বলেশ্বরের বুকে ষোড়শী জ্যোৎস্না
গতবার ইউএনও সাহেব আর এসিল্যান্ড সাহেবের সাথে বলেশ্বর নদীতে মৎস সংরক্ষণ সপ্তাহের অভিযানে গিয়েছিলাম ঠিক এরকম একটা দিনে। হাস্যকর হলেও সত্যি যে সেদিন “কবি” কোঠায় আমাকে তাঁরা সে অভিযানে সফরসঙ্গী করেছিলেন। সেখানে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও মৎস কর্মকর্তা সহ সাংবাদিকবৃন্দ সফরে সঙ্গী ছিলেন। ঠিক এমন মৌশুম চলছে তখন। ইলিশ প্রজননের ভরা মৌশুম। সেদিন ছিলো লক্ষ্মী পূজোর রাত। লক্ষ্মী দেবীকে গৃহে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যাতিব্যস্ত সনাতন ধর্মালম্বী ভাইয়েরা।
আমাদের ইউএনও সাহেব কবিতাবাদী মানুষ হওয়াতে তার সাথে প্রায় সন্ধ্যাতেই মঠবাড়িয়া ইউএনও বাংলোতে কবিতা আড্ডা জমতো। গতবারের এমন সন্ধ্যায় কালী পুজোর রাতে কবিতা আড্ডার খায়েশে ফোন দিলাম তৎকালীন ইউএনও সাহেবকে। তিনি জানালেন মাছুয়া লঞ্চ ঘাটে অভিযানের টহল ট্রলার যাত্রার অপেক্ষা করছেন। সবই প্রায় রেডী, মিনিট পাঁচেকেই নদীর উদ্যেশ্যে যাত্রা করবে। সেদিন ছিলো উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত। ফোনের এপাশ থেকে আমি দাবি করে বসলাম আমিও যাবো তার সাথে। বললাম, “ভাইয়া, আমারে নিয়ে যান।” ইউএনও সাহেবের সাথে সুনিবিড় এক কাব্যিক সম্পর্ক থেকেই তাঁকে আমি শ্রদ্ধাস্বরে ভাইয়া ডাকতাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ১০/১৫ মিনিটে ঘাটে যেতে পারবো কিনা। আমি “হ্যাঁ” সূচক সম্মতি জানালাম।
বাইক নিয়ে রওনা দিলাম আমি আর প্রিন্স। সবকিছু রেডি থাকা সত্যেও আমাদের জন্য অধীর হয়ে প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করলেন ইউ এন ও সাহেব, এসিল্যান্ড সাহেব, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সহ পুলিশ প্রশাসন ও সাংবাদিকবৃন্দ।
ঘাটে যখন পৌছলাম, দেখলাম তারা সবাই অপেক্ষা ক্লান্ত, তাই আমরা বোটে ওঠার পর পরই আর কোনো ফুরসত না দিয়ে টহল বোট উন্মাতাল দরিয়ার উদ্যেশ্যে যাত্রা সূচনা করলো৷ আকাশে তেজদৃপ্ত চাঁদ, একেবারে ভরা যৌবনাবতী জ্যোৎস্না। চাঁদের আলোয়ে বলেশ্বরের টলমল জল স্পষ্ট দেখা যায়। সেটা এক অনিদ্য নৈসর্গিক পরিবেশ, ধীরে ধীরে আমরা নগ্ন নদীর বুকে প্রবেশ করছিলাম, প্রবেশ করলাম আরেক অনুভূতির গভীরে।
ইউ এন ও সাহেবের সাথে গল্প করতে করতে শুনেছি এ মৌশুমে মাছধরার নিষিদ্ধ এসব এলাকায় জলদস্যুদের গোলাগুলির প্রকোপ বেড়ে যায় । সুন্দরবনের জলদস্যুরা প্রশাসনের সাথেও গোলাগুলি বাঁধাতে দ্বিধা করেনা। একবার নাকি এমন গোলাগুলির মুখোমুখি হয়েছিলেন আগের ইউএনও ফরিদ উদ্দিন সাহেব। এটা শুনে বেশ চিন্তাও হচ্ছিলো। তবে সেই চিন্তা বেশিক্ষণ সময় ক্ষেপণ করতে দিলোনা আকাশের চন্দ্রপূর্ণ ভরা জ্যোৎস্না। আসলে কোমল-সুনিবিড় পরিবেশে জ্যোৎস্নার মাতাল সমীরণ যে কাউকেই যাপিত জীবন ভুলিয়ে দেবার ক্ষমতা ধারণ করে, সেদিন এটা বাস্তবে উপলব্ধি করলাম।
এসিল্যান্ড রিপন বিশ্বাস সাহেবকে দেখলাম কারো সাথে কোন কথা না বলে বোটের সামনের দিকটায় নীরব হয়ে বসে আছেন। লক্ষ্মী পুজোর রাত যেখানে তাঁর কাটাবার কথা পরিবারের সদস্যদের সাথে, সেখানে এই উন্মাতাল বলেশ্বরের বুকে জ্যোৎস্না আর হাওয়া খেতে হচ্ছে বলেই হয়তো মন খারাপ করে আছেন। মজাচ্ছলে বললাম, “দাদা, পূজোর নাড়ু কোথায়? এই মাতাল জ্যোৎস্নায় আপনি নাড়ু খাওয়ালে মজাই হতো। আনমনে দু’ চারটে কথা বলে তিনি আবার বোটের মাথায় আনমনা হয়ে বসে থাকলেন। বোটের সবাই মোটামুটি নিরব।
আমি প্রিন্স আর ইউএনও সাহেব কথা বলছিলাম। এভাবেই সময় যেতে লাগলো।
ঘন্টাখানেকের বেশী টহল বোট চলার পর আমরা গিয়ে থামলাম “মাঝের চর” নামক আমাদের উপজেলার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে। এটি নদীর মাঝে পলিমাটিতে গড়ে ওঠা ছোট চর। এখানে প্রায় আড়াইশ এর বেশী নিম্নবিত্ত পরিবার বসবাস করেন। তারা অধিকাংশই জেলে, কৃষক ও দিনমজুর। মাঝের চরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব আর প্রতিকূলতা থাকার পরও সব মাথায় নিয়ে চরাশ্রিত এই পরিবার গুলো বসবাস করে আসছেন। আমাদের বোট সেখানকার ঘাটে ভিড়লো তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা৷ আকাশে মাতাল জ্যোৎস্না। এমন রাতে এইসব প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে যাওয়াটাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এক অনিদ্য সুন্দর জীবনে আস্বাদন।
বোট ভিড়লে চরের বুকে মাছ ধরার নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের সন্ধানে প্রশাসনের সাথে আমরা ঘুরে বেরুলাম। আমাদেরকে চরের মৎসজীবী সম্প্রদায়ের হর্তাকর্তা কিছু লোকজন সঙ্গ দিলেন। প্রায় দশ পনেরো মিনিট আমরা ঘুরলাম। এমন জীবনের কাছাকাছির গিয়ে এই মানুষদেএ জীবন-যাপন চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়তো লেখক হিশেবে থাকাটা জরুরী। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সেই প্রয়োজন মেটাতেই এমন সুযোগটা করে দিয়েছিলেন। চরের জমিনে ঘুরে আমরা যখন আবার বোটে উঠি তখন রাত প্রায় ১১ টা। ইউএনও জি. এম. সরফরাজ সাহেবকে পেয়ে জেলেরা এই কর্মবিরতী কালে তাদের কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেন
এবং আরও বিভিন্ন দাবী তুলে ধরেন ইউএনও সাহেবের কাছে ইলিশ প্রজনন মৌশুমে তাদের জীবন-যাপনের যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজন মেটানোর দাবী জানালেন। জেলেদের বিভিন্ন দাবী পুরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সহ আমরা বিদায় নিলাম। বোট ছাড়লো চর ছেড়ে মাঝ নদীর উদ্যেশ্যে।
আকাশে ষোড়শীর মতো রূপবতী জ্যোৎস্না আরো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলো। তখন রাত এগারোটা বেশী। আমাদের ট্রলার মাঝ নদীর উদ্যেশ্যে ছেড়ে দেয়া ঘোড়ার মতো ছুটছে। গভীর রাতে নদীর মাঝে জোৎস্না দর্শন আর চরের মেহনতি মানুষ দেখে এক নৈসর্গিক প্রানোচ্ছলতায় ডুবেছিলাম তখন। হঠাৎ করেই মাঝ নদীতে আমাদের বোট থেমে গেলো। এই পর্যায়ে আবার ভয় পেয়ে গেলাম। মাঝ নদী। হালকা ঢেউয়ের দোলে ইঞ্জিন বন্ধ বোটটি দুলছে। আসলে এটা যে এই যাত্রার পূর্ব পরিকল্পিত আয়োজনে অংশ আমি সেটা জানতাম না। হঠাৎ দেখলাম খাবার দেয়া হচ্ছে সবাইকে। খাবারের প্যাকেট, একটা পানি, একটা ড্রিংক্স আর টিস্যু মিলিয়ে একটা প্যাকেজ আমাকেও দেয়া হলো। তখন বুঝলাম আসল ঘটনা। মাঝ নদীতে ষোড়শী চাঁদের রূপের আলোতে নৈশভোজ, আহা। নসীব বড্ড অদ্ভুত জিনিস। কার নসীবে কি লেখা রয়েছে তা আমরা জানিনা। সকলই অদৃষ্টের খেল, ভাগ্য বড় মিরাকেলময় অদৃষ্ট।
খাওয়ার শুরুতে ইউ এন ও সাহেব বললেন, কোন প্যাকেট বা ময়লা কেউ নদীতে ফেলবেন না, তাঁর সচেতনতার কারনে কেউই কোন ময়লা নদীতে ফেললোনা। ফলে বলেশ্বর বাঁচলো দূষণ হতে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যাক্তিদের এমন সচেতন হওয়াটা বা মানুষকে নিজ দায়িত্বে সচেতন করাটা জরুরী। নিয়ম-শৃঙ্খলা উচ্চপদস্থ ব্যাক্তির দ্বারা এমন পরিচালিত হলে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ অনেক খারাপ অবস্থা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পেতো। শ্রদ্ধাপ্রতিম সররফরাজ ভাইয়া পরিশুদ্ধ মানুষ। সরফরাজ শব্দের অর্থ সম্মানিত জন। তিনি তাঁর নামের অর্থের যথাযথ ভার বহন করে সম্মানিত। আমাদের মঠবাড়িয়ার সকল মানুষই তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। তাঁর শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচারের জন্য তিনি আজও উপজেলা অধিকাংশ মানুষের হৃদয়ে স্মরনীয়। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানে সরফরাজ (সম্মানিত ব্যাক্তি)।
খাওয়া শেষে কথামতো উচ্ছিষ্ট এবং ময়লা গুলো বোটের মধ্যে থাকা ডাষ্টবিনে রেখে আবার বোট চালু হলো। আকাশে তখন চকচকে জ্যোৎস্না। বহুদূর পর্যন্ত দিনের মতো স্পষ্ট দেখা যায়। এমন নৈসর্গিক পরিবেশ ছেড়ে বলেশ্বরের বুক মাড়িয়ে আমদের গন্তব্য তখন উপকূলের উদ্যেশ্যে। বোট ছুটছে মঠবাড়িয়া দিকে, বোট ছুটছে দূর্বার গতিতে। পূবাল হাওয়া আর ষোড়শী আলোকে আমরা মনে মনে বিদায় জানাচ্ছি। শেষমুহূর্তে বোটের ছাউনির অংশে শুয়ে জাজ্বল্যমান মায়া জ্যোৎস্না ভরা মুক্ত আকাশটাকে উন্মাদের মতো উপভোগ করতে লাগলাম। মুগ্ধতা শেষে চলে যাওয়া সহজ তাই গল্পের শেষ বুঝি এভাবেই হয়।
ফিরতি পথে ইউ এন ও সাহেবকে দেখলাম হাতে থাকা প্যাড অন করে টাইপ করছেন। বুঝতে পেরেছিলাম কবিতা হচ্ছে। জেগে উঠেছিলো তাঁর ভেতর বসত করা প্রেমরাজ্যের ঘুমন্ত কবি। লিখে ফেললেন অসাধারণ কয়েকটা পংক্তি।
কবি জি. এম সরফরাজ লিখলেন,
“এখানে এই চাঁদ, উন্মুখ নদ, জ্যোৎস্না বিল্পবী।
আবডালে সব রঙ, কুলহীন গং, বিহনা শুধু তুমি।
লোক-লোকালয়ে, এমনো কি হয়, ভেসে যাই আমি,
তবু এই নদীবুক, উজানে ভাসুক, হোক সংগ্রামী।”
তৎকালীন মঠবাড়িয়ার এই শ্রেষ্ট ইউএনও সাহেব এখন পটুয়াখালী জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিশেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মনের ভেতর এমন সুকুমার কাব্য সত্তা নিয়ে তিনি যেখনেই যান সেই স্থান ও স্থানের মানুষদের তাঁর গুনে সমৃদ্ধ করেন আর তার কাব্যিক নন্দিত মননের সেবায় পরিতুষ্ট করেন। স্বয়ং স্রষ্টা তাঁকে গুণ ও দক্ষতায় সম্মানিত করে রেখেছেন। এমন গল্পের মানুষ, কবিতার মানুষের আমার শহরে প্রত্যাবর্তন হোক প্রতি জ্যোৎস্নার মৌসুমে।
আর এভাবেই সেবারের “বলেশ্বরের বুকে ষোড়শী জ্যোৎস্না” গল্পের শেষে বাড়ি ফিরেছিলাম।
আমাদের ইউএনও সাহেব কবিতাবাদী মানুষ হওয়াতে তার সাথে প্রায় সন্ধ্যাতেই মঠবাড়িয়া ইউএনও বাংলোতে কবিতা আড্ডা জমতো। গতবারের এমন সন্ধ্যায় কালী পুজোর রাতে কবিতা আড্ডার খায়েশে ফোন দিলাম তৎকালীন ইউএনও সাহেবকে। তিনি জানালেন মাছুয়া লঞ্চ ঘাটে অভিযানের টহল ট্রলার যাত্রার অপেক্ষা করছেন। সবই প্রায় রেডী, মিনিট পাঁচেকেই নদীর উদ্যেশ্যে যাত্রা করবে। সেদিন ছিলো উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত। ফোনের এপাশ থেকে আমি দাবি করে বসলাম আমিও যাবো তার সাথে। বললাম, “ভাইয়া, আমারে নিয়ে যান।” ইউএনও সাহেবের সাথে সুনিবিড় এক কাব্যিক সম্পর্ক থেকেই তাঁকে আমি শ্রদ্ধাস্বরে ভাইয়া ডাকতাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ১০/১৫ মিনিটে ঘাটে যেতে পারবো কিনা। আমি “হ্যাঁ” সূচক সম্মতি জানালাম।
বাইক নিয়ে রওনা দিলাম আমি আর প্রিন্স। সবকিছু রেডি থাকা সত্যেও আমাদের জন্য অধীর হয়ে প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করলেন ইউ এন ও সাহেব, এসিল্যান্ড সাহেব, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সহ পুলিশ প্রশাসন ও সাংবাদিকবৃন্দ।
ঘাটে যখন পৌছলাম, দেখলাম তারা সবাই অপেক্ষা ক্লান্ত, তাই আমরা বোটে ওঠার পর পরই আর কোনো ফুরসত না দিয়ে টহল বোট উন্মাতাল দরিয়ার উদ্যেশ্যে যাত্রা সূচনা করলো৷ আকাশে তেজদৃপ্ত চাঁদ, একেবারে ভরা যৌবনাবতী জ্যোৎস্না। চাঁদের আলোয়ে বলেশ্বরের টলমল জল স্পষ্ট দেখা যায়। সেটা এক অনিদ্য নৈসর্গিক পরিবেশ, ধীরে ধীরে আমরা নগ্ন নদীর বুকে প্রবেশ করছিলাম, প্রবেশ করলাম আরেক অনুভূতির গভীরে।
ইউ এন ও সাহেবের সাথে গল্প করতে করতে শুনেছি এ মৌশুমে মাছধরার নিষিদ্ধ এসব এলাকায় জলদস্যুদের গোলাগুলির প্রকোপ বেড়ে যায় । সুন্দরবনের জলদস্যুরা প্রশাসনের সাথেও গোলাগুলি বাঁধাতে দ্বিধা করেনা। একবার নাকি এমন গোলাগুলির মুখোমুখি হয়েছিলেন আগের ইউএনও ফরিদ উদ্দিন সাহেব। এটা শুনে বেশ চিন্তাও হচ্ছিলো। তবে সেই চিন্তা বেশিক্ষণ সময় ক্ষেপণ করতে দিলোনা আকাশের চন্দ্রপূর্ণ ভরা জ্যোৎস্না। আসলে কোমল-সুনিবিড় পরিবেশে জ্যোৎস্নার মাতাল সমীরণ যে কাউকেই যাপিত জীবন ভুলিয়ে দেবার ক্ষমতা ধারণ করে, সেদিন এটা বাস্তবে উপলব্ধি করলাম।
এসিল্যান্ড রিপন বিশ্বাস সাহেবকে দেখলাম কারো সাথে কোন কথা না বলে বোটের সামনের দিকটায় নীরব হয়ে বসে আছেন। লক্ষ্মী পুজোর রাত যেখানে তাঁর কাটাবার কথা পরিবারের সদস্যদের সাথে, সেখানে এই উন্মাতাল বলেশ্বরের বুকে জ্যোৎস্না আর হাওয়া খেতে হচ্ছে বলেই হয়তো মন খারাপ করে আছেন। মজাচ্ছলে বললাম, “দাদা, পূজোর নাড়ু কোথায়? এই মাতাল জ্যোৎস্নায় আপনি নাড়ু খাওয়ালে মজাই হতো। আনমনে দু’ চারটে কথা বলে তিনি আবার বোটের মাথায় আনমনা হয়ে বসে থাকলেন। বোটের সবাই মোটামুটি নিরব।
আমি প্রিন্স আর ইউএনও সাহেব কথা বলছিলাম। এভাবেই সময় যেতে লাগলো।
ঘন্টাখানেকের বেশী টহল বোট চলার পর আমরা গিয়ে থামলাম “মাঝের চর” নামক আমাদের উপজেলার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে। এটি নদীর মাঝে পলিমাটিতে গড়ে ওঠা ছোট চর। এখানে প্রায় আড়াইশ এর বেশী নিম্নবিত্ত পরিবার বসবাস করেন। তারা অধিকাংশই জেলে, কৃষক ও দিনমজুর। মাঝের চরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব আর প্রতিকূলতা থাকার পরও সব মাথায় নিয়ে চরাশ্রিত এই পরিবার গুলো বসবাস করে আসছেন। আমাদের বোট সেখানকার ঘাটে ভিড়লো তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা৷ আকাশে মাতাল জ্যোৎস্না। এমন রাতে এইসব প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে যাওয়াটাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এক অনিদ্য সুন্দর জীবনে আস্বাদন।
বোট ভিড়লে চরের বুকে মাছ ধরার নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের সন্ধানে প্রশাসনের সাথে আমরা ঘুরে বেরুলাম। আমাদেরকে চরের মৎসজীবী সম্প্রদায়ের হর্তাকর্তা কিছু লোকজন সঙ্গ দিলেন। প্রায় দশ পনেরো মিনিট আমরা ঘুরলাম। এমন জীবনের কাছাকাছির গিয়ে এই মানুষদেএ জীবন-যাপন চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়তো লেখক হিশেবে থাকাটা জরুরী। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সেই প্রয়োজন মেটাতেই এমন সুযোগটা করে দিয়েছিলেন। চরের জমিনে ঘুরে আমরা যখন আবার বোটে উঠি তখন রাত প্রায় ১১ টা। ইউএনও জি. এম. সরফরাজ সাহেবকে পেয়ে জেলেরা এই কর্মবিরতী কালে তাদের কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেন
এবং আরও বিভিন্ন দাবী তুলে ধরেন ইউএনও সাহেবের কাছে ইলিশ প্রজনন মৌশুমে তাদের জীবন-যাপনের যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজন মেটানোর দাবী জানালেন। জেলেদের বিভিন্ন দাবী পুরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সহ আমরা বিদায় নিলাম। বোট ছাড়লো চর ছেড়ে মাঝ নদীর উদ্যেশ্যে।
আকাশে ষোড়শীর মতো রূপবতী জ্যোৎস্না আরো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলো। তখন রাত এগারোটা বেশী। আমাদের ট্রলার মাঝ নদীর উদ্যেশ্যে ছেড়ে দেয়া ঘোড়ার মতো ছুটছে। গভীর রাতে নদীর মাঝে জোৎস্না দর্শন আর চরের মেহনতি মানুষ দেখে এক নৈসর্গিক প্রানোচ্ছলতায় ডুবেছিলাম তখন। হঠাৎ করেই মাঝ নদীতে আমাদের বোট থেমে গেলো। এই পর্যায়ে আবার ভয় পেয়ে গেলাম। মাঝ নদী। হালকা ঢেউয়ের দোলে ইঞ্জিন বন্ধ বোটটি দুলছে। আসলে এটা যে এই যাত্রার পূর্ব পরিকল্পিত আয়োজনে অংশ আমি সেটা জানতাম না। হঠাৎ দেখলাম খাবার দেয়া হচ্ছে সবাইকে। খাবারের প্যাকেট, একটা পানি, একটা ড্রিংক্স আর টিস্যু মিলিয়ে একটা প্যাকেজ আমাকেও দেয়া হলো। তখন বুঝলাম আসল ঘটনা। মাঝ নদীতে ষোড়শী চাঁদের রূপের আলোতে নৈশভোজ, আহা। নসীব বড্ড অদ্ভুত জিনিস। কার নসীবে কি লেখা রয়েছে তা আমরা জানিনা। সকলই অদৃষ্টের খেল, ভাগ্য বড় মিরাকেলময় অদৃষ্ট।
খাওয়ার শুরুতে ইউ এন ও সাহেব বললেন, কোন প্যাকেট বা ময়লা কেউ নদীতে ফেলবেন না, তাঁর সচেতনতার কারনে কেউই কোন ময়লা নদীতে ফেললোনা। ফলে বলেশ্বর বাঁচলো দূষণ হতে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যাক্তিদের এমন সচেতন হওয়াটা বা মানুষকে নিজ দায়িত্বে সচেতন করাটা জরুরী। নিয়ম-শৃঙ্খলা উচ্চপদস্থ ব্যাক্তির দ্বারা এমন পরিচালিত হলে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ অনেক খারাপ অবস্থা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পেতো। শ্রদ্ধাপ্রতিম সররফরাজ ভাইয়া পরিশুদ্ধ মানুষ। সরফরাজ শব্দের অর্থ সম্মানিত জন। তিনি তাঁর নামের অর্থের যথাযথ ভার বহন করে সম্মানিত। আমাদের মঠবাড়িয়ার সকল মানুষই তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। তাঁর শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচারের জন্য তিনি আজও উপজেলা অধিকাংশ মানুষের হৃদয়ে স্মরনীয়। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানে সরফরাজ (সম্মানিত ব্যাক্তি)।
খাওয়া শেষে কথামতো উচ্ছিষ্ট এবং ময়লা গুলো বোটের মধ্যে থাকা ডাষ্টবিনে রেখে আবার বোট চালু হলো। আকাশে তখন চকচকে জ্যোৎস্না। বহুদূর পর্যন্ত দিনের মতো স্পষ্ট দেখা যায়। এমন নৈসর্গিক পরিবেশ ছেড়ে বলেশ্বরের বুক মাড়িয়ে আমদের গন্তব্য তখন উপকূলের উদ্যেশ্যে। বোট ছুটছে মঠবাড়িয়া দিকে, বোট ছুটছে দূর্বার গতিতে। পূবাল হাওয়া আর ষোড়শী আলোকে আমরা মনে মনে বিদায় জানাচ্ছি। শেষমুহূর্তে বোটের ছাউনির অংশে শুয়ে জাজ্বল্যমান মায়া জ্যোৎস্না ভরা মুক্ত আকাশটাকে উন্মাদের মতো উপভোগ করতে লাগলাম। মুগ্ধতা শেষে চলে যাওয়া সহজ তাই গল্পের শেষ বুঝি এভাবেই হয়।
ফিরতি পথে ইউ এন ও সাহেবকে দেখলাম হাতে থাকা প্যাড অন করে টাইপ করছেন। বুঝতে পেরেছিলাম কবিতা হচ্ছে। জেগে উঠেছিলো তাঁর ভেতর বসত করা প্রেমরাজ্যের ঘুমন্ত কবি। লিখে ফেললেন অসাধারণ কয়েকটা পংক্তি।
কবি জি. এম সরফরাজ লিখলেন,
“এখানে এই চাঁদ, উন্মুখ নদ, জ্যোৎস্না বিল্পবী।
আবডালে সব রঙ, কুলহীন গং, বিহনা শুধু তুমি।
লোক-লোকালয়ে, এমনো কি হয়, ভেসে যাই আমি,
তবু এই নদীবুক, উজানে ভাসুক, হোক সংগ্রামী।”
তৎকালীন মঠবাড়িয়ার এই শ্রেষ্ট ইউএনও সাহেব এখন পটুয়াখালী জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিশেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মনের ভেতর এমন সুকুমার কাব্য সত্তা নিয়ে তিনি যেখনেই যান সেই স্থান ও স্থানের মানুষদের তাঁর গুনে সমৃদ্ধ করেন আর তার কাব্যিক নন্দিত মননের সেবায় পরিতুষ্ট করেন। স্বয়ং স্রষ্টা তাঁকে গুণ ও দক্ষতায় সম্মানিত করে রেখেছেন। এমন গল্পের মানুষ, কবিতার মানুষের আমার শহরে প্রত্যাবর্তন হোক প্রতি জ্যোৎস্নার মৌসুমে।
আর এভাবেই সেবারের “বলেশ্বরের বুকে ষোড়শী জ্যোৎস্না” গল্পের শেষে বাড়ি ফিরেছিলাম।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কল্পনা বিলাসী ৩১/১০/২০২০অসাধারণ,
-
আব্দুর রহমান আনসারী ৩১/১০/২০২০চমৎকার কথামালা
-
ফয়জুল মহী ৩১/১০/২০২০চমৎকার কথামালায় দারুণ