www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ছোটগল্প জীবনের প্রশ্নোত্তর মেলে না

ছোটগল্প: জীবনের প্রশ্নোত্তর মেলে না
সাইয়িদ রফিকুল হক

সমির কয়েকদিন যাবৎ খুবই বিমর্ষ। আজ সকাল থেকে তার মনটা আরও বেশি খারাপ।
তামান্নার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ইদানীং খুব-একটা ভালো যাচ্ছিলো না। তবুও সে এতোদিনের সম্পর্কটা ভাঙতে চায়নি। সে তাদের এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য গত কয়েকদিন যাবৎ যারপরনাই চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য আরেক পক্ষ থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।

গত পরশু পর্যন্ত তামান্না তার সঙ্গে দিনে দুই-চারবার কথা বলতো। কিন্তু গতকাল থেকে সে ফোনে এবং সবরকমের যোগাযোগ হঠাৎ করেই একদম বন্ধ করে দিয়েছে। এসবের কোনো মানে বুঝতে পারছে না সমির। এই জীবনে সে শুধু এই একজনকেই ভালোবেসেছিলো। আর তাকে সারাজীবনের জন্যই ভালোবেসেছিলো।
সে অনেক চেষ্টা করেও এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি। তামান্নার সঙ্গে তার এখন কথা বলার কোনো সুযোগ নাই।
কিছুক্ষণ আগে সে বড় আশা নিয়ে ফেসবুক খুলেছিলো। কিন্তু সেখানেও দুর্যোগের ঘনঘটা। তামান্না ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হঠাৎ আনফ্রেন্ড করে রেখেছে। সমির এর কারণ বুঝতে পারছে না। তার ঠিক মনে আছে, গত কয়েকদিনে সে তো তামান্নার সঙ্গে কোনোপ্রকার অশোভন আচরণ কিংবা বেআদবি করেনি! তবুও সে তাকে কেন এইরকম শাস্তি দিচ্ছে!
সমির আপনমনে ভাবতে থাকে: তাদের পাঁচবছরের সম্পর্ক হঠাৎ ভেঙে যায় কীভাবে? সে নিজের মনকে অনেকরকম প্রশ্ন করে—কিন্তু সবখানেই তার সরল উত্তর—এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! কিন্তু আজকাল এমনটিই তো হচ্ছে। সে তার কয়েক বন্ধুকে প্রেমে ব্যর্থ হতে দেখেছে। আর সে এতোদিন ভেবেছিলো, তাদের হয়তো কোনো ভুল আছে বা ছিল! কিন্তু নিজের জীবনের এই ঘটনাটা তাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। সে তো কোনো ভুলই করেনি! তবে কেন তার সঙ্গে নিয়তির এই নিষ্ঠুর খেলা! কেন মানুষ এমন করে?

সামনে সমিরের ফাইনাল পরীক্ষা। সে ভালোভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-পাস করেছে। তার মনে আশা ছিল—মাস্টার-ডিগ্রীটাও সে ভালোভাবেই শেষ করবে। তারপর বিয়ে করবে তামান্নাকে। কিন্তু তার জীবনে যে হঠাৎ এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে তার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে গতকাল থেকে আজ অবধি সারাক্ষণ নিজেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছে, তার কোনো ভুল ছিল কিনা। কিন্তু সে কোথাও নিজের ভুল খুঁজে পায়নি। গত পরশু দিন তাদের ক্যাম্পাসে শেষ কথা হয়। তারপর বাসায় ফিরেও তারা সারাদিনে বেশ কয়েকবার ফোনে কথাবার্তা বলেছিলো। গত পরশু সে ঘূণাক্ষরেও তামান্নার কোনো পরিবর্তন বুঝতে পারেনি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এনায়েত অবশ্য বলেছিলো, “তামান্নার নাকি বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে! আর পাত্রপক্ষ নাকি ভার্সিটিতে এসে তামান্নাকে দেখেও গেছে!”
তবুও এসবের কিছুই বিশ্বাস করেনি সমির। একটা পর্যায়ে মনের সন্দেহ দূর করার জন্য গত পরশু সমির কথাচ্ছলে তামান্নাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলো, “ঘটনাটা কতটুকু সত্য?”
সমিরের মুখে হঠাৎ এসব শুনে তামান্না প্রথমে কিছুটা মনভার করেছিলো। পরে সে আগের মতো খুব সুন্দর করে হেসে বলেছিলো, “তুমি এসব বিশ্বাস কর? এসব তো লোকের বাড়াবাড়ি। আর ভার্সিটিতে যে-ছেলেটি আমার সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকে একদিন দেখা করতে এসেছিলো—সে আমার কাজিন হয়। আর সে তো আমার অনেক জুনিয়র। এবার হলো তো। তোমার মনের অহেতুক সন্দেহ দূর হয়েছে? আর কক্ষনো এসব ভাববে না। তাছাড়া, আমরা তো প্রতিজ্ঞা করেছি যে, জীবনে কেউ কাউকে কখনও ছেড়ে যাবো না।”
সমির আর-কিছু বলতে পারেনি। তামান্নার কথা শুনে সেও হেসেছে। আর এসব লোকের বাড়াবাড়ি ভেবে সে একেবারে চুপ করে ছিল।
কিন্তু তখন তাদের পাশে বসা এনায়েত দু’জনের মাঝখানে কোনো কথা বলেনি। কিন্তু তামান্না চলে যেতেই এনায়েত খুব উদ্বিগ্ন হয়ে সমিরের ডানহাতটা চেপে ধরে বলেছিলো, “তুই আজই তামান্নাকে বিয়ে কর। নইলে, তামান্না তোর হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে রে!”
বন্ধুর কথা শুনে সমির হেসে বলেছে, “তুই একটা পাগল। ও অনেক ভালো একটা মেয়ে। আর আমাকে সে অনেক ভালোবাসে। ও কখনও আমার সঙ্গে এরকমকিছু করবে না।”
এনায়েত বুঝেছে, মানুষকে জোর করে কোনোকিছু বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করাটা সম্পূর্ণ বোকামি। আর জোর করে কাউকে কখনও কিছু খাওয়ালে যেমন বদহজম হয়—ঠিক তেমনি জোর করে কাউকে কোনোকিছু বিশ্বাস করাতে গেলেও তা সহজে তার বিশ্বাস হয় না। আর বদহজম হয়ে একসময় তা বেরিয়ে যাবেই। বিশ্বাস জিনিসটাই মনের স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাপার। তাই এখানে, কোনো জোরজবরদস্তি নাই।

আজ দু’দিন ধরে সমির ভার্সিটিতেও যায় না। তার মন খুব খারাপ। এককথায় তার মনটা এখন ভীষণ খারাপ। আর মনখারাপ হলে সে কোনোকিছুই করতে পারে না।
সকালে কোনোরকমে সামান্য নাস্তা করলো সমির। তারপর একটু গান শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেখানেও সে মন বসাতে পারলো না। তার মনের কোণে এখন একটা সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। আর এনায়েতের কথাগুলো তার কাছে এখন একটু-একটু করে সত্য হতে শুরু করেছে। তামান্নার আচরণগুলো এখন তার কাছে আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
একটু আগে তার মা তাকে কয়েকবার ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা বলে গেছেন। কিন্তু সমিরের মন ভালো নাই। সে একবার ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হতে গিয়েও পারলো না। একরাশ লজ্জা তাকে গ্রাস করলো। তার ঈর্ষাকাতর বন্ধুরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণ তাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে নানারকম বিদ্রুপ শুরু করে দিয়েছে। কথাটা ভাবতেই সমির কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সে বুঝতে পারছে, তার মন এখন একটু-একটু করে আরও খারাপ হচ্ছে। আর এই খারাপের যেন কোনো শেষ নাই। মন একবার খারাপ হতে শুরু করলে তা ক্রমাগত খারাপ হতেই থাকে। সে এই খারাপ মন নিয়ে আজ কোথাও যেতে পারবে না।
সে জোর করে নিজের মনটাকে অনেকরকম সান্ত্বনার বাণী প্রয়োগ করে একটু শান্ত ও চাঙ্গা করার চেষ্টা করলো। তবুও কোনো লাভ হলো না। তার মন থেমে-থেমে, থেকে-থেকে, ধীরে-ধীরে শুধু খারাপই হচ্ছে। আজ সমিরের দিনটাই খারাপ।

সমিরের মা ছেলের রুমে ঢুকে আদরমাখা-সুরে বললেন, “বাবা, আজ ভার্সিটিতে যাবি না?”
সমির মা-কে দেখে একটু উঠে বসার চেষ্টা করে বললো, “না, মা। আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। কেমন যেন খারাপ লাগছে!”
মা কাছে এসে ও-কে একটুখানি ভালোভাবে দেখে তারপর ওর কপালে হাত রেখে বললেন, “না, জ্বরটর তো তেমনকিছু নাই! তবে হঠাৎ শরীর খারাপ করবে কেন? এতো চিন্তার বিষয়! তাইলে শুয়ে থাক বাবা। আজও না হয় ভার্সিটিতে না গেলি।”
মা চলে যাওয়ার পর সমির আরও ভেঙে পড়ে। সে আর স্থির থাকতে না পেরে বন্ধু এনায়েতকে তখনই ফোন করলো।
প্রথম কলে সে বন্ধুর কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। পরেরবার ওপাশ থেকে ভেসে এলো বন্ধুর কণ্ঠ: “হ্যালো সমির, তুই কোথায়?”
সমির খুব মনমরা হয়ে বলে, “এই তো বাসায় রে!”
এনায়েত বলে, “আজও বাসায়! ক্যাম্পাসে একবার আসবি না? এদিকে তো একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তুই আয় তোকে সবটা বলি। ফোনে এতোকথা বলা যাবে না।”
সমির এতে দিশেহারা হয়ে বলে, “আমি এখন শয্যাশায়ী বন্ধু। পারলে তুই ভার্সিটি থেকে একবার এখানে আয়। আর সারাদিনের মতো চলে আয়। একা-একা আমার ভালো লাগছে নারে।”
এনায়েত কী যেন একটুখানি ভেবে শেষমেশ রাজী হয়ে বলে, “আচ্ছা। দুপুরের খানিকটা আগে আমি আসবো। আজকের শেষ-ক্লাসটা শেষ করেই আসি। যদি কোনো সাজেশন পাওয়া যায়। তুই কী বলিস?”
সমির আর বাধা দেয় না। সে শুধু অস্ফুটস্বরে বললো, “তা-ই কর।”


গান শোনায় মনোযোগ নাই দেখে সমির একখানা বই হাতে নিয়ে পড়বার অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু সেখানেও তার মনের জড়তা সে হাড়েহাড়ে টের পেলো। আসলে, তার মন ভেঙে গেছে। আর ভাঙা-মনে কোনোকিছুই ভালো লাগে না। তখন সবকিছু শুকনো, পানসে আর মরা-মরা মনে হয়।
বইটা সমিরের বুকের উপর পড়ে রইলো। আর সে শুয়ে-শুয়ে কেবলই ভাবতে থাকে: সে তো আজও তামান্নাকে কত ভালোবাসে। তার ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই। তার কেবলই মনে হতে লাগলো: জগতের সবকিছুতে এমনকি সোনায়ও খাদ আছে। কিন্তু তার ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই। সে কখনও তামান্নার অর্থবিত্তের দিকে তাকায়নি। সে শুধু সুন্দর একটি মনের প্রত্যাশায় তাকে ভালোবেসেছিলো। সে শুধু তামান্নাকে ভালোবেসেছিলো।

মানুষের দেহমন ক্লান্ত হলে সবখানে অবসাদ এসে ভর করে। তখন মানুষের দু’চোখে শুধু ঘুম আসে। সমিরও হঠাৎ অনেককিছু ভাবতে-ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
তার ঘুম ভাঙলো তার মায়ের ডাকে। তার মা বললেন, “সমির ওঠ বাবা, দেখ, তোর বন্ধু এনায়েত এসেছে।”
এনায়েতের নাম শুনে সমির ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসলো।
সে এনায়েতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর ফর্সা মুখটাতে হাসির কোনো রেখা পর্যন্ত নাই। ওর আর বুঝতে বাকী রইলো না যে, ভালো কোনো খবর এইমুহূর্তে তার জন্য সে বয়ে আনে নাই। সবখানে এখন তার জন্য অপেক্ষা করছে একরাশ গাঢ় অন্ধকারমাখা হতাশা।
তবুও সমির বন্ধুকে দেখে সামান্য হাসবার চেষ্টা করে। কিন্তু এনায়েত দেখলো, সমির যেন কাঁদছে!
এসব দেখেশুনে এনায়েতের ফর্সা মুখটা আরও অন্ধকার হয়ে আসে। তবুও সে জোর করে একটুখানি হাসবার চেষ্টা করতে থাকে। একসময় সে অনেক চেষ্টা করে হেসে বললো, “আসলে, বন্ধু এখন ভালোবাসা বলে কিছু নাই। সবখানে এখন শুধু লাভের হিসাব কষছে মানুষ। লাভালাভের হিসাব কষতে গিয়ে মানুষের মনে এখন দারুণ ব্যাধি জন্মেছে। এই ব্যাধি সহজে সারবার নয়। মানুষ এখন শুধু লাভই দেখে। আর দেখে সুখসমৃদ্ধিতে ভরপুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এখানে, আমি সত্যিকারের ভালোবাসা আজ কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি তাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে একেবারে মরেছো! আর তোমার মতো ভালোমানুষেরা জগতে শুধু ঠকতেই এসেছে।”
সমির মনখারাপ নিয়েই এবার একটুখানি হেসে বললো, “এবার তোমার আসল কথা বলো।”
এনায়েত কোনোপ্রকার ভনিতা না করে বলতে থাকে, “আজও ক্যাম্পাসে এসেছিলো তামান্না। আর ওর সঙ্গে ছিল সেই ছেলেটি। ওরা দু’জন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে একটা গাড়ি থেকে নামলো। আর ও-কে দেখে আমার মনে হলো: সে খুব স্বাভাবিক আর খুব সুখী। ওদের বিয়েটা হয়ে গেছে কিনা ঠিক আমার জানা নাই। তবে ওদের দেখে মনে হলো: ওরা যেন ঠিক স্বামী-স্ত্রী!”
সমিরের বুকটা সঙ্গে-সঙ্গে দুমড়েমুচড়ে ভেঙে যেতে লাগলো। তার পাঁজরের হাড়গুলো এসময় মটমট করে ভাঙছিলো। এনায়েত পাশে বসে কিছুটা হয়তো বুঝতে পারছিলো। তাই, সে ওদের ঘনিষ্ঠতার কথা আর বললো না।
সমির আরও কিছু শুনতে চাইছিলো। কিন্তু এনায়েত ইচ্ছে করেই সবকিছু চেপে গেল। সে আহত সমিরকে আরও আঘাতের দ্বারা তাকে আরও আহত করে আরও ক্ষতবিক্ষত করতে চায় না। সে সমিরকে খুবই পছন্দ করে। ওদের বন্ধুত্ব অনেক প্রগাঢ়।
তবুও সমির আরও জানতে চায়। তাই, সে এনায়েতকে আরও কিছু বলার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলো।
অনন্যোপায় হয়ে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিয়ে এনায়েত বললো, “তুই ওর সঙ্গে সরাসরি একবার কথা বলতো। ওর আসল মতলবটা কী—সেটা আগে জানা দরকার!”
সমির বন্ধুকে কষ্টের হাসি উপহার দিয়ে বললো, “সে চেষ্টা অনেকবার করেছি বন্ধু। কিন্তু ওর মোবাইলফোনের আগের দুটো সিমই বন্ধ। এখন আমি একেবারে নিরুপায়।”
এনায়েত তবুও হাল ছাড়ে না। সে বলে, “ওর সঙ্গে ফেসবুকেও তো যোগাযোগ করতে পারিস!”
হতাশ হয়ে সমির বললো, “সে চেষ্টাও করেছি বন্ধু। কিন্তু সে আমাকে চিরতরে আনফ্রেন্ড করে রেখেছে। মানে, আমাকে একেবারে ব্লক করে দিয়েছে!”
সব শুনে এবার এনায়েত নিজেই হতাশ। সে আর কিছু বলে না।

কক্ষের ভিতরটা এখন একেবারে নিস্তব্ধ। যেন মনে হচ্ছে—দুইটি মৃত মানুষ এখানে জোর করে জেগে রয়েছে। কিছুটা সময় কারও মুখে কোনো ভাষা নাই।

এমন সময় সমিরের মা ওদের জন্য চা আর বিস্কুট নিয়ে এলেন। আর তিনি যাওয়ার সময় এনায়েতের উদ্দেশ্যে বললেন, “বাবা, ওর মনটা ভালো নেই। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বললে ওর মনটা ভালো হতে পারে। তুমি আজ এখানেই থাকো। কাল সকালে দু’জনে একসঙ্গে ভার্সিটিতে যেয়ো।”
এনায়েত জ্বি, আচ্ছা, বলে রাজী হয়ে গেল। বন্ধুর এই বিপদে সে নিজেও মুষড়ে পড়েছে। তাকে সাহায্য করাটাকে সে এখন পরম ধর্মজ্ঞান করছে।

সমির কোনো কথা বলছে না দেখে অনেকক্ষণ পরে এনায়েত বললো, “এই মেয়েগুলো ভালোবাসা বোঝে না। এরা খুব লোভী। এদের কাছে অর্থই সবচেয়ে বড় জিনিস। নইলে, তোমার মতো একটা ভালোছেলেকে এভাবে কেউ পায়ে ঠেলতে পারে!”
সমির এবার ভেজাচোখে বলতে লাগলো, “আমি ওর জন্য কম করিনি। কখনও ওর মনে আঘাত দেইনি। আর কখনও ওর পিছনে টাকাপয়সা খরচ করতে কার্পণ্য করিনি। তবুও...।”
এনায়েত ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রচণ্ড রেগে বলতে থাকে, “সে ভালোবাসার মর্ম বুঝবে কীভাবে? সে তো পড়েছে কমার্স। সেখানে, ভালোবাসার একটা কথাও লেখা নাই। সেখানে, শুধু টাকা-পয়সা আর লাভ-ক্ষতির হিসাব! ওদের মনটা পাথরের তৈরি বন্ধু।”

দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা দু’জন বিশ্রামের জন্য সবেমাত্র বিছানায় বসেছে—এমন সময় বাসায় হাজির হলো ওদের আরেক বন্ধু সাবিকুন নাহার ওরফে রেশমা। সে ওদের দুজনেরই বন্ধু। ওরা একসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-ডিপার্টমেন্টে পড়ে।
মেয়েটি বড় ভালো। একেবারে বাঙালি-রমণীসুলভ আচরণ তার। সমিরের মা তাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি তাকে দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু মেয়েটি খাবার খেতে রাজী হলো না।
সে একপর্যায়ে খুব সুন্দর করে হেসে বললো, “খালাম্মা, আমি দুপুরে খেয়ে এসেছি। বিকালে সবার সঙ্গে শুধু চা-পান করবো। আজ সমিরের কাছে আমি একটা দরকারে এসেছি।”
একথা শুনে সমিরের মা হেসে বললেন, “আচ্ছা মা, তুমি এসেছো এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। এবার তোমরা গল্প করো। আমি হাতের কাজগুলো শেষ করি।”
তিনি একদিকে চলে গেলেন।

রেশমাকে দেখে ওরা দু’জনই খুব অবাক হয়েছে।
সমির নিজেকে আরেকটু সজীব করার চেষ্টা চালাতে-চালাতে জোর করে হেসে বললো, “তুমি হঠাৎ? কী মনে করে? আমার খুব অবাক লাগছে যে!”
রেশমা কোনোরকম ভনিতা না করে একটু হেসে বললো, “এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তোমার কষ্টের কথা শুনে আমি এসেছি। আর কিছু তথ্যও তোমাকে দিতে চাই। তুমি যাকে ভালোবাসো সেই তামান্না এখন বিবাহিতা। গত সপ্তাহেই ওদের বিয়ে হয়েছে। আমরা ক্যাম্পাসে যে-ছেলেটিকে দেখেছি, ঠিক তারই সঙ্গে। এই কয়েক সপ্তাহ সে তোমার সঙ্গে খুব লুকোচুরি খেলেছে? সে যে এতো খারাপ—তা আমি আগে জানতাম না। জানলে তোমাকে আগেই সতর্ক করতাম। তামান্নাদের ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আজই আমাকে এসব বলেছে। সে নাকি ওদের বিয়েতেও গিয়েছিলো।”
সব শুনে সমির বজ্রাহতের ন্যায় বিছানার এককোণে বসে রইলো।
এনায়েত বললো, “তুমি শক্ত হও বন্ধু। এবার শক্ত হও। একটা সামান্য মেয়ের জন্য তো আর তোমার মূল্যবান জীবনটা এভাবে ধ্বংস হতে পারে না।”
ওর কথা শুনে রেশমা এতে জোরালো সমর্থন জানিয়ে বললো, “তাইতো, তোমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর সামান্য একটা তামান্নার জন্য এভাবে তুমি নিজেকে কষ্ট দিতে কিংবা ধ্বংস করতে পারো না। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। সামনে তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। কথাটা মনে রেখো।”

ওদের দু’জনের কথায় কিছুক্ষণ পরে সমিরের কিছুটা সম্বিৎ ফিরে এলো। তবুও সে চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখ দুটো ভিজে গেছে অনেক আগে। তবুও সে হাসবার চেষ্টা করে বলতে থাকে, “সাবিকুন, তুমি আজই প্রথম আমাদের বাসায় এলে তোমাকে কী খাওয়াই বলো তো?”
রেশমা হেসে বলে, “এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এজন্য খালাম্মা রয়েছেন। তুমি শুধু নিজের কথা ভাবো। তোমার কষ্টের কথা ভেবেই আজ আমি এখানে এসেছি। তুমি কাল থেকে আবার নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাবে—এটা আমাদের সবার দাবি।”
এনায়েত খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো, “আমাদের রেশমা-বন্ধু ঠিকই বলেছে, তোমার লজ্জার কোনো কারণ নাই। তুমি কালই ক্যাম্পাসে যাবে। জীবনে জয়-পরাজয় আছে। আর তুমি কাউকে ভালোবেসে পরাজিত হওনি। কেউ তোমার ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়েছে।”

ততক্ষণে সমিরের মা ওদের জন্য চা নিয়ে এসেছেন। তিনি ওদের কথা বলার সুযোগ দিতে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালেন না।
চা-পান করতে-করতে সমিরের দিকে তাকিয়ে রেশমা বলে, “তুমি শুধু ওই বেআদব-মেয়েটাকে একবার জিজ্ঞাসা করবে সে কেন এতোদিন ভালোবাসার অভিনয় করলো? এর মানেটা কী?”
এনায়েত বললো, “ওর নতুন ফোন-নাম্বারটা তুমি আমাদের একবার জোগাড় করে দিতে পারবে?”
রেশমা দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, “পারবো।”

ওরা যখন এসব ভাবছিলো আর তামান্নাকে কিছুকথা বলার জন্য ওর ফোন-নাম্বার জোগাড়ের চেষ্টা করছিলো, তখনই তামান্না ফোন করলো সমিরকে।

সমির প্রথমেই কিছু বললো না। আগে ওদের ফোন-কলটা দেখালো। তারপর ওদের পরামর্শে সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, তামান্নার কণ্ঠ: “হ্যালো সমির, তুমি কিছু মনে কোরো না। হঠাৎ করে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তাই, আমার কিছু করার ছিল না। আর ছেলেটাও ভালো। লন্ডনে সেটেল্। সবাই একরকম জোর করে আমাকে ওর সঙ্গে আকদ করে ফেলেছে। আসলে, আমার কোনো দোষ ছিল না। আমি বারবার চাইছিলাম তোমার সঙ্গেই আমার বিয়েটা হোক। আর-একটা কথা: তুমি আমাদের এই সম্পর্কের কথাটা ওর মানে আমার বরের কাছে কখনও বোলো না।”
সমির খুব শান্তস্বরে বললো, “বেশ করেছো। তোমার জীবন তুমি যেমন ভেবেছো। আর আমি এতো নীচপ্রকৃতির নই যে তোমাকে ভালোবাসার দাবিতে মিছিল করবো কিংবা কারও কাছে এটি বলে বেড়াবো। কিন্তু আমার কয়েকটি প্রশ্ন: তুমি পাঁচটি বছর কেন আমাকে এভাবে আটকিয়ে রেখেছিলে? কেন? আর কেন পাঁচটি বছর এই ভালোবাসার অভিনয় করলে? আমি তো তোমাকে ভালোবেসে সুন্দর একটি জীবন গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেই জীবনে কেন এমন করে ছন্দপতন ঘটালে? আর তুমি কী কারণে ওই ছেলেটিকে বিবাহ করেছো? আমি শুধু এইই জানতে চাই।”

ওপাশ থেকে আর কোনো জবাব আসে না। জবাব আর আসবেও না। এমন প্রশ্নের জবাব তামান্নারা দিতে পারবে না। এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের জানা নাই—কিংবা জানা থাকলেও তারা বলবে না। জীবনের এমনতর বহু প্রশ্নোত্তর মেলে না। জীবনের প্রশ্নোত্তর কখনও মেলে না।

সমির জবাবের আশায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পরে সমির বুঝতে পারলো, ওপাশের সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সে ফোনটা রেখে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, “সাধারণ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর তামান্না দিতে পারলো না। ভালোবাসার মানুষের কাছেও এখন প্রশ্নোত্তর মেলে না।”
সমির যেন ভাবুক হয়ে উঠতে থাকে।

এনায়েত আর রেশমাও ভাবুকের দৃষ্টিমেলে সমিরের দিকে চেয়ে থাকে। তারাও একসময় ভাবতে থাকে: জীবনের প্রশ্নোত্তর কেন মেলে না?



সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৩/১১/২০১৭
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৯৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৩/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast