www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তিলোত্তমা

জীবনে কখনো এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি বলে মনে পড়ছেনা ।ভ্রু কুঁচকে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটাকে আবার ভালো করে দেখলাম।নাহ্।ভুল হতেই পারেনা । 
এক সাথে যার সঙ্গে চারটি বছর পড়ালেখা করেছি তাকে চিনতে আমার ভুল হবার কথা নয় ।এই মেয়ে তিলু না হয়েই যায়না । 
সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম আমি ।তিলু মানে তিলোত্তমা-আমাদের ইতিহাস বিভাগের তুখোড় ছাত্রী।আমরা ওকে ছোট্ট করে তিলু ডাকতাম । 
সেই থেকে ওর আরেকটা নামই হয়ে গিয়েছিল তিলু ।কিন্তু তবু একটা খটকা রয়েই গেল। 
তিলোত্তমা এখানে ! তাও এমন রূপে যা কখনো কল্পনা করা যায়না ।
এখানে তিলোত্তমাকে দেখে আমার চমকে ওঠাটাই স্বাভাবিক ।নিমেষে চারটা বছর পেছনে চলে গেল আমার মন। 
আমাদের ইতিহাস বিভাগে বোধকরি সব থেকে শান্ত মেয়েটি ছিল তিলোত্তমা ।নীরবে ক্লাসে আসতো,ক্লাস করে আবার চুপচাপ চলেও যেতো। সেজন্য ওর কোন বন্ধুও ছিলনা ।আমি নিজে থেকে ওর সাথে কথা বলেছিলাম বলেই আমাদের মাঝে বন্ধুত্বটা হয়েছিল।তাও সেটা শেষ বর্ষে এসে । 
শ্যামলা বর্ণের মায়া কাড়া চোখের এই মেয়েটাকে দেখলেই আমার কেন জানি রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের কথা মনে পড়তো।মনে হতো তিলোত্তমা বুঝি সেই সব গল্প থেকে উঠে এসেছে ।ভালো গান জানতো ও ।কিন্তু গাইতো না কখনো ।সবাই ক্লাশের ফাঁকে এখানে ওখানে বেড়াতে যেতো ।তিলোত্তমা কখনো যেতো না ।
একদিন প্রশ্ন করলাম,' আচ্ছা,তুই কোথাও বেড়াতে যাস না কেন?'
তিলোত্তমা হেসে বলল,'তোর প্রশ্নের উত্তরটা দেয়ার আগে তুই একবার ক্লাশের অন্য মেয়েদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখ।'
আমি দেখলাম ।
তিলোত্তমা বলল,'এবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ।'
ওর দিকে তাকিয়ে আমি যা অনুধাবন করতে পারলাম,
তিলোত্তমা সেই সত্যিটাকেই স্পষ্ট করে উচ্চারণ করল,'হ্যাঁ,আমার কোথাও যাওয়ার মতো ভালো কোন পোষাক নেই ।প্রায় দিন আমি একই পোষাক পরে আসি।'
তিলোত্তমা হাসছিলো।কিন্তু ওর চোখে খেলা করছিল অশ্রু।
 
 
সেই দিন জানতে পেরেছিলাম তিলোত্তমার মা মারা যান,ও যখন কলেজে পা দেয় তখন ।তার কিছুদিনের মধ্যে বাবাও পক্ষাঘাতগ্রস্হ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন ।তারপর থেকে ভাই-ভাবীর সংসারে ঠাঁই হয় ওদের।
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাদের মন রক্ষা করে চলতে হয় ।
ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার ফি দেয়ার দিন তিলু মুখ শুকনো করে এলো।'আমার পরীক্ষা দেয়া হবে না।ভাইয়া বলেছে ফি দিতে পারবে না ।'
আমি বললাম,'আমি দিয়ে দিচ্ছি।তুই পরে দিয়ে দিস।'
'সত্যি দিবি?দে তাহলে!আমি পরে দিয়ে দেবো।'করুণ স্বরে বলেছিল তিলোত্তমা ।
তারপর একদিন কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল ।বলেছিল,'হয় আমাকে একটা চাকুরি খুঁজে দে,না হয় একটা বর খুঁজে দে।আমি আর ঐ সংসারে থাকতে পারছি না ।'
আমি আমতা আমতা করে
বলেছিলাম,'আচ্ছা দেখি।'
সেটাই ছিল ওর সাথে শেষ দেখা ।
সেদিন হয়তো আমি ওর হাত ধরে নির্ভরতা দিয়ে বলতে পারতাম, আমি আছি তোর পাশে ।
বলিনি,কারণ হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম ওর প্রতি আমার ভালো লাগাটা কেমন জানি উবে গেছে ।
হয়তো অনিশ্চিত জীবনের একটা মেয়ের সাথে জড়ানোয় নিশ্চিত জীবনের প্রত্যাশী আমার মন স্বার্থপরের মতো পিছিয়ে গিয়েছিল।
তাই আর ওর খোঁজও রাখিনি ।
ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় ।কিন্তু আজ দামী গহনায় অঙ্গ মোড়ানো,আভিজাত্যময় শাড়িতে অপূর্ব সাজে সজ্জিত তিলোত্তমাকে দেখে আমার বুকের গভীরে কোথায় যেন একটা ঈর্ষার খোঁচা অনুভব করলাম ।
 
 
তিলোত্তমা এখন আমার কফি শপটার ঠিক সামনের শাড়ির দোকানটায় এসে ঢুকেছে ।
কাছ থেকে আমি আরেকবার ভালো করে নিরীক্ষণ করলাম তিলোত্তমাকে।
আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে ও দেখতে ।জৌলুসময় অলংকার ওকে আরো রূপবতী করে তুলেছে ।ওর চলায় এখন আগের মতো দিঘীর শান্ত জলের নির্লিপ্ততা নেই,আছে রাজহংসীর দৃঢ়তা ।
ওর পরনের শাড়িটার দামই হবে বিশ হাজার টাকা।এই শপিং মলটা শহরের সবথেকে অভিজাত শপিং মল ।এখানে লাখপতি ছাড়া কারো পা পড়ে না ।আমার মতো ছাপোষা মানুষেরও এখানে আসার কথা ছিল না,যদি না অফিসের কাজে আমাকে পাঠানো হতো ।
সুতরাং এখানে তিলুকে দেখে আমার চমকে ওঠারই কথা ।
আড় চোখে তিলোত্তমার পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম ।
চেহারায় কর্তৃত্ব আর আভিজাত্যের ছাপ দেখে বুঝতে কষ্ট হয়না এই লোক নিঃসন্দেহে টাকার কুমির ।
আরেকটা ঈর্ষার খোঁচা খেলাম বুকে ।বাহ্ ।তিলু তাহলে ভালোই বর জুটিয়েছে নিজের ।
দোকান থেকে শপিং করে বেরিয়ে এলো তিলোত্তমা ।ওকে ডাকবো কিনা ইতঃস্তত করতে লাগলাম ।
 
হঠাৎ করে ওর চোখ পড়ল আমার দিকে ।ভদ্রলোককে ফেলে প্রায় ছুটে এলো সে আমার দিকে ।মুখে সেই চির পরিচিত হাসি ।'আরে তুই এখানে?কতোদিন পর দেখা!কেমন আছিস বলতো?'
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।'এইতো ভালোই ।তুই কেমন আছিস ।বাবা আর ভাইরা কেমন আছেন ?'
হাসি থমকে গেল তিলোত্তমার ।
'বাবা মারা গেছে দু বছর হলো ।আর ভাই কেমন আছে জানি না ।তিন বছর আগে ওদের ওখান থেকে বাবাকে নিয়ে আসার পর আর কোন যোগাযোগ হয় নি ।স্বার্থপর পৃথিবীতে কে কার খবর রাখে বল ?
তুই-ই কি আমার কোন খোঁজ রেখেছিস না আমি রেখেছি তোর ?'অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকালো তিলু ।
ওর চোখের তীক্ষ্ন দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চোখ সরিয়ে নিলাম আমি ।পরক্ষণে ওর দিকে তাকিয়ে তীর্যক বাক্যবাণ ছুড়লাম ।
'ভালোই তো বর জুটিয়েছিস দেখতে পাচ্ছি ।খুব পয়সাওয়ালা মনে হচ্ছে ।খুব সুখেই আছিস তাহলে ।'
নিমেষে তিলোত্তমার চোখে ব্যাথাতুর দৃষ্টি ফুটে উঠতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম ।
তিলোত্তমার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।ওর ঠোঁটটা একটু কেঁপে উঠলো কিছু বলার জন্য ।
কিন্তু তার আগেই দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক ওকে ডাক দিলেন বিরক্ত গলায়।
'আসছি,'বলে ছুটে তার দিকে চলে গেল তিলু ।

উচিত না জেনেও আমার কান খাড়া হয়ে গেল ওদের কথা শোনার জন্য ।অবশ্য তার দরকার ছিল না।ভদ্রলোক যথেষ্ট জোরে কথা বলছিলেন যে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম ।'তোমার সাথে আজ সারাদিনের চুক্তি না আমার?টাকা এডভান্স নিয়েছো মনে নেই ?আর এখন এখানে সময় নষ্ট করছো ?নতুন মক্কেল জুটাতে হলে আমার সাথে চুক্তি শেষ হওয়ার পর জুটাও ।'ভদ্রলোকের গলায় সীমাহীন বিরক্তি ।
'না না !ও আমার বন্ধু,'আহত শোনায় তিলোত্তমার কন্ঠ ।
'তোমাদের মতো মেয়েদের আবার বন্ধু হয় নাকি !হাসালে ।'বিশ্রী হাসি ফুটে ভদ্রলোকের ঠোঁটে ।'যাও যাও ।বিদায় দিয়ে আসো ওকে ।'
 
আমার মাথা কেমন জানি ঘুরতে থাকে ।তিলোত্তমা-ভদ্রলোক-শপিং মল-সব কেমন জট পাকিয়ে যায় মাথায় ।মনে হতে থাকে স্বপ্ন দেখছি । বুকের ভেতর আবারও খোঁচা টের পাই আমি ।তবে এইবার ঈর্ষার নয়,কষ্টের । মৃদু পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তিলু ।সেই শান্ত দিঘীর জলের মতো টলটলে তিলোত্তমা ।

আমার চোখে উদভ্রান্তের দৃষ্টি দেখে বুঝে নেয় সব শুনেছি আমি ।শান্ত দিঘীর জলে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ জাগে তেমনি করে হাসির ঢেউ ছুঁয়ে যায় ওর ঠোঁট ।'এইবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস কতোটা সুখে আছি আমি।প্রতিদিন নতুন নতুন বর আমার ।সুখ তো বটেই ।'বলতে বলতে অশ্রু গড়ায় তিলুর চোখে ।'তবে প্রার্থনা করিস এমন সুখ যেন আর কোন মেয়েকে পেতে না হয় ।'
 
তিলোত্তমার চোখের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার চোখেও অশ্রু নামে । 
মনে হয় কেউ যেন আমার হৃৎপিন্ডটা চাকু দিয়ে কাটছে । 
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় ।মনে হয় যেন কয়েকযুগ ।
তারপর ফিক করে হেসে ফেলে তিলোত্তমা । 
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলে, 'যাই রে ।ভালো থাকিস তুই ।' 
অশ্রু সজল চোখে আমি তিলোত্তমার হাতটা চেপে ধরি । 
আমার চোখের দিকে তাকায় তিলু ।তারপর আস্তে করে ছাড়িয়ে নেয় নিজের হাতটা । 
মৃদু অথচ দৃঢ় শোনায় ওর কন্ঠ ।'এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কারো মনে যে আমার জন্য এইটুকু অনুভূতি রয়েছে এটাই আমার জন্য অনেক ।এই টুকু নিয়েই আমাকে থাকতে দে ।'কথা শেষ করে ঠোঁট কামড়ে অশ্রু সংবরণ করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায় ও।
 
ঝাপসা চোখে আমি দেখতে পাই তিলোত্তমা মৃদু পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে……হারিয়ে যাচ্ছে…..আমার সামনে থেকে । শুধু কি তাই ?ও কি নিজের কাছ থেকেও হারিয়ে যায়নি ?কি জানি !কেউ কি জানে,না জানতে চায়……..'
 
 
.....................অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি এখানেই ....................
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৫৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/০৮/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • দারুন
  • ফয়জুল মহী ০৪/০৯/২০১৬
    উজ্জ্বল দীপ্তিশিীল লেখা
  • সোলাইমান ০৩/০৯/২০১৬
    Nice
  • আনিসা নাসরীন ০১/০৯/২০১৬
    অনেক সুন্দর
  • মিজান রহমান ৩১/০৮/২০১৬
    ভালো লাগলো
 
Quantcast