আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এখনও যারা ভয় পায় ও অবমূল্যায়ন করে (প্রথম পর্ব)
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এখনও যারা ভয় পায় ও অবমূল্যায়ন করে (প্রথম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
এদেশ ছাড়বি কিনা বল?
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল!
এই হলো বাংলার আজন্ম-আমৃত্যু বিদ্রোহী-কবি নজরুল। ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরেজ-অপশক্তির বিরুদ্ধে এমন সাহসী, স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ উচ্চারণ আর কেউ করতে পারেননি।
বিশ্বমানবতার কবি নজরুল সাম্রাজ্যবাদী-ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এভাবেই একাকি-নিরস্ত্রভাবে গর্জে উঠেছিলেন। নজরুল ছিলেন সিংহপুরুষ। আর ধূর্ত-শঠ ইংরেজঅপশক্তি ছিল শৃগাল।
আমাদের কবি নজরুল ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী-ব্রিটিশবিরোধী ও এক মানবতাবাদী কবি। আর তিনি ছিলেন সকল ধর্মের মানুষের কবি। তিনি দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই একজন কবি হয়ে রাজনৈতিক নেতার মতো গর্জে উঠেছেন বারবার। তাঁকে ভয় পেয়ে রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত ছিল ইংরেজশক্তি। তাই, তারা নজরুলের আগ্নেয়গিরিসম কবিতা সহ্য করতে না পেরে কাপুরুষের মতো তাঁকে দুই-দুইবার জেলে আটকিয়ে রেখেছিলো। এটি তাদের নৈতিক পরাজয়ের দৃষ্টান্ত।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হওয়ার বহু আগে থেকে ছিলেন জননন্দিত। আর তাঁর কালে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে অত্যাচারিত ও অবহেলিত মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবি। তাছাড়া, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের নিকটও তিনি ছিলেন সমধিক জনপ্রিয়। তাঁর যোগ্যতাই তাকে মানুষের ভালোবাসা-অর্জনে সহায়তা করেছিলো।
কাজী নজরুল ইসলাম আজ আমাদের জাতীয় কবি। তিনি গণমানুষের কবি। তিনি সর্বহারাশ্রেণীর একমাত্র মুখপাত্রস্বরূপ-কবি। তাঁর কলম তরবারির চেয়ে বেশি ধারালো ছিল। আর তিনি নিজে ছিলেন আজন্ম-বিদ্রোহী। কবি নজরুল তাঁর কালে একটি সাম্রাজ্যবাদীগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের দ্বারা বিরাটভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। ঠিক আজও তিনি একইভাবে এই দুটি শ্রেণীর দ্বারা সমানভাবে বাধাপ্রাপ্ত। কবি নজরুল আজ ধরাধামে নাই—তবুও এই দুটি শ্রেণী আজও তাকে সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। মদীয় আলোচনা আজ এই প্রসঙ্গেই।
বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বড় মানবতাবাদী কবি হলেন আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজগণ লর্ড বায়রনকে বিদ্রোহী-কবি বলে থাকেন। সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আমাদের কবি নজরুলের দ্রোহী-চেতনার কাছে সকল বিদ্রোহী হার মানতে বাধ্য। নজরুল ছিলেন মানুষ আর মানবতার কবি। তিনি আমৃত্যু মানুষকে ভালোবেসে মানুষের পক্ষে লেখনিশক্তিধারণ করেছিলেন। নজরুলের জীবদ্দশায় বহু ইংরেজ-দালাল ও ইংরেজগামী প্রতিক্রিয়াশীলচক্র নজরুলকে ভয় পেতো। তারা নজরুলকে এড়িয়ে চলতো, এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ-রাজশক্তি যখন অন্যায়ভাবে তাঁকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার মিথ্যাঅভিযোগ আনয়ন করেছে, তখনও তারা নজরুলের বিরুদ্ধাচরণ করে ইংরেজশক্তির পক্ষেই বাহবা যুগিয়েছে, আর ইংরেজঅপশক্তির গোলামি করেছে। আজও ভারতীয় উপমহাদেশে একটি-দুটি-শ্রেণী সুযোগ পেলেই নজরুলকে আঘাত করে বসে। আর তাঁকে ঘায়েল করতে চায়। কিন্তু এরা খুবই ধূর্ত-শিয়াল! তাই, তারা নজরুলের প্রকাশ্যে সমালোচনার চেয়ে ভিতরে-ভিতরে তাঁর বিরোধিতা করতে ভালোবাসে। এরা এই জাতিরাষ্ট্রের আবর্জনাশ্রেণী।
নজরুলকে এখনও ভয় পায় সাম্রাজ্যবাদী-অপশক্তির দালালগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলচক্র:
এই দুটি শ্রেণীর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীঅপশক্তির দালালগোষ্ঠী নজরুলসাহিত্য একেবারেই পাঠ করে না, অধ্যয়ন করে না, নজরুল-চর্চা করে না, আর তাঁকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে না। তারা অনেকটা কৌশলে নজরুলকে এড়িয়ে চলে। এরা সবসময় ধূর্ত-ধুরন্ধর। কিন্তু কখনও ধীমান নয়। আর এদের কখনও ধীমান হওয়ার কোনো যোগ্যতা নাই। এই অযোগ্য-শ্রেণীটিই আজও নজরুলসাহিত্যকে উচ্চতর অধ্যয়নের যোগ্য মনে করে না। নজরুলরচনাবলী পড়লে এদের আঁতে ঘা লাগে। এরা ভণ্ড! এরা খুব স্বার্থপর-স্বার্থলোভী! তাই, এদের সবকিছু যেন একনিমিষে নজরুল-ঝড়ে পণ্ড হয়ে যাবে। আজ নজরুল বেঁচে থাকলে এরা কখনও নজরুলের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস পেতো না। আজও তাঁকে ভয় পেয়ে এরা তাঁর সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হওয়ার সাহস পায় না।
আরেকটি ধূর্তশ্রেণী হচ্ছে আমাদের পরিচিত ধর্মব্যবসায়ীগোষ্ঠী তথা প্রতিক্রিয়াশীলচক্র। এদেরই পূর্বপুরুষ নজরুলকে ব্যক্তিগত আক্রোশে ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়েছিলো। কারণ, কবি নজরুল এই ভণ্ডশ্রেণীটিকে সুস্পষ্টভাবে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কবিতারচনা করেছিলেন। এইরকম ভণ্ডবিরোধী অনেক কবিতাই লিখেছিলেন আমাদের কবি নজরুল। তাঁর বিখ্যাত ‘মানুষ’ কবিতা থেকে এখানে একটুখানি উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো:
‘আশীটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু।
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার!
খোদার ঘরে কে কবাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরি ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!—মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;—গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
এই শ্রেণীর ভণ্ডদের উদ্দেশ্যে কবি নজরুল তার ‘আমার কৈফিয়ত’ নামক সুবিখ্যাত কবিতায় সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন:
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর‘মোল্-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আম পারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!’
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পাত-নেড়ে!’
ওরা নজরুলকে এখনও সহ্য করতে পারে না। আর এই ভণ্ডের দল আজও নজরুলের ধর্মবিশ্বাস, বিবাহ, জীবনপ্রণালী ইত্যাদি নিয়ে আজেবাজে প্রশ্নের অবতারণা করে থাকে। এরা আঘাতপ্রাপ্ত সেই কাটমোল্লাদের উত্তরপুরুষ। তাই, নজরুলসাহিত্য এদের সহ্য হয় না—ভালো লাগে না।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৫/০৫/২০১৬
নজরুলজন্মজয়ন্তী-উপলক্ষে রচিত।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আলম সারওয়ার ২৯/০৫/২০১৭
-
শাহারিয়ার ইমন ২৬/০৫/২০১৭বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে লিখলে লেখা বার শেষ হবার নয়
-
তুষার রায় ২৫/০৫/২০১৭শুভেচ্ছা লেখক বন্ধু
জন -মানবের ভীড়ে।
বিদ্রোহী বেশে
কবিতার দেশে।
ধরিবে না কলম
শোষনের মলম।