www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আত্মকথা (১৪-২৩)

একজন চাকরের নিজের কথা (১৪)
আমি একজন চাকর। সারাদিন কাজ করি আর রাতে শান্তিতে ঘুমাই। সারাদিন কাজ করলে রাতে খুব ভালো ঘুম হয়। এটাই চরম বাস্তবতা। যারা শারিরীক পরিশ্রম তেমন একটা করে না তাদের রাতে ঘুমে অসুবিধা হয়। কিন্তু আমার এ জীবনে রাতে ঘুমে কোন অসুবিধা হয় নি। এজন্য আমি মনের দিক থেকে অনেক তেজদীপ্ত। মনের মধ্যে কোন কুটিল চিন্তা বসবাস করতে পারে না। মনে সব সময় প্রশান্তি বিরাজ করে।
আমার মনিব একজন কৃষক। এই কৃষকের ঘরে আমি কাজ করি। তার ১০ বিঘা জমি আছে, ৬টা গরু আছে। ৬ টা গরুর মধ্যে ১টা গাই গরু আছে। এই সমস্ত কিছু আমাকে দেখতে হয়। তবে বিভিন্ন কাজে আমার মনিবও যে সহযোগিতা করেন না তা কিন্তু নয়। গরু প্রতিদিন ৩/৪ কেজি দুধ দেয়। আমি সেই দুধ বিক্রি করতে প্রতিদিন বাজারে যাই। আবার আমি মাঠে-ঘাটে কাজও করি। আমার খাওয়া ও আদর যত্নে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু সমস্যা একটা আছে। আর সেটা হল আমার মনিব আমার বেতন প্রতিমাসে ঠিকমত দিতে পারে না। কারণ তার ক্যাশ টাকার অনেক অভাব রয়েছে। গৃরস্থদের আসলে এমনই হয়। এতে আমার কোন দু:খ নেই। আমার প্রতি মনিবের যে ভালোবাসা এটাই আমার কাছে অনেক বড় পাওনা। আমার মনিব প্রতিমাসে আমার বেতন দিতে না পারলেও ধান কাটার মৌসুমে তিনি ধান বিক্রি করে আমার বেতন সব মিটিয়ে দেন। আমাকে প্রতি বছর ১৫ দিনের ছুটি দেন। আমি এই ১৫ দিনে আমার বাড়ী গিয়ে নিজেকে রিচার্জ করে নেই। পরে এসে আবার কাজে লেগে যাই।
ইদানিং মনিবের বড় মেয়ের সাথে আমার অনেক সখ্যতা হয়ে যায়। জানি না, এটা প্রেম কি না? ভালোবাসা কি না? আমি তা করো সাথে বলতেও পারছি না! থাকতেও পারছি না। আমার মনিব জানলে কি হবে এই নিয়ে আমি এখন ভীষণ চিন্তিত! এই অসম প্রেমে আমার মনিব সায় দিবে তো?

একজন পথচারীর আত্মকাহিনী ( ১৫)
আমি একজন পথচারী। আমি ঢাকা শহরের পথচারী। আমার বাসা মালিবাগে। কাজের জন্য আমাকে প্রতিদিন ফার্মগেট আসতে হয় এবং দিন শেষে ফার্মগেট থেকে মালিবাগের বাসার যেতে হয়। আমি পায়ে হেঁটেই সাধারণত: যাওয়া আসা করি। অনেক দিনের অভ্যাস। আমি গাড়ীতে উঠি না। ঢাকা শহরের যে ট্রাফিক জ্যাম এতে করে হেঁটে গেলেই আগে যাওয়া যায়। আমি আগে অবশ্য বাসে যাওয়া-আসা করতাম। কিন্তু এতে আমার সময় অনেক বেশী লাগতো। পরে এই যে হেঁটে যাওয়া শুরু করেছি, তো করেছিই। এখন আর বাসে উঠি না, হেঁটেই সারা পথ যাই। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন বরং বাসে ‍উঠা বিরক্ত লাগে।
আমি ঢাকার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলি একনাগারে। মাঝে মাঝে ফুটপাত দিয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলগুলো আমার যাত্রায় ছন্দপতন ঘটায়। তখন আমি বিরক্ত হই খুবই। কিন্তু কিছুই বলতে পারি না, কিছু করতে পারি না। কেন যে মোটরসাইকেলওয়ালারা ফুটপাত ব্যবহার করে বলতে পারি না। মূল রাস্তায় একটু জ্যাম দেখলেই মোটরসাইকেলচালকরা ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালায়। আমরা নিয়ম মানতে চাই না। তাই আমাদের দেশে ট্রাফিক জ্যাম অনেক বেশী অন্য দেশের তুলনায়।
রাস্তা পারাপারের সময় বেখেয়ালী হলে চলবে না। আমাদের ঢাকার রাস্তা পারাপার হওয়া খুবই কঠিন। বেশী জেব্রা ক্রসিং নেই। নেই তেমন একটা ওভারব্রীজ। আমি সব সময় রাস্তা পারাপারে ওভারব্রীজ ব্যবহার করি। ইহা কষ্টসাধ্য কিন্তু নিরাপদ। আন্ডারপাস মোটে ১/২ টা আছে, তাও আবার প্রয়োজনের সময় থাকে বন্ধ। আমাদের ঢাকার মানুষ ওভারব্রীজ ব্যবহার করতে চায় না। ওভারব্রীজ থাকতেও রাস্তার মধ্য দিয়ে দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয় এবং তখন দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের শহরের মানুষ সচেতন না বলে দুর্ঘটনার হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ঢাকার মানুষকে ওভারব্রীজ ব্যবহারে উৎসাহী করতে হবে। তবে দুর্ঘটনা জ্যামিতিকভাবে কমে যাবে।
মালিবাগ থেকে রেলপথ ধরে ফার্মগেটের কাছাকাছি যাওয়া যায়। কিন্তু আমি নিয়েও রেললাইন দিয়ে চলি না এবং অন্যকেও বলি রেললাইন দিয়ে না আসার জন্য। কারণ, রেললাইন দিয়ে আসলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে বেশী মাত্রায়। যে কোন সময় রেলগাড়ী আসতে পারে। তাই সবাইকে রেললাইন পরিহার করার কথা বলি।
আমাদের একই সড়ক দিয়ে বাস চলে আবার রিক্সাও চলে। এটা কোনভাবে সঠিক নয়। কারণ বাসের গতি বেশী; পক্ষান্তরে রিক্সার গতি খুবই কম। বেশী ও কম গতির যানবাহন একই রাস্তা দিয়ে চললে দুর্ঘটনা বেশী হয়। এই বিষয়টাকে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দুই ধরনের যানবাহনের জন্য আলাদা আলাদা লেন করে দিতে হবে। আমাদের সড়ককে টেকসই ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের ব্যবস্থাপনা যদি সুদৃঢ় হয় তবে পরিবহন খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আত্মকাহিনী: গাব গাছ (১৬)
আমি একটি গাব গাছ। আমার বয়স প্রায় শত বর্ষের কাছাকাছি। আমার অবস্থান একটি পুরাতন পুকুরের পাশে। আমার শিকড় এই পুকুর থেকে জলরাশি সংগ্রহ করে আমাকে যুগের পর যুগ বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি পথিকদের ছায়া দিয়ে তাদের ক্লান্তি দূর করি। জমিতে কাজ করা অনেক মানুষ আমার ছায়াতলে এসে আরাম অনুভব করে। আমি তাদের ছায়া দিয়ে ধন্য হই। অনেক পাখি আমার কাছে আশ্রয় নেয়। অনেক বিদেশী পাখীও আসে মাঝে মাঝে। আমার ঢালে বাসা বাঁধে। অনেক মানুষ আমার ঢালে বসে থাকে। বাতাস খায়। মানুষের সেবা করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত হই। আমার শুকনো পাতা দিয়ে মানুষ রান্না-বান্না করে। আমার পঁচা পাতা ফসলের সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমার পাতা গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আমার কাঠ দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী করা যায়। ছেলে-মেয়েরা আমার ঢাল থেকে আনন্দে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়। আমি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের উপকারে আসি।
আমার গাব ফল খুবই সুস্বাদু। গাব পেকে হলুদ বর্ণ ধারন করে। খেতেও খুব মিষ্টি। কাঁচা গাব খুবই আঠালো। কাঁচা গাব জাল ও নৌকায় দেয়া হয়।এতে তাদের জীবনকাল দীর্ঘ হয়।
অনেকের আমার সম্পর্কে একটি ভুল ধারনা আছে। আমার ঢালে নাকি ভূত থাকে। আমি তা বিশ্বাস করি না। আমার ঢালে ভুতের কোন স্থান নেই। আমি ভুতকে প্রশ্রয় দেই না। আমি ভূত তাড়িয়ে দেই।
কিছুদিন আগে একজন মানুষ জীবনে হতাশ হয়ে আমার ঢালে আত্মহত্যার জন্য এসেছিলেন। আমি তাকে আত্মহত্যা করতে দেই নি। তাকে জীবনবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে এ খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছি। এটা আমার জীবনের জন্য একটি পরম পাওয়া বলে আমি মনে করি।
13.05.21

আত্মকাহিনী: হাত পাখা (১৭)
আমি একটি হাতপাখা। আমাকে গ্রামের অনেকে ‘বিচন’ বলে ডাকে। ‘বিচন’ বলে ডাক দিলে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তালপাতা দিয়ে তৈরী। ৫ বছর আগে আমার মনিব নিজেই আমাকে বানিয়েছে। আমার যেদিন জন্ম সেদিন আমার মালিকের ছেলেরও জন্ম। তবে আমার মালিকের ছেলে আমার চেয়ে ১ ঘন্টার বড়। আমার মালিকের ছেলে এক গ্রীষ্মের দুপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি গরমে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তার কষ্ট দেখে তখনই আমার মনিব আমাকে তৈরী করে তার ছেলেকে বাতাস দেয়ার জন্য। আমার মনিবের স্ত্রী আমার চারিদিকে কাপড় লাগিয়ে দেয়। এতে আমার বাতাস খুব শীতল হয়।
আমার মনিব একজন কৃষক। এই কৃষক পরিবারের সবাইকে আমি বাতাস দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। কৃষক পরিবারের সবাই আমাকে খুব যত্ন করে ব্যবহার করে। আমি এই পরিবারে জন্ম নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি।
আমি যখন একজনকে বাতাস দেই তখন তেমন একটা অসুবিধা হয় না। অনায়াসে একজনকে সুন্দরভাবে বাতাস সরবরাহ করতে পারি। কিন্তু অনেক মানুষকে বাতাস দিতে গেলে একটু অসুবিধা হয়। কিন্তু তার জন্য আমার মনে তেমন কোন কষ্ট নেই।

একটি বই-এর আত্মকাহিনী (১৮)
আমি একটি বই। আমার নাম শেষের কবিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৯ সালে আমাকে লিখেছেন। আমার নাম কবিতা হলেও আমি আসলে কবিতার বই নই। আমি আসলে একটা উপন্যাসের বই। কবিগুরু কেন আমার নাম কবিতা দিলেন, আবার উপন্যাস করে রাখলেন এর রহস্যই এখন পর্যন্ত বুঝলাম না। কবিগুরু বেঁচে থাকলে তাঁকে প্রশ্ন করতাম, কেন এই রহস্য? কিন্তু তার ও কোন জো নেই। কবিগুরু আমাকে অনেক যত্ন করে লিখেছেন।
আগে মানুষ আমাকে অনেক পড়তো। আমাকে পড়ে মানুষ তার জ্ঞান পিপাসা নিবারন করতো। মানুষের মনে যখন দু:খ আসে, মানুষ তখন বেশী করে বই পড়ে। তাই আগে আমার কাটতি ছিলো অনেক বেশী। মুদ্রণ হলেই বিক্রি হয়ে যেত। আমার যে কত কপি বিক্রি হয়েছে তার কোন হিসাব-কিতাব নেই। শুধু আমাকে বিক্রি করে অনেক প্রকাশক অনেক বড়লোক হয়ে গেছে।
এখন মানুষ আর আমাকে পড়ে না। আমি পড়ে রয়েছি লাইব্রেরীর এক কোনায়। একেবারে ধূলা পড়ে গেছে আমার গায়ে। মানুষ এখন বই না পড়ে সারাদিন শুধু ইন্টারনেট চালায়। মোবাইল চালায়, কম্পিউটার চালায়। জানি না কি হবে জাতির, কিই বা হবে বই-এর।

একটি ছাতার আত্মকাহিনী (১৯)
আমি একটি ছাতা। অনেক আগের দিনের ছাতা আমি। আমার বর্ণ কালো। ইদানিং দেখি, অনেক বর্ণের ছাতা রয়েছে। কিন্তু আগে কালো রঙ্গের ছাতাই বেশী ছিলো। আগে ছাতা বলতে কালো রংকেই বুঝতাম। আমার প্রধান হাতলটি কাঠের তৈরী ছিলো। অনেকটা লাঠির মত, খুবই মজবুত।
আমি মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। আমি রোদে বৃষ্টিতে দুই সময়ই সমানভাবে কার্যকরী। প্রখর সূর্যতাপে আমি মনুষকে আরাম দেই। আমার ছায়াতলে মানুষ প্রশান্তি অনুভব করে।
অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টির কবল থেকে আমি মানুষকে রক্ষা করি। মানুষকে নিরাপদে রাখাই আমার প্রধান দায়িত্ব।

একটি বালতির আত্মকাহিনী (২০)
আমি একটি বালতি। আমি অতীব জরুরী একটি বস্তু। আমি সাধারণ বালতির মত নই। আমার মালিক আমাকে একটি অসাধারণ বালতিতে পরিনত করেছে। আমাকে পিতল দিয়ে তৈরী করেছে। তাই আমি অন্যান্য বালতি থেকে আলাদা হয়ে রইলাম। আমার দাম একটু বেশী বলে
আমার মালিক আমাকে বেশী আদর করেন, স্নেহ করে। আমাকে প্রতিদিন শেষে ধুঁয়ে-মুছে ঘরে তুলে রাখেন।
আমার মালিকের ২টা দুধাল গাভী আছে। দুধ দোহন ও রাখার জন্য আমাকে মূলত: ব্যবহার করা হয়। মাঝে মাঝে আমি গাভীর লাথি খাই। আমার তেমন একটা খারাপ লাগে না। কারণ আমি জানি, দুধ দেয়া গাভীর লাথি খাওয়া মন্দ না। আমার মধ্যে দুধ রাখা হলে আমার চেহারা পাল্টে যায়। আমাকে খুব সুন্দর লাগে। জীবনটা স্বার্থক মনে হয়। আমার মধ্যে দুধ রেখে আমার মালিক আমাকে নিয়ে বাজারে যায়। বাজার থেকে এসে আমাকে যত্নের সাথে রেখে দেয়।
আমার মালিক গোসলের পানি রাখার জন্য আমাকে ব্যবহার করেন। তিনি টিউবওয়েলের পানি আমার মধ্যে রাখেন এবং পরে এই পানি দিয়ে গোসল করেন। আমার মালিক আমাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি যেখানে যান, সেখানেই আমাকে নিয়ে যান। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ী কোন জিনিস নিতে আমাকে ব্যবহার করেন। লাউ ক্ষেতে পানি দেয়ার জন্য আমাকে ব্যবহার করেন। আরো কত কি !
আমার মালিকের ছেলে আমাকে ব্যবহার করে অযত্নে। মাঝে মাঝে আমাকে হাত থেকে ফেলে দেয়। এতে আমার অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় মালিকের কাছে বিচার দেই। কিন্তু বলতে পারি না। আমি যে কথা বলতে পারি না !

একটি কুপি বাতির আত্মকাহিনী (২১)
আমি একটি কুপি বাতি। আমার জন্ম ১৯৭১ সালে। সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত একাধারে জলেছি এমনি করে ২০ বছর। সন্ধ্যা নামলেই আমার গুরুত্ব বেড়ে যায়, গ্রামে-গঞ্জে শুরু হয় কুপির আলোর মহড়া। সন্ধ্যার পরে চলে কুপি বাতিরই রাজস্ব। সন্ধ্যার পরে সব কাজ এই কুপি বাতির আলোতে হয়ে থাকে। রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু কুপির আলোতে হয়। বিশেষ করে পড়াশুনার ক্ষেত্রে কুপির অবদান অপরিসীম। ঐ সময়ে যারা পড়াশোনা করেছে তারা কুপির আলোতেই পড়েছেন। এখন যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা সবাই কুপির আলোতেই পড়েছেন। একটি সামান্য কুপি হয়ে আমি অনেক মানুষের জীবনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি, আমার এ ক্ষুদ্র জীবন স্বার্থক মনে করছি।
আশির দশকের পরে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে কুপি বাতির গুরুত্ব কমে গেছে। এখন কুপি বাতির দুর্দিন চলছে।

একটি কুন্দার আত্মকাহিনী (২২)
আমি একটি কুন্দা। আমি তাল গাছ দিয়ে তৈরী একটি জলযান বিশেষ। একটা তাল গাছ দিয়ে দুটি ‍কুন্দা হয়। আমাকে তৈরী করার জন্য মাটিতে থাকা নিচের অংশসহ (মোতা) তালগাছ উত্তোলন করতে হয়। এই তাল গাছ উত্তোলন করে তালগাছের মাঝখান দিয়ে করাত চালালে আমি অনেকটা তৈরী হয়ে যাই। এরপর তালগাছের ভিতরের অংশ যাকে পল বলে তা ফেলে দিয়ে বাহিরের আস্তরন যাকে সার বলে তা রেখে কিছুটা সাইজ করে আমাকে তৈরী করা হয়েছে।
আমি অনেক লম্বা। বর্ষা কালে আমি পানিতে ভেসে থাকি। আমাকে দিয়ে মানুষ সাধারণত: পারাপার হয়। আমার কোন হাত-পা নেই। আমি বাতাসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারি। মানুষ আমাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সহায়তা করে। আমাকে চালানোর জন্য লাগে লগ্গি বা বৈঠা। বেশী পানিতে বৈঠা এবং অল্প পানিতে লগ্গি। স্রোতে আমাকে চালানো ঠিক নয়। কারণ স্রোতে আমি ডুবে যেতে পারি। আমি ২/৩ জন যাত্রী খুব সুন্দরভাবে বহন করতে পারি। এর বেশী হলে আমার খুব কষ্ট হয়। এমন কি আমি ডুবেও যেতে পারি। আমাকে নিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। কৃষক-ছেলে আমার মাথায় বসে গরুর জন্য ঘাস কাটে। তখন আমার জীবন স্বার্থক মনে হয়।
আমি মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে আনন্দ ও গর্ব বোধ করি। একদিন বিলের মাঝখানে একটি মর্মান্তিক কুন্দাডুবি হল। কুন্দার মাঝি পানিতে পড়ে হা-বু-ডু-বু খাচ্ছে। প্রায় মরতে বসেছে। তখন আমার মালিক আমাকে নিয়ে সেই মাঝিকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে। এই ঘটনা মনে পড়লে আমি এখনও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যাই। আমার কুন্দার জীবন সফল হয়েছে বলে মনে করি।
ছোট ছোট বাচ্চারা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। তারা আমার উপর উঠে নাচানাচি করে। আমার উপর থেকে জলে লাফ দেয়। আবার কখনো কখনো আমাকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। পানিতে ডুবিয়ে দিলে যে আমার পরাজয় হয় তা আমি তাদের বুঝাতে পারি না। আমি বড় হৃদয়ের বলে তাদের অত্যাচার সহ্য করি এবং তাদের ক্ষমা করে দেই। তবে কখনো যে আমার মধ্যে প্রতিশোধপরায়নতা কাজ করে না তা হলফ করে বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে আমার মন খারাপ হয়ে গেলে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আমি হাটু জলে ডুবে যাই। তবে খেয়াল রাখি এতে ওদের যেন কোন ক্ষতি না হয় । আমি জানি এটা খারাপ কাজ কিন্তু তার পরেও আমি মাঝে মাঝে তা করি। তবে আমি আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করছি এরুপ খারাপ কাজ আর করবো না কখনো।

একটি নৌকার আত্মকাহিনী (২৩)
বাংলাদেশ নদীমতৃক দেশ। এই নদী বিধৌত দেশে আমি একটা নৌকা। যদিও আমি নৌকা, তবে লোকে আমাকে ভালোবেসে নাও কয়। এতে আমার কোন অনুযোগ নেই। কারণ, ভালোবেসে মানুষ অনেক কিছুই বলতে পারে। আমি কাষ্ঠ দ্বারা তৈরী একটি বাহন। আমি জলে চলি। ডাঙ্গায় আমার কোন দাম নেই। জলে নামালে আমি দামী হয়ে উঠি। বর্ষাকালে যখন চারিদিক পানিতে থৈ থৈ করে তখন আমার কদর বেড়ে যায়। মানুষকে বাড়ীর বাইরে আসতে হলেই আমার প্রয়োজন পড়ে। হাট-বাজারে যাওয়া, স্কুলে যাওয়া, বেড়াইতে যাওয়া প্রভৃতি সব কাজেই আমাকে লাগে। স্বচ্ছ ও বেশী পানিতে আমাকে চালাতে বৈঠা দরকার। তবে অস্বচ্ছ ও কম পানিতে আমাকে বৈঠা দিয়ে চালানো যায় না, লাগে বাঁশের লগ্গি। অনেকে যখন আমাকে চালায় তখন বৈঠাই লাগে, লগ্গিতে কাজ হয় না।
আমি খুবই মানবিক। আমার মধ্যে যাই উঠাক না কেন, আমি কিছু বলি না। তবে আমার একটি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ধারণ ক্ষমতার বেশী মালপত্র উঠালে আমি মনের দু:খে নীরবে কান্না করি। মাঝে মাঝে অতি কষ্টে পানিতে ডুবে যাই। সকল মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমার মালিক অনুধাবন করে যে আমাকে কষ্ট দেয়া ঠিক না।
একটা ঘটনার কথা বলি। একবার আমার মালিক আমাকে নিয়ে পূবাইল গেলেন খের আনার জন্য। যথারীতি আমার মধ্যে ভরা হল খের এবং আমরা বাড়ীর ‍উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মাঝপথে বৃষ্টি ও ঝড়ের কবলে পরলাম। অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। প্রায় ডুবে গিয়েছিলাম বলে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ আশীর্বাদে ঐ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ঐ সময় নৌকাডুবি হলে এ দুনিয়া থেকে হয়তো চলেই যেতাম। এই ঘটনার পর আমার মালিক প্রতিজ্ঞা করেন যে, আমার ধারণ ক্ষমতার বেশী মালপত্র তিনি আমার মধ্যে আর উঠাবেন না।
বর্ষাকাল চলে গেলে আমার স্থান হয় পুকুরে। তখন আমি পুকুরে ডুবে থাকি। খুব আমার লাগে। কোন কাজ নেই, শুধুই অবসর। তখন আমি মাছের সাথে খেলা করি। মাছদের আমার কাছে আশ্রয় দেই। আমার খুব ভালোই লাগে।
আমি মানুষের ‍উপকারের পাশাপাশি মাছেরও উপকার করতে পেরে অনেক আনন্দে অভিভূত। আমার জীবন স্বার্থক।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৮৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০৫/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast