www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হুমায়ূন আহমেদ- হিমু নাকি মিসির আলী

মানুষের অস্তিত্ব ম্পর্কে ফরাসী দার্শনিক জঁ্যা পল সার্তে বলেছেন Man is a useless passion মানুষ যে মুহূর্তে চিরদিন বেঁচে থাকার মোহ, মায়া থেকে মুক্ত হবে তখনই সে উপলদ্ধি করবে যে, "খরভব যধং হড় সবধহরহম" জীবনানন্দ দাস মৃত্যু ম্পর্কে বলেছেন, "আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর?/জানি না কি আহা!/সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো/ এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ....." মৃত্যু চিরন্তন কিন্তু মানুষের কর্ম মৃত্যুকে জয় করে এগিয়ে যায় মহাজনমের দিকে। যেখানে আর কোন মৃত্যু নেই। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মৃত্যুকে কি জয় করতে পেরেছেন? উত্তরের যে কেউ বলবে হ্যাঁ। মানুষ মানুষের ভেতর বেঁচে থাকে অনন্তকাল। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি হিমু ও মিসির আলীর ভেতর তিনি বেঁচে থাকবেন। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাসে এ দু টো চরিত্রকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন আমেজ। কিছুটা বাস্তবিক, কিছুটা কাল্পনিক, কিছুটা অতিবাস্তবিক তাঁর লেখার সহজ সরল ও সাবলীল ভঙ্গিতে এরকম জাদু বাস্তবতা পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখতো। এক অন্য ঘোরে। সহজ কথাগুলো আসত্দে আসত্দে মগজের ভেতরে ঢুকে গিয়ে মাথাটাকে একদম ভারী করে দিতো। এ যেন আমাদের মনের কথা, প্রাণের কথা। মানুষের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবাবেগগুলো সযতনে ঠাঁই পেতো তাঁর লেখায়। তাই সে মানুষের কাছে এতো জনপ্রিয় হতে পেরেছেন। ভাষা জটিলতা ও ভাবের দুর্বোধ্যতার কারণে যখন আসত্দে আসত্দে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল তখন পাঠককে ঠিক অনেকটা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বইয়ের দিকে টেনে এনেছেন। যে যুবক বা যুবতী কোন দিন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য কোন বই পড়েন নি, তারাও কোন না কোন সময়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি বই হলেও পড়েছেন। আর তাঁর বই পড়ে কেউ কেউ হয়ে গেছেন হিমু। হলুদ পাঞ্জাবী, খালি পা, উস্কুখুস্কু চুল এ এ সাজে সেজেছেন তাঁর পাঠকেরা। হিমু একটা স্বাপি্নক চরিত্র। যার হয়তো এক বা একাধিক ডানা আছে। চোখ বন্ধ করে হয়তো সে পৌঁছে যেতে পারে মহাজগতের কাছাকাছি। আমরা মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষগুলো খুবই অসহায়। তারা চিরকালই অসুখী। তারা কল্পনার ভেতর সুখ খুঁজে বেড়ায় স্বপ্ন্ন দেখতেও তারা ভালবাসে। হুমায়ূন আহমেদ এই মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের উপলব্ধিগুলো ধারণ করতে পেরেছিলেন। তাইতো সে কখনো হিমু আবার কখনো বা মিসির আলী হয়ে হাজির হয়েছেন আমাদের সামনে। হুমায়ূন আহমেদের নামকে সংক্ষিপ্ত করলে কিংবা তার যদি কোন ডাক নাম দেওয়া যায় তবে তা হবে হিমু। হুমায়ূন থেকে হিমু। তিনি হয়তো তার নিজেরই একটা নাম নিজেই দিয়েছেন। তার দ্বৈতসত্ত্বা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। হিমু ও মিসির আলী চরিত্র তৈরির মাধ্যমে।
হিমুর ভবিষ্যত ম্পর্কে চিন্তা করার অসম্ভব একটা ক্ষমতা ছিল। তা অনেক সময় ঠিক হতো অনেক সময় হতো না। অনেক দিন সে না খেয়ে কাটিয়েছে, খালি পায়ে তপ্ত পিচঢালা পথে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়েছে, কখনওবা জেলখানায়, কখনওবা পার্কের বেঞ্চিতে অবসন্ন দেহটিকে এলিয়ে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কঠিনতম সময়কে রূপকভাবে তুলে ধরেছেন হিমু চরিত্রটির মাধ্যমে। তাই তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার না করলেও অনেকেই হিমু চরিত্রটির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদকে খুঁজে পান।
হুমায়ূন আহমেদকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি হিমু না মিসির আলী? তিনি অনেক ভেবেচিন্তে বলেছিলেন তিনি মিসির আলী। মিসির আলী প্রফেসর মানুষ, একাকীত্ব জীবন পছন্দ করেন। স্বপ্ন দেখেন ভাবেন অসঙ্গতি নিয়ে, সুন্দর ও অসুন্দরকে নিয়ে। নিজের কাজে মগ্ন হয়ে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদের জীবনটাও ঠিক এরকম। তাই তিনি নিজের মতোই একটা চরিত্র তৈরি করলেন যার নাম মিসির আলী। হিমুর ভবিষ্যত ম্পর্কে চিন্তা করার অসম্ভব একটা ক্ষমতা ছিল। তা অনেক সময় ঠিক হতো অনেক সময় হতো না। অনেক দিন সে না খেয়ে কাটিয়েছে, খালি পায়ে তপ্ত পিচঢালা পথে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়েছে, কখনওবা জেলখানায়, কখনওবা পার্কের বেঞ্চিতে অবসন্ন দেহটিকে এলিয়ে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কঠিনতম সময়কে রূপকভাবে তুলে ধরেছেন হিমু চরিত্রটির মাধ্যমে। তাই তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার না করলেও অনেকেই হিমু চরিত্রটির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদকে খুঁজে পান।
যারা একসময় হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় তাঁর লেখনির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন, তারাই তাঁর মৃত্যুর পর গদগদ হয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন। সত্যিই এইসব সমালোচকদের চরিত্র খুবই হাস্যকর ও অদ্ভুত। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তো এদেরকে নিয়েও একটা চরিত্র তৈরি করতেন। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনশিল্পীর মতো হুমায়ূন ছিলেন ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অনেক সমালোচক উল্লেখ করেছেন তার পড়াশোনার ব্যপ্তি ছিলো বিশাল। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র হয়েও তিনি বিশ্বের প্রধান লেখকদের বিভিন্ন রচনা নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিলো বিস্ময়কর। তিনি ধর্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, ম্যাজিক, পরিবেশ ও জলবায়ু, বৃক্ষ, লোকসাহিত্য, লোকজীবন ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তাছাড়া স্পেনের বিখ্যাত কবি ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন ও তার নাটকে সুযোগ পেলেই ব্যবহার করেছেন। জন স্টেইনবেক, অ্যালানপো বিষয়ে তিনি চমৎকার গল্প বলতেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙক্তি দিয়ে তিনি উপন্যাসের নামকরণ করেন। যেমন: দারুচিনি, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। তবে তাঁর ভুবনের বিশাল অংশ জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের অবিনাশী গান, গীতাঞ্জলী রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার পঙক্তি দিয়ে তিনি অনেক উপন্যাসের নামকরণ করেন। উদাহরণ স্বরূপ: আগুনের পরশমণি, আমার আছে জল, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, দিনের শেষে, দূরে কোথায়, বাদল দিনের প্রথম কদমফুল, মেঘ বলেছে যাব যাব, শ্যামলছায়া, সকল কাঁটা ধন্য করে, সবাই গেছে বনে ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদ চরমভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক অজ্ঞ সমালোচক তাকে নাস্তিক বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ধর্ম ও ঈশ্বর চিন্তাকে অনেক সতর্ক ও সযতনে প্রবেশ করেছিলেন তার সৃষ্টিকর্মে অনেক মিরাকল ঘটনার উদ্ভব তিনি দেখিয়েছেন। তার লেখনিতে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি অতি সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। নিম্নবর্ণের মানুষগুলোর কথা তিনি লিখেছেন কখনওবা প্রতিবাদী ভঙ্গিতে।
হুমায়ূন আহমেদ ম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। যা এ স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। আসলে স্রষ্টার মৃত্যু নেই। হুমায়ূন আহমেদ অনেক চরিত্রের স্রষ্টা। সে তাঁর চরিত্রের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। শেকস্পিয়র তাঁর ট্রাজিক চরিত্র হ্যামলেটের মহৎ মৃত্যুতে তাঁর বন্ধু হোরেশিওর মুখ দিয়ে বলেছেন“Now cracks a noble heart .The flight of angel will sing thee” হুমায়ূন জানতেন তিনি মেঘের উপর বাড়ি তৈরি করেছেন। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন হিমু কিংবা মিসিল আলী হয়ে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১১৪০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৭/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast