সংসার
আজকাল পাকা সড়কে উঠতে উঠতেই হাঁপিয়ে যাই; যদিও সড়কটি বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। চৈতের দুপুর। অসুস্থ মালতিকে একা রেখেই বেরোতে হবে। আরও মাইল খানেক সড়ক ধরে যেতে হবে লতিফের চায়ের দোকান পর্যন্ত; ওখানেই শুধু বাসগুলো থামে। মেয়ের বাড়ি বাসে আবার এক ঘন্টার পথ। মেলেন্দ বাজার। বাসষ্ট্যান্ড থেকেও আবার মেঠো পথে ঘন্টা খানেক হাটতে হবে। মেয়েটাও নাকি অসুস্থ; বাচ্চা হবে পাশের বাড়ির কমলা জানালো। কমলা মেলেন্দ বাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আয়ার চাকরী করে। ছুটিতে তার মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। মালতিকে খবরটা দিতেই আর কি ! শুরু হলো তোলপাড়; আমি এই বুড়ো বয়সে মেয়ের খোঁজ নিতে মালতির আবদার রক্ষা ছাড়া কোন উপায় পেলাম না।
-‘ছাতাটি কোথায় রেখেছো, মালতি’ ?
তিন বছর আগে মালয়েশিয়া থেকে ছুটিতে দেশে আসার সময় মীর বাড়ির নুরু দিয়েছিল। ও আমারই ছাত্র স্কুল বয়সের। মালতি বিছানায় আজ মাস হয়ে গেল পড়ে আছে। তবু মেয়ের বাড়ি যাবো শুনে, দ্যাখি ছাতাটি খুঁজতে শুরু করেছে। পেলো ঘরের কোণে ঘুণে খাওয়া ঢাকনা বিহীন কাঠের বাক্সে। কত ত্যানায় যে পেঁচানো। ছাতাটি খুলে দ্যাখে ইঁদুরে বড় বড় কয়েকটা ছিদ্র করে ফেলেছে। যে রুগ্ন মুখে এতক্ষণ হাসি দেখলাম, তার ফ্যাকাসে মুখে চমকে উঠেছি। চোখগুলোও ভেজা ভেজা।
-‘এখন কি হবে গো’। সে হয়ত ভেবেছে, আমি আর যাবো না।
আমার কষ্ট হয় হোক, তবু বল্লাম-‘যাবো যখন বলেছি একবার, রোদ প্রচন্ড আগুনের মতো হোক না, যবোই’।
শুকনো মুখে যেন জোর করেই হাসি মেখে আবার বিছানায় ঢলে পড়লো। আমি বালিশটার যে দিকে তুলো আছে সে দিকটা মাথার নীচে দিয়ে দিয়েছি। খুব দুর্বল শরীর। ঠিক মত নাওয়া খাওয়া নেই। আমি বুড়ো ছেলে হয়েও রান্নাবান্না কতটুকুই বা কি করতে পারি। মালতি যখন সুস্থ্য ছিল, তখন আমার ঝামেলাই ছিল না। আমাকে কখন কি খাওয়াবে তার কত চিন্তা ভাবনা।
-‘ওগো শুনছো, তোমার মাথার কাছেই ভাত আর তরকারী যতটুকু রান্না করেছি তাই রাখা আছে; জল ভর্তি গ্লাসটিও। সময় মত যা পার খেয়ে নিও। আমার আসতে যদি দেরী হয়ে যায়’।
বছর খানেক হয়ে গেল, মেয়েটাও আসলো না। আর আমরা বুড়োবুড়ি দু’টি প্রাণী কি যে অসহনীয় নিঃসঙ্গ জীবন কাটে। পাশেই অবশ্য ফকরুদ্দীন মোড়লের বাড়ি। ওদের সংসারে তো আমাদের মত আর অতো টানাটানি নেই। তাছাড়া আমরা হিন্দু ও গরীব পরিবার। অবসর ভাতা কয় টাকা আর পাই। দিন আনা দিন খাওয়ার মত। পারুল নামে তার একটি মেয়ে আছে। আমার এক সময়ের ছাত্রী এবং আমার মেয়ের বান্ধবীও বটে।
পারুল মেয়েটা খুব ভালো। জাত পাত যেন মানে না। ও মালতিকে রান্নাবান্নাতে, তরী তরকারি কেটে কুটে সাহায্য করতে প্রায়ই আসে। তার বড় ভাই অবশ্য এসব পছন্দ করে না। মালতি অসুস্থ্য হওয়ার পরেও খবরটা অন্তত রাখে। আর সুযোগ পেলেই আমাকে রান্নাবান্নাটা শিখিয়েও দিয়ে যায়। আজ পাঁচ ছয় দিন হলো ও আসলো না। বোধ হয় বড় ভাই শাসন করেছে। অথচ আজকেই ওর যে একটু দরকার অনুভব করলাম। মালতি একা। মাটির কলসী থেকে জল ভরে খাওয়ার শক্তিটুকু যেন তার নেই। বের হবো দরজায় পা রেখেছি, মালতি মাথাটা তুলে বল্লো:
পারুল মেয়েটা খুব ভালো। জাত পাত যেন মানে না। ও মালতিকে রান্নাবান্নাতে, তরী তরকারি কেটে কুটে সাহায্য করতে প্রায়ই আসে। তার বড় ভাই অবশ্য এসব পছন্দ করে না। মালতি অসুস্থ্য হওয়ার পরেও খবরটা অন্তত রাখে। আর সুযোগ পেলেই আমাকে রান্নাবান্নাটা শিখিয়েও দিয়ে যায়। আজ পাঁচ ছয় দিন হলো ও আসলো না। বোধ হয় বড় ভাই শাসন করেছে। অথচ আজকেই ওর যে একটু দরকার অনুভব করলাম। মালতি একা। মাটির কলসী থেকে জল ভরে খাওয়ার শক্তিটুকু যেন তার নেই। বের হবো দরজায় পা রেখেছি, মালতি মাথাটা তুলে বল্লো:
-‘যদি তোমার স্বাস্থ্য না কুলোয়, যেয়ো না গো’। দেখলাম গাল বেয়ে জল পড়ছে। আমিও কান্না থামাতে পারলাম না। আস্তে করে বাঁশের দরজাটা সরাতে সরাতে বলি:
-‘আসি। খেয়ে নিয়ো কিন্তু’।
পথ চলতে চলতে মোড়ল বাড়ির জাম গাছটির নীচে দাঁড়ালাম। ভাবছি, যদি পারুল মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। ঈশ্বরের কি ইচ্ছে, ঐ জাম গাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে পড়লো। মেয়েটা বড় হাসি খুশী চঞ্চল; এখনও যেন কৈশোর ফুরোয় নি। গাছ থেকে নেমে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো।
-‘কোথায় যাচ্ছেন, স্যার’। কথাটি বলেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি তো বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা।
-‘যাচ্ছি, মেয়ের বাড়ি’।
-‘ও ! উমার কাছে। কি গরম ! আগুনের মত রোদ; ছাতা নেই, স্যার ? একটু দাঁড়ান, একটা ছাতা দিই’।
-‘না না ছাতার দরকার হবে না। একটা কথা শুন, মা। বাড়ীতে তোমার কাকিমা একা। সন্ধ্যে বেলায় একটু কুপি বাতিটা জ্বেলে দিয়ে এসো। ওর গায়ে একদম বল নেই, অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তেমন হুশও নেই। নয়ত অন্ধকারেই পড়ে থাকবে’।
-‘আপনি ভাববেন না, স্যার। আমি চুপ করে হলেও যাবো’। একটু স্বস্তি পাওয়া গেল যেন। …ক্রমশ
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৮/০৬/২০১৬
-
শ্যামেন্দু ০৮/০২/২০১৬পারুলের মানবতাবোধ বেশ উল্লেখ করার মত
-
আজিজ আহমেদ ০৫/০২/২০১৬ভাল লাগলো
-
নির্ঝর ০৪/০২/২০১৬অনেক অনেক ভাল
-
দেবব্রত সান্যাল ০৩/০২/২০১৬আপনার ডিটেলের কাজ খুব ভালো। ঘটনাটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। ছাপার ভুল শুধরে নেবেন।
-
বিদ্রোহী ফাহিম খান ০৩/০২/২০১৬অসাধারণ
-
প্রদীপ চৌধুরী ০৩/০২/২০১৬সুন্দর
-
মাহাবুব ০৩/০২/২০১৬সুন্দর, ভালো লাগলো।
-
ধ্রুব রাসেল ০৩/০২/২০১৬ভাল লাগল।
রচনা