পাকিস্তানে ছিল এক জিন্না। আর এখন স্বাধীনবাংলাদেশে অসংখ্য জিন্না
পাকিস্তানে ছিল এক জিন্না। আর এখন স্বাধীনবাংলাদেশে অসংখ্য জিন্না!
সাইয়িদ রফিকুল হক
এখন বাংলাভাষার অনেক শত্রুও লোকদেখানো ও স্বার্থসিদ্ধির-আনুষ্ঠানিক ভাষাপ্রেম দেখানোর জন্য শহীদমিনারে গিয়ে বেদীতে ফুল দেয়। তারপর ছবি তুলে কিংবা বিশাল একটা ভিডিও করে বাসায় ফিরে আসে। তারপর এগুলো দিয়ে ব্যবসা করে খায়। অনেক ভণ্ড এখন শহীদমিনারে গিয়ে ফুল দিচ্ছে। অথচ, এদের মনের মধ্যে বাংলাভাষার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ নাই। এদের মনে যদি বাংলাভাষার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকতো—তাহলে, বাংলাভাষা কি এতোদিনেও বাংলাদেশে উপেক্ষিত থাকতো?
পাকিস্তানীজালিমগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইসংগ্রাম করে আমরা ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি। এখানে, আমরা মানে—আমাদের পূর্বপুরুষ—শহীদ রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম শফিউর প্রমুখ। ভাষাআন্দোলনের ৬৫ বছর পার হয়ে গেছে। তবুও আমরা বাংলাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বমহিমায় ও আপন-মর্যাদায় আজও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
বাংলাদেশে এখনও পাকিস্তানীদের ভূত চেপে বসে আছে। পাকিস্তানীদের মতোই এখনও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বাংলাভাষার প্রতি বিমাতাসুলভ-আচরণপ্রকাশ করা হচ্ছে। দেশের শাসকগোষ্ঠী তথা সরকার বাংলাভাষাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে। আর সবাই মুখে-মুখে কিংবা লোকদেখানোভাবে বাংলাভাষার জন্য মায়াকান্নাপ্রদর্শন করে নিজেদের ইমেজবৃদ্ধি করার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে, দেশস্বাধীনের পর কোনো সরকারই বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অগ্রাধিকার ও বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য কোনোপ্রকার কার্যকর পদক্ষেপগ্রহণ করেনি। আজ পর্যন্ত কেউই বাংলাভাষাকে ভালোবেসে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ব্যবহারের ও প্রচলনের কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেনি। সবাই শুধু সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করার অপকৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে। দেশস্বাধীনের পর একজন স্বৈরশাসক—এরশাদ দেশে সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের জন্য সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে আইনপ্রণয়ন করেন। তারপর আবার সবকিছু থেমে যায়। আর বর্তমান আওয়ামীলীগসরকারও ২০১৩ সালে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের এক নির্দেশ জারী করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এসব শুধু কাগজে-কলমে। এদেশে বাংলাভাষার পক্ষে আজও কোনো বাঘ তৈরি হয়নি। আছে শুধু লোকদেখানো কতকগুলো কাগুজেবাঘ। আর এদের হাতে বাংলাভাষা প্রতিদিন আর প্রতিনিয়ত কেবল নিঃগৃহীতই হচ্ছে! তাহলে, আমাদের রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ কী? কীভাবে এটি রাষ্ট্রভাষা বলে বিবেচিত হবে? আর সবকিছুই কি শুধু কাগজে-কলমে?
এই দেশে ২১-এ ফেব্রুআরি এলে কত-শত ভাষাপ্রেমিক দেখা যায়! আর তাদের কী চেহারা! এরা একেকজন বাংলাভাষার জন্য কেঁদে-কেঁদে একেবারে অন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার! আর ২১-এ ফেব্রুআরির প্রথম প্রহরে অর্থাৎ, রাত বারোটা একমিনিটে শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার জন্য কত যুদ্ধংদেহীমনোভাব! কিন্তু জানি, এসবই লোকদেখানো আর ভয়ানক ভণ্ডামি।
এখন আগের মতো হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আর প্রভাতফেরিও হয় না। হয়তো কোথাও-কোথাও হয়। তা হয়তো আমার জানা নাই। কিন্তু চোখের সামনে আজকাল যা দেখছি তা সম্পূর্ণ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। একুশের প্রথম প্রহরে ফুল দেওয়ার জন্য যুদ্ধ করা যায়—কিন্তু বাংলাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সর্বস্তরে প্রচলনের জন্য সামান্য একটু লড়াই করা যায় না?
এই দেশে ভণ্ডামি আর কত দেখবো! ইচ্ছা করে এখন সমাজের কথিত-এলিটশ্রেণী বাংলাকে দাবিয়ে রেখেছে আর নিয়মিত রাখছে। আর এদের সর্বপ্রকার সমর্থন দিচ্ছে এদেশেরই সরকার! এই দেশে আজও বাংলাভাষাপ্রেমিক-সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবখানে আজ মোনাফেকি। শহীদদের রক্তের সঙ্গে সবাই বেঈমানী করছে হাসিমুখে। আর সবসময় শুনছি মিথ্যাআশ্বাস। কিন্তু ভরসা নাই কোথাও!
আজ বাংলাদেশের আদালতে (উচ্চ, মধ্য, নিম্ন সবখানে) ইংরেজি-ভাষার সীমাহীন দাপট! আর উচ্চ-আদালতে তো বাংলাভাষার প্রতি রীতিমতো অবজ্ঞাই করা হচ্ছে। সমস্ত সরকারি-অফিসে ইংরেজি-ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য আর নগ্ন-দাপট। বেসরকারি-প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরও ভয়াবহ দাপট দেখা যায়। পারলে এরা বাংলাভাষাকে তাদের অফিসে নিষিদ্ধ করে আরকি!
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ইংরেজি-ভাষার দাপট বাড়ছে। এখানেও ইংরেজি-ভাষার নগ্ন-হস্তক্ষেপ! আর দেশের প্রাইভেট-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বাংলাভাষাকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর দেশের সরকার-বাহাদুর তা-ই দেখে আনন্দে উদ্বেলিত।
সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে বাংলাভাষার অমর্যাদা করা হচ্ছে। এখানে, সরকারের কতকগুলো দালাল আর চামচা নিজেদের সবজান্তা মনে করে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে রীতিমতো আগ্রাসন শুরু করেছে। এরা নরঘাতক-পাকিস্তানীদের চেয়েও এককাঠি সরেস!
এখন দেশের প্রশাসনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বসে আছে একেকটা জিন্না! এরা সবসময় নিজেদের শয়তানীশক্তির প্রভাব খাটিয়ে বাংলাভাষার বুকে ছুরি চালাচ্ছে। এরা পাকিস্তানীদের চেয়েও এখন বেশি হিংস্র।
পাকিস্তানআমলে একজন জিন্না, একজন খাজা নাজিমউদ্দিন ছিল। আর এখন বাংলাদেশে জন্মলাভ করেছে অসংখ্য জিন্না, অসংখ্য খাজা নাজিমউদ্দিন! এদের সীমাহীন আগ্রাসনে স্বদেশে বাংলাভাষা আজ একেবারে কোণঠাসা! বাংলাভাষার কণ্ঠচেপে ধরেছে এখন এদেশীয় জিন্না আর খাজা নাজিমউদ্দিন, লিয়াকত আলীগং! এদের আগ্রাসন ও শয়তানী ঠেকানোর কোনো বন্দোবস্ত এদেশের সরকারের নাই। এখন দেশের সরকার থেকে শুরু করে একশ্রেণীর চূড়ান্ত-ভণ্ড বাংলাভাষার বুকে ইংরেজি-পেরেক ঠুকে বাংলার প্রতি দরদপ্রর্দশন করছে! এরা জিন্নার চেয়েও খারাপ।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৩/০২/২০১৭
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
এস এম আলমগীর হোসেন ০৪/০৩/২০১৭খুবই ভাল
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৪/০৩/২০১৭এতে সরকারের কোন দোষ আছে কি???
-
মনিরুল ইসলাম ফারাবী ০৪/০৩/২০১৭valo bolecen