একটি বিলের আত্মকথা (৪)
আমার নাম পাত্তুরী বিল। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় আমার অবস্থান। শীতলক্ষ্ম্যা নদীর ধারে। আমি আগে ঢাকা জেলায় অর্ন্তভুক্ত ছিলাম। পরে অবশ্য আমি নারায়ণগঞ্জ জেলারও অর্ন্তভুক্ত ছিলাম। তবে হালে আমি গাজীপুর জেলায় পড়েছি। আমার ভাগ্যটা অনেক ভালো বলে মনে হয়। কারণ আমার জেলা ছিলো তিনটা। অনেকের ভাগ্যে এমনটা হয় না। আমার পরিসর ছিল অনেক বড়। আমার চারিদিকে হাড়িখোলা, পিপ্রাশৈর, বোয়ালী, সোমা, ফরিয়াখালী, বাইয়াসতি, পুইনারটেক, চড়াখোলা.... ইত্যাদি গ্রাম। একদিক থেকে তাকালে অন্যদিক দেখা যেত না। আমার পানি ছিল অনেক স্বচ্ছ। এতো স্বচ্ছ যে একেবারে পান করা যেত। অনেক মানুষ আমার পানি পান করে তৃষ্ঞা নিবারণ করতো। আমার স্বচ্ছ জলে অনেক মাছ থাকতো। কই, মাগুর, ভেদা, খইলসা, পুটি, রুই, কাতলা, বোয়াল, টাকি, সিং, চিংড়ি, ফইলা, বাইলা, বাইং ইত্যাদি। শিকারীরা আপন মনে মাছ ধরতো আমার জলে! আমার পানিতে অনেক জেলেরা টেটা দিয়ে মাছ ধরতো। তখন আমার অনেক খারাপ লাগতো। টেটা দিয়ে মাছকে ক্ষত-বিক্ষত করা হলে মাছরা অনেক কান্না করতো। কিন্তু নিষ্ঠুর জেলেরা মাছের কান্না শুনতে পেত না। তারা মনের আনন্দে মাছের গায়ে টেটা বিদ্ধ করে ক্ষত-বিক্ষত করতো। একটুও দয়া-মায়া নেই তাদের! জাল দিয়ে মাছ ধরলেও আমার অনেক খারাপ লাগতো। কারণ জালে আটকে গিয়ে মাছগুলো দম আটকে মারা যেত। এই দৃশ্য দেখে আমার কান্না পেত। বরশি দিয়ে মাছ মারলেও আমার কষ্ট পেত। কারণ বরশির টানে কোন কোন মাছের ঠোঁট ছিড়ে যেত। তখন মাছের যে কান্না তা শিকারীরা অনুভব করতে পারতো না! শিকারীরা নিষ্ঠুরের মত শুধু আনন্দই পেত। তবে জালি দিয়ে মাছ ধরলে মাছের কোন সমস্যা হত না। জালি দিয়ে ধরা কিছু মাছ আবার লাফিয়ে আমার বুকে চলে আসতো। তখন আমার অনেক আনন্দ লাগতো। আমার পানির উপর অনেক ঘাস জন্মাত। যেমন- কচুরীপানা, পটকা, মালঞ্চ, কমলিলতা- আরো কত কি? এই ঘাস কাটতে অনেক কৃষক সন্তান আসতো। তারা নৌকা বা কুন্দা ভরে ঘাস নিয়ে গরুকে খাওয়াত। এই গরুর দুধ বিক্রি করে তাদের সংসার চালাতো। আমার তখন খুশি লাগতো। আমার বুকে পদ্ম ফুঁটত, শাপলা ফুঁটত। তখন আমি অপরুপ হয়ে যেতাম। একটা সাজানো বাগানের মত লাগতো। আমার ঘাসের উপর অনেক পাখি বসেতো। বক, শালিক, ময়না... আরো অনেক পাখি। হাঁসেরা খেলা করতো আমার পানিতে। সুন্দরই লাগতো। কিন্তু হাঁসেরা মল ত্যাগ করলে আমার পানি নষ্ট হয়ে যেত। মানুষ মল ত্যাগ করলেও আমার পানি নষ্ট হয়ে যেত। তখন আমার মনটা কাতর হয়ে যেত। এই নষ্ট করা পানিতে মানুষ নামলে আমি তাদের কামড়াতাম। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েই আমি এ কাজ করতাম। আমার বুকে পালতোলা নৌকা চললে আমার কোন কষ্ট হত না। কিন্তু যখন নৌকা বাইচ হত তখন বৈঠার চাপে আমার বুকটা ছিড়ে যেত। কিন্তু কিছুই করার নেই। মানুষের আনন্দের জন্য একটু কষ্টতো স্বীকার করতেই হবে বৈ কি!
আমার পানি যখন কমে যায় তখন মানুষ আমার মাটিতে বোরো ধান চাষ করে। খুব সহজে এই ধান হয়। তেমন কোন পরিশ্রম লাগে না। মনকে মন ধান হয় আমার মাটিতে। সোনার ফসল হয়। তখন গর্বে আমার মনটা ভরে যায়। আমার ধান খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে? অবশ্য তখন আমার বুকে তেমন পানি থাকে না। পানি ফুরিয়ে গেলে মানবকুল আমার যে মাছগুলো থাকে তা সমূলে উদপাটন করে আমাকে নি:স্ব করে দেয়। তবে আমার উপর জন্মানো ঘাস খেয়ে গরু বাছুর জীবন পায়। কিস্তু গরম কালে সূর্যের প্রচন্ড তাপে আমার মাটি ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়।
একটা দু:খের কথা বলে এখন শেষ করবো। এতক্ষণ যে বিলের কথা বলেছি তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তা এখন শুধুই স্মৃতি। বেরিবাঁধ দিয়ে এই বিলের অস্তিত্বকে বিলিন করে দেয়া হয়েছে। আর এ বিল দেখতে পারবো না কখনও!
-স্বপন রোজারিও (মাইকেল), 06.04.21
আমার পানি যখন কমে যায় তখন মানুষ আমার মাটিতে বোরো ধান চাষ করে। খুব সহজে এই ধান হয়। তেমন কোন পরিশ্রম লাগে না। মনকে মন ধান হয় আমার মাটিতে। সোনার ফসল হয়। তখন গর্বে আমার মনটা ভরে যায়। আমার ধান খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে? অবশ্য তখন আমার বুকে তেমন পানি থাকে না। পানি ফুরিয়ে গেলে মানবকুল আমার যে মাছগুলো থাকে তা সমূলে উদপাটন করে আমাকে নি:স্ব করে দেয়। তবে আমার উপর জন্মানো ঘাস খেয়ে গরু বাছুর জীবন পায়। কিস্তু গরম কালে সূর্যের প্রচন্ড তাপে আমার মাটি ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়।
একটা দু:খের কথা বলে এখন শেষ করবো। এতক্ষণ যে বিলের কথা বলেছি তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তা এখন শুধুই স্মৃতি। বেরিবাঁধ দিয়ে এই বিলের অস্তিত্বকে বিলিন করে দেয়া হয়েছে। আর এ বিল দেখতে পারবো না কখনও!
-স্বপন রোজারিও (মাইকেল), 06.04.21
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১৪/০৪/২০২২চমৎকার লেখনীতে মুগ্ধ
-
নাসরীন আক্তার রুবি ০৮/০৪/২০২১চমৎকার লিখেছেন।
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ০৭/০৪/২০২১nice works...
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৭/০৪/২০২১অপূর্ব কথন
-
ফয়জুল মহী ০৬/০৪/২০২১ভীষণ সুন্দর কথন,