www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সখী - ভালোবাসা কারে কয়

______________
সেই আলখাল্লা বুড়ো, যার কাছে ফিরে ফিরেই যেতে হয়, জীবনের প্রয়োজনে, মনের তাগিদে, হৃদয়ের যাতনায়, সঙ্কটের তাড়নায়, প্রকৃতির ভাব আলাপনে । সেই অনাদি বুড়োর কাছে মননশীল, সাহিত্যমনস্ক, সাধারণ, অসাধারণ সবারই ছুটে ছুটে বারে বারে যেতেই হয়, শান্তির জন্যে, আত্মার তৃপ্তির জন্যে, বেদনার উপশমের জন্যে, আত্মমগ্নতার প্রহেলিকায় নিমজ্জিত হবার জন্যে । না গিয়ে যে উপায় নেই । বুড়ো যে অন্তরে অন্তরে কত বিশাল প্রেমিক ছিলেন, কত বড় সাধক ছিলেন, কত মহৎ আত্মার অধিকারী ছিলেন, তা’ তাঁর কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে, উপন্যাসে নানা ভাবে, নানা ব্যঞ্জনায় আমাদের জানিয়ে গেছেন । আমরা যারা সেই অমৃতরস গ্রহণ করার সমূহ সুযোগ পেয়েও নেবার অবহেলায় নিজেকে বঞ্চিত করে চলেছি, সে যে কত বড় দূর্ভাগ্যের বিষয়, তা’ কি আমরা আদৌ বুঝি !
বুড়োর হাজার হাজার গানের মধ্যে এই একটি গান যে কত লক্ষবার আলোচিত হয়েছে, গীত হয়েছে, নানা আলাপে ব্যবহৃত হয়েছে তার কোন সীমা পরিসীমা নেই । হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আমি সেই গানটির কথাই বলছি, যে গানে বুড়ো ভালোবাসাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ভালোবাসার এক অনন্য রূপ এঁকেছেন –---; সখী ভালোবাসা কারে কয় !
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয় ! সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল ? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত ।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোক সাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী,আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা ।।
তাইতো- ভালোবাসা কারে কয় ! সেকি শুধু চোখের জল, দুখের আশ ?
একদিন সুখের হাসিতেই শুধু ভরে থাকাই কি সেই ভালোবাসা ! কি জানি ! কেউ ভালোবাসা জীবনে সহজে পেয়েও তার নাগাল পায় না, তার রূপের দেখাই পায় না, তার মোহন স্নিগ্ধতার পরশটুকু জীবনজুড়েই পায় না । আবার কেউ সারাটিজীবন ভালোবাসার জন্যে আকুল হয়ে কেঁদে মরেও, ব্যাকুল হৃদয়ে হা-হুতাশ করেও এক কণা ভালোবাসারই সন্ধান পায় না ।
কেউ ভালোবাসার সন্ধান পেয়েও আবার জীবনের টানাপোড়েনের আকিঞ্চনে বিষাদের স্বাদেই জীবনভরে নিয়ে যাতনার দুঃসহ জীবনযাপন করে যায়, আবার কেউ দু’চোখের মুহুর্তের ভালোলাগাকেই ভালোবাসা ভ্রমে অখাত সলিলে হাবুডুবু খেয়ে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ভাবের দহনে আকুলিবিকুলি করে ।
ভালোবাসাও কত প্রকারের, কত সম্পর্কের বিভিন্নতায় কত স্বরূপের রঙে রঞ্জিত তারও কি সীমা পরিসীমা আছে !
মায়ের সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা বা মমতা তা শ্রেষ্টতম এই ধরার বুকে, তেমনই শ্রেষ্টতম ভালোবাসা পরমেশ্বরের জন্যে যে আকুল হৃদয়ের ভালোবাসা । আর সব ভালোবাসাই নানা রকমের, নানা সম্পর্কের, স্বার্থের, আদানপ্রদানের, কতভাবেই চিহ্নিত ! আলখাল্লা বুড়ো তাঁর একটি প্রবন্ধেও চণ্ডিদাসের প্রেম নিয়ে যে কথা বলেছেন, তার কিছু অংশ নীচে তুলে দিলামঃ
“চণ্ডিদাসের প্রেম কি বিশুদ্ধ প্রেম ছিল। তিনি প্রেম ও উপভোগ উভয়কে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে পারিয়াছেন। তাই তিনি প্রণয়িনীর রূপ সম্বন্ধে কহিয়াছেন, “কামগন্ধ নাহি তায়! “ আর এক স্থলে চণ্ডিদাস কহিয়াছেন–
রজনী দিবসে হব পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা–
একত্র থাকিব নাহি পরশিব
ভাবিনী ভাবের দেহা।
দিবস রজনী পরবশে থাকিব, অথচ প্রেমকে স্বপ্নের মধ্যে রাখিয়া দিব। একত্রে থাকিব অথচ তাহার দেহ স্পর্শ করিব না। অর্থাৎ , এ প্রেম বাহ্য জগতের দর্শন-স্পর্শনের প্রেম নহে, ইহা স্বপ্নের ধন, স্বপ্নের মধ্যে আবৃত থাকে, জাগ্রত জগতের সহিত ইহার সম্পর্ক নাই। ইহা শুদ্ধমাত্র প্রেম, আর কিছুই নহে। যেকালে চণ্ডিদাস ইহা লিখিয়াছিলেন, ইহা সেকালের কথা নয়। কঠোর ব্রতসাধনা-স্বরূপে প্রেমসাধনা করা চণ্ডীদাসের ভাব, সে ভাব তাঁহার সময়কার লোকের মনোভাব নহে, সে ভাব এখনকার সময়ের ভাবও নহে– সে ভাবের কাল ভবিষ্যতে আসিবে। যখন প্রেমের জগৎ হইবে, যখন প্রেম বিতরণ করাই জীবনের একমাত্র ব্রত হইবে– পূর্বে যেমন যে যত বলিষ্ঠ ছিল সে ততই গণ্য হইত, তেমনি এমন সময় যখন আসিবে, যখন যে যত প্রেমিক হইবে সে ততই আদর্শস্থল হইবে– যাহার হৃদয়ে অধিক স্থান থাকিবে, যে যত অধিক লোককে হৃদয়ে প্রেমের প্রজা করিয়া রাখিতে পারিবে সে ততই ধনী বলিয়া খ্যাত হইবে– যখন হৃদয়ের দ্বার দিবারাত্রি উদঘাটিত থাকিবে ও কোনো অতিথি রুদ্ধ দ্বারে আঘাত করিয়া বিফলমনোরথ হইয়া ফিরিয়া না যাইবে– তখন কবিরা গাইবেন–
পিরীতিনগরে বসতি করিব,
পিরীতে বাঁধিব ঘর।
পিরীতি দেখিয়া পড়শি করিব,
তা বিনু সকলি পর।“
ভালোবাসার এই অপরূপ ভুবনেই আবার হিংসার, বিদ্বেষের, শত্রুতা্র ও কি কিছু কম আছে ! তবুও এই পৃথিবীতে শুধু মমতার মোহে, ভালোবাসার আশ্বাসে, প্রেমের টানে মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে, দেখে ভালোবাসার শত রঙের মোহনীয় বাহার । সেই বাহারই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আশায় আশায় ।
তবু জানতে ইচ্ছে করে, কেমন সেই ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় মানুষ নিজের মা, বাবা, ভাই বোনকেও দূরে ঠেলে কী অদৃশ্য মোহের টানে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় কোন অনিশ্চিতের পানে । কোন ভয় বা শঙ্কাই যেন বাঁধ মানে না । তেমন যে ভালোবাসা, তা’ হিসেব কষে, গাণিতিক সূতের ধারায় ফেলে বিচার করে হয় না। সে যেন বাঁধভাঙা উত্তাল নদীর জোয়ার । সকল কিছুকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় অবলীলায় ।
তেমনই এক ভালোবাসার ঘোরে দিন কাটছে আমার সহকর্মী, বন্ধু মার্ক এর । বয়সে সে আমার চেয়ে চৌদ্দপনের বছরের ছোট । কিন্তু সে স্বভাবে এমনিতেই একটু পাগল গোছের । খুব বড় একটি মন তার চিলতে শরীরের মধ্যে চুপটি করে লুকিয়ে আছে । সে যে কত বড় মন তার হদিস যে না পেয়েছে তা বোঝার ক্ষমতা তার কখনো হবে না । তার ঠাকুর দা’ এসেছিলো আয়ারল্যান্ড থেকে, আর ঠাকুর মা’ জার্মানের ।
এক মধুর দম্পতি ছিলেন ওঁরা । ঠাকুরদা’র মৃত্যুর দিনই বিকেলে ঠাকুর মা’ ও চলে যান । এমনই তাঁদের প্রাণের টান ছিলো । মার্ক বড় হয়েছে তার ঠাকুর মা, ও ঠাকুর দা’র কাছেই । সে মা হারিয়েছে জন্মের পরপরই, বাবাকে হারিয়েছে, যখন সে মাত্র তিন বছরের শিশু - ভিয়েতনামের যুদ্ধে ।
মার্কের পিতামহ ও পিতামহী এমনভাবে মার্কের জীবনজুড়ে ভালোবাসার তুমুল ঐশ্বর্য্য ভরে দিয়েছেন বলেই না তার হৃদয়টা এমন বড় – ওই একটুকুনি শরীরে । অমন মার্কের হঠাৎ প্রেম হয়েছে তার তেতাল্লিশ বছর বয়সে এসে । এ যেন দুকূল ভাঙা নদীর জোয়ারের মতো প্রেম, ওর প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে শ্রোতারও যেন মনে হয় আহা – এমন একখানা প্রেম এই জীবনে যে আর হলোই না । হবার বয়স ও যে আর নেই ! সেই মার্ক বিগত তিনদিন কাজে আসে নি, অসুস্থ বলে ছুটি নিয়েছে । খবর নিয়ে জানলাম, সে হাসপাতালে । খোঁজখবর নিয়ে ছুটে গেলাম ওর কাছে হাসপাতালে ।
ওয়ার্ডে গিয়েই আমার তো ভিরমি খাবার যোগাড় । একটি রুমে মার্ক শুয়ে আছে, তার একই রুমে পাশের রোগী একজন মহিলা । যা’ সাধারণতঃ হাসপাতালে দেখাই যায় না । নারী পুরুষের আলাদা ওয়ার্ডই তো থাকে । এই ওয়ার্ডের নার্স ভারতের উত্তর কেরালার- মেরী জানালে, ওই মহিলা মার্কের গার্লফ্রেণ্ড । মহিলা অন্ধ, আর মার্ক তার একটি চোখ গতকাল তার গার্লফ্রেণ্ডকে দান করেছে । আমার তো আক্কেলগুড়ুম হবার অবস্থা । মার্কতো এতো গল্পের মধ্যে একবারও বলে নি যে, তার ভালোবাসার রমণীটি অন্ধ !
আমার হাতে ছিলো একটি ফুলের তোড়া, আস্তে আস্তে গিয়ে চোখ মুদে থাকা মার্কের কাছে গিয়ে ডাকলাম – মার্ক ! সে চোখ খুলে তাকালো আমার দিকে, তার মুখ ভরে গেলো এক অপরূপ স্বর্গীয় হাসিতে । আমি বললাম , কেমন আছিস রে পাগলা ! সে কিছু না বলে আমাকে ইশারা করে তার ভালোবাসার রমণীটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওই যে শুয়ে আছে ক্যাথেরীনা – তোমাকে ওর কথা যে আমি সারাক্ষনই বলি । আমি বললাম, মার্ক, আমি জানি – আমি আগেই জেনে নিয়েছি । কিন্তু তুই তো কখনো আমাকে বলিস নি যে, সে অন্ধ ছিলো । মার্ক হেসে বললো, সে অন্ধ ছিলো – এখন কিন্তু সে আর অন্ধ নয় । ডাক্তার বলেছে, তিনদিন পর ওর চোখের বাঁধন কাটলেই সে দেখতে পাবে, সে দেখতে পাবে আমাকে, এই পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য - আমারই চোখ দিয়ে ! কি মজা তাই না !
আমি বিমুঢ় বাকরহিত হয়ে একবার মার্ক ও একবার ক্যাথেরীনার দিকে তাকাচ্ছি । আমার দুচোখ ভরে এলো এক ঝলক অশ্রুজলে । আমার সারা শরীর জুড়ে এক অকল্পনীয় শিহরণ – সে কি আনন্দের, সে কি অচেনা অদেখা অভূতপূর্ব্ব প্রেমের হঠাৎ দেখার শিহরণ ! আমি জানি না । শুধু মনে মনে প্রার্থনার মতো করে বলি – হে ইশ্বর, ওদের প্রেম যেন সফল হয়, ওরা যেন খুউব সুখী হয় জীবনে । আমার কানে অলক্ষ্যে অনবরত বাজতে থাকে আলখাল্লা বুড়োর সেই চিরজীবি অমৃতসঙ্গীত -- সখী, ভালোবাসা কারে কয় !!

https://youtu.be/0CnN7PSAGGQ
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২১৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০৬/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • তাবেরী ১২/০৩/২০১৭
    খুবই সুন্দর
  • সাইদুর রহমান ১৪/০৬/২০১৫
    খুব সুন্দর গল্পটি।
  • রেনেসাঁ সাহা ১০/০৬/২০১৫
    অসাধারণ গল্প। বাঁশির সুরে যেন সারা গল্প জুড়ে মিষ্টি শিহরণ রেখে যাচ্ছে ভালবাসা, যতবার পড়েছি, স্নিগ্ধমধুর এই গল্পে হৃদয় ডুবে যাচ্ছে।

    ভালো থাকুন। ভালো থাকুন এবং এমনি অসাধারণ সব গল্প লিখুন।
  • T s J ০৮/০৬/২০১৫
    মানুষের জীবনে কত কি ঘটে তার মাঝে গল্প টি মিলে গেলে, অতীতে যাব বার বার ফিরে।. গল্প টি ভাল লাগল
  • মোবারক হোসেন ০৮/০৬/২০১৫
    আমরা বাস্তবতার নিরিখে র্কম ব্যস্ত হয়ে পড়ি জিবন
    চালাতে।কিন্তু যখন র্কম বিরতিতে অবসর পাই তখন
    ফিরে যাই অতীতে । আর অতীত প্রান ফিরে পায় স্বপ্ন
    আর ভালবাসাকে ঘিরে।আমরা বাঙ্গালী সব কিছু ছেড়ে
    গেলেও প্রকৃতি আর ভালবাসা সব সময় আমাদের পাশেই থাকে। ঠিক শিশির বিন্দুর মত।এই গল্পেও ভালবাসার জয়গান করা হয়েছে। ধন্যবাদ।
  • গল্প টা ভালো লাগলো !!
  • অগ্নিপক্ষ ০৬/০৬/২০১৫
    দিল্লী কা লাড্ড-উ-উ-উ-উ-উ!!!!!
 
Quantcast