একজন কুলির আত্মকথা (১১)
আমি একজন কুলি। আমার বাড়ী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়। আমার বাড়ী থেকে আড়িখোলা রেল স্টেশন খুব কাছে। হেঁটে যেতে মাত্র ২০ মিনিট লাগে। আমি ছোট বেলায় রেল গাড়ী দেখতে খুব ভালোবাসতাম। মাঝে মাঝে রেলগাড়ীর পিছনে পিছনে মনের আনন্দে দৌঁড়াতাম। রেল গাড়ী ছুঁয়ে দেখতে আমার খুব আনন্দ লাগতো। তাই ছোট বেলা থেকেই হাড়িখোলা স্টেশনে এসে বসে থাকতাম রেল গাড়ী নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখার জন্য। আমি প্রথম যে দিন রেলগাড়ী ছুঁয়ে দেখেছি, সেদিনের যে কি মধুর অনুভূতি, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। রেল গাড়ী দেখা আমার একটা নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। আর আমি হা করে গাড়ী দেখতাম। তাই আমি স্কুল ছেড়ে, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে রেল স্টেশনে পড়ে থাকতাম। বাবা-মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে রেল স্টেশনে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি শুনতাম না। তাই এক পর্যায়ে বাবা-মা বাড়ী গেলে ভাত দিতো না। শুরু হল আমার কষ্টের জীবন।
পড়াশুনা না করার কারণে পরে আমি কুলিগিরিকেই পেশা হিসেবে আপন করে নিয়েছি। জীবনের প্রথমদিকে আমি আড়িখোলা স্টেশনেই কুলিগিরি করেছি। আমার কাজ ছিলো মানুষের বাক্স ও ব্যাগ সুন্দরভাবে রেল গাড়ীতে তুলে দেয়া। এতে তারা খুশি হয়ে আমাকে যা দিতেন তাই নিতাম। আমার জীবনে কোন মানুষের কাছ থেকে দাবী করে কোনদিন টাকা নেই নি। আমি কাজে অনেক আন্তরিক ছিলাম। আমি খুব মন দিয়ে কাজটা করতাম। আড়িখোলা স্টেশনে গাড়ী বেশীক্ষণ থেমে থাকতো না। তাই আমি একজন যাত্রীর বাক্স বা ব্যাগ নিয়ে তাকে গাড়ীর মধ্যে তার জিনিস ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে তবে গাড়ী থেকে নামতাম। এতে করে আমার দ্বিতীয় যাত্রী ধরার কোন সুযোগ থাকতো না। সারাদিনে ১০০/২০০ টাকার বেশী রোজগার করতে পারতাম না। এতেই আমার চলে যেত বেশ। আমার খাবারের খরচ রেখে আমি বাকী টাকা বাবা-মাকে দিয়ে দিতাম সংসারের খরচ মেটানোর জন্য।
এভাবে দিনে দিনে আমার বয়সও অনেক হয়ে গেল। প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই। বাবা-মা আমার বিয়ে দিতে চাইলো। তারা পাত্রী দেখতে শুরু করলো। পাত্রী দেখলোও অনেক। কিন্তু কোন পাত্রী নিজের ইচ্ছায় আমার সাথে বিয়ে হতে চাইলো না। আমার দোষ আমি একজন কুলি। কুলি হওয়াই আমার অপরাধ, আমার আজন্ম পাপ। এ বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারি নি। মন আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কুলিরা কি মানুষ না? তাদের রক্ত কি লাল না? কুলির রক্ত যদি লাল হয় তাহলে সমাজের আর ১০ টা মানুষের চাইতে তারা অবহেলিত কেন? আমি এই দু:খে ২দিন খাওয়া-দাওয়া করি নি। আমি পৃথিবীতে শুধু ভালোবেসে গেলাম। কিন্তু ভালোবাসা পেলাম না। আমার প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর যেমনটি গেয়েছিলেন। পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর এই দেশেই থাকবো না। যেই দেশ আমাকে ভালোবাসে নি, যে দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে নি সেই দেশে থেকে কি লাভ? পরে আমি দু:খ দু:খ মনে ভারতের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওয়ানা দিলাম।
আমি চোখে জল নিয়ে বাবা-মার আর্শীবাদ নিয়ে অনেকটা খালি হাতেই বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি ভারত যাওয়ার পথে যখনই টাকার সমস্যায় পড়েছি তখন কারো কাছে হাত পাতি নি, বরং কাজ করে টাকা উপার্জন করে দেনা পরিশোধ করে দিয়েছি। এভাবে কাজ করে করে আমার বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার পর্যন্ত যেতে ১০ দিন সময় লেগেছিলো। বর্ডারের ডিউটি অফিসার আমাকে ভারত যেতে দেয় নি। পাসপোর্ট আর ভিসার জন্য। আমি তাকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে যেতে দেন নি।
পরে আবার দেশের ছেলে দেশেই ফিরে আসলাম। গেল ৩ বছর থেকে আমি কাওরান বাজারে থাকি। এখন আমি কাওয়ান বাজারের মিন্তি। কুলি নই মিন্তি। কাজ একই কিন্তু নাম আলাদা। এখন আমার বয়স হয়েছে। কাজ বেশীে একটা করতে পারি না। আমার কতগুলো বান্দা কাষ্টমার আছে। তাদের কাজ করেই আমার দিব্যি চলে যায়। আবার কিছু টাকা বাড়ীতেও পাঠাতে পারি। তবে গত এক বছরের বেশী সময় ধরে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে কামাই অনেক কম। মানুষ বাজারে আসে না। অনলাইন বাজার করে। আশার কথা হলো, আমার কোন মেন্তি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয় নি। তারা হারভাঙ্গা রোদে পরিশ্রম করে বলেই হয়তোবা তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত করতে পারে নি।
আমার আরেকটি দু:খের জায়গা আছে। আমার এলাকার অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা কাওরান বাজার থেকে বাজার করে। তারা বড় বড় অফিসার। আমি যেহেতু কাওরান বাজারে মিন্তিগিরি করি তাই তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হলে তারা আমাকে নাক ছিটকায়। আমার কাছে আসতে চায় না, কথা বলতে চায় না। তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। আমিও তাদের কিছু বলি না।
তো যা হোক, আমরা মিন্তিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি সমিতি করেছি। আমাকে সবাই সেই সমিতির সভাপতি বানিয়েছে। আমরা মেন্তিদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করবো। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
পড়াশুনা না করার কারণে পরে আমি কুলিগিরিকেই পেশা হিসেবে আপন করে নিয়েছি। জীবনের প্রথমদিকে আমি আড়িখোলা স্টেশনেই কুলিগিরি করেছি। আমার কাজ ছিলো মানুষের বাক্স ও ব্যাগ সুন্দরভাবে রেল গাড়ীতে তুলে দেয়া। এতে তারা খুশি হয়ে আমাকে যা দিতেন তাই নিতাম। আমার জীবনে কোন মানুষের কাছ থেকে দাবী করে কোনদিন টাকা নেই নি। আমি কাজে অনেক আন্তরিক ছিলাম। আমি খুব মন দিয়ে কাজটা করতাম। আড়িখোলা স্টেশনে গাড়ী বেশীক্ষণ থেমে থাকতো না। তাই আমি একজন যাত্রীর বাক্স বা ব্যাগ নিয়ে তাকে গাড়ীর মধ্যে তার জিনিস ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে তবে গাড়ী থেকে নামতাম। এতে করে আমার দ্বিতীয় যাত্রী ধরার কোন সুযোগ থাকতো না। সারাদিনে ১০০/২০০ টাকার বেশী রোজগার করতে পারতাম না। এতেই আমার চলে যেত বেশ। আমার খাবারের খরচ রেখে আমি বাকী টাকা বাবা-মাকে দিয়ে দিতাম সংসারের খরচ মেটানোর জন্য।
এভাবে দিনে দিনে আমার বয়সও অনেক হয়ে গেল। প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই। বাবা-মা আমার বিয়ে দিতে চাইলো। তারা পাত্রী দেখতে শুরু করলো। পাত্রী দেখলোও অনেক। কিন্তু কোন পাত্রী নিজের ইচ্ছায় আমার সাথে বিয়ে হতে চাইলো না। আমার দোষ আমি একজন কুলি। কুলি হওয়াই আমার অপরাধ, আমার আজন্ম পাপ। এ বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারি নি। মন আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কুলিরা কি মানুষ না? তাদের রক্ত কি লাল না? কুলির রক্ত যদি লাল হয় তাহলে সমাজের আর ১০ টা মানুষের চাইতে তারা অবহেলিত কেন? আমি এই দু:খে ২দিন খাওয়া-দাওয়া করি নি। আমি পৃথিবীতে শুধু ভালোবেসে গেলাম। কিন্তু ভালোবাসা পেলাম না। আমার প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর যেমনটি গেয়েছিলেন। পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর এই দেশেই থাকবো না। যেই দেশ আমাকে ভালোবাসে নি, যে দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে নি সেই দেশে থেকে কি লাভ? পরে আমি দু:খ দু:খ মনে ভারতের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওয়ানা দিলাম।
আমি চোখে জল নিয়ে বাবা-মার আর্শীবাদ নিয়ে অনেকটা খালি হাতেই বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি ভারত যাওয়ার পথে যখনই টাকার সমস্যায় পড়েছি তখন কারো কাছে হাত পাতি নি, বরং কাজ করে টাকা উপার্জন করে দেনা পরিশোধ করে দিয়েছি। এভাবে কাজ করে করে আমার বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার পর্যন্ত যেতে ১০ দিন সময় লেগেছিলো। বর্ডারের ডিউটি অফিসার আমাকে ভারত যেতে দেয় নি। পাসপোর্ট আর ভিসার জন্য। আমি তাকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে যেতে দেন নি।
পরে আবার দেশের ছেলে দেশেই ফিরে আসলাম। গেল ৩ বছর থেকে আমি কাওরান বাজারে থাকি। এখন আমি কাওয়ান বাজারের মিন্তি। কুলি নই মিন্তি। কাজ একই কিন্তু নাম আলাদা। এখন আমার বয়স হয়েছে। কাজ বেশীে একটা করতে পারি না। আমার কতগুলো বান্দা কাষ্টমার আছে। তাদের কাজ করেই আমার দিব্যি চলে যায়। আবার কিছু টাকা বাড়ীতেও পাঠাতে পারি। তবে গত এক বছরের বেশী সময় ধরে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে কামাই অনেক কম। মানুষ বাজারে আসে না। অনলাইন বাজার করে। আশার কথা হলো, আমার কোন মেন্তি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয় নি। তারা হারভাঙ্গা রোদে পরিশ্রম করে বলেই হয়তোবা তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত করতে পারে নি।
আমার আরেকটি দু:খের জায়গা আছে। আমার এলাকার অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা কাওরান বাজার থেকে বাজার করে। তারা বড় বড় অফিসার। আমি যেহেতু কাওরান বাজারে মিন্তিগিরি করি তাই তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হলে তারা আমাকে নাক ছিটকায়। আমার কাছে আসতে চায় না, কথা বলতে চায় না। তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। আমিও তাদের কিছু বলি না।
তো যা হোক, আমরা মিন্তিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি সমিতি করেছি। আমাকে সবাই সেই সমিতির সভাপতি বানিয়েছে। আমরা মেন্তিদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করবো। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১০/০৩/২০২২অনুপম
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৩/০৫/২০২১Sundor
-
ফয়জুল মহী ০২/০৫/২০২১খুব চমৎকার উপস্থাপন