www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বাবার সিগারেট ছাড়ার গল্প

বাসায় বিরাট গণ্ডগোল!
রাত বাজে এগারোটা। মা ওয়াক ওয়াক, গগগ করতে করতে এক দৌড়ে এসে বেসিনে হাঁপিয়ে পড়লেন। আমরা দুই ভাই-বোন রিডিং রুমে পড়ছিলাম। দৌড়ে গেলাম। মা বকবক করে বাবাকে বকে যাচ্ছেন। অর্ধেক বকা দিতেই আবার গগগ ওয়াক থুঃ। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা।

মা বমি করে দিয়ে বেসিনে উপুড় হয়ে হাঁপাচ্ছেন। চোখ-মুখ বেয়ে পানি পড়ছে।
ভাইয়া মার মাথাটা একটু ধরতে গেলেন। কিন্তু মা বিছার মতো লাফিয়ে উঠে একটা ঝেংরা মেরে বললেন, ‘সর, সর, আমার সামনে থেকে, সর। ধরতে হবে না।’ ভাইয়া ভয়ে দুই পা সরে গিয়ে বলল, ‘আমি আবার কী করলাম? আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার এমন করছ যে?
মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘তোমার বাবা জোর করে আমার মুখের ভেতর সিকেরেটের ধুমা দিছে। ওয়াক থুঃ।’
ভাইয়া বলল, এ জন্য এমন করতে হবে নাকি তোমার?
মা বললেন, ‘এমন করতে হবে না মানে? ইন্দুর পচা গন্ধ। ওয়াক থুঃ।’

মা নিজে নিজেই বকবক করতে লাগলেন। ‘আর সম্ভব না। আমি আলাদা থাকব। যার ইমান আমল নেই, তার সাথে কীসের সংসার? একশ বার কিরা-কসম কেটে সিকারেট খাওয়া ছাড়ে; আবার একশবার সিকারেট ধরে। বিদ্যা নিয়ে কিরা, পশ্চিম দিকে ফিরে কিরা, কানে ধরে কিরা, আমার মাথায় ধরে পর্যন্ত কিরা কসম কেটেছে। কিরা-কসম কেটে সিকারেট ছেড়ে ধরে পান। কদিন বাদে দেখি, পান-সিকারেট দুটোই সমানে খায়। আল্লা-খোদার ভয় নি আছে।’

বাবা খুব রাগী মানুষ হলেও মাঝে মধ্যে খুব দুষ্টুমি করে আমাদের সাথে। আমি ভয়ে ভয়ে বাবার ঘরে চুপি দিয়ে দেখি, বাবা সমানে সিগারেট টানছে শুয়ে শুয়ে। পায়ের উপর পা দোলাচ্ছে। আর মুখে মুচকি হাসি। হাসি দেখে সাহস করে গিয়ে বললাম, ‘এহ্ কিরা কেটে কেটে সিগারেট খাও আবার মাকেও খাওয়াও, নাহ্? আবার হাসে? এখন বকা খেতে মজা লাগে তোমার, হেহ্?’ এ কথা বলে এক দৌড়ে চলে এলাম রিডিং রুমে। ভাইয়া বলে, ‘তোর তো সাহস কম না! এখন না দুজনেই থাপ্পড় খামু।’ ভাইয়া ভয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগল মাথা ঝাকিয়ে।
বাবা কিছুই বললেন না।

মা হনহন করে এসে বললেন, ‘এই লোকের সাথে থাকা সম্ভব না। ওই রুমে কেউ যাবি না। রুমে বিষ। আমি অন্যরুমে থাকব। মা বালিশ নিয়ে ধপ থপ করে অন্যরুমে গিয়ে ঠাস করে শুয়ে পড়লেন।
সব কিছু নীরব হয়ে গেল।

২.
দাদির ডাক পড়ল।
খোকা, ‘আমার ঘরে আসো।’ (বাবার ডাকনাম খোকা)।
বাবা সার্ট পরে কুলি করে দাদির সামনে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালেন।
দাদি বললেন, ‘তুমি তিন দিনের মধ্যে সিগারেট খাওয়া ছাড়বে। এটা আমার নির্দেশ।’
বাবা কী যেন বলতে চাইলেন, দাদি বললেন, ‘কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। যাও।’
বাবা মুখটা ইঁদুরের মুখের মতো চোখামোখা করে বেরিয়ে এসে চুপ করে শুয়ে রইলেন।

দাদি আবার ডাকলেন, ‘গালিব সুমাইয়া আমার কাছে আসো।’
আমরা দাদির পাশে গিয়ে গাল ফুলিয়ে বেজার মুখে দাঁড়ালাম। দাদি বললেন, ‘আজ সালাম দিতেও ভুলে গেছ তোমরা।’ এ কথা শুনে আমরা দুজনেই হাতে মুখে সমানে সালাম দিলাম। দাদি বললেন, ‘এটা সালাম নয়। সালাম দিতে হয় মন থেকে। তোমাদের মন ভালো নেই।’

কতক্ষণ চুপ থেকে দাদি বললেন, ‘মা-বাবার ঝগড়া দেখার ভাগ্য সব সন্তানের হয় না। তোমাদের হয়েছে। আজ বড় আনন্দের দিন। কোনো পড়া হবে না এখন। বই বন্ধ করে আনন্দ করো গিয়ে, যাও।’
আমরা পা টিপে দাদির ঘর খেকে এসে চুপ করে শুয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ভাইয়া আমাকে বলে, ‘একটা চুপি দিয়ে দেখে আয়, আব্বু আর আম্মু এখন কী করছে. যা।’
আমি পা টিপে গিয়ে চুপি দিলাম। দেখি, ‘মা কফিতে টোস্ট ভিজিয়ে বাবার মুখে দিচ্ছে। আর হাসি হাসি মুখে কথা বলছে। দেখে রাগের চোটে আমি ফ্লোরে একটা উষ্ঠা মেরে চলে এলাম।

ভাইয়া বলে, ‘দেখছস, রাতে কেমন ঝগড়া করলো। এখন কেমন খাতির? আমাকে কেমন একটা বকা দিয়েছিল মনে নেই? আর এখন? আয় আমরা আবাবু-আম্মুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই, হে?
আচ্ছা।
আমরা গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম।
মা আমাদের জন্য কফি আর টোস্ট নিয়ে এসে পাশে বসলেন। ভাইয়া চেয়ার ঘুরিয়ে একদিকে আর আমিও মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে রইলাম। রাগে আমাদের শরীর কাঁপছে।
আমাদের ভাব দেখে মা বললেন, ‘শোনো, রাগ করে তিন ঘণ্টার বেশি কথা না বললে ভীষণ পাপ হয়, নইলে আমি বুঝি এ ভদ্রলোকের সাথে কথা বলি? জীবনেও না।’
মা আমাদের রাগ দেখে হাসতে হাসতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলেন।

৩.
বাবা অফিস থেকে বাসায় দেরি করে এলেন। মা বললেন, এতো দেরি কেন আপনার? বাবা বলে, ‘নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম।’
‘নিউ মার্কেটে কেনো?’
বাবা ব্রিফকেস থেকে একে একে বের করতে লাগল ইয়া বড় বড় সিগারেট। দেশ-বিদেশের যত পদের সিগারেট আছে সব কিনে এনেছেন। কোনটা মশলার তৈরি। কোনটা চিকন, কোনটা আবার ছয় ইঞ্চির মতো লম্বা, কোনটা মোটা সিগারেট। আমরা অবাক।
বাবা বললেন, ‘জীবনের শেষ টানা টানবো এই তিন দিন। আমাকে কিছু বলতে পারবে না তোমরা। মা তিন দিন সময় দিয়েছেন। এটা আমি ষোলোআনা কাজে লাগাবো। এমন খাওয়া খাবো, যাতে কোনদিন আফছুছ করে বলতে না হয়, এই ব্র্যাণ্ডের সিগারেটটা তো খাওয়া হয়নি আমার!’
বাবা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে এই সিগারেট টানেন।

আজ তিনদিনের শেষ দিন। এমনভাবে সিগারেট টানলেন যে, ঠিক রাত বারোটাও বাজল, বাবা সিগারেটে শেষ টান দিলেন।
বাবা ঝিমাতে ঝিমাতে ঘরে এসে বললেন, ‘তোমরা আমার পাশে এসে বসো। আজকে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নেবো আমি।’
আমরা হাসি হাসি ভাব নিয়ে বাবার দুপাশে গিয়ে লাফিয়ে বসলাম। মা-ও এএসে বসলেন।

বাবা খুব বিনয়ের সাথে বললেন, ‘তোমাদের সবার সামনে শপথ করে বলছি, আমি আর ধূমপান করবো না, আজ আমি মুক্ত, আমি পবিত্র ।’
দিলাম জোরে হাততালি।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮১১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সিগারেট ছাড়ার ইচ্ছা রইল আমার ও । দোয়াই শুধু কাম্য ।
  • প্রবাসী পাঠক ০৪/১১/২০১৩
    আপনার লেখাটা পড়ে ভাল লাগল । খুব সুন্দর উপস্থাপনায় ধূমপান ছাড়ার বিষয়টার সাথে তুলে এনেছেন একটি পরিবারের ভালবাসার বন্ধনের চিত্র।
    আমি নিজে একজন স্মোকার । আপনার গল্পের বাবার মত অনেক চেষ্টাই করেছি এখনও করছি ধূমপান ছাড়ার জন্য। আশা করি একসময় অবশ্যই সফল হব ।
    • অনেক ভালো লাগল। আশা কির আপিনও পারবেন এ নেশাটা ত্যাগ করতে। আপনার জন্য দোয়া রইল। ধন্যবাদ।
      • প্রবাসী পাঠক ০৫/১১/২০১৩
        আপনার গল্পের বাবার মত অনেক পদ্ধতি করছি ধূমপান ছাড়ার জন্য কিন্তু সফল হচ্ছিনা ।
        ধন্যবাদ আপনাকে দোয়া করার জন্য।
  • সায়েম খান ০৪/১১/২০১৩
    সিগারেট আসলে কোন নেশা নয়। এটি ছাড়ার জন্য ইচ্ছেশক্তিই যথেষ্ট।
    • কে বলল নেশা না?
      কত ঘটনা যে ঘটছে সিগারেট ছাড়া নিয়ে, সেটা কি জানেন? সেই ঢ়টনা নিয়ে আরেকটা পোষ্টই দেয়া যাবে, হু।
  • ইসমাত ইয়াসমিন ০৪/১১/২০১৩
    অনেক সুন্দর লিখেছেন, সব বাবারা যদি এরকম হত...।তাহলে কি মজাই না হত।
  • জহির রহমান ০৪/১১/২০১৩
    অনেক চমৎকার সাজানো আর গোছানো উপস্থাপন। গল্পটিতে সব ভাবেরই উপস্থিতি ছিলো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপু পারিবারিক গল্পটি শেয়ার করার জন্য। পড়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম।
    • আপনার মন্তব্য পড়ে আমিও আনন্দে চিকমিক করছি। খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ নিন।
      • জহির রহমান ০৪/১১/২০১৩
        একটা অনুরোধ করবো। আমাকে আপনি 'তুমি' করে সম্বোধন করলে খুশি হবো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে- আমি বয়সে আপনার জুনিয়র হবো।
  • খুবই চমৎকার।অসম্ভব সুন্দর।খুবই গোছানোো লেখা।সবকিছুই একদম পরিপূর্ণ।শেষের একটা প্যারায় হূমায়ূন স্যারের গন্ধ পেলাম ।ধন্যবাদ।
    • দারুন বলেছেন ভাইয়া। আমি খুবই উৎসাহবোধ করছি। পারিবারিক ঘটনাকে নিয়ে এই লেখা। ভালো লাগায় আনন্দিত হলাম। তবে হুমায়ুনি ভাবটা যে কীভাবে এসে গেলো! আমার লেখায় আরেকজনের ভাব আসবে কেনো? রাখেন, পরের লেখাতে আমি এই ভাবের বারোটা বাজিয়ে পরে ছাড়ব।

      অনেক ধন্যবাদ সাখাওয়াৎ ভাইয়া।
      • আরে না না এমন করবেন না আপু।আপনি যে লেখনীতে সার্থক তাই বলতেে চেয়েছিলম।স্যারের লেখায় যে মজা পেয়েছি আপনার লেখায় তার ধাঁচ পেয়েছি।এটাই বলতে চেয়েছি। লেখা চালিয়ে যান।আপনি অবশ্যই সার্থক হবেন।সেই দোয়া আপনার জন্য।আর যেহেতু আপনি এখন মাধ্যমিকে পড়েছেন সেহেতু পড়াশোনায় ও সময় দিতে হবে।যদি সব কিছু করার পর সময় থাকে তবে, ভাইয়ার নিয়মিত আয়োজনে একটু ঢুঁ মেরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ রইল।শুভকামনা বোনের জন্য সবসময়।
 
Quantcast