www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সুপ্রিয়র প্রিয় কিছু

জল কাব্যের উর্বশী

এক
সকাল থেকেই জলের গা বেশ গরম | জ্বরটা অবশ্য রাতেই এসেছিলো, ঘুমের ঘোরে অস্বস্তিটা আমলে নেয়নি । কাব্য একবার ভাবলো – জলের কপালটা ছুঁয়ে দেখবে । ছোঁবে কি ছোঁবে না ,এই দ্বিধাদন্দেই কেটে গেল অনেকটা সময় | আরেকবার ভাবলো জলের মাথাটা ধুয়ে দেবে , কিন্তু কিছুই করা হচ্ছে না ! কেমন একটা আড়ষ্টতা ঘিরে আছে কাব্যেকে | এদিকে উর্বশী এসে গেলে আর কিছুই করা হবে বা | উর্বশী জলের বিবাহিতা স্ত্রী |
কাব্য জলের রুমে পায়চারি করছে। আজ পর্যন্ত্য জলকে একবারও বাবা বলে ডাকা হয়নি | ইচ্ছে করলেও ডাকটা মুখে আসে না | কাব্যের কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব স্বার্থপর ও লোভী মনে হয়ছে। বাবার মৃত্যুর পর মা একটু ভালো থাকার জন্যে হুট্ করে আরেকটা বিয়ে করে ফেললো ! বিয়েটাই কি সব ?
কাব্য জলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো | মৃদু কাশি দিয়ে বললো- আমি কি আপনার কপালটা ছুঁয়ে দেখতে পারি !

জল আলতো করে তাকালো | নিজের সন্তান হয়নি এখনো , কাব্যকে সে নিজের মেয়েই ভাবে | কিন্তু কাব্যের দিক থেকে এই ভালোবাসার কোন রেসপন্স সে পায়নি। ।
জল মৃদু হেসে উত্তর দিলো- একদিন ছুঁয়ে দিলেই কি ভালোবাসার মায়া পড়বে !
দ্বিধান্বিত কাব্য উত্তর দিলো - জানিনা , কপাল ছুঁয়ে দেয়ার সাথে ভালোবাসার কথা আসছে কেন ?
- কোনো মায়া না থাকলে কপাল ছোঁয়ার কথাই বা আসবে কেন ? অসুস্থ রোগী ভেবে !
- ঠিক তা নয় , মা বলে গিয়েছে খেয়াল রাখতে | আমার মনে হচ্ছে আপনার অনেক জ্বর | মাথাটা ধুয়ে দেই ?
- মায়ের ভালোবাসাকে মূল্য দিতে গিয়ে কিছুটা আবেগ আমার জন্যে খরচ করছো !
- জানিনা , একজন মানুষ কষ্ট পাচ্ছে আর আমি চুপচাপ বসে বসে দেখবো ! এটা কি হয় ?
- মাথার চুলগুলিতে একটু বিলি কেটে দেবে মা !
- হ্যাঁ |
জলের মাথার ঘন কালো চুলগুলুতে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে কাব্যের মুখ থেকে অস্ফুটে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এল- এতো জ্বর নিয়ে কেউ চুপচাপ বসে থাকে ! আশ্চর্য্য !!

দুই

লিভিং রুমের পাশেই ছোট্ট একটা ড্ৰাই কিচেন রেখেছে উর্বশী | এক কর্নারে রাখা আছে কফি মেশিন আর জুসার | অরিজিনাল কফি সীড ভেঙে গরম জল দিয়ে কফি খুব পছন্দ জলের | মিনি একটা সুগার প্যাকেট দিলে ব্ল্যাক কফির রিয়েল টেস্টটা পাওয়া যায় | সাথে কুপার্সের ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রি হলে তো আর কথাই নেই | কফি মেশিনে ইথিওপিয়ার গোল্ড ব্লেনডেড সীড ভাঙছিল উর্বশী | বর্ষার পড়ন্ত বিকেলে এক মগ কফি হলে মন্দ হয় না | এমন সময় রুমে ঢুকলো জল |
- উর্বশী, আমার জন্য কি এক মগ হবে !
- অবশ্যই , তুমি বারান্দায় গিয়ে বস, আমি নিয়ে আসছি |
- থ্যাংক ইউ মেরে ইয়ার !
- ওয়েলকাম মিস্টার ওয়াটার !
- এই,...তোমাকে না কতবার বলেছি , আমাকে মিস্টার ওয়াটার বলে ডাকবে না ||
- সরি মিস্টার ওয়াটার, নো ফারদার মিস্টেক !
- আবার ?
- মাই এপোলোজিএস মিস্টার ওয়াটার !
জল বারান্দায় গিয়ে বসলো | একটা টুইন ট্রেতে করে দু'মগ কফি আর দু'পিস্ পেস্ট্রি নিয়ে বারান্দায় লনে ঢুকলো উর্বশী | সদ্য জ্বর থেকে ওঠা কাব্যর মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া লাগছে ।
- আচ্ছা উর্বশী, তোমাকে না বলেছিলাম দু'দিনের ছুটি নিতে ! অরিন্দম তোমাকে কিছু বলেনি | ওকে না আমি বলে দিয়েছিলাম |
- শোনো জল, আমি ইচ্ছে করে না করেছি ,
-কেন ?
- অরিন্দমের নতুন বেবি হয়েছে ! ও অনেক করে বলেছে , বৌদিমনি , তুমি কটাদিন বাদে ছুটি নিলে কোনো প্রব্লেম হবে ? জলদাকে যদি একটু বুঝিয়ে বলতে !
- এটা কোনো কথা ?
- থাক জল, ডোন্ট বি এক্সসাইটেড ! জানো, বাবা হবার পর অরিন্দমের সে কি খুশি ? সে কি আনন্দ ! তাছাড়া তুমিও মাত্র জ্বর থেকে উঠলে।
- আবার মায়ায় পড়ে গেলে !
- জল, তোমার বাবা হতে ইচ্ছে করে না !
- না !
-কেন ?
- কাব্যর ভালোবাসাকে ভাগ করতে চাচ্ছি না | আর এই বয়সে বেবী নিলে লোকজন কি ভাববে ?
- তাই বলে তুমি বাবা হবে না ?
- কাব্যকে এভাবে ভাগ করার কোনো মানে হয়না উর্বশী ! ও খুব ইনোসেন্ট |
- কাব্য যে তোমাকে বাবা বলে ডাকে না, তোমার মন খারাপ হয় না ! জানো, ওকে কতবার বলেছিও ।কোনো উত্তর দেয় না ! এ বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বাড়ানোটাও ঝামেলার।
- প্লিজ উর্বশী, ওকে কখনো মেন্টাল টর্চার করবে না ! বাবা ডাকটাই কি সব ?
- তুমি তো কেবল দিয়েই যাচ্ছ ? আমি কি কিছুই দেব না ?
- এই যে ভালোবাসা দিচ্ছ , গরম কফি দিচ্ছ , যখন যা খেতে চাইছি খাওয়াচ্ছ, আর কি !
- একরকম বিনিময়ের ভালোবাসাকে কেমন করুনা আর আশ্রয় মনে হয় জল !
- ভালোবাসার জন্যে মানুষ ঘর বাঁধে, করুনা ,আশ্রয় এসবের জন্যে মন্দির ।তুমি আমাকে মন্দিরের দেবতা বানিয়ে দিচ্ছ উর্বশী ! ! এভাবে সব দেখছো কেন ?
- জল, দিনকে দিন তুমি আমাকে ঋণী করে ফেলছো ! কাব্যর উপর কোনো রাগ রেখো না প্লিজ !
- উর্বশী, বেশী বেশী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ! কফিটা শেষ করে চলো , একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি !
ক'দিনের জ্বরে তো অনেকদিন ঢাকার আকাশ দেখা হয়নি !
অনেকক্ষন চুপ করে বসে ছিল উর্বশী | বাকরুদ্ধ নিজেকে সামলে নিলো | জল ওর মাথার মধ্যে দু'টা চাটি মেরে দাঁড়ালো ...এই উর্বশী উঠো !
সন্ধ্যামালতি ফুলের সুবাসে চারদিক যতটা না মধুময় হয়ে উঠেছে , তার চেয়ে বেশী সুবাস ছড়িয়েছে জলের এই কথাগুলো ! উর্বশী ভাবছে আর হাটছে , একটা মানুষ এতটা ভালো কি করে হয় ! কিছু সেক্রিফাইসের সত্যিই কোনো প্রতিদান থাকে না |

তিন
ক'দিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে | এখন বৃষ্টিটা আর ভাললাগার মধ্যে নেই | মহাবিরক্ত কাব্য | এভাবে কলেজে অনুপস্থিত থাকাটা মোটেও ভালো লাগছে না ওর | রাস্তাঘাটের বেহাল দশা | গাড়ি নিয়ে বেরুলে যেখানে সেখানে আটকে যাবার ভয় | ড্রাইভার রশীদ মিয়া ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে, কবে আসবে বলে যায়নি | বাড়িতে নাকি পানি উঠেছে , পানি নামলে তবেই ফিরবে | বিষয়টা সেনসেটিভ ,তাই মেজাজ গরম করেও লাভ নেই । আইফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো কেউ মেসেজ দিয়েছে কী না ! না, ওখানে কিছু নেই | এমনকি হোয়াটস্যাপ-এও কোনো কল নেই ! সবাই কী বৃষ্টির মতো স্যাঁতস্যঁতে হয়ে গেলো ? কুশলকে একটা ফোন করলে কেমন হয় ! কাব্যর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বলতে ওই একজনই |
- কুশল,কী করছিসরে ?
- আমি ?
- ফোনটা কাকে দিয়েছি ?
-বৃষ্টির ফোটা গুনছি, এক হাজার চারশ পঁয়ত্রিশ........
- এই ফাজলামো বন্ধ কর , বল কী করছিস ?
- সত্যি বললাম, বৃষ্টির ফোটা গুনছি | পাঁচ হাজার হলেই তোকে কড়াইগোস্তে ইলিশ খিচুড়ি খাওয়াবো |
- এই ফাজিল, আমি ফোন রাখলাম |
- হ্যাঁ, রাখ, পরে কথা হবে |
টানা বৃষ্টি নিয়ে এমনিতেই মেজাজ চড়া ছিল কাব্যর , তার উপর আবার কুশলের এ'ধরণের ইয়ার্কি গরম তাওয়ায় ঘি ঢেলে দেবার অবস্থা ! কী করে সময়টা কাটানো যায় কিছুক্ষন ভাবলো । ইউটিউবে মিস্টার সুইসাইডশিপ চ্যানেলে মৌনিকার কাট মাই হেয়ার গানটা শুনলে কেমন হয় ! মন্দ না | এমন সময় মায়ের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল | উর্বশীর রুম থেকেই কাব্যের রুমের এন্ট্রেন্সটা দেখা যায় | বলতে গেলে একরকম চোখে চোখেই থাকে কাব্য |

- আমাকে ডেকেছো মামনি |
- তাড়া আছে বুড়ি ?
- না, বলো |
- আমের আচার খাবে ! আচার খেতে খেতে কথা বলি |
- দাও, সিরিয়াস কোনো কথা ?
- আরে না, কতদিন হয় তোর সাথে মন খুলে প্রাণ খুলে গল্প করা হয় না ! কী ব্যস্ততায় গেলো ক'টা দিন |
- সত্যি তাই, সুন্দর সুন্দর দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে , তাই না মামনি !
- ইচ্ছে করলেই এই সুন্দর সময়গুলো আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে পারি । পারি না বুড়ি ?
- হ্যাঁ , তুমি পারবে মামনি | ইউ হ্যাভ দ্যাট পাওয়ার |
- আমার প্রতি তোমার অভিমান বা রাগ কী এখনো কমেনি ?
- মাম্মি, আচারটাতে মনে হয় লবন বেশি হয়েছে ।
- উত্তর দিলে না যে !
- আমি তো সব মেনেই নিয়েছি । আবার এসব কথা কেন?
- মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া এক কথা নয় কাব্য !
- মাম্মি, তুমি আমার কাছে সমুদ্র, আমার পৃথিবী, আমি তোমার আকাশ ! তোমার সাথে দূরত্বে থাকার প্রশ্নই আসে না !
- সেই পৃথিবীর একটা অংশ জল , জলের সাথে দূরত্বটা কি একটুও কমানো যায় না ? সমুদ্রের পূর্ণতাও তো জল দিয়েই কাব্য !
- ওহ মাই গড! মাম্মি, ভুলেই গিয়েছিলাম আমার একটা জরুরি এসাইনমেন্ট আছে । এখন যাই ! মেনি মেনি থাঙ্কস মাম্মি ফর ডিলিসিয়াস আচার ! এই নাও একটা আচারিচুমু |
কাব্যের এই অকস্মাৎ চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে উর্বশী | কিভাবে কেমন করে এই দূরত্ব কমানো যায়, তাই নিয়ে অনেক ভেবেছে , কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না ! এভাবেই কী চলবে তাহলে ? কোনো উত্তর মেলে না| নিজেকে খুব সংকীর্ণ আর ছোট মনে হয় মাঝে মাঝে | শুধু নিজের নিরাপত্তা আর ভালোবাসার জন্যেই কি ও জলকে বিয়ে করেছিলো? না, সেখানে কাব্যের ভবিষ্যত ভাবনাও অনেকটা জুড়ে ছিলো। অথচ সেই কাব্যই আজ ভাল নেই। জলের সাথে কাব্যর দুরত্ব অনেক চেষ্টাতেও কমাতে পারছে না। নাহ , একটা কিছু করতে হবে উর্বশীকে | কাব্যের মুখে হাসির জন্যে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত সে | প্রয়োজনে জলের সাথে বসবে | |

চার
আর ক'দিন পরেই দুর্গোৎসব |
পূজার কেনাকাটা হয়নি এখনো | কাকে কি দেওয়া যায় সেটা নিয়ে বসেছে উর্বশী | ছোট্ট একটা ডাইরিতে টুকে নিচ্ছে সব | গত দু'বছর জলদের বাড়ীর সকলের জন্য কেনাকাটা করে পাঠানো হয়, কিন্তু দু'দিন বাদে সেগুলো আবার ফেরত দেয়া হয়। এ'নিয়ে উর্বশী যতটা না কষ্ট পায় , তার চেয়ে বেশী কষ্ট অনুভব করে জলের জন্য | এই বিয়ের কারণেই জলের সাথে ওর পরিবারের দূরত্বটা তৈরী হয়েছে | উর্বশীর মন খারাপ দেখে জল একবার বলেছিলো-
-উর্বশী, মন খারাপ করার কিছু নেই | অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে সবাই অবাক হয়, শকড হয়, এটাই স্বাভাবিক | বাট, সময়ই এটাকে ঠিক করে দেয় |
- গত দু'বছর হয়ে গেলো জল, তোমার সাথে কেউ মন খুলে কথা বলে না; তোমাকে কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে না ; আমি যদি যাই, এই ভয়ে !
- তাতে কী হয়েছে ! এটা কোনো বিষয় নয় ! একটা মানুষ চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করলে তাকে কী সবাইকে জানিয়ে , সবার অনুমতি নিয়ে বিয়ে করতে হবে ? এটা কী ধরণের সামাজিক দায়বদ্ধতা ?
সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার অসম্ভব কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে জলের , উর্বশীর তা নেই | জলের জন্য মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় উর্বশীর | ইচ্ছে করে, ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষন কাঁদতে !
কেনাকাটার লিস্টে এবারও জলদের পরিবারের সবার নাম দেখে জল কিছুটা বিরক্ত।
- আবার ও কিছু টাকা নষ্ট করা হচ্ছে উর্বশী !
- জল, তুমি বাড়ীর বড় ছেলে ; তোমার দায়িত্ব এটা | কে নিলো, কে নিলো না ; কেন ফিরিয়ে দিলো সেটা দেখার বিষয় নয় !
- ভালোবাসাকে যারা মূল্যায়ন করতে পারে না, অনুধাবন করতে জানে না তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনেরও কিছু নেই উর্বশী |
- সবাই সব কিছু বুঝতে পারে না জল | এ'রাগ অভিমান একদিন থাকবে না | যাও, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আজকেই কেনাকাটা শেষ করে ফেলবো |
- লিটেল প্রিন্সেস যাবেন না !
- বলে দেখো , যায় কী না !
- ওরে বাবা ...তুমি বলো ! আমি ভয় পাই |
মন ভালো থাকলে জল উর্বশীকে প্রিন্সেস আর কাব্যকে লিটল প্রিন্সেস বলে ডাকে | এ'ধরণের ডাক শুনে উর্বশীর চোখ বেয়ে জল আসে | এতো সুখ সে কখনই প্রত্যাশা করেনি ঈশ্বরের কাছে ! কী এমন পুন্য কর্মের ফলে ভগবান তাকে এই দেবতা উপহার দিয়েছে , মাঝে মাঝে যখনই এই মধুর সময়গুলো আসে, উর্বশী ভাবে আর অবাক হয় !
এবারের দূর্গাপূজায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মা দুর্গাকে একটা লাল বেনারসি শাড়ি প্রণামী দেবে ভাবছে , সাথে এক জোড়া শাখা আর এক কৌটা মহাশিব সিঁদুর | মা দুর্গার জন্য শাড়ি কেনা দিয়েই শুরু হবে এ বছরের কেনাকাটা| তারপর জলের জন্য মান্যভরের ধুতি আর নকশা করা পাঞ্জাবি ; কাব্যর জন্য ওর পছন্দের ব্রান্ড থেকে নিতে হবে। লিস্টটা ভাঁজ করে শপিংয়ের জন্য তৈরী হতে গেলো উর্বশী |

রাত্র প্রায় এগারোটা | খাটে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো জল | উর্বশী খাটে বসে শপিং প্যাকেটগুলোতে নাম লিখছে আর প্রাইস ট্যাগগুলো খুলছে | কাজের ফাঁকেই আড়চোখে জলের দিকে তাকায় উর্বশী । একটু ভয় ভয় নিয়ে বললো-
- একটা কথা বলবো জল !
- জ্বি ম্যাডাম বলেন !
- ফাজলামো করবে না | যা বলবো সরাসরি উত্তর দিবে !
- আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই !
- আহা, তোমাকে টাকার কথা কে বললো ?
- না, দুর্বল জায়গাটা আগেই শক্ত করে নিলাম |
- কথাটা কী বলবো ?
- আজ্ঞে প্রিন্সেস বলেন !
- ধরো জল, আমি রোড একসিডেন্টে মারা গেলাম কিংবা কিডন্যাপাররা আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেললো , তুমি কী আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে !!
- তোমার কী কাজ শেষ হয়েছে ? লাইটটা অফ করে ঘুমাও , আমার খুব ঘুম পাচ্ছে |
হাতের কাজ শেষ করে বিছানায় এসে বসলো উর্বশী |
- বলো না জল, তুমি কী করবে ?
- উর্বশী , তুমি জানি - এসব ফালতু কথা আমি একদম পছন্দ করিনা | কেন শুধু শুধু এসব বলছো ?
- আচ্ছা ধরো , আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গেলাম বহুদূরে কাব্যকে নিয়ে ! তুমি একা একা থাকতে পারবে ?
- উর্বশী , এ'সব মস্করা আমার একদম পছন্দ না ! তুমি কী ঘুমাবে না আমি বারান্দায় গিয়ে বসে থাকবো ?

এরপর চাইলেও আর কথা এগোনো যায় না। এও তো দিনের আলোর মতই সত্যি যে উর্বশীকে বি য়ে করার কারণেই আত্মীয় স্বজন , বাবা-মা সবার কাছে জলকে হেয় হতে হয়েছে | উর্বশী আর কাব্য ছাড়া জলের আর কোন স্বজন নেই | আর আছে একটা সফটওয়্যার ফার্ম | এটুকুই এখন জলের জগৎ | এটাকে আর কোনোভাবেই ছোট করা যায় না | একদিন কাব্য আর জলের জন্যে সবাইকে ছেড়ে এসেছে জল। আজ নিজেদের স্বার্থে জলকে ছেড়ে যাবার কথা কেমন করে ভাবল সে – নিজকেই ধিক্কার দিল বারবার। ছিঃ ছিঃ ! এত হীন ভাবনা তার মাথায় এলো কি করে? বিছানায় শুয়ে কান্নায় বালিশ ভেজাল উর্বশী | জল ঘুমিয়ে গেছে | বুকের উপর থেকে বইটা সরিয়ে জলের চুলে কিছুক্ষন বিলি কেটে দিলো পরম মমতায় | আমি সত্যিই স্বার্থপর জল। আমায় ক্ষমা করো- বিরবির করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে , টের পায়নি উর্বশী |

পাঁচ
পূজার ছুটিতে ঢাকার বাইরে যেতে চায় কাব্য | এ নিয়েই ডাইনিং টেবিলে কথা হচ্ছিলো | পাউরুটিতে জেলি মাখতে মাখতে জল বললো- “বন্ধুরা যারা যাবে, তারা সবাই কেমন ? ফ্যামিলি থেকে সবার সম্মতি কী আছে?” । “আমার বন্ধুরা সবাই ভালো “- কাব্যের সোজা উত্তর | উর্বশীর উত্তরটা বোধ হয় পছন্দ হয়নি | তাই একটু রাগ নিয়ে কাব্যর কথার সূত্রধরে বললো- “ভালো তো সবাই, খারাপ হতে কতক্ষন ?”
- এখানে তুমি খারাপটাকে টানছো কেন ?
-টানবো না ! চারদিকে কি হচ্ছে দেখতে তো পাচ্ছি।
- এত কিছু দেখো কেন ?
- কাব্য, বেশী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু !
পরিস্থিতির উত্তাপ আঁচ করতে পেরে জল ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো-
- ঠিক আছে, তুমি বন্ধুদের সাথে যাও | পিছে পিছে আমরাও যাবো ! ঘুরে এলাম সাজেক ভেলী , শুনেছি জায়গাটা সুন্দর ! কী বলো উর্বশী !
কাব্য কোনো কথার উত্তর না দিয়ে কফির গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলো | উর্বশী মেয়ের মন খারাপ হয়েছে কিনা সেটা কনফার্ম হওয়ার জন্য জলের কথার সূত্র ধরে বললো-
কী কাব্য , আমরা কী যাচ্ছি তাহলে ! নাকি তোমার বন্ধুরা মাইন্ড করবে ?
- মাইন্ড করবে না তবে হাসাহাসি করবে।
- তা করুক। মেয়েরা বড় হয়ে গেলে মা-বাবার যে কত চিন্তা , সেটা মা হলেই বুঝবে, এখন বুঝবে না !
- এই ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলো দেখে দেখে তোমার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মামনি !
- হ্যা, তাতো হয়েছেই , আবার শিখেছিও অনেক ! কী আর করা । তাছাড়া তুমি এখনো অতটি বড়ও হওনি । মায়ের মন তুমি কি করে বুঝবে।
উর্বশী চোখের জল আড়ালের চেষ্টা করে। জল পরিবেশ কিছুটা হালকা করার জন্য বলল,-
লিটল প্রিন্সেস, মায়ের সাথে এতো কড়া ভাষায় কথা বলতে নেই, উনি রেগে গেলে আমাদের মিল বন্ধ হয়ে গেলে খাবো কী ?
উর্বশী কথাটা লুফে নিলো-
জল, আমি রেগে গেলে কখনো মিল বন্ধ করেছি ?
- জাস্ট কিডিং ম্যাডাম ! তাহলে এটাই ফাইনাল হলো, লিটল প্রিন্সেস এর সাথে আমরা বুড়োবুড়ি ও যাচ্ছি !
কাব্য মাকে জড়িয়ে ধরে সরি বলে চুমু খেলো | জলের দিকে এগিয়ে গিয়েও কী একটা সংকোচে পিছিয়ে এলো ।ব্যাপারটা জল ও উর্বশী কারো চোখই এড়ায়নি। মুচকি হেসে উর্বশী বললো- মনে কষ্ট নিও না জল, আমি পুষিয়ে দেব |
- আজকেই দেবে তো !
- যাও ফাজিল !

বিকাল তিনটা | অফিসে বসে সাজেক ভেলির হোটেল কিংবা রিসোর্টের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলো জল | বাংলাদেশের পর্যটন খাতের দুরবস্থা নিয়ে সে খুবই হতাশ | ফেসবুক এবং ওয়েবসাইট ঘেঁটে কিছু ফোন নম্বর সংগ্রহ করা গেছে কিন্তু কোনো সঠিক গাইডলাইন পায়নি | চরম বিরক্ত জল ! কিছু বন্ধু বান্ধবকেও ফোন দিয়েছে | কেউ বলেছে , যতটা বাইরে থেকে শুনেছিস , আসলে তেমন কিছু না | অনেকে বলেছে, যা দোস্ত, বৌদিকে নিয়ে ঘুরে আয় ! পাহাড়ে বসে কবিতা লিখবি , চাইলে জোৎস্নায় সন্ধ্যার আকাশে তাঁরা দেখতে দেখতে বৌদির সাথে .........|
জল বুঝতে পারছে না কী করবে ? এভাবে ফ্যামিলি নিয়ে হুট্ করে রওয়ানা দেয়াটা ওয়াইজ ডিসিশন হবে না ! কাব্য এবং তার বন্ধুরাই বা কিভাবে যাবে, কোথায় গিয়ে উঠবে ? এইসব প্রশ্নও তো করা যাবে না কাব্যকে | যদি ভেবে বসে - বেশী গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে ! কী যে মুশকিল !
উর্বশীর সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলে কেমন হয় ! আইফোনের সিরিকে বললো - হাই সিরি, কল উর্বশী |
- হ্যা বলো ! ওপর থেকে উর্বশীর কণ্ঠ |
-উর্বশী , আমি তো সাজেক ভেলিতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকার মতো কোনো ভাল রিসোর্ট বা হোটেলের সন্ধান পাচ্ছি না ! কী করি বলো তো !
- তুমি অরিন্দমকে ফোন দাও ! ওর এক ভাই একটা আর্মিতে আছে ! আর্মির রেফারেন্স-এ গেলে ইজি হবে !
- গ্রেট ! গুড আইডিয়া মাই ডিয়ার | থাঙ্কস.
জল ফোনটা রাখতে যাবে এমন সময় উর্বশী বলে উঠলো -
-এই শোনো, একটা কথা বলার ছিলো।
-মাত্র একটা?
- আহা শোনই না।
-বলো
- তুমি কী সেদিন মনে কষ্ট পেয়েছো !
- আরে নাহ , এটাই তো স্বাভাবিক উর্বশী | তাছাড়া আমি তো আর ওর আসল বাপী না ! তাহলে আমাকে কেন অযথা আদর করবে ? এখনকার জেনারেশনের ছেলে-মেয়েরা খুবই স্পষ্টবাদী ও স্ট্রেট-ফরওয়ার্ড হয় ! আই লাইক ইট ! ড্রপ দিস ম্যাটার ! তুমি খেয়েছো ?
- হ্যাঁ !
- তাহলে আমি অরিন্দমের সাথে কথা বলছি |
- ঠিক আছে |
ফোন রেখে উর্বশী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো - এভাবেই কী যাবে জলের জীবনটা? কাব্য কি কখনোই ওকে বাপী বলে ডাকবে না ? উর্বশী সব মানিয়ে নিতে পারলে এই পুঁচকে মেয়েটা কেন পারবে না ? কী এতো ইগো প্রব্লেম ?

ছয়

না জা্নিয়েই অনুষ্ঠানটা করতে চায় কাব্য | মামনিকে একটা সারপ্রাইজ দেয়া আরকি । বন্ধুদের সাথে য়ে নিয়ে কথা বলছিল । কিভাবে কী করলে পুরো অনুষ্ঠানটা ইমোশনাল হবে, সে ব্যাপারে বন্ধুদের কাছ থেকে নানা প্রস্তাবও জমা হচ্ছে ।
এর মধ্যে কুশল হচ্ছে পুরো অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। যে ধরনের প্ল্যান তাতে পুলিশি ঝামেলায় পরার সম্ভাবনা আছে। যদি পুলিশি ঝামেলা হয়েই যায়,কুশলের এক মেষো লোকাল থানার ওসি। তার মাধ্যমে সামাল দেয়া যাবে।
কীভাবে মামনিকে ব্যাপারটা জানানো হবে,কে ফোন দেবে সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করছিল কাব্য। এর মধ্যে ভিতুর ডিম এক বন্ধু বলে বসলো-
কাব্য, এইসব সিনেমা করে কী আমরা অস্কার পাব ?
কুশল পাশ থেকে ধমক দিয়ে বললো-
চুপ গাধা , এটা কাব্যের অনুভবের অন্যরকম উপস্থাপন । ওর ভিতরের ভালবাসা, আবেগ,না বলা কথাটা আজ এতদিন পর প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। আয়োজনটা একটু তো আলাদা হতে হবে,নাকি?
- সেতো বুঝতে পারছি ! কিন্তু পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে আমাদের কী রিমান্ডে নেবে কুশল ?
- কাব্য কপাল চাপড়ে বললো, “ওহ গড ! পুলিশ , রিমান্ড আসছে কেনো ? যা তো, তুই বাড়ী যা !”
-না ! আজ দুপুরের মেনু কী ?
- কালো বিড়ালের মাথার মুড়িঘন্ট |

নিজেদের মধ্যে আরো কিছু কথা বার্তা ,প্লান প্রোগ্রাম ঠিক করে সবাই কাগজ টুকে নিল কার কী দায়িত্ব ! তারপর হাতে হাত রেখে শপথ করলো সবাই । এর মধ্যেই ভীতুর ডিম সেই বন্ধু বলে উ্ঠলো –
আমরা কি যুদ্ধে জয়লাভ করেছি ?
সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো ।

উর্বশীর ড্রাই কিচেনের কফি কর্নারে ছোট একটা অফিস ডেস্ক করেছে জল । যখনই অফিসের জরুরী কোন কাজ থাকে,সেখানে বসেই টুকটাক কাজ শেষ করে নেয় সে। বেশ কিছু কাজ জমে গেছে ক'দিনে । সাজেক ভ্যালীর বাজে অভিজ্ঞতায় জলের মেজাজ এখনো ফোরটি নাইন ! এতসুন্দর জায়গাগুলো অনাদরে-অবহেলায়-অপরিকল্পনায়-অযত্নে পড়ে আছে । কোনো সিস্টেম নেই ! ল্যাপটপে কী যেন টাইপ করছিল জল । এমন সময় পিছনে এসে দাঁড়াল উবশী । জলের পিঠের দিকে মুখ ঝুঁকে মাথা রেখে বললো- কী করছেন জনাব ?
-এই , কিছু অর্ডার আপডেট করে দিচ্ছি ।
-আমার সাথে এক জায়গায় যাওয়া যাবে ।
-কোথায় ?
- এইতো একটা ছোটখাট শপিংমলে ? আমি গরীব মানুষ, বড় শপিংমলে তো আর নিয়ে যেতে পারবো না ?
-তা কী জন্য ?
-শোনো জল, আমি তোমার কাছে ইন্টারভিউ দিতে পারবো না ! যাবে কী না বল ?
-আমার জন্যে শপিং-!
-না ! ভূতের জন্য ! তোমার কী জামা–কাপড়ের অভাব আছে ? শার্ট ৪২ টা, প্যান্ট ৩৩ টা ,টাই ৭১ টা, স্যুট ৮টা, ব্লেজার ৪ টা , শাল ৯ টা, জ্যাকেট ৫ টা ,
-আরে থামো, থামো ! ওহ্ মাই গড ! তুমি কি সময় পেলেই এগুলো গুনো নাকি ! তা আন্ডারপ্যান্ট কয়টা !
-কথায় কথায় ফাজলামো করবে না তো জল ! বলো, যাবে কী না ?
-ঘড়ি ধরে এক ঘন্টার জন্য ! এক ঘন্টার বেশী হলে প্রতি মিনিটের জন্যে একহাজার করে টাকা আর --!
আঙ্গুঁল দিয়ে নিজের গাল দেখলো জল !
উর্বশীও কম যায় না ? “ঠিক আছে- একটা এডভান্স দিয়ে রাখলাম”
এই বলে জলের গালে ছোট একটা চুমু বসিয়ে দিল ।
-এখন উঠে পড়ুন ! ঝটপট তৈরী হয়ে নিন !

কেন, কী জন্য শপিং করতে বেড়িয়েছে উর্বশী, কোন কিছুই শেয়ার করেনি জলের সাথে । সবার জন্যই আবার নূতন করে কেনাকাটা হলো । শপিং করা উর্বশীর কাছে ভাত খাওয়ার চেয়েও বেশী তৃপ্তির, নিজের সঞ্চয়ের চেয়েও বেশী আনন্দের । নিজের জন্য তো কেনেই, জল এবং কাব্যকে কোন পোশাকে বেশি মানাবে , সেটা নিয়েও গবেষনা করে | মাঝে মাঝে জল আর কাব্যের ছবি ওয়াশ করে সেখানে থেকে তাদের মাথা কেটে ম্যাগাজিনের মডেলদের মাথার উপর লাগিয়ে দেখে , এই পোশাকে ভাল লাগছে কী না ! চাকুরী, সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি কিছু কিছু মেয়েদের আলাদা একটা জগত থাকেই !

সাত

৩১ শে অক্টোবর । মঙ্গলবার । বিকেল ৫টা । সোফায় বসে ডেইলী স্টারে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল জল । ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজের কানের দুল লাগাতে ব্যস্ত উর্বশী । উর্বশীর দিকে তাকিয়ে জল জিঞ্জাসা করলো, “ ম্যাডাম কি রেডি?”
-এই তো ! আর দশ মিনিট ! তুমি রেডি হয়ে নাও । এমন সময় জলের মোবাইলে রিং । মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অপরিচিত নাম্বার দেখে ভাবল রিসিভ করবে না কিন্তু কী মনে করে রিসিভ করলো !
-আপনি কি শুভাগত চৌধুরী বলছেন !
-জ্বি বলছি ! আপনি কে ?
-আপনি আমাকে চিনবেন না । যা বলবো , শুধু শুনে যাবেন ! বেশী কথা বলা যাবে না !
-আপনি কোথা থেকে বলছেন ?
সোফা থেকে উঠে দাড়াঁলো জল । উর্বশী জলের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে, কোন একটা সমস্যা হয়েছে ! উর্বশীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বল্লো ! ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো- কাব্য কি ঘরে !
- না, ওতো বন্ধুদের সাথে গেছে । বলে গেলো জরুরী এসাইনমেন্ট আছে !
জল ফোনের অপর প্রান্তের লোককে বললো-
জ্বি বলেন ! কী বলতে চাইছেন !
-আপনি কোনরকম পুলিশি ঝামেলায় না গিয়ে গুলশানের “ফুড এন্ড গুড ” রেস্তোরায় চলে আসুন ।
- কেন ? আমি কেন ওখানে আসবো?
- অযথা কথা না বাড়িয়ে চলে আসুন । নইলে মেয়েকে পাবেন কেমন করে? ফোন রাখছি । রিমেমবার-মি:শুভাগত ,নো পুলিশ নো হয়রানি ! ঠিক সাতটায় ! বেস্ট অব লাক !
- ফোনটা কেটে গেলো ! ধুপ করে সোফায় বসে পড়ল জল।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন ঝরছে ! উর্বশীর দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় বললো-তুমি কাব্যকে একটা ফোন দাও তো !
-কী হয়েছে জল ? বল ! আমার কাব্য !
-কিছু হয়নি উর্বশী । ডোন্ট বি পেনিক ! আগে কল দাও ।
উর্বশী কাপা হাতে মোবাইল তুলে নিল। কাব্যর ফোন বেজে চলছে, কিন্তু ধরছে না ।
-তুমি ওর বন্ধু কুশলকে একটা ফোন দাও ।
উর্বশী কুশলকেও ফোন দিলো | কুশলের ফোন ও বেজে চলছে ।
“ওরা ফোন ধরছে না কেন ? ” –উবশীর উদ্বিগ্ন কন্ঠ ! “কি হয়েছে তুমিও তো খুলে বলছো না। আমার মেয়ের কি কিছু হয়েছে?বল। চুপ করে থেক না জল। উদ্বিগ্ন উর্বশী পাগলের মত আচরণ করছে।
-উর্বশী, প্লিজ ডোন্ট বি একসাইটেড !
- তুমি অরিন্দমকে ফোন দাও । আর গুলশান থানার ওসিকেও একটা ফোন দাও !
-পুলিশি ঝামেলা করতে ওরা বারন করেছে । আগে চল, আমরা ঐ রেস্টুরেন্টে যাই !
-আচ্ছা,ঐ রেস্টুরেন্টে একটা ফোন দেয়া যায় না?
-ঠিক আছে দিচ্ছি । তুমি কুইক রেডি হও । আমি সব দেখছি !


জল ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে ফুড এন্ড গুড রেস্টুরেন্টের নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিলো , কিন্তু কেউই ফোন ধরছে না। মহা টেনশন আর বিরক্ত নিয়ে অরিন্দমকে ফোন দিলো !
- অরিন্দম , তুমি কোথায় ?
- কেন স্যার ?
- তুমি এক্ষনি গুলশান দুই নাম্বার ফুড এন্ড গুড রেস্তোরায় এসো তো ।
- স্যার , আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে কোনো প্রব্লেম ?
- এখন কিছু বলা যাবে না ....তুমি আসো আগে ।

জল দ্রুত একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার চাপিয়ে উর্বশীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো । গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো- উর্বশী, ডোন্ট ক্রাই প্লিজ । তাহলে আমি গাড়ি চালাতে গিয়ে একসিডেন্ট করে ফেলবো । ভগবানকে ডাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে ।

- তুমি আমাকে ওই লোকের নাম্বারটা দাও, আমি একটা কল দেই !
জল মোবাইলটা এগিয়ে দিলো । উর্বশী ওই নাম্বারে কল ব্যাক করে শুনলো - দুঃখিত, কাঙ্খিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না । সরি, দি নাম্বার ইউ ডায়াল্ড ইজ কারেন্টলি আনরিচেবল !

একটার পর একটা ফোন নাম্বারে কল দিয়েই যাচ্ছে উর্বশী । হঠাৎ করেই পেয়ে গেলো কুশলকে । কুশল সব শুনেও না শোনার ভান করে চিৎকার করে বলছে -
হ্যালো , কিছু শোনা যাচ্ছে না । আপনি একটু পরে কল করুন আন্টি !
-- কুশল , হ্যালো। কাব্য কোথায় ??

লাইন কেটে দিলো কুশল। উর্বশী টেনশন , চোখ ভরা জল আর আতংক নিয়ে জলের পাশে বসে একটার পর একটা ফোন দিয়েই যাচ্ছে | জল গাড়ি চালানো অবস্থাতেই উর্বশীর একটা হাত ধরে রাখলো । জলের গাড়ি ক্রস করে দুইটা পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে গেলো । আরো টেনশন বাড়ছে উর্বশীর । আত্মীয় স্বজন কে ফোন দেয়াটা বোকামি হবে। কি হয়েছে না দেখে না বুঝে সবাইকে জড়ানো ঠিক হবে না ।পরে এটা একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে । বাঙালি আবার তিলকে তাল করতে মহা উস্তাদ । সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে আর কাব্যর চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে উর্বশীর ।ভগবানই জানেন মেয়েটা কেমন আছে। কি অবস্থায় আছে।


আট

ওয়েস্টিন হোটেলকে বাঁয়ে রেখে একটু সামনে গিয়ে ডানে মোড় দিলেই ফুড এন্ড গুড রেস্তোরাঁ । গাড়ি থেকে নেমে চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে সোজা রেস্তোরার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো জল ও উর্বশী ! ঘুটঘুটে অন্ধকার ! বাইরে কেউ নেই কেন ? আশ্চর্য !

হঠাৎ একটা লাইট জলে উঠলো ! আলো আঁধারের আবছায়ায় হেটে আসছে একটা মেয়ে ! আস্তে আস্তে
আরো দুই তিনটি লাইট জলে উঠলো -- তারপর একটা কণ্ঠ : হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বাবা ! আই লাভ ইউ !

একে একে সব বন্ধুরা এসে সামনে দাঁড়ালো ! কানে ধরে ক্ষমা চাইলো জল আর উর্বশীর কাছে ! খুশিতে আর আবেগে জলের চোখে সত্যি সত্যি জল এসে গেছে ! কাব্য হাত ধরে জলকে নিয়ে গেলো একটা সাদা পর্দা দিয়ে ঘেরা চার কোনা মঞ্চের দিকে ! একটা রিমোর্ট হাতে দিয়ে বলল, “প্লে বাটনে চাপ দাও বাবা “

জল খুশির আবেগে প্লে বাটনে চাপ দিলো । উপর থেকে পুরো পর্দাটা নিচে পড়ে গেলো !
একটা সাদা মনিটর ! সেখানে কাব্যের ষ্টীল ছবি ! আগে থেকেই ভিডিওতে ধারণ করা কাব্যের কবিতা আবৃত্তি শুরু হবে এক্ষুনি ! ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ! অপরূপ সুন্দর ! আজকের এই সুন্দর দিনটি শুধুই তার মায়ের খুশির জন্যে , বাবাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে !
কাব্যের কবিতা আবৃত্তি শুরু হয়েছে ! পিন পতন নীরবতা !

একজন বাবা
একটি মানুষ
দুটি অক্ষরে গড়া
দুই জাহানের এক বিশাল মানচিত্র !
আমি তারখেলার পুতুল।
ইচ্ছে মতন যে আমাকে সাজায়
হৃদয়ের সাতরঙা রংধনুতে !

বাবা ,
তুমি আমার মায়ের সৌন্দর্য্যসত্তা
শাঁখা সিঁদুরে
লাল সূর্য্যের উত্তাপ !
মায়ের চকচকা রঙ্গীন শাড়ী ;
হৃদয়ে খুশির সমুদ্র |

বাবা,
তুমি আমার স্বপ্নের রাজপুত্র
সেই দূরদেশ থেকে ঘোড়ায় চড়ে আসা
কল্পনার দৃশ্যপট ; আমার ইচ্ছে পুরনের
মায়াবী জাদুকর


প্রিয় বাবা
তুমি আমার সকাল , দুপুর ,
বিকেল ।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি
শীতের নকশী কাঁথা
গায়ে জড়ালেই সুখের ওম।

বাবা
তুমি ছিলে ,তুমি আছো আমার হৃদয়ের রাজপ্রাসাদে
শুধুই ভালোবাসার বাপী হয়ে
আমার আর মামনির খুশির ফোয়ারায়
আনন্দের জল হয়ে
শুভ জন্মদিন বাপী !


মুহুর্মুহ হাততালির শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলো জল ও উর্বশী । কাব্যকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো জল।এবার জলের চোখেও জল।কাব্যর বন্ধুদের চোখেও। কেউ সে জল লুকাবার চেষ্টা করছে না। অন্তত একটা সত্যি তারা অনুধাবন করেছে ; জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না।ভালোবাসা, স্নেহ, প্রেম, মায়া-মমতা , দায়িত্ববোধই তার সত্যিকারের অবস্থানকে নির্ণয় করে।তাতে রক্তের সম্পর্ক থাকুক বা নাই থাকুক।

উর্বশীর এখনকার কান্না সুখের কান্না , অনেকদিনের জমে থাকা কষ্টের সমুদ্রে সুখের উথাল পাথাল ঢেউ , এই ঢেউ অনেক আবেগের , এ আবেগ স্বর্গ সুখানুভুতির । জল উর্বশীকে পাশে টেনে নিলো । এই একটা দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো সে , কিন্তু তা যে এভাবে পাবে , স্বপ্নেও ভাবেনি জল ।ভালোবাসার ডানায় ভর দিয়ে স্বপ্নের আকাশে ভাসছে যেন জল। হা ইশ্বর! ভালোবাসার মুহূর্তগুলো এতো সুন্দর হয় !

ব্যাক স্টেজে থেকে লো ভলিউমে বেজে চলছে শাফিন আর হামিনের গান ।

আজকের আকাশে অনেক তারা ,
দিন ছিল সূর্য্যে ভরা ;
আজকের জোস্ন্যাটা আরো সুন্দর ,
সন্ধ্যাটা আগুন লাগা !
................... আজ জন্মদিন তোমার !!!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৫/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast