্থের মহাবাণীর মতো চিরসত্য। আসলেই তো মানুষের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো! সবসময় যা সংশয়-সন্দেহে দোদুল্যমান।
মানবজীবনের সঙ্গে এতো সুন্দর তুলনীয় কোনোকিছু আর খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষের জীবন বড়ই সামান্য ও তুচ্ছ। এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন যেকোনো মুহূর্তে ও যেকোনোভাবে যখন-তখন শেষ হয়ে যেতে পারে। আর কোনো মানুষই আগে থেকে জানতে পারে না—সে কখন এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিবে। অথচ, এই মানুষ নিজের বাহাদুরি দেখাতে ও ক্ষমতাপ্রদর্শন করতে কতই না আস্ফালন করছে! এই মানুষ এখনও জানে না যে, সে যখন-তখন মরে যেতে পারে! আর তার এই মরে যাওয়া একেবারে চিরস্থায়ী। এ-কথা শুনে হয়তো কেউ বলতে পারেন, এসবতো সবাই জানে। আসলে, এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। তার কারণ, মানুষের মৌখিক-স্বীকৃতির চেয়ে আত্মিক-স্বীকৃতি ও অনুভবের মূল্য অনেক-অনেক বেশি। আজকাল সবাই সব-বিষয়ে খুব পণ্ডিত। আর তাই, কাউকে কিছু বলা যায় না। এরা সবই জানে। সবই বোঝে। আর এরা ভয়ানক সবজান্তা! কিন্তু জানে না শুধু—তার জীবনটা যে ভয়ংকর তুচ্ছ। অথচ, এই জীবনের জন্য সে যেকোনো-ধরনের অন্যায়-অপকর্ম করতে কোনোপ্রকার দ্বিধাবোধ করছে না। এমনকি এই পৃথিবীতে সামান্য কয়টা দিনের জন্য সে মানুষ পর্যন্ত খুন করতে দ্বিধা করছে না!
কচুপাতার উপরে বৃষ্টির সামান্য পানি কিংবা শিশিরের জলকণা জমে থাকে। আর এই জলটুকু সবসময় সংশয়ে, সন্দেহে ভয়ানকভাবে দোদুল্যমান-অবস্থায় টলমল করতে থাকে। যেকোনো-সময়ে এগুলো পড়ে যেতে পারে। এতটুকু ছোঁওয়া লাগলেও কচুপাতার উপরে জমে থাকা এই টলটলায়মান পানিটুকু পড়ে যাবে। মানুষের জীবনটাও এই কচুপাতার পানির মতো সদাসর্বদা টলটলায়মান। তবুও কি আমরা তা কখনও উপলব্ধি করতে পারি? আমাদের অনেকেরই আজ ভোগের ও লোভের কোনো শেষ নাই। আজ আমাদের সবখানে শুধু চাই-আর-চাই। আর কী-না চাই? আমাদের এখন সবকিছু চাই! আগের দিনের সাধারণ মানুষের মতো অল্পে কিংবা স্বল্পে সন্তুষ্টি যেন কারও মধ্যে নাই! আমাদের বর্তমান সমাজ-রাষ্ট্রে স্বল্পেতুষ্টপ্রাণ-মানুষের আজ বড় অভাব। আর প্রায় সবাই এখন শুধু নিজের লাভটা বোঝে। আর এজন্য এরা নিজেকে আজকাল যথেষ্ট বুদ্ধিমানও ভেবে থাকে! এখানেই আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।
মানুষের এখন মৃত্যুচিন্তা একেবারে নাই। জীবন-যৌবনে এখন শুধু ভোগের চিন্তা। ভোগচিন্তাই মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে। তবুও এই মানুষের সেদিকে একটুখানি খেয়াল নাই। মানুষ কেবলই বল্গা-হরিণের মতো অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে। আজ তার যেন কীসের তাড়া। কীসের তাড়া এতো? কারও সঙ্গে মনখুলে দু-দণ্ড কথা বলার মতো সময় কারও নাই! কোথাও একটু থামার যেন সময় তার নাই! আজ এই মানুষের স্বস্তি, শান্তি, ধৈর্য ও স্থিতি একেবারে নাই। এই মানুষ যাবে কোথায়? আর মানুষ কতদূর যেতে পারে? আচ্ছা, মানুষ ছুটতে-ছুটতে কতবড় হতে পারে? কতবড়? হিমালয়ের সমান নাকি তারচেয়েও বড় কিংবা আকাশের সমান নাকি তারচেয়ে আরও বড়? তাও তো নয়। তবে কেন অবিরামগতিতে মানুষের এই ছুটে চলা? লাভ ও লোভের আগুনে পুড়তে-পুড়তে মানুষ আজ কয়লা হয়ে যাচ্ছে। লোভের আগুনে চারিদিকে মানুষের কলজে পোড়া গন্ধ পাচ্ছি! মানুষ লোভে বেহুঁশ হয়ে আজ বুঝি জাহান্নামের রাস্তাটাই ধরেছে! এই মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে ধাবিত করে তাদের এবার মনুষ্যত্বের পথে ফেরাতে হবে।
আমাদের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো সদাসর্বদা কম্পমান! আর খুব টলটলায়মান! আর খুব নাজুক-অবস্থায় দোদুল্যমান। যেকোনো ভূমিকম্পের চেয়েও আমরা সবসময় ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছি। অমোঘ ও মহাসত্য মৃত্যু আমাদের যেকোনো-সময়ে চিলের মতো ছোঁ-মেরে নিয়ে যেতে পারে। একটু বাতাসে কচুপাতা দুলছে, কাঁপছে! যেকোনো-সময়ে পড়ে যেতে পারে আমাদের আয়ুটুকু। সবসময় মনে রাখুন: আমাদের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো।
হে মানুষ, কচুপাতার পানিতে শুয়ে-বসে তোমরা আর কত লোভ, লাভ ও পরের ক্ষতি করার চিন্তা করবে? আর কত মানুষখুন, পরের জায়গাজমি-দখল, সুদ-ঘুষসহ ইত্যাদি অপকর্ম করার চিন্তাভাবনা করবে?
কবে আমাদের বিবেক একটু জাগ্রত হবে? কবে আমাদের মনে মৃত্যুচিন্তা আসবে? আর কবে আমরা একটু মানুষ হবো?
কচুপাতাটি কাঁপছে! পানিটুকু পড়ে গেলে থমকে যাবে আমাদের এই সাধের জীবন!
সাইয়িদ রফিকুল হক
০২/১১/২০১৮
সাইয়িদ রফিকুল হক
শৈশবে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতাম, কিছুদিন সেখানে থাকতাম, মানুষের সঙ্গে মিশতাম, তখন গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ মুরুব্বিদের মুখে শুধু শুনতাম—জীবনটাতো কচুপাতার পানি! খুব সহজ আর সাধারণ কথা এটি। কিন্তু, তখন এ-কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারতাম না। এসব শুনে শুধু বড়দের মুখের দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন বুঝি, আর এখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি: এর মতো নিরেট, দামি ও ধ্রুব সত্য পৃথিবীতে আর নাই। এটি ধর্মগ্রন্থের মহাবাণীর মতো চিরসত্য। আসলেই তো মানুষের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো! সবসময় যা সংশয়-সন্দেহে দোদুল্যমান।
মানবজীবনের সঙ্গে এতো সুন্দর তুলনীয় কোনোকিছু আর খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষের জীবন বড়ই সামান্য ও তুচ্ছ। এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন যেকোনো মুহূর্তে ও যেকোনোভাবে যখন-তখন শেষ হয়ে যেতে পারে। আর কোনো মানুষই আগে থেকে জানতে পারে না—সে কখন এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিবে। অথচ, এই মানুষ নিজের বাহাদুরি দেখাতে ও ক্ষমতাপ্রদর্শন করতে কতই না আস্ফালন করছে! এই মানুষ এখনও জানে না যে, সে যখন-তখন মরে যেতে পারে! আর তার এই মরে যাওয়া একেবারে চিরস্থায়ী। এ-কথা শুনে হয়তো কেউ বলতে পারেন, এসবতো সবাই জানে। আসলে, এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। তার কারণ, মানুষের মৌখিক-স্বীকৃতির চেয়ে আত্মিক-স্বীকৃতি ও অনুভবের মূল্য অনেক-অনেক বেশি। আজকাল সবাই সব-বিষয়ে খুব পণ্ডিত। আর তাই, কাউকে কিছু বলা যায় না। এরা সবই জানে। সবই বোঝে। আর এরা ভয়ানক সবজান্তা! কিন্তু জানে না শুধু—তার জীবনটা যে ভয়ংকর তুচ্ছ। অথচ, এই জীবনের জন্য সে যেকোনো-ধরনের অন্যায়-অপকর্ম করতে কোনোপ্রকার দ্বিধাবোধ করছে না। এমনকি এই পৃথিবীতে সামান্য কয়টা দিনের জন্য সে মানুষ পর্যন্ত খুন করতে দ্বিধা করছে না!
কচুপাতার উপরে বৃষ্টির সামান্য পানি কিংবা শিশিরের জলকণা জমে থাকে। আর এই জলটুকু সবসময় সংশয়ে, সন্দেহে ভয়ানকভাবে দোদুল্যমান-অবস্থায় টলমল করতে থাকে। যেকোনো-সময়ে এগুলো পড়ে যেতে পারে। এতটুকু ছোঁওয়া লাগলেও কচুপাতার উপরে জমে থাকা এই টলটলায়মান পানিটুকু পড়ে যাবে। মানুষের জীবনটাও এই কচুপাতার পানির মতো সদাসর্বদা টলটলায়মান। তবুও কি আমরা তা কখনও উপলব্ধি করতে পারি? আমাদের অনেকেরই আজ ভোগের ও লোভের কোনো শেষ নাই। আজ আমাদের সবখানে শুধু চাই-আর-চাই। আর কী-না চাই? আমাদের এখন সবকিছু চাই! আগের দিনের সাধারণ মানুষের মতো অল্পে কিংবা স্বল্পে সন্তুষ্টি যেন কারও মধ্যে নাই! আমাদের বর্তমান সমাজ-রাষ্ট্রে স্বল্পেতুষ্টপ্রাণ-মানুষের আজ বড় অভাব। আর প্রায় সবাই এখন শুধু নিজের লাভটা বোঝে। আর এজন্য এরা নিজেকে আজকাল যথেষ্ট বুদ্ধিমানও ভেবে থাকে! এখানেই আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।
মানুষের এখন মৃত্যুচিন্তা একেবারে নাই। জীবন-যৌবনে এখন শুধু ভোগের চিন্তা। ভোগচিন্তাই মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে। তবুও এই মানুষের সেদিকে একটুখানি খেয়াল নাই। মানুষ কেবলই বল্গা-হরিণের মতো অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে। আজ তার যেন কীসের তাড়া। কীসের তাড়া এতো? কারও সঙ্গে মনখুলে দু-দণ্ড কথা বলার মতো সময় কারও নাই! কোথাও একটু থামার যেন সময় তার নাই! আজ এই মানুষের স্বস্তি, শান্তি, ধৈর্য ও স্থিতি একেবারে নাই। এই মানুষ যাবে কোথায়? আর মানুষ কতদূর যেতে পারে? আচ্ছা, মানুষ ছুটতে-ছুটতে কতবড় হতে পারে? কতবড়? হিমালয়ের সমান নাকি তারচেয়েও বড় কিংবা আকাশের সমান নাকি তারচেয়ে আরও বড়? তাও তো নয়। তবে কেন অবিরামগতিতে মানুষের এই ছুটে চলা? লাভ ও লোভের আগুনে পুড়তে-পুড়তে মানুষ আজ কয়লা হয়ে যাচ্ছে। লোভের আগুনে চারিদিকে মানুষের কলজে পোড়া গন্ধ পাচ্ছি! মানুষ লোভে বেহুঁশ হয়ে আজ বুঝি জাহান্নামের রাস্তাটাই ধরেছে! এই মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে ধাবিত করে তাদের এবার মনুষ্যত্বের পথে ফেরাতে হবে।
আমাদের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো সদাসর্বদা কম্পমান! আর খুব টলটলায়মান! আর খুব নাজুক-অবস্থায় দোদুল্যমান। যেকোনো ভূমিকম্পের চেয়েও আমরা সবসময় ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছি। অমোঘ ও মহাসত্য মৃত্যু আমাদের যেকোনো-সময়ে চিলের মতো ছোঁ-মেরে নিয়ে যেতে পারে। একটু বাতাসে কচুপাতা দুলছে, কাঁপছে! যেকোনো-সময়ে পড়ে যেতে পারে আমাদের আয়ুটুকু। সবসময় মনে রাখুন: আমাদের জীবনটা কচুপাতার পানির মতো।
হে মানুষ, কচুপাতার পানিতে শুয়ে-বসে তোমরা আর কত লোভ, লাভ ও পরের ক্ষতি করার চিন্তা করবে? আর কত মানুষখুন, পরের জায়গাজমি-দখল, সুদ-ঘুষসহ ইত্যাদি অপকর্ম করার চিন্তাভাবনা করবে?
কবে আমাদের বিবেক একটু জাগ্রত হবে? কবে আমাদের মনে মৃত্যুচিন্তা আসবে? আর কবে আমরা একটু মানুষ হবো?
কচুপাতাটি কাঁপছে! পানিটুকু পড়ে গেলে থমকে যাবে আমাদের এই সাধের জীবন!
সাইয়িদ রফিকুল হক
০২/১১/২০১৮
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
নাসরীন আক্তার রুবি ১৮/১২/২০১৮ভীষণ ভালো লাগলো পড়তে।মন চলে গেলো সুদূর অতীতে
-
সেলিম রেজা সাগর ০২/১২/২০১৮সুন্দর
-
রাহুল শীল(হুসবসার) ২৮/১১/২০১৮বাহ্ দারুণ লাগলো
-
মোহাম্মদ তামিম হোসেন (দীপ্ত কবি) ২৬/১১/২০১৮অসাধারণ প্রবন্ধ ।
কবির জন্য শুভকামনা রইল । -
রাহুল শীল(হুসবসার) ২২/১১/২০১৮বাহ্ দারুন
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৯/১১/২০১৮দারুন