একজন দিনমজুরের আত্মকথা (১২)
আমি একজন দিনমজুর। আমার বাড়ী কালীগঞ্জে। আমাদের দেশে কালীগঞ্জ অনেক আছে। খোলাসা করে বলি, আমার বাড়ী গাজীপুরের কালীগঞ্জে। আমি ৫ম শ্রেণী পাশ করেছি। আমি পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলাম। ৫ম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় আমি ১ম হয়েছিলাম। তখন ভালো ছাত্র হিসেবে আমার খুব একটা নাম ডাক ছিলো। কিন্তু দু:খের বিষয়, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক করে আমার বাবা মারা যান। আমার বাবা মারা যাওয়ার আমাদের সংসারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যাক্তিকে আমরা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমি ছিলাম পরিবারের সবার বড় সন্তান। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় সন্তান হিসেবে সংসার চালানোর দায়িত্ব আমার উপরে বর্তায়। আমার পরিবারে আমার আরও দু’জন বোন আছে। আমাদের পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে আমি স্কুল ছেড়ে দিয়ে রোজগারের পথ খুঁজতে লাগলাম।
অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি। কিছুদিন মাছ ধরে বিক্রিও করেছি। কিন্তু মাছ ধরা অনেকটা সিজনাল। শুষ্ক মৌসুমে এলাকায় মাছ পাওয়া যায় না। কিছুদিন ঢাকায় দারোয়ানের চাকুরীও করেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারি নি। বেতন খুবই কম। আসা-যাওয়া করে আর কিছু থাকে না। শেষে অনেক কষ্ট করে বাড়ীর পাশে একটা দোকানও দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিনের কালবৈশাখী ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। দু:খে আমার মনটা ভরে গেল। পরে সব কিছু বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি দিনমজুরী করবো। গ্রামে যাকে বলে কামলা। আমি দৈনিক ভিত্তিতে কামলা দেয়া শুরু করলাম।
আমি কামলা দেয়ার কাজে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে ফেললাম। সারাদিন মানুষের কাজ করতাম। আমি অন্যান্য কামলাদের তুলনায় বেশী পরিশ্রম করতাম। বেশী কাজ করতাম। ফলে কামলা হিসেবে এলাকায় আমার নাম হয়ে গেল। কেউ কেউ আদর করে আমাকে ফিহিরের কামলা বলতো। আমি বেশী কাজ করি বিধায় আমাকে অনেক মানুষ কামে নিতে চাইতো। যে কোন কাজেই আমি পটু ছিলাম। মাটি কাটা, ধান কাটা... সব কাজই আমি পারতাম। আমি দৈনিক ৩০০ টাকা করে মজুরী পেতাম। দিন শেষে টাকাটা হাতে পেয়ে আমার খুব ভাল লাগতো। দিনের সব কষ্ট ভুলে যেতাম। এই টাকা দিয়ে আমি সংসার চালাতাম। যে মালিক আমাকে সঠিকভাবে টাকা দিতো না তার কাজ আমি দ্বিতীয়বার করি নি। এটা আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। আমার কথা ছিলো, আমার পরিশ্রমের টাকা দিন শেষে দিতে হবে। কেউ টাকা না দিলে আমি আর তার কাজ করতাম না।
সন্ধ্যা সময় এলাকার সকল লোকদের নিয়ে সমাজ উন্নয়ন বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করতাম আমি। সাংগঠনিক বিষয়গুলো আমার খুব ভাল লাগতো। সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগতো। কোন সাঁকো ভেঙ্গে গেলে, কোন রাস্তা খারাপ হয়ে গেলে আমি ও আমার দল তা মেরামত করার চেষ্টা করতাম। একান্ত মন থেকেই আমি উক্ত কাজগুলো করতাম।
পাশের বাড়ীর শিউলীকে আমার অনেক পছন্দ হত। শিউলীও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। মাঝে মাঝে শিউলীকে দেখার জন্য স্কুলের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মনটা ভরে যেত ওকে দেখলে। দিনের ক্লান্তি সবটুকু এক নিমেষেই চলে যেত তাকে দেখার পর। শিউলীকে আমার ভালোবাসার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অনেক। কিন্তু মুখে বলতে পারি নি। শিউলীর বাবা একদিন হঠাৎ করে শিউলীকে একজন বিদেশী বাঙ্গলী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এই ঘটনায় আমি ভীষণ কষ্ট পাই। অন্তরটা জ্বলে একেবারে ছাই হয়ে যায়। আমার ভালোবাসার কি কোনই মূল্য নেই? গরীবের কি কোনই মূল্য এ সমাজে নেই? এই ঘটনার পর আমার মনটাকে আর মানাতে পারি নি। সিদ্ধান্ত নিলাম, মা ও দুই বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবো। এ গ্রামে আর থাকবো না। যে গ্রামে একজন কামলার কোন দাম নেই সেই গ্রামে আর থাকবো না।
এখন আমি ঢাকায় চলে এসেছি। ঢাকায় আসার সাথে সাথে আমার নাম বদল হয়ে গেল। এখন আমি কামলা নই দিনমজুর। বাসা নিয়েছি মগবাজারে। প্রতিদিন আমি মগবাজার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। মালিকরা এসে আমাকে কাজে নিয়ে যায়। সারাদিন কাজ করলে ৫০০ টাকা পাই। শহরে আয় রোজগার বেশী। তবে একটা সমস্যা হল- প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। মাসে গড়ে প্রায় ৭/৮ দিনই কাজ পাওয়া যায় না। তার পরেও আমি খুব ভালো আছি। ঢাকা শহরে শিউলী ফুল নাই.. শিউলী ফুলের গন্ধ নাই...।
দিনমজুরী খাটতে খাটতে আমারও বয়স হয়ে গেছে। আমার বোনদের খুব ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার দায়িত্ব শেষ। এখন একটু অবসর নিতে চাই....
অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি। কিছুদিন মাছ ধরে বিক্রিও করেছি। কিন্তু মাছ ধরা অনেকটা সিজনাল। শুষ্ক মৌসুমে এলাকায় মাছ পাওয়া যায় না। কিছুদিন ঢাকায় দারোয়ানের চাকুরীও করেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারি নি। বেতন খুবই কম। আসা-যাওয়া করে আর কিছু থাকে না। শেষে অনেক কষ্ট করে বাড়ীর পাশে একটা দোকানও দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিনের কালবৈশাখী ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। দু:খে আমার মনটা ভরে গেল। পরে সব কিছু বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি দিনমজুরী করবো। গ্রামে যাকে বলে কামলা। আমি দৈনিক ভিত্তিতে কামলা দেয়া শুরু করলাম।
আমি কামলা দেয়ার কাজে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে ফেললাম। সারাদিন মানুষের কাজ করতাম। আমি অন্যান্য কামলাদের তুলনায় বেশী পরিশ্রম করতাম। বেশী কাজ করতাম। ফলে কামলা হিসেবে এলাকায় আমার নাম হয়ে গেল। কেউ কেউ আদর করে আমাকে ফিহিরের কামলা বলতো। আমি বেশী কাজ করি বিধায় আমাকে অনেক মানুষ কামে নিতে চাইতো। যে কোন কাজেই আমি পটু ছিলাম। মাটি কাটা, ধান কাটা... সব কাজই আমি পারতাম। আমি দৈনিক ৩০০ টাকা করে মজুরী পেতাম। দিন শেষে টাকাটা হাতে পেয়ে আমার খুব ভাল লাগতো। দিনের সব কষ্ট ভুলে যেতাম। এই টাকা দিয়ে আমি সংসার চালাতাম। যে মালিক আমাকে সঠিকভাবে টাকা দিতো না তার কাজ আমি দ্বিতীয়বার করি নি। এটা আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। আমার কথা ছিলো, আমার পরিশ্রমের টাকা দিন শেষে দিতে হবে। কেউ টাকা না দিলে আমি আর তার কাজ করতাম না।
সন্ধ্যা সময় এলাকার সকল লোকদের নিয়ে সমাজ উন্নয়ন বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করতাম আমি। সাংগঠনিক বিষয়গুলো আমার খুব ভাল লাগতো। সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগতো। কোন সাঁকো ভেঙ্গে গেলে, কোন রাস্তা খারাপ হয়ে গেলে আমি ও আমার দল তা মেরামত করার চেষ্টা করতাম। একান্ত মন থেকেই আমি উক্ত কাজগুলো করতাম।
পাশের বাড়ীর শিউলীকে আমার অনেক পছন্দ হত। শিউলীও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। মাঝে মাঝে শিউলীকে দেখার জন্য স্কুলের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মনটা ভরে যেত ওকে দেখলে। দিনের ক্লান্তি সবটুকু এক নিমেষেই চলে যেত তাকে দেখার পর। শিউলীকে আমার ভালোবাসার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অনেক। কিন্তু মুখে বলতে পারি নি। শিউলীর বাবা একদিন হঠাৎ করে শিউলীকে একজন বিদেশী বাঙ্গলী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এই ঘটনায় আমি ভীষণ কষ্ট পাই। অন্তরটা জ্বলে একেবারে ছাই হয়ে যায়। আমার ভালোবাসার কি কোনই মূল্য নেই? গরীবের কি কোনই মূল্য এ সমাজে নেই? এই ঘটনার পর আমার মনটাকে আর মানাতে পারি নি। সিদ্ধান্ত নিলাম, মা ও দুই বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবো। এ গ্রামে আর থাকবো না। যে গ্রামে একজন কামলার কোন দাম নেই সেই গ্রামে আর থাকবো না।
এখন আমি ঢাকায় চলে এসেছি। ঢাকায় আসার সাথে সাথে আমার নাম বদল হয়ে গেল। এখন আমি কামলা নই দিনমজুর। বাসা নিয়েছি মগবাজারে। প্রতিদিন আমি মগবাজার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। মালিকরা এসে আমাকে কাজে নিয়ে যায়। সারাদিন কাজ করলে ৫০০ টাকা পাই। শহরে আয় রোজগার বেশী। তবে একটা সমস্যা হল- প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। মাসে গড়ে প্রায় ৭/৮ দিনই কাজ পাওয়া যায় না। তার পরেও আমি খুব ভালো আছি। ঢাকা শহরে শিউলী ফুল নাই.. শিউলী ফুলের গন্ধ নাই...।
দিনমজুরী খাটতে খাটতে আমারও বয়স হয়ে গেছে। আমার বোনদের খুব ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার দায়িত্ব শেষ। এখন একটু অবসর নিতে চাই....
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৪/০৫/২০২১কাহিনী ভালো লেগেছে।
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ০৪/০৫/২০২১nice work
-
ফয়জুল মহী ০৩/০৫/২০২১Excellent writen