মধুকবির বীরাঙ্গনারা(11)
(পরবর্তী অংশ)
একাদশ সর্গে রানি জনা রাজা নীলধ্বজ রায়কে এই চিঠি লিখেছেন যখন তিনি জানতে পেরেছেন যে রাজা তাঁর পুত্র প্রবীরের হত্যাকারী পার্থের সঙ্গে সন্ধি করেছেন।এই চিঠিতে মাতৃক্রোধ এবং তা থেকে উৎপন্ন ঘৃণাকে মধুসূদন অভূতপূর্বভাবে উপস্থাপিত করেছেন।পত্রের প্রথমেই জনা রাজাকে লিখেছেন-'মহাবাহু!যাও বেগে গজরাজ যথা/যমদন্ডসম শুন্ড আস্ফালি নিনাদে!/টুট কিরীটির গর্ব্ব আজি রণস্থলে!/খন্ডমুন্ড তার আন শূল-দন্ড-শিরে!' তারপরই বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন _'হায়,পাগলিনী জনা!তব সভামাঝে/নাচিছে নর্ত্তকী আজি,গায়ক গাইছে,/উথলিছে বীণাধ্বনি!তব সিংহাসনে/বসিছে পুত্রহা রিপু -মিত্রোত্তম এবে!' নাকি পুত্রশোকে রাজার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে একথা ভেবে ক্ষত্রিয় ধর্মের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য জনা কষাঘাত করে লেখেন-'না ভেদি রিপুর বক্ষ তীক্ষ্নতম শরে/রণক্ষেত্রে,মিষ্টালাপে তুষিছে কি তুমি/কর্ণ তার সভাতলে?......'।এরপর থেকেই চিঠিতে মাতৃক্রোধ রূপান্তরিত হয় তীব্র ঘৃণায়-'নরনারায়ণ-জ্ঞানে,শুনিনু,পুজিছ/পার্থে রাজা,ভক্তিভাবে;-এ কি ভ্রান্তি তব?'।এমনকি দ্রৌপদীও সেই ঘৃণার আগুনের আঁচ এড়াতে পারেন না-'....তবে যদি অবতীর্ণ ভবে/পার্থরূপে পীতাম্বর,কোথা পদ্মালয়া/ইন্দিরা? দ্রৌপদী বুঝি?আঃ মরি,কি সতী!/'।এরপর রাজ্ঞী জনা অর্জুনের বীরত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং তার যুক্তিযুক্ত কারণও দেখিয়েছেন-'দহিল খান্ডব দুষ্ট কৃষ্ণের সহায়ে।/শিখন্ডির সহকারে কুরুক্ষেত্র রণে/পৌরব-গৌরব ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে/সংহারিল মহাপাপী! দ্রোণাচার্য গুরু,-/কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,/দেখ স্মরি?..........'।এরপর জনা নীলধ্বজের শ্লাঘাবোধকে জাগ্রত করার জন্য লিখেছেন-'চন্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে?/কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু/দাবানলে ..........?' তারপরই জনার লেখনীতে ফুটে উঠেছে-'কুলনারী আমি,নাথ,বিধির বিধানে/পরাধীনতা!নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে/এ পোড়া মনের বাঞ্ছা!......'।কোনো বীরাঙ্গনার লেখনীই একথা লিখতে পারে।এরপর পুত্রশোকে জনা আকুল হয়ে ওঠেন এবং রাজা নীলধ্বজের প্রতি তাঁর তীব্র অভিমানমিশ্রিত রাগে লেখেন-'তুমি পতি,ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি/তুমি!কোন সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?'।
এই "বীরাঙ্গনা কাব্য"টিতে মাইকেল তাঁর অনুকরণীয় ভঙ্গিতে নারীচরিত্রগুলির লেখনীতে শব্দ বসিয়েছেন।তাই তার নারীরা কখনও বিরহিনী বধূ আবার কখনও বা স্নেহশীলা জননী।অথচ এইসব নারীদের প্রত্যেকরূপের মধ্যে রয়েছে বীররসের ধারা।সেই বীরত্ব কখনও চরম ঘৃণায় পুত্রহন্তার স্বহস্তে বিনাশ করতে চায়,কখনও প্রণয়ীকে হরণ করতে আহ্বান জানায়,কখনও অপ্রিয় সত্য বলতে পিছপা হয় না,আবার কখনও বা অবৈধ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে চায়।আসলে এসবের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে চান এইসব নারীরা।পুরুষশাসিত সমাজে এমন স্বাধিকারের দাবি যারা করেন তাঁরাই তো প্রকৃতপক্ষে বীরাঙ্গনা। (সমাপ্ত)
একাদশ সর্গে রানি জনা রাজা নীলধ্বজ রায়কে এই চিঠি লিখেছেন যখন তিনি জানতে পেরেছেন যে রাজা তাঁর পুত্র প্রবীরের হত্যাকারী পার্থের সঙ্গে সন্ধি করেছেন।এই চিঠিতে মাতৃক্রোধ এবং তা থেকে উৎপন্ন ঘৃণাকে মধুসূদন অভূতপূর্বভাবে উপস্থাপিত করেছেন।পত্রের প্রথমেই জনা রাজাকে লিখেছেন-'মহাবাহু!যাও বেগে গজরাজ যথা/যমদন্ডসম শুন্ড আস্ফালি নিনাদে!/টুট কিরীটির গর্ব্ব আজি রণস্থলে!/খন্ডমুন্ড তার আন শূল-দন্ড-শিরে!' তারপরই বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছেন _'হায়,পাগলিনী জনা!তব সভামাঝে/নাচিছে নর্ত্তকী আজি,গায়ক গাইছে,/উথলিছে বীণাধ্বনি!তব সিংহাসনে/বসিছে পুত্রহা রিপু -মিত্রোত্তম এবে!' নাকি পুত্রশোকে রাজার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে একথা ভেবে ক্ষত্রিয় ধর্মের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য জনা কষাঘাত করে লেখেন-'না ভেদি রিপুর বক্ষ তীক্ষ্নতম শরে/রণক্ষেত্রে,মিষ্টালাপে তুষিছে কি তুমি/কর্ণ তার সভাতলে?......'।এরপর থেকেই চিঠিতে মাতৃক্রোধ রূপান্তরিত হয় তীব্র ঘৃণায়-'নরনারায়ণ-জ্ঞানে,শুনিনু,পুজিছ/পার্থে রাজা,ভক্তিভাবে;-এ কি ভ্রান্তি তব?'।এমনকি দ্রৌপদীও সেই ঘৃণার আগুনের আঁচ এড়াতে পারেন না-'....তবে যদি অবতীর্ণ ভবে/পার্থরূপে পীতাম্বর,কোথা পদ্মালয়া/ইন্দিরা? দ্রৌপদী বুঝি?আঃ মরি,কি সতী!/'।এরপর রাজ্ঞী জনা অর্জুনের বীরত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং তার যুক্তিযুক্ত কারণও দেখিয়েছেন-'দহিল খান্ডব দুষ্ট কৃষ্ণের সহায়ে।/শিখন্ডির সহকারে কুরুক্ষেত্র রণে/পৌরব-গৌরব ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে/সংহারিল মহাপাপী! দ্রোণাচার্য গুরু,-/কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,/দেখ স্মরি?..........'।এরপর জনা নীলধ্বজের শ্লাঘাবোধকে জাগ্রত করার জন্য লিখেছেন-'চন্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে?/কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু/দাবানলে ..........?' তারপরই জনার লেখনীতে ফুটে উঠেছে-'কুলনারী আমি,নাথ,বিধির বিধানে/পরাধীনতা!নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে/এ পোড়া মনের বাঞ্ছা!......'।কোনো বীরাঙ্গনার লেখনীই একথা লিখতে পারে।এরপর পুত্রশোকে জনা আকুল হয়ে ওঠেন এবং রাজা নীলধ্বজের প্রতি তাঁর তীব্র অভিমানমিশ্রিত রাগে লেখেন-'তুমি পতি,ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি/তুমি!কোন সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?'।
এই "বীরাঙ্গনা কাব্য"টিতে মাইকেল তাঁর অনুকরণীয় ভঙ্গিতে নারীচরিত্রগুলির লেখনীতে শব্দ বসিয়েছেন।তাই তার নারীরা কখনও বিরহিনী বধূ আবার কখনও বা স্নেহশীলা জননী।অথচ এইসব নারীদের প্রত্যেকরূপের মধ্যে রয়েছে বীররসের ধারা।সেই বীরত্ব কখনও চরম ঘৃণায় পুত্রহন্তার স্বহস্তে বিনাশ করতে চায়,কখনও প্রণয়ীকে হরণ করতে আহ্বান জানায়,কখনও অপ্রিয় সত্য বলতে পিছপা হয় না,আবার কখনও বা অবৈধ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে চায়।আসলে এসবের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে চান এইসব নারীরা।পুরুষশাসিত সমাজে এমন স্বাধিকারের দাবি যারা করেন তাঁরাই তো প্রকৃতপক্ষে বীরাঙ্গনা। (সমাপ্ত)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।