আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৭৯-৯০)
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৭৯)!
বটকিরা গান!
আমরা আগে গ্রামে অনেক কিছু বলতাম যার কোন অর্থ আদৌ আছে কি না বলতে পারবো না। সেরকম একটি হল বটকিরা গান! বৈঠক থেকে বৈঠকী গান আর আমরা এই গানকে বানিয়ে বলতাম বটকিরা গান। আদতে তা বৈঠকী গান ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের এলাকায় অনেক বটকিরা গান হত। এগানে দুইটা দল থাকতো। পালাক্রমে এক দলের পর আরেক দল এই গান করতো। এই গান মূলত: বাইবেল ভিত্তিক ধর্মীয় গান। এই গানের প্রতিটি দলে একজন প্রধান ব্যক্তি, তাকে বলা হত সরকার বা গায়েন। গানের মধ্যে একদল অন্য দলকে ধর্মভিত্তিক প্রশ্ন করতো এবং অন্য দল তার উত্তর দিতো। খুবই আকর্ষণীয় ছিলো এই গান। এই গান শুনলে ধর্ম সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান আহরন করা যেত। মানুষ রাত জেগে এই গান উপভোগ করতো। এলাকার ঐতিহ্যবাহী এই গান টিকে থাকুক যুগ যুগ করে।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮০)!
ঢ্যাপ-শালুকের দেশে!
ঢ্যাপ ও শালুক চেনে না এমন লোক গ্রামে আছে বলে আমার জানা নেই। বিশেষ করে যারা বিলের জলে বড় হয়েছে তাদের কাছে ঢ্যাপ ও শালুক চির চেনা। শাপলার উপরের অংশে জন্মে ঢ্যাপ যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কনা সদৃশ বস্তুর মত। শালুক শাপলা ফুলের নীচের দিকে জন্মে যার কোন সাইজ নেই। আমরা কোন্দা বা নৌকা নিয়ে মাঝ বিলে যেতাম ঢ্যাপ আনার জন্য। আবার অল্প জলে ডুব দিয়ে শালুক আনারও আনন্দ উপভোগ করতাম। একটা ঢ্যাপ বা একটা শালুক আমাদের কাছে মহামূল্যবান বস্তু ছিলো। আমাদের জীবনের অনেক স্মৃতি এই শালুক ও ঢ্যাপের সাথে জড়িয়ে আছে।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮১)!
গাব!
গাব এক ধরনের ফল। গ্রামে অনেক গাব গাছ থাকলেও পুরানো গাব গাছ এখন তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের কাছে গাব ছিলো খুবই লোভনীয় ফল। একেবারে অমৃতের মত! আমরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই গাব গাছে উঠতাম একটা পাকা গাব পাওয়ার জন্য। গাছের মগ ডালে পর্যন্ত উঠে যেতাম এই গাবের জন্য। আর যাদি পেয়ে যেতাম তবে কি যে খুশী লাগতো তা এখন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। একটা গাব পেলে সারা দিনটাই আনন্দময় হত। আমাদের প্রতিদিনের কাজ ছিলো সকালে অন্তত: একবার গাব গাছে উঠা। আমরা অনেক সময় কাঁচা গাব গাছ থেকে পেরে খেরে পাড়ার মধ্যে পাকার জন্য রেখে দিতাম। এটাকে বলতাম জাগ দেয়া। এই জাগ দেয়া গাব সমবয়সী অনেকে মিলে খেতাম। গাব খুবই সুস্বাদু ফল। পাকা গাবের বীজ খেতে খুবই মজাদার। পাকা গাবের বীজ ছাড়া অন্যান্য অংশও খেতে বেশ ভালো। কাঁচা গাবও খুব দরকারী। কাঁচা গাবের ভিতরটা আঠালো প্রকৃতির। কাঁচা গাব নৌকায় দেয়া হলে নৌকার বর্ণ সুন্দর হয় এবং নৌকা বেশীদনি টেকসই হয়। জালের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্যও এই গাব দেয়া হত।
১৩.0৫.২১
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮২)!
পুকুরে গোসল করা!
আমরা আগে পুকুরে গোসল করতাম। কলের পানিতে গোসল করার সুযোগ সারা জীবনে খুব একটা হয় নি। তাছাড়া কল চেপে পানি বের করে সেই পানি দিয়ে গোসল করা খুবই কষ্টের ব্যাপার। পুকুরে পানি থাকতে আমরা সেই কষ্টটা সাধারণত: করতাম না। গ্রীষ্মকালে আমরা পুকুরের পাড় থেকে লাফিয়ে পুকুরে পড়তাম এবং গোসল করে আমাদের শরীরকে আদ্র করতাম। পুকুরে গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ২/১টা মাছও ধরে ফেলতাম। এটা ছিলো পুকুরে গোসল করার বোনাস। বর্ষাকালে পুকুর আর পুকুর থাকতো না। পুকুর বিলের সাথে মিলে বিলের রূপ পরিগ্রহ করতো। অর্থাৎ পুকুর হত বিল। তখন সমবয়সী আমরা গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পুকুরে পড়তাম আর গোসল করতাম। সাঁতার দিতাম। কখনো কখনো মনের অজান্তে সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম। এই স্মৃতিভেজা দিনগুলো আর কখনো ফিরে পাবো না। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৩)!
আমাদের ছুক্কি খেলা!
ছুক্কি খেলা বললে অনেকে হয়তো বুঝতে পারবে না। তবে মার্বেল খেলা বললে অনেকে বুঝবেন। ছুক্কি খেলার আরেক নাম মার্বেল খেলা। গোলাকৃতি মার্বেলকে আমরা বলতাম ছুক্কি। ছোটবেলায় এই ছুক্কি খেলা আমাদের খুব প্রিয় ছিলো। একেবারে নেশার মত লাগলো। একবার খেলা শুরু করলে দিন চলে যেত, কিন্তু খেলা শেষ হতো না। এই খেলার জন্য একজন পার্টনার, গোলাকৃতি মার্বেল (ছুক্কি) ও সমতল ভূমি (উঠান বা দুয়ার) লাগতো। দুইজনের সমসংখ্যক ছুক্কি দিয়ে এ খেলা শুরু হত। একজন উভয়পক্ষের ছুক্কিগুলো উঠানের/দুয়ারের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতো এবং দূর থেকে অপর জনের নির্দেশিত ছুক্কিতে টাক দিতে পারলে তিনি ঐ পর্যায়ে বিজয়ী হতেন এবং উভয়পক্ষের ছুক্কিগুলোর অধিকারী হতেন। ছোট বেলায় হাতে কয়েকটি ছুক্কি পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। আর ছুক্কি খেলে কিছু ছুক্কি জিততে পারলে পুরো পৃথিবীটাই যেন হাতের মুঠোয় পেয়ে যেতাম। ছুক্কিগুলো দেখতেও খুব সুন্দর লাগতো। ভিতরের সুন্দর ডিজাইন বাইরে থেকে খুবই সুন্দর লাগতো।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৪)!
কচুরি ফুল !
বিলে অনেক ফুল ফুঁটে। যেমন- শাপলা, পদ্ম, কমলি ইত্যাদি। তবে বিলের সৌন্দর্য্য যে কচুরি ফুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদা বর্ণের এই কচুরি ফুল বিলের সব দিকে শোভা পায়। বিল যেন নয়, এ এক শ্বেত-শুভ্র-কানন। বিলের পানি ধীর-স্থিত হলে সেখানে কচুরি-পানা বাসা বাঁধে। এই কচুরি বড় হয়, ঘন হয়। একসময় এই কচুরি ফুল দেয়। সারা বিল শোভাময় করে তোলে। আমরা কোন্দা দিয়ে কচুরি ফুল কুঁড়িয়েছি অনেক। মালাও গেঁথেছি কত। পড়িয়েছি এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গলায়। এই ফুল তোলা যে শুধুই ফুল তোলা নয়, এক মিলন ও ভ্রাতৃত্বের মহা বন্ধন। এ এক অতীতের অমূল্য ইতিহাস !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৫)!
পাহুর দেয়া !
আমাদের ভাওয়াল এলাকায় (তুমিলিয়া, নাগরী, মঠবাড়ী, রাঙ্গামাটিয়া, দড়িপাড়া. মাউছাইদ, ধরেন্ডা ধর্মপল্লী) অনেক আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে যা আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই আঞ্চলিক শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো অচিরেই সংরক্ষণ করা জরুরী। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই শব্দগুলো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের একটি শব্দ হল পাহুর। যারা জানেন না তার শুনলে অবাক হবেন। অনেকের আবার হাঁসি পাবে। পাহুর মানে আবার কি? এটা কি অভিধানে আছে? অভিধানে না থাকলেও পাহুর-এর একটা সুন্দর অর্থ আছে। গরুর ছোট বাছুর তার মায়ে দুধ পান করে বা দুধ পান করার জন্য যে আহলাদের দৌড় দেয় তাকে পাহুর বলে। এক কথায় বাছুর কর্তৃক আহলাদের লম্ফ-ঝম্প দেয়াই পাহুর। প্রায়সই গরুকে এই ধরনের পাহুর দিতে দেখা যেত। গরু যখন আনন্দে উত্তেজিত হয় তখন পাহুর দেয়। এতে মানুষ অনেকটা ভয়ে থাকতো। কারণ তখন গরু কি করতে কি করে ফেলতো তার কোন ঠিকানা ছিলো না !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৬)!
গাছ পাকা আম !
গ্রীষ্মকাল শুরু হলেই আম পাকা শুরু হত। কত যে আম খেয়েছি ! এর কোন হিসাব পত্র নেই। কুড়িয়ে খেয়েছি। কিনে খেয়েছি। অনেক আম গাছ থেকে পুকুরে গিয়ে পড়তো। সেই আম পেতে কি যে প্রানান্ত পরিশ্রম ! এই আমকে মুক্তা মনে করে পুকুরে দিতাম এক ডুব। ডুব দিয়ে মুক্তাসম আম নিজের করে নিতাম আর প্রাণ ভরে (খেতাম) উপভোগ করতাম। সবচেয়ে ভালো লাগতো গাছ পাকা আম গাছে বসে খেতে। আমরা ছেলে বেলায় সমবয়সীরা একসাথে উঠে যেতাম আমগাছে। অনেক কষ্টে শিষ্টে পেয়ে যেতাম পাকা আম। আর গাছের মগ ডালে বসে সেই আম খেতাম। আহা ! কি মজা ! মিষ্টি যেন গুর !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৭)!
১০ পয়সার আইসক্রীম !
সত্তর দশকের শেষ দিকে এবং আশির দশকে আমরা ৫ পয়সা/১০ পয়সা দিয়ে আইসক্রীম কিনে খেয়েছি। স্কুলের ফটকে এই আইসক্রীমওয়ালাদের দেখা যেত বেশী। তবে তারা পাড়া-মহল্লায়ও এই আইসক্রীম বিক্রি করতো। আইসক্রীমওয়ালারা একটি বাক্স সদৃশ পাত্রে আইসক্রীমগুলো রাখতো এবং ক্রেতাদের নজর কাড়ার জন্য পাত্রের ঢাকনা লাগানোর সময় বিকট শব্দ করতো। বরফের সাথে রঙ্গীন পানির সংমিশ্রনে এই আইসক্রীমগুলো তৈরী করা হত। কিন্তু এই রঙ্গীন বরফ পানিই তখন আমাদের কাছে অমৃতের মত লাগতো। অনেক সময় পয়সার অভাবে হয়তো কিনতেও পারতাম না।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৮)!
আমাদের জীবনে সুখের দাম ছিলো ১ টাকারও কম !
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের দেশে পয়সার প্রচলন ছিলো। ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা। তখন অবশ্য ১ পয়সায় তেমন কিছু পাওয়া যেত না। তবে ৫ পয়সায় কিছু জিনিস পাওয়া যেত এবং ১০ পয়সায় অনেক কিছু পাওয়া যেত। আমার মনে আছে, ১০ পয়সায় আইসক্রীম পাওয়া যেত। ১০ পয়সায় গাট্টা ও চিন্তামনি পাওয়া যেত। আমরা ১০ পয়সার গাট্টা ও চিন্তামনি অনেক খেয়েছি স্কুলে পড়ার সময়। ছোটবেলায় আমাদের টিফিন খাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে সাধারণত: ৫/১০ পয়সা দেয়া হত। এতেই আমরা অনেক খুশী থাকতাম। ৪ আনা (২৫ পয়সা) বা ৮ আনা (৫০ পয়সা) টিফিন খাওয়ার জন্য পেলে আমরা যার পরনাই খুশী হতাম। এই খুশী কোন মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। হায়রে সেই দিনগুলো!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৯)!
কয়েন ও আনার হিসাব !
আগে আমাদের চাহিদা ছিলো অল্প। করতাম আনার হিসাব। করতাম পয়সার হিসাব। এক টাকারও কম হিসাব। ছিলো ৫/১০/২৫/৫০ পয়সার কয়েন। ঢাকায় ছিলো কয়েনবক্স টেলিফোন। এই ফোনে কয়েন প্রবেশ করালে ডায়াল টোন আসতো এবং পরে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফোন করা যেত। মোবাইল আসার পরে টেলিফোন জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল। যাহোক, ২৫ পয়সায় ৪ আনা হিসাব করতাম। ৫০ পয়সায় হিসাব করতাম ৮ আনা আর ১৬ আনায় ১ টাকা। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কত পয়সার এক আনা হয় তা কখনো হিসাব করতাম না বা এ নিয়ে কখনো প্রশ্নও করতাম না। এখন হিসাব করে দেখি ১ আনায় ৬.২৫ পয়সা। এখন বুঝেছি, এই বেখাপ্পা হিসাবের জন্যই ১ আনাকে পয়সার হিসেবে নেয়া হত না। শুধু ৪ আনা ও ৮ আনা করতাম।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৯০)!
জাম ও জাবন !
আমরা ছোট বেলায় আমের সাথে জাম খেয়েছি সমান তালে। কিন্তু এখন আমাদের এলাকায় জাম তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের এলাকাতে আগে যেমন ছিলো আম গাছ, সমানতালে ছিলো জাম গাছ, আর আমরা আম-জাম খেয়েছি প্রায় সম হারে। জাম ও জাবন মূলত একই প্রজাতির ফল। জাম একটু লম্বাটে আকৃতির। কিন্তু জাবন গোলাকৃতির। তবে এর কোন ব্যাখ্যা অভিধানে আছে বলে মনে হয় না।
বটকিরা গান!
আমরা আগে গ্রামে অনেক কিছু বলতাম যার কোন অর্থ আদৌ আছে কি না বলতে পারবো না। সেরকম একটি হল বটকিরা গান! বৈঠক থেকে বৈঠকী গান আর আমরা এই গানকে বানিয়ে বলতাম বটকিরা গান। আদতে তা বৈঠকী গান ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের এলাকায় অনেক বটকিরা গান হত। এগানে দুইটা দল থাকতো। পালাক্রমে এক দলের পর আরেক দল এই গান করতো। এই গান মূলত: বাইবেল ভিত্তিক ধর্মীয় গান। এই গানের প্রতিটি দলে একজন প্রধান ব্যক্তি, তাকে বলা হত সরকার বা গায়েন। গানের মধ্যে একদল অন্য দলকে ধর্মভিত্তিক প্রশ্ন করতো এবং অন্য দল তার উত্তর দিতো। খুবই আকর্ষণীয় ছিলো এই গান। এই গান শুনলে ধর্ম সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান আহরন করা যেত। মানুষ রাত জেগে এই গান উপভোগ করতো। এলাকার ঐতিহ্যবাহী এই গান টিকে থাকুক যুগ যুগ করে।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮০)!
ঢ্যাপ-শালুকের দেশে!
ঢ্যাপ ও শালুক চেনে না এমন লোক গ্রামে আছে বলে আমার জানা নেই। বিশেষ করে যারা বিলের জলে বড় হয়েছে তাদের কাছে ঢ্যাপ ও শালুক চির চেনা। শাপলার উপরের অংশে জন্মে ঢ্যাপ যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কনা সদৃশ বস্তুর মত। শালুক শাপলা ফুলের নীচের দিকে জন্মে যার কোন সাইজ নেই। আমরা কোন্দা বা নৌকা নিয়ে মাঝ বিলে যেতাম ঢ্যাপ আনার জন্য। আবার অল্প জলে ডুব দিয়ে শালুক আনারও আনন্দ উপভোগ করতাম। একটা ঢ্যাপ বা একটা শালুক আমাদের কাছে মহামূল্যবান বস্তু ছিলো। আমাদের জীবনের অনেক স্মৃতি এই শালুক ও ঢ্যাপের সাথে জড়িয়ে আছে।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮১)!
গাব!
গাব এক ধরনের ফল। গ্রামে অনেক গাব গাছ থাকলেও পুরানো গাব গাছ এখন তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের কাছে গাব ছিলো খুবই লোভনীয় ফল। একেবারে অমৃতের মত! আমরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই গাব গাছে উঠতাম একটা পাকা গাব পাওয়ার জন্য। গাছের মগ ডালে পর্যন্ত উঠে যেতাম এই গাবের জন্য। আর যাদি পেয়ে যেতাম তবে কি যে খুশী লাগতো তা এখন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। একটা গাব পেলে সারা দিনটাই আনন্দময় হত। আমাদের প্রতিদিনের কাজ ছিলো সকালে অন্তত: একবার গাব গাছে উঠা। আমরা অনেক সময় কাঁচা গাব গাছ থেকে পেরে খেরে পাড়ার মধ্যে পাকার জন্য রেখে দিতাম। এটাকে বলতাম জাগ দেয়া। এই জাগ দেয়া গাব সমবয়সী অনেকে মিলে খেতাম। গাব খুবই সুস্বাদু ফল। পাকা গাবের বীজ খেতে খুবই মজাদার। পাকা গাবের বীজ ছাড়া অন্যান্য অংশও খেতে বেশ ভালো। কাঁচা গাবও খুব দরকারী। কাঁচা গাবের ভিতরটা আঠালো প্রকৃতির। কাঁচা গাব নৌকায় দেয়া হলে নৌকার বর্ণ সুন্দর হয় এবং নৌকা বেশীদনি টেকসই হয়। জালের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্যও এই গাব দেয়া হত।
১৩.0৫.২১
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮২)!
পুকুরে গোসল করা!
আমরা আগে পুকুরে গোসল করতাম। কলের পানিতে গোসল করার সুযোগ সারা জীবনে খুব একটা হয় নি। তাছাড়া কল চেপে পানি বের করে সেই পানি দিয়ে গোসল করা খুবই কষ্টের ব্যাপার। পুকুরে পানি থাকতে আমরা সেই কষ্টটা সাধারণত: করতাম না। গ্রীষ্মকালে আমরা পুকুরের পাড় থেকে লাফিয়ে পুকুরে পড়তাম এবং গোসল করে আমাদের শরীরকে আদ্র করতাম। পুকুরে গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ২/১টা মাছও ধরে ফেলতাম। এটা ছিলো পুকুরে গোসল করার বোনাস। বর্ষাকালে পুকুর আর পুকুর থাকতো না। পুকুর বিলের সাথে মিলে বিলের রূপ পরিগ্রহ করতো। অর্থাৎ পুকুর হত বিল। তখন সমবয়সী আমরা গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পুকুরে পড়তাম আর গোসল করতাম। সাঁতার দিতাম। কখনো কখনো মনের অজান্তে সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম। এই স্মৃতিভেজা দিনগুলো আর কখনো ফিরে পাবো না। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৩)!
আমাদের ছুক্কি খেলা!
ছুক্কি খেলা বললে অনেকে হয়তো বুঝতে পারবে না। তবে মার্বেল খেলা বললে অনেকে বুঝবেন। ছুক্কি খেলার আরেক নাম মার্বেল খেলা। গোলাকৃতি মার্বেলকে আমরা বলতাম ছুক্কি। ছোটবেলায় এই ছুক্কি খেলা আমাদের খুব প্রিয় ছিলো। একেবারে নেশার মত লাগলো। একবার খেলা শুরু করলে দিন চলে যেত, কিন্তু খেলা শেষ হতো না। এই খেলার জন্য একজন পার্টনার, গোলাকৃতি মার্বেল (ছুক্কি) ও সমতল ভূমি (উঠান বা দুয়ার) লাগতো। দুইজনের সমসংখ্যক ছুক্কি দিয়ে এ খেলা শুরু হত। একজন উভয়পক্ষের ছুক্কিগুলো উঠানের/দুয়ারের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতো এবং দূর থেকে অপর জনের নির্দেশিত ছুক্কিতে টাক দিতে পারলে তিনি ঐ পর্যায়ে বিজয়ী হতেন এবং উভয়পক্ষের ছুক্কিগুলোর অধিকারী হতেন। ছোট বেলায় হাতে কয়েকটি ছুক্কি পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। আর ছুক্কি খেলে কিছু ছুক্কি জিততে পারলে পুরো পৃথিবীটাই যেন হাতের মুঠোয় পেয়ে যেতাম। ছুক্কিগুলো দেখতেও খুব সুন্দর লাগতো। ভিতরের সুন্দর ডিজাইন বাইরে থেকে খুবই সুন্দর লাগতো।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৪)!
কচুরি ফুল !
বিলে অনেক ফুল ফুঁটে। যেমন- শাপলা, পদ্ম, কমলি ইত্যাদি। তবে বিলের সৌন্দর্য্য যে কচুরি ফুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদা বর্ণের এই কচুরি ফুল বিলের সব দিকে শোভা পায়। বিল যেন নয়, এ এক শ্বেত-শুভ্র-কানন। বিলের পানি ধীর-স্থিত হলে সেখানে কচুরি-পানা বাসা বাঁধে। এই কচুরি বড় হয়, ঘন হয়। একসময় এই কচুরি ফুল দেয়। সারা বিল শোভাময় করে তোলে। আমরা কোন্দা দিয়ে কচুরি ফুল কুঁড়িয়েছি অনেক। মালাও গেঁথেছি কত। পড়িয়েছি এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গলায়। এই ফুল তোলা যে শুধুই ফুল তোলা নয়, এক মিলন ও ভ্রাতৃত্বের মহা বন্ধন। এ এক অতীতের অমূল্য ইতিহাস !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৫)!
পাহুর দেয়া !
আমাদের ভাওয়াল এলাকায় (তুমিলিয়া, নাগরী, মঠবাড়ী, রাঙ্গামাটিয়া, দড়িপাড়া. মাউছাইদ, ধরেন্ডা ধর্মপল্লী) অনেক আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে যা আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই আঞ্চলিক শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো অচিরেই সংরক্ষণ করা জরুরী। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই শব্দগুলো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের একটি শব্দ হল পাহুর। যারা জানেন না তার শুনলে অবাক হবেন। অনেকের আবার হাঁসি পাবে। পাহুর মানে আবার কি? এটা কি অভিধানে আছে? অভিধানে না থাকলেও পাহুর-এর একটা সুন্দর অর্থ আছে। গরুর ছোট বাছুর তার মায়ে দুধ পান করে বা দুধ পান করার জন্য যে আহলাদের দৌড় দেয় তাকে পাহুর বলে। এক কথায় বাছুর কর্তৃক আহলাদের লম্ফ-ঝম্প দেয়াই পাহুর। প্রায়সই গরুকে এই ধরনের পাহুর দিতে দেখা যেত। গরু যখন আনন্দে উত্তেজিত হয় তখন পাহুর দেয়। এতে মানুষ অনেকটা ভয়ে থাকতো। কারণ তখন গরু কি করতে কি করে ফেলতো তার কোন ঠিকানা ছিলো না !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৬)!
গাছ পাকা আম !
গ্রীষ্মকাল শুরু হলেই আম পাকা শুরু হত। কত যে আম খেয়েছি ! এর কোন হিসাব পত্র নেই। কুড়িয়ে খেয়েছি। কিনে খেয়েছি। অনেক আম গাছ থেকে পুকুরে গিয়ে পড়তো। সেই আম পেতে কি যে প্রানান্ত পরিশ্রম ! এই আমকে মুক্তা মনে করে পুকুরে দিতাম এক ডুব। ডুব দিয়ে মুক্তাসম আম নিজের করে নিতাম আর প্রাণ ভরে (খেতাম) উপভোগ করতাম। সবচেয়ে ভালো লাগতো গাছ পাকা আম গাছে বসে খেতে। আমরা ছেলে বেলায় সমবয়সীরা একসাথে উঠে যেতাম আমগাছে। অনেক কষ্টে শিষ্টে পেয়ে যেতাম পাকা আম। আর গাছের মগ ডালে বসে সেই আম খেতাম। আহা ! কি মজা ! মিষ্টি যেন গুর !
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৭)!
১০ পয়সার আইসক্রীম !
সত্তর দশকের শেষ দিকে এবং আশির দশকে আমরা ৫ পয়সা/১০ পয়সা দিয়ে আইসক্রীম কিনে খেয়েছি। স্কুলের ফটকে এই আইসক্রীমওয়ালাদের দেখা যেত বেশী। তবে তারা পাড়া-মহল্লায়ও এই আইসক্রীম বিক্রি করতো। আইসক্রীমওয়ালারা একটি বাক্স সদৃশ পাত্রে আইসক্রীমগুলো রাখতো এবং ক্রেতাদের নজর কাড়ার জন্য পাত্রের ঢাকনা লাগানোর সময় বিকট শব্দ করতো। বরফের সাথে রঙ্গীন পানির সংমিশ্রনে এই আইসক্রীমগুলো তৈরী করা হত। কিন্তু এই রঙ্গীন বরফ পানিই তখন আমাদের কাছে অমৃতের মত লাগতো। অনেক সময় পয়সার অভাবে হয়তো কিনতেও পারতাম না।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৮)!
আমাদের জীবনে সুখের দাম ছিলো ১ টাকারও কম !
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের দেশে পয়সার প্রচলন ছিলো। ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা। তখন অবশ্য ১ পয়সায় তেমন কিছু পাওয়া যেত না। তবে ৫ পয়সায় কিছু জিনিস পাওয়া যেত এবং ১০ পয়সায় অনেক কিছু পাওয়া যেত। আমার মনে আছে, ১০ পয়সায় আইসক্রীম পাওয়া যেত। ১০ পয়সায় গাট্টা ও চিন্তামনি পাওয়া যেত। আমরা ১০ পয়সার গাট্টা ও চিন্তামনি অনেক খেয়েছি স্কুলে পড়ার সময়। ছোটবেলায় আমাদের টিফিন খাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে সাধারণত: ৫/১০ পয়সা দেয়া হত। এতেই আমরা অনেক খুশী থাকতাম। ৪ আনা (২৫ পয়সা) বা ৮ আনা (৫০ পয়সা) টিফিন খাওয়ার জন্য পেলে আমরা যার পরনাই খুশী হতাম। এই খুশী কোন মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। হায়রে সেই দিনগুলো!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৮৯)!
কয়েন ও আনার হিসাব !
আগে আমাদের চাহিদা ছিলো অল্প। করতাম আনার হিসাব। করতাম পয়সার হিসাব। এক টাকারও কম হিসাব। ছিলো ৫/১০/২৫/৫০ পয়সার কয়েন। ঢাকায় ছিলো কয়েনবক্স টেলিফোন। এই ফোনে কয়েন প্রবেশ করালে ডায়াল টোন আসতো এবং পরে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফোন করা যেত। মোবাইল আসার পরে টেলিফোন জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল। যাহোক, ২৫ পয়সায় ৪ আনা হিসাব করতাম। ৫০ পয়সায় হিসাব করতাম ৮ আনা আর ১৬ আনায় ১ টাকা। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কত পয়সার এক আনা হয় তা কখনো হিসাব করতাম না বা এ নিয়ে কখনো প্রশ্নও করতাম না। এখন হিসাব করে দেখি ১ আনায় ৬.২৫ পয়সা। এখন বুঝেছি, এই বেখাপ্পা হিসাবের জন্যই ১ আনাকে পয়সার হিসেবে নেয়া হত না। শুধু ৪ আনা ও ৮ আনা করতাম।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম (৯০)!
জাম ও জাবন !
আমরা ছোট বেলায় আমের সাথে জাম খেয়েছি সমান তালে। কিন্তু এখন আমাদের এলাকায় জাম তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। আমাদের এলাকাতে আগে যেমন ছিলো আম গাছ, সমানতালে ছিলো জাম গাছ, আর আমরা আম-জাম খেয়েছি প্রায় সম হারে। জাম ও জাবন মূলত একই প্রজাতির ফল। জাম একটু লম্বাটে আকৃতির। কিন্তু জাবন গোলাকৃতির। তবে এর কোন ব্যাখ্যা অভিধানে আছে বলে মনে হয় না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাঞ্জু ১৩/০৬/২০২১পুরোনো স্মৃতিগুলো সব সময় আবেগকে আন্দোলিত করে তুলে
-
মাহতাব বাঙ্গালী ১৩/০৬/২০২১সুন্দর দিনগুলো এভাবেই শব্দের মাধ্যমে গ্রথিত হয়ে হয়তো অমর হওয়ার চেষ্টা করবে // উপভোগ্য আপনার "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" সিরিজখানা
-
অনিমেষ চক্রবর্তী ১৩/০৬/২০২১দারুন
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১২/০৬/২০২১আগের দিনগুলো সুন্দর ছিল।