www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

এক মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী

১১৯৬৯ সাল, দেশে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। বুঝতে পারছিলাম দেশে যেকোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শংকায় কাটে প্রতিদিন। বয়েস আমার বেশী না। কেবল যৌবনে পা দিয়েছি। অন্যায় কিছু দেখলে রক্ত টগবগ করে। প্রতিবাদ করতে মন চায়। কোন কিছু বাঁধা মানতে চায় না।

আমি ছিলাম নারিন্দার একটি টেকনিক্যাল স্কুলের ছাত্র। পাকিদের উপর চরম ঘৃনা জন্মে গিয়েছিল। আমি প্রায়ই দেখতাম ঢাকা কলেজের ছাত্র/ছাত্রীরা মিটিং-মিছিল নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। তাদের একটাই দাবি ছিল স্বাধীনতা চাই। আমি পালিয়ে পালিয়ে প্রায়ই এস্ব মিটিং-মিছিলে চলে যেতাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমাকে বেশী আকৃষ্ট করত ছাত্রদের তেজময়ী বক্তব্য। তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম কি করে দেশের সেবা করা যায়। এ সময় আমার কয়েক বন্ধু জুটে গেল। যারাও আমার মতো দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতো। বিজয়,জর্জ ,ছিলু, রঞ্জন ও সমর মিলে আমরা মিছিলে যেতাম।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ । একটি ইতিহাস একটি দিন দিন, একটি ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ। রক্ত টগবগ করছিল। শত বাঁধা উপেক্ষা করে আমরা ক'জন চলে গেলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। শুধু একটি বাণী কান দিয়ে প্রবেশ করল, আর হৃদয়ে তা গেঁথে রইল। 'এবারের স্ংগ্রাম স্বাধীনতার স্ংগ্রাম।' বাণীটি আমার বিবেকের দ্বারে বার বার আঘাত করছিল।  ভাবলাম, দেশের জন্য একটা কিছু করতেই হবে।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। দিশেহারা হয়ে গেলাম। ২৫ মার্চ রাতের গনহত্যা আমাকে পাগল করে দিল। চারিদিকে কেবল লাশ আর লাশ। রক্ত আর রক্ত। সেই রাতেই বাড়ি ফিরে এলাম। যদিও আমাদের হোষ্টেল প্রধান বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জাতির দুর্যোগের সময় এই আদেশ ঠুনকো। ২৮ মার্চ আমি ঢাকা ত্যাগ করি।

বাড়ি এসে মন কেবল ছট্ফট। কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাব? কার সাথে যাব। মা ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। এদিকে চারিদিকে পাকি ও রাজাকারদের লুন্ঠন ও অত্যাচারে জীবন অথিষ্ঠ। চারিদিকে ডাকাতি।বাড়ি বাড়ি অগ্নিসংযোগ। দিশেহারা হয়ে গেলাম। তখন আমার গ্রামের পাশের গ্রামের রহমানের সাথে দেখা। তাকে বললাম চল যুদ্ধ করি, ভারত দিয়ে প্রশিক্ষণ নেই। সে রাজী হলো। আমাদের সাথে যোগ দিল আবু তালিব নামের অন্য একজন।

একদিন রাতে তিন জন বেড়িয়ে পড়ি।  ১৪ মাইল পায়ে হেঁটে কালিগঞ্জ থেকে পৌঁছাই। সেখান থেকে কুমিল্লার নবিনগর। ক্ষুধা। যুদ্ধের উত্তেজনায় সব ভুলে গেলাম। একদিন পর আমরা গেলাম সীমান্ত গ্রাম চন্দ্রপুরে। সেখানে রাতে অল্প ভাত খেলাম। এ সময় কোন পাকি গাড়ি দেখলেই কামলার মত ক্ষেতে কাজ করার ভান করতাম। ওরা ভাবত আমরা ভারতীয় কামলা। একদিন পৌঁছে গেলাম আগরত্লা। রাত ৯টার দিকে আগরতলা কংগ্রেস ভবনে পোউঁছে দেখি বাংলাদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ। যারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। ভিতরে ঢুকতে না পেরে বাইরে রাস্তায় তার কাটালাম।্সকালে দেখি আমার আপন বড় ভাই যোসেফ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে দু'জনে জড়িয়ে ধরে অনেক্ক্ষণ কাঁদলাম। দাদা বলল, তুই বাড়ি চলে যা, আমরা দুই জন যদি মরে যাই মাকে কে দেখবে? আমি বলাম, দাদা মরি দুজন মরব, আর বাঁচি তো দুজন এক সাথে বাঁচব। দাদার মুখে শুনেছি মা প্রতিদিন কাঁদে আর গির্জায় আমাদের জন্য প্রার্থনা করেন।
 
পরদিন ভবনে নাম লিখিয়ে চলে গেলাম প্রশিক্ষণ  হাটানিয়া ক্যাম্পে। আমি ছিলাম এফ এফ মানে ফ্রিডম ফাইটার। আমাদের দায়িত্ব ছিল, ভারতে যেন কোন পাক আক্ত্রম করতে না পারে। প্রশিক্ষণে আমাদের শেখানো হল গ্রেনেড চালানো। আমি চাইছিলাম অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করব। চলে এলাম দেশে। দেশে এসে ভাবলাম গ্রেনেড দিয়ে যুদ্ধ করা যাবে না। চলে গেলাম আবার ভারতে। আবার হাটানিয়া প্রশিক্ষণ  ক্যাম্প। এবার ভারি আস্ত্র চালানো শেখানো হলো। কিছুদিন পর আমাদের পাঠানো হলো পুনার একটি ক্যাম্পে। এখানে ১৬ ট্রাকে ৮০০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিলাম। রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, রাস্তার দুধারে হাজার হাজার বাংলাদেশী শরণার্থী । মানুষ্গুলো আমাদের শ্লোগান দিয়ে উত্সাহিত করল।

প্রশিক্ষণ শেষে আবার ভারতিয় সৈন্যদের পাহারা। ভাল লাগল না। ৩ং সেক্টর  কমান্ডার সফিউলকে  বললাম, আমি দেশে গিয়ে যুদ্ধ করতে চাই। যেতে দিল না। এবার সবাই মিলে আন্দোলন করলাম অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি ফিরে দেখি যুদ্ধ শেষ। মন ভারাক্রান্ত যুদ্ধ করতে পারলাম না। একদিন আস্ত্র জমা দিয়ে দিলাম। চারিদিকে অরাজতা। একটি ভগ্ন দেশ নেতা জেলে। এই সুযোগে চারিদিকে ডাকাতি লুন্ঠন। সব দোষ মুক্তিযোদ্ধাদের। তাই সাতটি মামলা মাথায় নিয়ে সাত মাস জেল খাটলাম। আমার কম্বলটিও নিয়ে নেওয়া হলো। সাথে ছিলো শুধু সার্টিফিকেট। এটা নিয়ে মনের দুঃখে বিদেশ চলে গেলাম। আজক প্রবাসে পড়ে আছি।

কষ্ট লাগে দেশের যারা বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ অধিপতি। আর আমরা ভিক্ষার পাত্র। আমাদের নেই ক্ষমতা, নেই টাকা। মনে শান্তনা দেশ তো পেয়েছি। আর কিছু চাই না।

(হৃদয়ে একাত্তর)
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১০৭৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/১২/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Înšigniã Āvî ১৩/১২/২০১৩
    অনবদ্য...
  • ইসমাত ইয়াসমিন ১২/১২/২০১৩
    সুন্দর হয়েছে। শুভকামনা রইল।
  • אולי כולנו טועים ০৯/১২/২০১৩
    valo laglo besh. : )
  • প্রবাসী পাঠক ০৯/১২/২০১৩
    ৭ ই মার্চের ভাষণ এর তারিখটা মনে হয় ভুল টাইপ করেছেন ভাইয়া, ১৯৭০ সালের ৭ ই মার্চ ।
    ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ - এডিড করে দেবেন প্লিজ।
 
Quantcast