www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রেল পথের আত্মকাহিনী (৩)

আমি একটি রেল পথ। বৃটিশ আমলের কোন এক সময় আমার জন্ম। আমি লৌহ দিয়ে তৈরী নির্জীব পদার্থ সদৃশ হলেও আমি অনেক কিছু উপলব্দি করতে পারি। আমার লৌহ নির্মিত দুটি শক্ত বাহুর ন্যায় দন্ড রয়েছে যা সর্বদা সম দূরত্বে অবস্থান করছে। এতে কোন বিচ্যুতি নেই, নেই কোন অসচ্ছ্বতা। যদিও দেখতে দেখা যায় আমি শুয়ে আছি কিন্তু তা নয়; আদতে আমি ছোট ছোট কাঠের স্লিপারের উপর সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সুন্দরবন বা গজারী বন থেকে এ কাঠ সংগ্রহ করে আমাকে তৈরী করা হয়েছে। কাষ্ঠ খন্ডের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য পাথর। এই নিষ্ঠুর পাথরখন্ডগুলো কাষ্ঠ খন্ডগুলোকে মিলিত হয়ে একাত্ম হতে দিচ্ছেনা যেন কখনো। আমার উপর দিয়ে লম্বা সাপের ন্যায় রেল গাড়ী (ট্রেন) অবিরাম চলছে, তাদের আমি আকড়ে ধরে থাকি, যাতে আমা থেকে বিচ্যুত না হয়, যান-মালের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত যেন না হয়। আমার শরীর দুটি লৌহ খন্ড দিয়ে তৈরী। লৌহ খনিজ সম্পদ। খনি থেকে এই লৌহ আহরণ করা হয়। খনি থেকে আহরিত লৌহ প্রক্রিয়াকরণ করে আমাকে তৈরী করা হয়েছে। আমি অনেক লৌহ খন্ডের সমাহারে তৈরী। লৌহ খন্ডের মধ্যে মধ্যে অনেক ফাঁকা রয়েছে। এর কারণ হল- যখন আমার উপর দিয়ে লম্বা গাড়ীগুলো যতায়াত করে তখন চাকার ঘর্ষণ জনিত কারণে এবং প্রচন্ড গরমে আমি বর্ধিত হয়ে যাই এবং সেই ফাঁকা জায়গা পূরণ করি। এই ফাঁকা অংশ না থাকলে আমার যে কি অবস্থা হতো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভাল করে জানেন। আমি প্রস্থে এক মিটার আর তাই আমার নাম মিটারগেজ রেল পথ। আবার আমার বড় ভাই আছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে তার বসবাস। আমার চেয়ে বড় বলে তার নাম দেয়া হয়েছে ব্রড গেজ রেল পথ। আমার উপর দিয়ে যে রেল গাড়ী চলে তা প্রস্থে ছোট আবার ব্রড গেজ (ভাই-এর উপর) লাইন দিয়ে যে রেল গাড়ী চলে তা প্রস্থে কিছুটা বড়।
আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল-এই আমার উপর দিয়ে প্রতিদিন অনেক অনেক লোক বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করে। কেউ ব্যবসার জন্য, কেউ বেড়াতে আবার কোন কোন কবি ও সাহিত্যির তার জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমার সরাসরি সহায়তা নিয়ে থাকে। এইতো গেল ১লা বৈশাখে আমার বড় ভাইয়ের উপর দিয়ে মৈত্রী ট্রেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পর্যন্ত চলে গেছে। অনেক গণ্যমান্য লোক সেদিন তার উপর দিয়ে ভারত গিয়েছেন। তখন গর্বে আমার বুকটা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। আর মনটা ভরে গিয়েছিল আনন্দে। আমার উপর দিয়ে যখন কোন বন্ধু তার অতি প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবীর হাত ধরে চলে যায় দুর দূরান্তে তখন অপূর্ব লাগে। মাঝে মাঝে পড়ে যায়, আবার হাত ধরে চলে যা মানুষের জীবনেরই মত। কেউ কেউ স্লিপারের উপর দিয়ে হাঁটে। স্লিপারের উপর দিয়ে হাঁটতে হলে সব সময় সম দুরত্বে পা ফেলতে হয়। তা না হলে পা মচকে (কখনো বা ভেঙ্গে) দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা অনেক বেশী থাকে। যেখানে আমার ভাই সুখু মিয়া (আর আমি দুঃখু) আছে অর্থাৎ দুটি রেল পথ আছে বিশেষ করে টঙ্গী জংশন (জংশন হল- যে রেল স্টেশন থেকে একাধিক রেল পথ দেশের বিভিন্ন জেলাতে গমন করেছে) থেকে ঢাকা (কমলাপুর) পর্যন্ত সেখানে সর্বদা ডান দিকের রেল পথ দিয়ে হাঁটা নিরাপদ। কারণ ডান দিকের রেল পথ দিয়ে হাঁটলে গাড়ী সামনে পড়ে এবং জীবন বাঁচানোর তাগিতে নিরাপদ স্থানে যাওয়া যায়। তবে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, আমার বুকের উপর দিয়ে বেখেয়ালীভাবে হাঁটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। আমার উপর দিয়ে হাটতে হলে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। তা না হলে যে কোন দূর্ঘটনা ঘটে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। আমার সবচাইতে বেশী খারাপ লাগে যখন কোন আদম সন্তান আমার উপর আত্মহত্যা করে। তখন লজ্জা,ঘৃণা এবং রাগে আমার মাথা নীচুঁ হয়ে যায়। আমার ন্যায় অসার রেলপথ অর্থহীন মনে হয়। মনে হয় আমি না থাকলে হয়ত একটা মানব দেহ প্রাণে বেঁচে যেত। সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত হতো না। মানব কেন যে আমার উপর আত্মহত্যা করে তা আমি ভেবে পাই না। কিসের এত দুঃখ মানুষের? মানব জীবন কি এতই অসার? যাহোক, আমার মনে হয় আমার উপর আত্মহত্যা করা চরম অন্যায়। কারণ আমার উপর আত্মহত্যা করলে মানুষের দেহ কেটে এবং দুমরে মুচড়ে একাকার হয়ে যায় যা তার আপন জনদের ও চিনতে অসুবিধা হয়। এ ভেবে অন্তত আমার উপর আত্মহত্যা না করা ভাল (তবে আমি এটাও বলছি না যে, কেউ অন্য কোন উপায়ে আত্মহত্যা করুক, কারণ আত্মহত্যার বিপক্ষে আমার অবস্থান)। আমার আরও একটি দুঃখের কারণ হল- দূর্ঘটনায় মানুষের প্রান নাশ হওয়া। আমার বুকের উপর সাধারণতঃ দুই ভাবে দুর্ঘটনা ঘটে। একটি হল- একই লাইন দিয়ে যখন একটি গাড়ী আসতে থাকে তখন সে লাইন দিয়ে আরেকটি গাড়ীকে যেতে অনুমতি দেয়া (মুখোমুখি সংঘর্ষ)। আর অন্যটি হল- লাইনের কোন অংশ উঠিয়ে ফেলা। দুটি কারণের জন্যই মানুষের অসতর্কতা দায়ী। সতর্কতার সাথে কাজ করলে কোন দুর্ঘটনাই ঘটবে না এবং আমার কোন দুঃখ ও থাকবে না। আমি আশা করি এ বিষয়ে সকল পক্ষের সহযোগিতা থাকবে।
বাংলাদেশের সব জেলাতে যাওয়ার আমার অনেক শখ। কিন্তু যে জেলাতে বেশী নদী রয়েছে সেখানে আমি যেতে পারিনি। এটা আমার একটা অন্যতম দুঃখ। তবে দেশী ও বিদেশী সহায়তায় নদীর উপর রেল ব্রীজ তৈরী করা হলে আমার পক্ষে দেশের সকল জেলায় যাওয়া সম্ভব। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে আমি সকল জেলায় যেতে পারবো এবং আমার মনের আশা পূরণ হবে এবং আমার দুঃখ দূর হবে।
একটি ঘটনা দিয়ে লেখার যবনিকা টানি। একদিন একটি টগবগে যুবক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আমার উপর আসলো আত্মহত্যা করার জন্য। সে সবে মাত্র ঢাকায় এসেছে কলেজে পড়ার জন্য। কিন্তু টাকা পয়সার অভাবে সে কলেজে ভর্তি হতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। আমি তাকে আত্মহত্যা করতে দেইনি। আমি তাকে অনেক করে বুঝালাম। অত্মহত্যা মহাপাপ....ইত্যাদি ইত্যাদি। তাকে বললাম সমবায় সমিতির সদস্য হতে। ছেলেটি আমার কথামত সমবায় সমিতির সদস্য হল। সে প্রতিমাসে নিজে তার বই জমা দিত। ফলে বিভিন্ন সদস্যদের সাথে তার পরিচয় হয়ে গেল। পরের বৎসর যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় এল তখন সে সমিতি থেকে একটি ঋণ নিয়ে কলেজে ভর্তি হল। টিউশনি করে কিস্তির টাকা এবং নিজের খরচ চালিয়ে নিতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। এভাবে যখনই তার বড় অংকের টাকার প্রয়োজন পড়েছে তখনই সে সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে। সবচাইতে সুখের বিষয়, সে স্নাতক পাশ করার পর আমার সমবায় সমিতিতেই চাকুরি নিয়েছে। সে এখন প্রতিদিন আমার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অফিসে যায়। তাকে দেখলে আমার আনেক ভাল লাগে। কারণ সৃষ্টিকর্তার একটি মাত্র সন্তানকে হলেও আমি আত্মহত্যার মত জঘণ্য কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছি। এটা আমার জীবনে পরম পাওয়া।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৩২০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/১২/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast