www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গ্রাম-গঞ্জের বিয়ে সাদি

আজ থেকে ৪০ বছর আগের আমাদের এলাকায় বিয়ে সাদির কথা বলছি। গ্রামে একটা বিয়ে মানে বিরাট ব্যাপার ছিলো। গ্রামের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যেতো। এর পিছনে যে কত সময় ও শ্রম ব্যয় হত তা কল্পনা করা যায় না। ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া-পরশির ঘুম নাই’ এমন অবস্থা আর কি! এই ধরুন- মেয়ে দেখা, ছেলের বাড়ী দেখা, মাছ-ভাত, খাওয়া-দাওয়া, বান প্রকাশ (চার্চে ছেলে-মেয়ের নাম প্রকাশ), গুয়ামেল, .... আরও যে কত কি ! তা প্রকাশ করা মুসকিল। আজকে শুধু আমি বিয়ের অংশটুকু বলবো। সব বর্ণনা দিতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। পাঠকরা পড়ে বোর হয়ে যাবেন।
আমাদের এলাকায় অনেক গ্রামীন সংগঠন বা ক্লাব আছে। আছে শক্ত ও দায়িত্ববান সমাজ। সমাজ মানে বিশাল ব্যাপার। সমাজের কেউ মৃত্যুবরণ করলে সমাজের সবাইকে ৩দিন নিরামিষ খেতে হয়। সমাজ অর্থ হল অনেকটা এই ধরনের জিনিস। বিয়ের দায়িত্বটা সাধারণত: ক্লাব ও সমাজের লোকেরাই নেয়। বিয়ের ৭দিন আগে থেকে বিয়ের জন্য খড়ি (লাকরি) ফারার কাজ শুরু হয়ে যায়। এর পরে হয় গুয়ামেল। গুয়ামেল হল বিয়ের সার্বিক ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত আলোচনা ও দায়িত্ব বন্টনের সভা। বিয়ের তিন দিন আগে আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়ার পর্ব শুরু হয়ে যেতো। তিন দিন আগে বরের আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়ার পর্ব শেষ করতে হবে। যে যেখানেই থাকুক না কেন। এর পর শুরু হয় বিয়ে বাড়ী সাজানোর অধ্যায়। বিয়ে বাড়ী সাজানোর জন্য সামিয়ানা আবশ্যিক উপাদান। একটা সামিয়ানা টানানো হলে বাড়ীটা বিয়ে বাড়ী বিয়ে বাড়ী মনে হয়। আর রাতের জন্য হ্যাজাক লাইট অবশ্যই লাগবে। হ্যাজাক লাইট হলো বিয়ে বাড়ীর শুভা। আগে গায়ে হলুদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর বানানোর তেমন একটা প্রয়োজন পড়তো না বা বানানো হত না। কিন্তু ইদানিং গায়ে হলুদের জন্য আলাদা ঘর চাই-ই চাই। যাহোক, বিয়ের আগের দিন গুরু হয় গায়ে হলুদ পর্ব। গায়ে হলুদ একটি পবিত্র অনুষ্ঠান যেখানে আলাদা আলাদাভাবে বর ও কনেকে হলুদ মেখে শুভ্র করা হয়। একদিকে গায়ে হলুদ চলতে থাকে এবং আরেক দিকে চলতে থাকে বাজনা। বিয়েতে বাজনা বাজানোর ঐহিত্য আমাদের এলাকায় অনেক আগে থেকেই রয়েছে। এই বাজনার তালে তালে বিভিন্ন ধরনের নাচ চলতো। যেহেতু আমাদের কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অঞ্চল, সেহেতু বিয়ে বাড়ীতে নাচের বিষয়টি কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতো। অর্থাৎ বিয়ে বাড়ীতে বাজনার সাথে সাথে ধানের জমি প্রস্তুত করা, ধান রোয়া, ধান কাটা, ধান গোলাজাত করা এই পুরা প্যাকেজটাই নৃত্যের তালে তালে অভিনয় করে দেখানো হত। এখন আর সেই বহুমুখী নাচের ধরন আর একেবারেই চোখে পড়ে না। এখন বিয়ে বাড়ীতে যার যেমন খুশি সেইভাবেই নৃত্যের পর্ব সুসম্পন্ন করে। গায়ে হলুদ দেয়ার পর ¯œান শেষে শুরু হয় বর/কনেকে আশীর্বাদ দেয়ার পর্ব। এই বিষয়টিকে গ্রামের ভাষায় বেছাম বলে। এই বেছাম দেয়ার পর খাওয়া-দাওয়া শেষে সমাপ্ত হয় গায়ে হলুদ পর্ব। গায়ে হলুদের পরের দিন শুরু হয় বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এ পর্ব চার্চে বা গীর্জায় সম্পন্ন করা আত্যাবশ্যক। চার্চে একজন পুরোহিত মন্ত্র পরিয়ে বর ও কনেকে একত্রিত করে দেয় এবং বিয়ে রেজিষ্ট্রি করা হয়। এর পর শুরু হয় ফটোসেশন। তখন বর কনে তাদের জীবনের মধুময় ক্ষণটি ক্যামেরা বন্দি করে নেয়। এখন অবশ্য ভিডিও-ও করা হয়। অত:পর বর-কনে যদি দ্রæত সময় বাড়ীতে আসে তাহলে ছোট-খাট একটা নাস্তা খাওয়ার পর্ব থাকে। পরে শুরু হয় উপহার প্রদান ও খাবারে পর্ব। প্রতি বিয়েতে গ্রামের মাতব্বর একটি মিথ্যে ঘোষণা দেয়- ‘ ঠায়সকল, আপনাদের জন্য কিছু লবন-ভাতের আয়োজন করা হয়েছে’ কিন্তু আদতে তা ভাতের সাথে ৩টা তরকারী এবং মিষ্টান্ন (জাউ)। খোদ মাতব্বররাই কিভাবে এরুপ মিথ্যা কথা বলে, বুঝি না। ভাতের সাথে একটা মাংসের ভাজি, একটা মাংস দিয়ে মাসকলাই ডাল, একটা আমিলা (মশুরী) ডাল এবং দুধভাত বা মিষ্টান্ন বা জাউ। যারা খাবার পরিবেশন করে তাদের সাইদার বলা হয়। প্রতিটি আইটেম নিয়ে সাইদারদের ২বার করে অতিথিদের কাছে যেতে হয়। এই সুস্বাদু খাবার কিন্তু প্রস্তত করতো গ্রামের মহিলারাই। এতোগুলো আইটেম তারা কি ভাবে যে তৈরী করতো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানে। বিয়ের পরদিন আবার চলতো সাইদারদের অপ্যায়নের কাজ। এইভাবেই কেটে যেত বিয়ে সাদির কাজ। আজ যা শুধুই স্মৃতি!
স্বপন রোজারিও, ২৮/০৯/২০
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩০৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/০৯/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast