শিশুশিক্ষা ও শিশুশ্রম নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
শিশুশিক্ষা ও শিশুশ্রম নিয়ে প্রাসাঙ্গিক কিছু কথা
স্বপন শর্মা
.
যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যতো ভালো সে দেশে শিশু শ্রম তত কম। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণেই ব্যাপক সংখ্যক শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিল, তবে এখন যে শিশুশ্রম একেবারেই নেই, সে কথা মোটেও সত্য নয়। এ কথা সত্য যে, প্রত্যক্ষ শিশুশ্রম আগের চেয়ে বহুলাংশে অনেকটা কমেছে। কারণ যদি খেয়াল করি তাহলে দেখতে
পাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি দেশেও নিষিদ্ধ হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। তবুও সারাদেশে প্রায় ৫২ লক্ষ শিশু রয়েছে যারা প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, অথচ তারা যে পারিশ্রমিক পায় তা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় অতি নগন্য। শিশুরা যদি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়, তাহলে সেই শিশুদের হাত ধরেই পিছিয়ে পড়বে আমাদের সমাজ, দেশ এবং জাতি।
তখন দেশের উন্নতি, জাতির উন্নতি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদের বর্তমান সরকার শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে অঙ্গিকারবদ্ধ। সরকার ও সমাজ তাই দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করে শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে চান। আর এই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চান অবশ্যই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশের শিশু শিক্ষার শিক্ষাব্যবস্থা কী আলো ছড়ানোর মতো? সরকার পক্ষের হয়ত বিশ্বাস এতে শিশুদের শারীরিক কষ্ট লাঘব হবে, শিশুরা হয়ত উন্নতির শিখরে পৌছাবার পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু যারা এই আলো ছড়ানোর দায়িত্বে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন, তারা কতটুকু আন্তরিক? শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের শ্রম লাঘব হচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কারণ আমি খুব নিকট হতে দেখেছি তৃনমূল পর্যায়ে শিশুশিক্ষার বেহাল ব্যবস্থা, যে ছয় প্লাস বয়েসের শিশু ভর্তি হয়ে এক বছরেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শিখতে পারে না( শিখাতে পারি না), যেখানকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গণ মিড-ডে মিল, উপবৃত্তির এবং নিজের বেতন ভাতা'র ভাগাভাগিতে স্কুল আওয়ার শেষ করেন, সেখান হতে কিভাবে শিশুশিক্ষার আলো জ্বলবে! তিনশ পয়ষট্রি দিনে বর্ণমালার বর্ণ শিখাতে পারি না। কি চমৎকার তৃর্নমূলের শিশু শিক্ষা ব্যবস্থা! আমার সৌভাগ্য হয়েছিল যুব উন্নয়নের এক প্রজেক্টের আওতায় দুবছর ব্যাপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করার অর্থাৎ শিক্ষকতা করা, সেখানে অনেক কিছু শিখি, কেমন করে মিড-ডে মিলের বিস্কুট বন্টন শিটে লেখতে হয়, উপবৃত্তির কার্ড প্রতি কত টাকা করে নিতে হবে, পরীক্ষা ফি ইচ্ছে মাফিক উত্তোলন করা ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হলো দুবছরে মাত্র দু'বার শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঐ বিদ্যালয়ে পেয়েছিলাম। তার গড় অবস্থান দশ মিনিট হয়ত হবে। প্রধান শিক্ষক প্রায় থাকতেন শিক্ষা অফিসের বারান্দায়, বিদ্যালয় চলত প্রধান শিক্ষক ছাড়া। আমাদের ইচ্ছে মাফিক। এরকম আলোর কেন্দ্র হতে শিশু শিক্ষার আলো যে কত দূর পর্যন্ত আলোকিত করবে সন্দেহ থেকে যায়।
আবার শহরের দিকে খেয়াল করুন- বিপত্তিটা এখানে সৃষ্টি হয় যখন শিশুকে আমাদের শিক্ষব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হয়। মনে হয় এই প্রক্রিয়ায় শিশুশ্রম নিরোধ না হয়ে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মা-বাবারা শিশুদের মুখ থেকে দুধের গন্ধ শেষ হওয়ার আগে সে মুখ থেকে পড়ালেখার বুলি শুনতে চান। এরপর যখন শিশুর মুখ থেকে দুধের গন্ধ সামান্য কেটে যায়, তখনই শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সেটা আবার যে সে বিদ্যালয় নয়, দেশের নামকরা সব স্কুল গুলো। যে করেই হোক, তাদের ঐ স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়ার লক্ষ্যে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের প্রাণপণ চেষ্টা করে অসংখ্য ভর্তি গাইড, বই, শিট পড়ানো শুরু করেন। অনেকে আবার তাদের সন্তানদের ‘ভর্তি কোচিং’ নামক অজায়গায় ভর্তি করে দেন। ফলে শিশুশ্রম না কমিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এভাবে প্রতিনিয়ত। আমরা যদি একটু ভিন্ন দৃষ্টি দিই দেখতে পাব ভিন্ন কিছু শিশুশিক্ষা পাশাপাশি শ্রমবিষয় উঠে আসবে হয়ত-
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশই শিশু। সংবিধানে সব ধর্ম বর্ণের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা থাকলেও আমরা তা নিশ্চিত
করতে পারছি না। বিশ্বের সব দেশেই শিশু অধিকার নিয়ে জোড়ে শোড়ে আলোচনা হলেও প্রায় সব দেশেই কম
বেশি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তবে উন্নত রাষ্ট্র গুলোর তুলনায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি
ঘটছে। ইউএনডিপি'র মতে ১৩ থেকে ১৮ বৎসরে সারাদেশে ৪৯ ভাগ পথশিশু রয়েছে। ১০ থেকে ১২ বছরে শতকরা ৪৩ ভাগ, ৬ থেকে ৯ বৎসরে শতকরা ৭ ভাগ পথশিশু। শতকরা ৪৬ ভাগ শিশু সংসারের প্রয়োজনে চরম দারিদ্র্যতার কারণে এবং ২১ ভাগ শিশুকে উপার্জনের জন্য রাস্তায় আবাসন গড়তে হয়। শিশুনীতি ২০১০ অনুযায়ী শিশুর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও অধিকার সংরক্ষণে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শিশুর অধিকার সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। আমাদের জাতীয় শিশুনীতিতে বলা আছে, ১৪ বৎসরে নীচে শিশুদের যে কোন ধরনের কাজে
নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ৩ আগস্ট ১৯৯০ জাতিসংঘ শিশুর অধিকার সনদ বাংলাদেশ সমর্থন করে।
বাস্তবে এদেশের চিত্র বিপরীতমুখী। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে ৮ লাখ পথশিশু রয়েছে তাদের দায়ভার রাষ্ট্রের অথচ দেশের সরকারগুলো তাদের ব্যাপারে উদাসীন। বিশেষতঃ আমাদের দেশের শিশুরা কর্ম ক্ষেত্র, গৃহসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত হয়। গৃহ পরিচারিকাদের উপর নির্মম নির্যাতনের কথা প্রায়ই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবেক বোধের উন্নয়ন, নৈতিকতার উন্নতি না ঘটলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে না পারলে এ থেকে পরিত্রানের উপায় পাব না। শিশুদের বিনোদনের জন্য গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও খেলার মাঠ থাকলেও শহরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। ফলে বিনোদনসহ মনোবিকাশের যথেষ্ট সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের
দেশের শিশুরা। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। শিশু অধিকার সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী কাজ করছে সেভ
দ্য চিলড্রেন। শিশুদের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা, অপব্যবহার, সহিংসতা রোধ সর্বোপরি কিভাবে তাদের রক্ষা করা
যায় এ ব্যাপারে ১৯৮৯ সালের, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের বহুমুখী নির্যাতন,
শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্য প্রতিরোধে কমিউনিটি থেকে সর্বত্র কাজ করে আসছে। অনেক শিশু অনৈতিক বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটায়। দারিদ্রতার
কারণে শিশুরা যুক্ত হচ্ছে শ্রম বিক্রির সাথে। মালিক পক্ষ কাজের যথাযথ পরিবেশ করে না দিলেও শিশু শ্রমিককে কম বেতনে নির্ধারিত সময়ের
চেয়ে বেশি পরিশ্রম করানো হয়। শিশুরা গৃহ, দোকান পাট, যানবাহনের কাজ এমনকি ওয়েল্ডিং এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও করছে। মধ্য প্রাচ্যের
দেশ গুলোতে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের শিশু শ্রমিকদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিশুদের বেতন মওকুফ, ফ্রি বই প্রদান করা হলেও শিক্ষা গ্রহন থেকে ঝড়ে পরা বিপুল সংখ্যক শিশু লেখা পড়া শেষ করতে পারছে না। যে সব শিশু ঝড়ে পরছে তাদের সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহন করা হচ্ছে না। অনেক মেয়ে শিশু পরিবারের মা বোন খালা ফুফু দের দেখে শুনে অর্থ উপার্জনের জন্য পরিবারকে সহায়তা করার জন্য নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বেশি দেখিয়ে প্রত্যয়ন নিয়ে যৌন কর্মী
হিসেবে খদ্দেরের মনো রঞ্জন করে থাকেন। অসচেতন পরিবারের প্রধানরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভার চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে জন্মসনদ নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন বিয়ের পিঁড়িতে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করে মৌলভী ডেকে কলেমা পড়িয়ে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসার করানো হয়। পরে সুযোগ সুবিধা মতো সময়ে রেজিষ্ট্রি করে নেয়। শিশু অপরাধ, কিশোর অপরাধ এবং বয়স্ক অপরাধীদের মধ্যে বয়সের তফাৎ থাকলেও তা সঠিক ভাবে মেনে চলা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছল অসচেতন মা বাবা অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের লালন পালন করতে পারেন না। কেবল মাত্র
পরিবারকে স্বচ্ছল করতে তাদেরকে পিতার কাজে সহায়তা করতে হয়। আর এসব পিতা মাতাও তাদের সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করে নিজেদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সংসারে বাড়তি স্বচ্ছলতার
আশায় পিতা মাতা অনেকটা নিরুপায় হয়ে যান। যা হোক পারিবারিক আর্থিক
অস্বচ্ছলতা যে শিশু শ্রমের প্রধান কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শিশু
বান্ধব পরিবেশ গড়তে আমাদের করণীয় হলো, সব পিতা মাতার উচিত শিশুদের প্রতি সব সময় নজর রাখা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, শিশুদের মধ্যে বিদ্যমান
অসমতা দূর করতে হবে। শিশুদের কাজেন নূন্যতম বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে তা শিশু কল্যানে
ব্যয় করা যেতে পারে।
.
কলামিষ্ট: স্বপন শর্মা
[email protected]
স্বপন শর্মা
.
যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যতো ভালো সে দেশে শিশু শ্রম তত কম। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণেই ব্যাপক সংখ্যক শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিল, তবে এখন যে শিশুশ্রম একেবারেই নেই, সে কথা মোটেও সত্য নয়। এ কথা সত্য যে, প্রত্যক্ষ শিশুশ্রম আগের চেয়ে বহুলাংশে অনেকটা কমেছে। কারণ যদি খেয়াল করি তাহলে দেখতে
পাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি দেশেও নিষিদ্ধ হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। তবুও সারাদেশে প্রায় ৫২ লক্ষ শিশু রয়েছে যারা প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, অথচ তারা যে পারিশ্রমিক পায় তা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় অতি নগন্য। শিশুরা যদি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়, তাহলে সেই শিশুদের হাত ধরেই পিছিয়ে পড়বে আমাদের সমাজ, দেশ এবং জাতি।
তখন দেশের উন্নতি, জাতির উন্নতি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদের বর্তমান সরকার শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে অঙ্গিকারবদ্ধ। সরকার ও সমাজ তাই দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করে শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে চান। আর এই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চান অবশ্যই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশের শিশু শিক্ষার শিক্ষাব্যবস্থা কী আলো ছড়ানোর মতো? সরকার পক্ষের হয়ত বিশ্বাস এতে শিশুদের শারীরিক কষ্ট লাঘব হবে, শিশুরা হয়ত উন্নতির শিখরে পৌছাবার পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু যারা এই আলো ছড়ানোর দায়িত্বে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন, তারা কতটুকু আন্তরিক? শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের শ্রম লাঘব হচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কারণ আমি খুব নিকট হতে দেখেছি তৃনমূল পর্যায়ে শিশুশিক্ষার বেহাল ব্যবস্থা, যে ছয় প্লাস বয়েসের শিশু ভর্তি হয়ে এক বছরেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শিখতে পারে না( শিখাতে পারি না), যেখানকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গণ মিড-ডে মিল, উপবৃত্তির এবং নিজের বেতন ভাতা'র ভাগাভাগিতে স্কুল আওয়ার শেষ করেন, সেখান হতে কিভাবে শিশুশিক্ষার আলো জ্বলবে! তিনশ পয়ষট্রি দিনে বর্ণমালার বর্ণ শিখাতে পারি না। কি চমৎকার তৃর্নমূলের শিশু শিক্ষা ব্যবস্থা! আমার সৌভাগ্য হয়েছিল যুব উন্নয়নের এক প্রজেক্টের আওতায় দুবছর ব্যাপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করার অর্থাৎ শিক্ষকতা করা, সেখানে অনেক কিছু শিখি, কেমন করে মিড-ডে মিলের বিস্কুট বন্টন শিটে লেখতে হয়, উপবৃত্তির কার্ড প্রতি কত টাকা করে নিতে হবে, পরীক্ষা ফি ইচ্ছে মাফিক উত্তোলন করা ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হলো দুবছরে মাত্র দু'বার শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঐ বিদ্যালয়ে পেয়েছিলাম। তার গড় অবস্থান দশ মিনিট হয়ত হবে। প্রধান শিক্ষক প্রায় থাকতেন শিক্ষা অফিসের বারান্দায়, বিদ্যালয় চলত প্রধান শিক্ষক ছাড়া। আমাদের ইচ্ছে মাফিক। এরকম আলোর কেন্দ্র হতে শিশু শিক্ষার আলো যে কত দূর পর্যন্ত আলোকিত করবে সন্দেহ থেকে যায়।
আবার শহরের দিকে খেয়াল করুন- বিপত্তিটা এখানে সৃষ্টি হয় যখন শিশুকে আমাদের শিক্ষব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হয়। মনে হয় এই প্রক্রিয়ায় শিশুশ্রম নিরোধ না হয়ে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মা-বাবারা শিশুদের মুখ থেকে দুধের গন্ধ শেষ হওয়ার আগে সে মুখ থেকে পড়ালেখার বুলি শুনতে চান। এরপর যখন শিশুর মুখ থেকে দুধের গন্ধ সামান্য কেটে যায়, তখনই শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সেটা আবার যে সে বিদ্যালয় নয়, দেশের নামকরা সব স্কুল গুলো। যে করেই হোক, তাদের ঐ স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়ার লক্ষ্যে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের প্রাণপণ চেষ্টা করে অসংখ্য ভর্তি গাইড, বই, শিট পড়ানো শুরু করেন। অনেকে আবার তাদের সন্তানদের ‘ভর্তি কোচিং’ নামক অজায়গায় ভর্তি করে দেন। ফলে শিশুশ্রম না কমিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এভাবে প্রতিনিয়ত। আমরা যদি একটু ভিন্ন দৃষ্টি দিই দেখতে পাব ভিন্ন কিছু শিশুশিক্ষা পাশাপাশি শ্রমবিষয় উঠে আসবে হয়ত-
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশই শিশু। সংবিধানে সব ধর্ম বর্ণের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা থাকলেও আমরা তা নিশ্চিত
করতে পারছি না। বিশ্বের সব দেশেই শিশু অধিকার নিয়ে জোড়ে শোড়ে আলোচনা হলেও প্রায় সব দেশেই কম
বেশি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তবে উন্নত রাষ্ট্র গুলোর তুলনায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি
ঘটছে। ইউএনডিপি'র মতে ১৩ থেকে ১৮ বৎসরে সারাদেশে ৪৯ ভাগ পথশিশু রয়েছে। ১০ থেকে ১২ বছরে শতকরা ৪৩ ভাগ, ৬ থেকে ৯ বৎসরে শতকরা ৭ ভাগ পথশিশু। শতকরা ৪৬ ভাগ শিশু সংসারের প্রয়োজনে চরম দারিদ্র্যতার কারণে এবং ২১ ভাগ শিশুকে উপার্জনের জন্য রাস্তায় আবাসন গড়তে হয়। শিশুনীতি ২০১০ অনুযায়ী শিশুর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও অধিকার সংরক্ষণে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শিশুর অধিকার সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। আমাদের জাতীয় শিশুনীতিতে বলা আছে, ১৪ বৎসরে নীচে শিশুদের যে কোন ধরনের কাজে
নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ৩ আগস্ট ১৯৯০ জাতিসংঘ শিশুর অধিকার সনদ বাংলাদেশ সমর্থন করে।
বাস্তবে এদেশের চিত্র বিপরীতমুখী। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে ৮ লাখ পথশিশু রয়েছে তাদের দায়ভার রাষ্ট্রের অথচ দেশের সরকারগুলো তাদের ব্যাপারে উদাসীন। বিশেষতঃ আমাদের দেশের শিশুরা কর্ম ক্ষেত্র, গৃহসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত হয়। গৃহ পরিচারিকাদের উপর নির্মম নির্যাতনের কথা প্রায়ই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবেক বোধের উন্নয়ন, নৈতিকতার উন্নতি না ঘটলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে না পারলে এ থেকে পরিত্রানের উপায় পাব না। শিশুদের বিনোদনের জন্য গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও খেলার মাঠ থাকলেও শহরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। ফলে বিনোদনসহ মনোবিকাশের যথেষ্ট সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের
দেশের শিশুরা। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। শিশু অধিকার সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী কাজ করছে সেভ
দ্য চিলড্রেন। শিশুদের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা, অপব্যবহার, সহিংসতা রোধ সর্বোপরি কিভাবে তাদের রক্ষা করা
যায় এ ব্যাপারে ১৯৮৯ সালের, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের বহুমুখী নির্যাতন,
শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্য প্রতিরোধে কমিউনিটি থেকে সর্বত্র কাজ করে আসছে। অনেক শিশু অনৈতিক বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটায়। দারিদ্রতার
কারণে শিশুরা যুক্ত হচ্ছে শ্রম বিক্রির সাথে। মালিক পক্ষ কাজের যথাযথ পরিবেশ করে না দিলেও শিশু শ্রমিককে কম বেতনে নির্ধারিত সময়ের
চেয়ে বেশি পরিশ্রম করানো হয়। শিশুরা গৃহ, দোকান পাট, যানবাহনের কাজ এমনকি ওয়েল্ডিং এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও করছে। মধ্য প্রাচ্যের
দেশ গুলোতে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের শিশু শ্রমিকদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিশুদের বেতন মওকুফ, ফ্রি বই প্রদান করা হলেও শিক্ষা গ্রহন থেকে ঝড়ে পরা বিপুল সংখ্যক শিশু লেখা পড়া শেষ করতে পারছে না। যে সব শিশু ঝড়ে পরছে তাদের সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহন করা হচ্ছে না। অনেক মেয়ে শিশু পরিবারের মা বোন খালা ফুফু দের দেখে শুনে অর্থ উপার্জনের জন্য পরিবারকে সহায়তা করার জন্য নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বেশি দেখিয়ে প্রত্যয়ন নিয়ে যৌন কর্মী
হিসেবে খদ্দেরের মনো রঞ্জন করে থাকেন। অসচেতন পরিবারের প্রধানরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভার চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে জন্মসনদ নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন বিয়ের পিঁড়িতে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করে মৌলভী ডেকে কলেমা পড়িয়ে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসার করানো হয়। পরে সুযোগ সুবিধা মতো সময়ে রেজিষ্ট্রি করে নেয়। শিশু অপরাধ, কিশোর অপরাধ এবং বয়স্ক অপরাধীদের মধ্যে বয়সের তফাৎ থাকলেও তা সঠিক ভাবে মেনে চলা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছল অসচেতন মা বাবা অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের লালন পালন করতে পারেন না। কেবল মাত্র
পরিবারকে স্বচ্ছল করতে তাদেরকে পিতার কাজে সহায়তা করতে হয়। আর এসব পিতা মাতাও তাদের সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করে নিজেদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। সংসারে বাড়তি স্বচ্ছলতার
আশায় পিতা মাতা অনেকটা নিরুপায় হয়ে যান। যা হোক পারিবারিক আর্থিক
অস্বচ্ছলতা যে শিশু শ্রমের প্রধান কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শিশু
বান্ধব পরিবেশ গড়তে আমাদের করণীয় হলো, সব পিতা মাতার উচিত শিশুদের প্রতি সব সময় নজর রাখা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, শিশুদের মধ্যে বিদ্যমান
অসমতা দূর করতে হবে। শিশুদের কাজেন নূন্যতম বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে তা শিশু কল্যানে
ব্যয় করা যেতে পারে।
.
কলামিষ্ট: স্বপন শর্মা
[email protected]
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুল হক ০১/০৭/২০১৭সুন্দর লিখার জন্য ধন্যবাদ!!