www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

একটি প্রবন্ধ ও একটি গল্প

মে দিবসের অঙ্গীকার

আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে ১৮৮৬ সালের এই দিনে (১ মে) যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই দিন তাঁদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছিল। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিব বর্ষে গড়ব দেশ’।
কিন্তু প্রশ্ন হ’ল শ্রমজীবীরা কি তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে? উত্তর হল- না পায় নি। এই প্রায় একমাস হল- দেশে লকডাউন চলছে। এই লকডাউনে শ্রমজীবীরা কিভাবে দিনাতিপাত করছে, তার খবর কি কেউ নিয়েছে, না নেয় নি। শ্রমজীবীরা তাদের ন্যায্য অধিকার যদি না পায় তাহলে মে দিবস পালন করে কোন লাভ নেই। শ্রমজীবীদের অধিকার আগে ফিরিয়ে দিতে হবে। একজন রিক্সাওয়ালাকে আমরা ১০ টাকা বেশী দিতে চাই না। ৫০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকায় যেতে পারলে মনে প্রশান্তি অনুভব করি। কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য আমরা দিচ্ছি না। এক ডজন কলা কিনতে তিন বার দাম করি। কমে কিনতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি। বাসে বা টেম্পুতে উঠে কন্ডাক্টরকে ছেঁড়া টাকা দেই বা কোন সময় ভাড়া না দিয়েই নেমে যাই। কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে চৌদ্দবার দাম-দর করি। আমরা উদার না হতে পারলে শ্রমজীবীরা এ দেশে বাঁচবে না। ১০ টাকার হিসাব করলে রিক্সাওয়ালা বাঁচবে কি করে? অথচ এই আমরাই কোন বড় ৫ তারকা হোটেলে গেলে মনটা অতি উদার হয়ে যায়। বিল ৯৯০০ টাকা হলে ১০০০০ টাকা দিয়ে চলে আসি। অথচ ১০ টাকা রিক্সাওয়ালাকে দিলে আমাদের আত্মা বের হয়ে যায়। হায়রে মানুষ! তো যাই হোক, শ্রমজীবীদের ন্যায্য অধিকারই হোক আমাদের মে দিবসের অঙ্গীকার।
(২)
একজন রিক্সাচালকের আত্মকথা (১০)

আমি একজন রিক্সাচালক। মানুষ আমাকে রিক্সাওয়ালা বলে। চালক বলতে চায় না। তাতে আমার কোন দু:খ নাই। যেহেতু রিক্সা চালাই সেহেতু রিক্সাওয়ালা বলতেই পারে। কিন্তু যখন মানুষ আমাকে এই ‘খালি’ বলে ডাকে তখন আমার মনটা একেবারে খারাপ হয়ে যায়। ‘খালি’ আবার কি? এটা কি কোন নাম হতে পারে? আমাকে কি ‘ভাই’ বলে ডাকা যায় না? আচ্ছা, সম্মানের খাতিরে ‘ভাই’ নাই বললো, কিন্তু অন্তত রিক্সাওয়ালা তো বলা যায়। কিন্তু তা না বলে আমাকে ডাকে ‘খালি’। আমাকে এখন ‘খালি’ বললে আমি আর শুনি না। ভাই, নিজের আত্মসম্মান বোধ কিছুটা হলেও তো আছে। এদেশে তো আর গঙ্গার জলে ভাইসা আসি নাই। কিছুটা সম্মানবোধ তো আছে! হতে পারি রিক্সাওয়ালা! কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
আমি মানুষের কাছে বেশী ভাড়া চাই না। ন্যায্য ভাড়া চাই। ন্যায্য ভাড়া নেই। বেশী দিতে চাইলেও নেই না। সবচেয়ে খারাপ লাগে মানুষ যখন আমার সাথে ১০ টাকার জন্য দরা-দরি করে। এতো কষ্ট করি, কিন্তু শুধু ১০ টাকার জন্য মানুষের সাথে যখন সমস্যা হয়, তখন অন্তরটা জ্বলে যায়। সবার সাথে যে সমস্যা হয় তাও না। গুটি কয়েক ব্যক্তির সাথে সমস্যা হয়। বেশীরভাগ মানুষই কিন্তু ভালো। আমার সাথে আরেকটা সমস্যা হয়। কিছু মানুষ আছে, ভাড়া না বলে আমাকে নিয়ে যায়। কিন্তু গন্তব্যে গিয়ে আমাকে ভাড়া কম দেয়। তখন আর কিছু বলার থাকে না। নিজেরে নিজে মারতে ইচ্ছা করে, কেন ভাড়া ফয়সালা না করে উনাকে রিক্সায় উঠালাম?
আমার বাড়ী ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও- এ। আমার বাড়ী গফরগাঁও রেল স্টেশনের পাশেই। আমি ট্রেনে খুব সকাল বেলা ঢাকায় আসি এবং ২/৩ দিন একনাগারে রিক্সা চালিয়ে আবার রাতে ট্রেনে বাড়ীতে চলে যাই। বাড়ীতে কয়েকদিন থেকে আবার ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে রিক্সা গ্যারেজে থাকি। আমি ফার্মগেট এলাকায় বেশী রিক্সা চালাই। তবে অন্য জায়গায় যে যাই না তাও নয়। এজন্য ফার্মগেটের অলি-গলি সব আমার চিনা-পরিচিত। আমি রিক্স চালিয়ে যা পাই তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায় ভালই। তবে এই লকডাউনে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ট্রেন না চলার জন্য আমি ঢাকা আসতে পারি নি। আমার স্ত্রী বাড়ীতে কাজ করে। আমি যেহেতু ঢাকায় চলে আসি, তাই আমার স্ত্রী আমার সংসার দেখভাল করে। আমার বড় ছেলে গত বছর ইন্টারমিডিয়েটে অটো পাশ দিয়েছে। সে স্থানীয় কলেজে পড়েছে। তার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। আমার মেয়েটা ছোট। এখনও স্কুলে দেই নি।
আমি ঢাকা শহরে একজন ভালো মানুষের সন্ধান পেয়েছি। তিনি প্রতিদিন অফিস থেকে রাত ১০ টার দিকে বের হয়। কিন্তু কাকতালিয়ভাবে আমিও রাত ১০ টার দিকে তার অফিসের সামনে থাকি। তিনি আমাকে প্রায় প্রতিদিন তার বাসায় নিয়ে যায়। তিনি কখনো ভাড়া কম/বেশী দেন না। বাজারে যা ভাড়া আছে তাই দেন। এমন ভালো লোক আমি কম দেখেছি। একেবারে জীবন্ত ফেরেশতা! তাকে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ইচ্ছা হয়। কিন্তু ভয়ে দাওয়াত করতে পারি নি, না জানি উনি কি মনে করে!
তো, শেষে একটি ভালো খবর দিয়ে শেষ করি। এবার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় আমার ছেলে ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক বড় খবর। আমার ছেলের জন্য আমার জীবন স্বার্থক হয়েছে। আমি দোয়া করি, আমার ছেলে যেনো ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে। সাথে সাথে আরেকটি ভয়ও কাজ করছে। ছেলে ঢাকা থাকলে আমি ঢাকায় রিক্সা চালাতে পারবো তো? ছেলের আত্মসম্মানে বাঁধবে না? এরকম বিষয় হলে আমি ছেলেকে বোঝাবো যে, দুনিয়ায় কোন কাজই ছোট না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৪৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৫/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast